#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৫৮
-আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি তন্নি। শত চেষ্টা সত্ত্বেও পারলাম না তোমায় ভালোবাসা থেকে নিজেকে আটকাতে। পারলাম এই সত্যিটা তোমার থেকে লুকিয়ে বেড়াতে। পারলাম না এই কথাটা অস্বীকার করে নিজেকে কঠোর প্রমান করে। আর নাই বা পারলাম তোমার মতো এ অনুভুতিকে এড়িয়ে যেতে! পারলাম না!
অশ্রুভরা দৃষ্টি তন্নির দিকে নিবদ্ধ রেখে একশ্বাসে কথাগুলো বললো স্বস্তিক। তন্নি স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে। সবগুলো কথা যেনো মাথার উপর দিয়ে গেছে ওর। বিকেল গরিয়েছে। সুর্য হেলতে শুরু করেছে পশ্চিমাকাশে। মুখার্জীবাড়ির পশ্চিমে থাকা নারিকেল গাছটার জন্য ডুবতে থাকা সূর্যের কিরন বাধা পরলো স্বস্তিকের মুখশ্রী থেকে। তন্নি ছাদে এসেছিলো মেলে দেওয়া জামাকাপড় তুলতে। কখন স্বস্তিক এসে দাড়িয়েছে,টেরই পায়নি ও। হাতের জামাকাপড়গুলো শক্তভাবে ধরে বললো,
-এ্ এসব কি বলছেন কি আপনি?
স্বস্তিক আরেকপা এগোলো। বুকভরে শ্বাস নিয়ে বললো,
-তোমাকে ভালোবাসি তন্নি। রাগারাগি,ঝগড়া,খুনশুটি,যাই থাকুক না কেনো,তোমার সাথে কথা বলাটা ভালো লাগে আমার। তোমাকে আশেপাশে পেলেও ভালো লাগে। গত কয়েকদিনে অজানা কারনে আমার প্রতি তোমার ইগ্নোরেন্সটা আমার ভালো লাগেনি তন্নি। একদমই ভালো লাগেনি। তাই কনফার্ম হয়ে গেলাম। ভেতরটা কি চায় আমার। শুনবে কি চায়?
-আ্ আপনি…
-উপেক্ষা নয়,বাকি জীবনটা এই বিলেতি কদু তোমার সাথেই কাটাতে চায় তন্নি। তোমাকে চায় নিজের পাশে। নিজের কাছে। থাকবে তন্নি? থাকবে আমার পাশে?
জলে ভরে উঠলো তন্নির চোখ। এই লোকটার প্রতি যে ওরও দুর্বলতা তৈরী হয়নি,তা নয়। কিন্তু ওর সে দুর্বলতার স্বীকৃতি যে অসম্ভব। বাস্তবতা জানে ও। তাইতো সেদিন পুকুরপাড়ের ঘটনার পর থেকে স্বস্তিককে সবরকমভাবে উপেক্ষা করে এসেছে ও। সামনে পরলেও পাশ কাটিয়ে চলে আসতো। কথা বলা তো অনেকদুরের বিষয়। একটা শুকনো ঢোক গিলে পাশ কাটিয়ে চলে আসছিলো ও। স্বস্তিক ওর হাত ধরে ফেলে। হাত মুচড়ামুচড়ি করতে করতে তন্নি কেদে দিলো। স্বস্তিককের হেরফের নেই। ও আবারো তন্নির সামনে এসে বললো,
-কেউ কাউকে ভালোবাসি বললে তার উত্তর দু রকম হয়। হ্যাঁ অথবা না। তুমি তো কোনোটাই বললে না তন্নি। উল্টো কাদছো। এর মানে জানো?
-ছাড়ুন আমার হাত!
-এর মানে তুমি ভয় পাও। ভালোবাসো বলতে ভয় পাও। ভালোবাসো না বলতে বলতে ভয় পাও। আমি জানি,এর উল্টোটা হলে তুমি কি করতে এখন। তাই প্লিজ তন্নি,প্লিজ অস্বীকার করো না আমাকে। প্লিজ!
-ছাড়ুন আমাকে!
-সাথে আরেকটা জিনিসকে ভয় পাচ্ছো তুমি। আমাদের ধর্মের ভিন্নতাকে। তাইনা?
তন্নি এবার হার মানলো। শব্দ করে কেদে দিয়ে বললো,
-সবই যখন জানেন তাহলে কেনো যেতে দিচ্ছেন না আমায়? কেনো?
ওর দুহাত মুঠো করে নিলো স্বস্তিক। দুহাতে চুমো দিয়ে বললো,
-পারবো না তন্নি। বলেছিলাম তো সেদিন তোমায়,আমার যদি মনে হয় এই হাত ধরে রাখা আবশ্যক,আমি ধরেই রাখবো। তুমি আমার জন্য আবশ্যক হয়ে গেছো। বুঝতে কেনো চাইছো না তুমি?
নিজেকে ছাড়িয়ে পিছিয়ে গেলো তন্নি। হাতের পিঠে চোখমুখ মুছে বললো,
-কি চান আপনি?
-তোমাকে।
-আপনি জানেন তা সম্ভব না।
-কেনো সম্ভব না তন্নি? তুমি তো পিতৃপরিচয়ে মুসলিম নও! তুমি তো অনাথআশ্রমে বড় হয়েছিলে।
তন্নির দৃষ্টি পরিবর্তন হলো। এতোক্ষন যে চাওনিতে দুর্বলতা ছিলো,তা বিস্ময়,কিঞ্চিত ঘৃনায় পরিনত হয়েছে। স্বস্তিকের অনাথ শব্দটাতে ওর কিছু যায় আসে না। কিন্তু পিতৃপরিচয় ছাড়াও এতোদিন যে ধর্মকে মেনে এসেছে ও,তাকে অসম্মান করলো স্বস্তিক,এমনটা মনে হলো ওর। মুচকি হাসলো স্বস্তিক। আবারো এগিয়ে বললো,
-তবুও তুমি মুসলিম। আমি মানি তুমি মুসলিম। আমি তোমাকে মানি তন্নি। আর তোমার ধর্মকেও।
….
-তোমাকে তোমার ধর্ম ছাড়তে হবে না তন্নি। ঘরে তুমি নামাজে তোমার আল্লাহ্কে ডেকো,আমি মন্দিরে গিয়ে আমার ভগবানকে ডেকে আসবো। তুমি রোজা রেখে দোয়া করো,আমিও উপোষ করে প্রার্থনায় বসবো। তুমি ঈদের চাঁদ দেখে আনন্দে মেতো,আমি না হয় পাড়ার পুজোমন্ডপে গিয়ে ধুনুচি নেচে আসবো। কিন্তু দিনশেষে মানুষ পরিচয়ে,দুটো মনের ভালোবাসা দিয়ে ঘর বাধবো আমরা।
….
-বাবাকে তো চেনো তুমি। বাবা কখনোই অমত করবে না,এটাও জানো। দুটো আলাদা ধর্মের মানুষের পরিবর্তে দুটো একই মনের মানুষ হিসেবে এক হবো আমরা। রেজেস্ট্রি ম্যারেজ। আমি বিদেশে ফিরতে চাইনা তন্নি। বাবাকে নিয়ে,তোমাকে নিয়ে,তোমাদের সবাইকে নিয়ে এই চিলেকোঠাতেই থাকতে চাই। আজীবন। তুমি চাইলে…তুমি চাইলে আজই বাবাকে বলবো আমি তন্নি। আজই!
-স্বস্তিক?
নিচতলা থেকে বাবার গলা শুনে একপলক তন্নির দিকে তাকালো স্বস্তিক। তন্নি হ্যাঁ সুচক উত্তরের প্রতিক্ষায় মুচকি হেসে চলে গেলো ও। তন্নির চোখ বেয়ে অনবরত জল গরাচ্ছে। অতঃপর শেষ বিকেলের নিবুনিবু রোদ্দুরটাও ডুব দিলো। দুর দালানগুলোর আড়ালে। নতুন ভোরের আলো হয়ে ফিরবে বলে।
•
থাইগ্লাস ভেদ করে চোখে বাইরের আলো এসে পরায় মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় আরাবের। নড়েচড়ে উঠতে গিয়েও থেমে গেলো ও। ওর উন্মুক্ত বুকের মাঝে দোয়া গভীর ঘুমে আছন্ন। চাদর দিয়ে ঠিকঠাকমতো জরিয়ে নিলো দোয়াকে ও। ঘুমের ঘোরে আরো আস্টেপৃষ্টে আরাবকে জরিয়ে ধরলো দোয়া। দোয়ার চুলগুলোতে আঙুল চালিয়ে শান্তভাবে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো আরাব। পর্দা বারবার উড়ে ওঠায়,জানালা দিয়ে আসা আবছা আলোছায়া খেলা করছে রুমজুড়ে। তাতে একবার স্পষ্টতর হচ্ছে দোয়ার চেহারা,তো একবার অস্পষ্ট। দোয়া চোখ বন্ধ রেখে ঘুমোঘুমো কন্ঠে বললো,
-আমাকে দেখে রাত কাটিয়ে দেওয়ার প্লান আছে নাকি জনাবের?
আরাব হাসলো। দোয়ার চুলগুলো মুঠো করে নিয়ে নাকে নাক ডলে দিয়ে বললো,
-এতো অল্পেই কেনো ঘুম ভেঙে যায় তোমার বলতো?
চোখ মেললো দোয়া। আরাবের দিকে তাকিয়ে শান্তভাবে বললো,
-কি করবো বলুন? চোখ বন্ধ করলেই দেখি আপনি এভাবেই আমাকে জরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
-তাই নাকি? তো ভালো তো। যখন কাছে থাকবো না,এভাবেই চোখ বন্ধ করে…
আরাব শেষ করার আগেই ওর ঠোটে আঙুল দিয়ে ওকে থামিয়ে দিলো দোয়া। চোখের কোনা বেয়ে জল গরালো ওর। আরাব অবাকচোখে তাকিয়ে। দোয়া ধরা গলায় বললো,
-আপনাকে কাছছাড়া করার কথা আমি কল্পনাও করতে পারি না আরাব।
আরাব হেসে ওর আঙুলেই চুমো দিলো। দোয়াকে ঠিকঠাকমতো বালিশে শুইয়ে দিয়ে একাধারে ওর কপাল,দুচোখ,নাক অতঃপর ঠোটে আলতোভাবে ঠোট ছোয়ালো। চোখ বন্ধ করে রইলো দোয়া। ওর মুখের উপর ঝুকে থেকেই আরাব বললো,
-আরাবের স্পর্শের মতো আরাবও তো তোমার সবটাতে মিশে আছে। জানো তুমি সেটা। যতই দুরুত্ব আসুক,তোমার হৃদস্পন্দন,অনুভবে,আমি আছি তো!
দোয়া চোখ মেললো। ওর চোখে তখনও কাতরতা। আরাব দ্বিতীয়বারের মতো ওর কপালে চুমো দিয়ে বললো,
-তোমাকে ছাড়া আমিও যে থাকতে পারি না কোথাও,বোঝো না তুমি এটা? পাগলামি কেনো করছো?
দোয়া আর কিছুই বললো না। আরাবকে জরিয়ে আস্তেধীরে মুখ গুজলো ওর বুকে। শুনশান চারপাশের আড়ালে বাইরে কোথাও রাতজাগা পেচার ডাক শোনা যায়। ডাক বললে ভুল হবে। ওটা যেনো কিছু হারানোর আর্তনাত। বিচ্ছেদের আহাজারি। আরো শক্ত করে আরাবকে জরিয়ে ধরলো দোয়া। পর্দার ওপারে দেখা যাওয়া জোৎসার আলো আজও বেশ উজ্জল। কিন্তু হৃদমন প্রসন্নে সক্ষম সে জোৎসায় আজ বুকভারি কেনো লাগছে? প্রনয়ী পায়রাগুলোর হঠাৎ ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ কেনো শোনা যায়? সাদাকালো আলোছায়ার খেলা বুঝি রংধনুর রঙ কাড়তে চলেছে। দোয়ার কানে যেনো এমনই দীর্ঘশ্বাস স্পষ্টভাবে বাজলো।
#চলবে…
#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৫৯
আরাবের বিছানায় স্তব্ধ হয়ে বসে তৌফিকা। ওর দৃষ্টি মেঝেতে স্থির। বিছানার উপরই কিছু কাগজপত্র,ফাইল,ছবি এলোমেলোভাবে পরে আছে। খোলা কাবার্ডের গোপন লকারটাও খোলা। টুইঙ্কেল গিয়ে লকারে ঝুলানো চাবির গোছাটা নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাজাতে লাগলো। ঝুমঝুম শব্দ করছে চাবিগুলো একসাথে এতে বেশ মজা লাগছে ওর। কয়েকবার চাবি বাজিয়ে মায়ের দিকে এগোলো টুইঙ্কেল। মায়ের সামনে তুলে ধরে আবারো বাজিয়ে বললো,
-দেখো আম্মু? চাবিগুলো কতো সুন্দর বাজে! আরাব মামা তো বলে উইশমামের চুড়ি আর ঝুমকোই সবচেয়ে সুন্দর বাজে! এটাও কতো জোরে বাজে দেখো? দেখো আম্মু?
তৌফিকা চুপ। টুইঙ্কেল বিছানার দিকে তাকিয়ে বললো,
-উইশমাম আসার পর থেকে আরাব মামা আর ঘর এলোমেলো করে না বলে তুমি সব এলেমেলো করে দিলে আম্মু?
তৌফিকা তখনও চুপ। টুইঙ্কেল চাবিটা ঘোরাতে ঘোরাতে বিছানায় উঠলো। দুবার লাফিয়ে নাচের ভঙিমাও করলো চাবির শব্দে। এরমাঝে পায়ের নিচে থাকা ছবিটা চোখে পরলে ওটা তুলে হাতে নিলো ও। ঠিকঠাকমতো দেখে তৌফিকার গলা পেছন থেকে জরিয়ে ধরলো। ছবিটা তৌফিকার সামনে তুলে বললো,
-আম্মু? আব্বুর সাথে এই আঙ্কেলটা কে?
ছবিটা সামনে আসতেই চোখ ফেটে জল গরিয়ে পরলো তৌফিকার। ছবিতে সজল,সুমন দুই জনের হাসোজ্জ্বল চেহারা। এই ক্রিমিনালটার মতো ওর বরও একটা ক্রিমিনাল,ওরা দুই ভাই,সত্যিটা আরেকবার আঘাত করলো অচল নিউরনে।
আরাব বায়োমেডিতে গিয়েছে। হুট করে তৌফিক ওয়াহিদ দোয়াকে অফিসে ডেকেছেন বলে দোয়াও বেরিয়েছে তাড়াহুড়ো করে। হসপিটাল থেকে টুইঙ্কেলকে নিতে এসেছিলো তৌফিকা। মায়ের সাথে ড্রয়িংরুমে কথা বলে হাসিমুখে এপ্রোনটা হাতে ঝুলিয়ে টুইঙ্কেলকে খুজতে খুজতে উপরে চলে আসলো তৌফিকা। আরাবের ঘরে ঢুকে দেখে ওদের কাবার্ড পুরোটা খোলা আর টুইঙ্কেল বসেবসে পেন্সিলে কোনো এক ফাইলে দাগাচ্ছে। হন্তদন্ত হয়ে ফাইলটা কেড়ে নেয় তৌফিকা। ও জানে টুইঙ্কেল খোলেনি কাবার্ড। কোনোভাবে দোয়া চাবি নিতে ভুলে গেছে আর টুইঙ্কেল এসে ওইটাই খেলনা বানিয়েছে। কিন্তু ওর হাতে থাকা সুমন,মুফতাহিরের জয়েন্ট একাউন্টের ফাইলটা দেখে নিজেকে সংবরন করতে পারলো না তৌফিকা। নিজে থেকেই আরাবের লকার খুলেছে। আর ওখান থেকে সব কাগজ,প্রমান বেরিয়ে এসেছে। যেগুলো উচ্চস্বরে বলছে,মুফতাহির সুমনের ভাই,মুফতাহির ওকে শুধু সম্পত্তির জন্য বিয়ে করেছে,মুফতাহির ঠকিয়েছে ওকে। ঠকিয়েছে!
-আম্মু? কাদছো কেনো তুমি?
…
-ও আম্মু? কাদছো কেনো?
….
-আজকেও আব্বু হসপিটাল থেকে এসে তোমাকে হাইপাপ্পি দেয়নি বুঝি?
-কেউ আব্বু হয়না তোমার টুইঙ্কেল! কোনো আব্বু নেই তোমার! বুঝেছো? তোমার কোনো আব্বু নেই! কোনো ঠকবাজ তোমার আব্বু হতে পারে না! কোনো যোগ্যতা নেই ওর তোমার আব্বু হওয়ার! কোনো যোগ্যতা নেই! বুঝেছো তুমি টুইঙ্কেল? আজ থেকে তোমার আব্বু নেই! বুঝেছো তুমি?
কাদতে কাদতে চেচিয়ে উঠলো তৌফিকা। টুইঙ্কেলের ছোট্ট হাতদুটো শক্ত করে ধরে ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে কথাগুলো বলে ছেড়ে দিলো ওকে। মাথা চেপে ধরে চিৎকার করে কাদতে লাগলো ও। আতকে উঠে বসেবসেই অনেকটা পিছিয়ে গেলো টুইঙ্কেল। সিড়ি বেয়ে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ওঠার সময় তৌফিকার চিৎকার কানে আসলো দোয়ার। একটু থেমে ছুট লাগালো রুমে ও। রুমে চোখ বুলিয়ে থমকে যায় দোয়া। মুফতাহির সুমনের একসাথে ছবি,দুজনের বিভিন্ন সার্টিফিকেটসসহ ওরা দুই ভাই যে এন্টিডোড কেলেংকারিতে সমভাবে জড়িত সবকরমের প্রমান,ফাইল বিছানায় ছন্নছাড়া হয়ে আছে। মুহুর্তেই আতংকে চোখ ভরে উঠলো দোয়ার। তৌফিকাকে কিছু বলার আগেই টুইঙ্কেল একছুটে এসে কোমড় জরিয়ে ধরলো দোয়ার। আজ পর্যন্ত কোনোদিনই তৌফিকা এমন ব্যবহার করেনি ওর সাথে। এতো উচুস্বরে কথা বলেনি ওর সাথে। আর আজ মায়ের এক অন্যরুপ দেখেছে ও। টুইঙ্কেল ভয়েভয়ে ফুপাতে ফুপাতে বললো,
-উ্…উইশ্…উইশমাম্…উইশমাম…আম্মু…
ওর অবস্থা দেখে মেঝেতে বসে টুইঙ্কেলেকে জাপটে জরিয়ে ধরলো দোয়া। দোয়ার কাধে মুখ গুজে ফুপাতে লাগলো টুইঙ্কেল। ওকে শান্ত করবে বলে দোয়া বড়বড় শ্বাস ফেলে বললো,
-শান্ত হও টুইঙ্কেল। শান্ত হও? এইযে উইশমাম আছে তোমার কাছে। এইতো উইশমাম! আম্মুকে বকে দেবে উইশমাম! শান্ত হও আমার লিটল স্টার? আম্মুর ব্যাড এন্জেলকে উইশমাম বকে দেবে তো? টুইঙ্কেল?
টুইঙ্কেল ঢলে পরলো দোয়ার কোলে। দোয়া জমে গেছে যেনো। সামনে আনতেই দেখে জ্ঞান হারিয়েছে টুইঙ্কেল। ছোট্ট হাতদুটোতে বিভৎস্যভাবে পাঁচ আঙুলের দাগ বসে গেছে ওর। টুইঙ্কেল বলে চেচিয়ে উঠলো দোয়া। তৎক্ষনাৎ পেছন ফিরলো তৌফিকা। দোয়া টুইঙ্কেলকে এনে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছে। ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে ডাকছে আর কাদছে। তৌফিকা বিমুঢ়। দোয়ার কান্না শুনে এবার তৌফিক ওয়াহিদ আর তার মিসেস ছুটে আসলেন রুমে। টুইঙ্কেলকে অজ্ঞান দেখেই কাদতে লাগলেন মিসেস ওয়াহিদ। তৌফিক ওয়াহিদ নিজেও স্তব্ধ। তৌফিকার দিকে এগোতেই দোয়া চেচিয়ে বললো,
-আপু টুইঙ্কেল সেন্সলেস হয়ে গেছে!
হুশ ফিরলো যেনো তৌফিকার। দিশেহারার মতো এদিকওদিক তাকিয়ে পানির গ্লাস নিয়ে ছুটলো ও। মেয়েকে জরিয়ে দুবার চোখেমুখে পানির ছিটা দিলো। কয়েকবার ডাকার পর আস্তেধীরে চোখ মেললো টুইঙ্কেল। কিন্তু স্বাভাবিক হলো না। কম্পিত ক্ষুদ্র শরীরটা একপ্রকার ছিনিয়ে নিলো মায়ের কাছ থেকে। জাপটে জরিয়ে ধরে মুখ লুকালো দোয়ার কোলে। ফাকা কোল আর বিশ্বাসভাঙা মন নিয়ে তৌফিকা নিঃস্বর মতো তাকিয়ে রইলো মেয়ের দিকে। দোয়া কিংকর্তব্যবিমুঢ়। তৌফিকাকে শান্তনা দেবে,নাকি টুইঙ্কেলকে সামলাবে,বুঝে উঠতে পারছে না ও। ভেতরটা থেকে অবুঝের মতো কেউ চেচিয়ে বলছে,সত্যের তান্ডব বড্ড ভয়ানক! বড্ড ভয়ানক!
•
ঘরে বসে মায়ের শাড়ি গয়না বের করে দেখছে স্বস্তিক। অরুনাভ মুখার্জী ফেরেননি এখনো। মেসের ছেলেগুলোও নেই। ফাকা নিচতলায় একাকী ঘরে শুধু স্বস্তিক। শাড়িটা হাতে নিয়ে ভাবছে স্বস্তিক,এই লাল বেনারসীটা রেজেস্ট্রির দিন পরতে বলবে ও তন্নিকে। তন্নি ধর্ম না বদলালেও,ওকে মানা করবে না। এটা ওর দৃঢ় বিশ্বাস। ওকে ছাড়বে না তন্নি। মুচকি হেসে গয়নাগুলো বাক্সে ঢুকাতে লাগলো ও। এরমাঝেই দরজায় নখের টোকা পরলো। চোখ তুলে তাকালো স্বস্তিক। হাতে একবাটি পায়েস নিয়ে দরজায় দাড়িয়ে ও। হাসি প্রসারিত হলো স্বস্তিকের চেহারায়। বললো,
-এসো ভেতরে?
-চাচীমা বললো আপনাকে দিয়ে যেতে। কাকাবাবুকে দিতে বারন করেছে।
স্বস্তিক এগিয়ে গেলো। বাটিটা ওর হাত থেকে নিয়ে বললো,
-এসো তন্নি? আমার ঘরে?
-আমি আপনার ঘরে কোনোদিনও আসবো না স্বস্তিক।
স্বস্তিক নিচদিক তাকিয়ে আরেকটু হাসলো। তন্নির ভালো লাগেনি ওই হাসি। আর আড়াল রাখতে চায়না ও কোনো। নিজেকে শক্ত করে বললো,
-আপনার যুক্তিগুলো আমাদের দুজনকে এক করার জন্য যথেষ্ট নয় স্বস্তিক।
মাথা তুললো স্বস্তিক। তন্নি বললো,
-হ্যাঁ,আপনাকে ভালো লাগতে শুরু করেছিলো আমার। আস্তেআস্তে আপনার প্রতি দুর্বল হয়ে পরছিলাম। কিন্তু কাল আপনার কথাতেই সেটা শেষ হয়ে গেছে স্বস্তিক।
স্বস্তিক বিস্ফোরিত চোখে তাকালো। তন্নি স্বাভাবিক গলায় বললো,
-আপনার ভালোবাসি বলাতে আমি কতোটা কষ্টে ছিলাম,সেটা শুধু আমিই জানি স্বস্তিক। আমারো মনে হচ্ছিলো,আপনি ঠিকই বলেছিলেন। কাদছিলাম কারন ভালোবাসি বলাটা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। আর না সম্ভব ছিলো ভালোবাসি না বলা। কষ্টটা বেশি ছিলো,ভালোবেসেও বলতে পারছি না ভালোবাসি। কতো বাধা! কতোবড় বাস্তবতা! আমরা দুজন আলাদা ধর্মের দুটো আলাদা মানুষ!
…
-কিন্তু নিমিষেই আপনি আমার কষ্টটা গায়েব করে দিলেন স্বস্তিক। এটা বলে,আমি পিতৃপরিচয়ে মুসলিম নই। আর তবুও আপনি আমাকে মুসলিম মানেন। আমার ধর্মকে মানেন। আমার ধর্মসহ আমাকে আপন করতে চান।
স্বস্তিক মুখে জোরপুর্বক হাসি টানলো একটা। তন্নি চোয়াল শক্ত করে একপা এগোলো ওর দিকে। বললো,
-আপনি শেষ কথাগুলো হয়তো আমাকে ভালোবেসে বলেছিলেন স্বস্তিক। কিন্তু প্রথমে আমাকে আমার অনাথ পরিচয় মনে করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যটা আলাদা ছিলো আপনার। আর তাতে আমার ক্ষনিকের ভালোলাগার সাথে কথিত ভালোবাসি না বলার কষ্টটাও গায়েব হয়ে গেছে স্বস্তিক। থ্যাংকস্ টু ইউ।
বিস্ফোরিত চোখে তাকালো স্বস্তিক। কোনোমতে বললো,
-ক্ কি বলছো তুমি এসব তন্নি?
-ভুল বললাম? সত্যি করে বলুন তো স্বস্তিক? আপনার প্রথমে আমার পরিচয় বলার কারন কি ছিলো স্বস্তিক? আমাকে মনে করিয়ে দেওয়া,আমার নওমুসলিম হওয়ার সম্ভবনা আছে। আর সেটা মনে করে,আপনাকে ভালোবেসে আমি যেনো শুরুতেই ধর্মান্তরিত হতে রাজি হয়ে যাই। তাই নয় কি স্বস্তিক?
-না তন্নি! কি বলছো কি তুমি এসব?
-ক্ষমা করবেন। আমি তো এখানে আপনার ভুল ধরিয়ে দিতে এসেছি। কি বলুনতো? আপনি চেয়েছিলেন আগে আমি স্বীকারোক্তি দেই,আপনাকে ভালোবাসি। কিন্তু ভালোবাসার জন্য আগে বিপরীত মানুষটাকে সম্মান করতে শিখতে হয়। কিন্তু আপনার কথায় আমার আপনার প্রতি সম্মানটা শেষ হয়ে গেছে স্বস্তিক। সেখানে আর যাই হোক,ভালোবাসা সম্ভব নয়। ভালোবাসি না আপনাকে। তাই রেজেস্ট্রি কেনো,আপনিও যদি ধর্মান্তরিত হয়ে আমার জীবনে আসতে চান,আপনাকে আমি কোনোদিনও স্বীকার করবো না। প্লিজ ভবিষ্যতে আর আমার সামনে আসবেন না। আপনার মনমানসিকতা জানতে পেরে গেছি তো,ঘেন্না করে চোখের সামনে আপনার মতো নিচ মানসিকতাসম্পন্ন মানুষের চেহারা দেখলে। এতোটা নিচ আপনি? ছিহ্!
একছুটে বেরিয়ে গেলো তন্নি। ধপ করে মেঝেতে হাটুতে বসে পরলো স্বস্তিক। কি বলে গেলো মেয়েটা এসব? ও কখনো চায়নি তন্নি ওর ধর্মকে ছাড়ুক। কখনো চায়নি তন্নি ধর্মান্তরিত হয়ে ওর বউ হোক। কখনো ভাবেই নি ও এসব। টপটপ করে জল গড়াতে লাগলো ওর চোখ দিয়ে। হুট করেই তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটলো ওর ঠোটে। চোখের জল গরাচ্ছেই। তবুও হাসছে স্বস্তিক। তাচ্ছিল্যে হেসে তন্নির সবগুলো জবাবকে মস্তিষ্কে বসিয়ে নিলো ও। ওর বুঝতে বাকি নেই সবটাই অজুহাত ছিলো তন্নির। ও যেমন পারবে না নিজের ধর্মকে ছাড়তে,তেমনি চায়না আলাদা ধর্মের একটা মানুষকে নিজের জীবনে জড়াতে।
বিয়েটা যেভাবেই হোক,বিয়ের পর একদিন না একদিন,দুটো মানুষের কাউকে না কাউকে তো মানিয়ে নিতে হতোই। যেটা ও পারতো না,চায়নি স্বস্তিক সেটা করুক। তাই এসব অজুহাতে একেবারে দুরে সরিয়ে দিয়ে গেলো ও স্বস্তিককে। আর কিছুই নয়।
একসময় অট্টোহাসিতে ফেটে পরে বুকে হাত গুজে আবারো চিৎকার করে কাদতে লাগলো স্বস্তিক। ভালোবাসার দাবি নিয়ে আর যাবে না ও তন্নির কাছে। কোনোদিনও যাবে না। শুধু আফসোস একটাই। ধর্ম তো সৃষ্টিকর্তাপ্রদত্ত্ব। আর ভালোবাসাও তারই দেওয়া এক পবিত্র উপহার। অন্যধর্মের কাউকে ভালোবাসাটা যদি এতোটা যন্ত্রনারই হবে,তবে সৃষ্টিকর্তা কেনো অন্যধর্মের কারো প্রতি এই পবিত্র অনুভবের উদ্ভব ঘটালো? কেনো?
#চলবে…
[ আসসালামু আলাইকুম পাঠকমহল,
কেমন আছেন সবাই? গত পর্বে স্বস্তিক-তন্নির সম্পর্কটা নিয়ে আপনাদের করা কমেন্টে আমি কোনো জবাব দেইনি। এর একমাত্র কারন,আজকের পর্বে জবাবটা ছিলো। শুধু আপনারা একপর্ব আগে সতর্কবার্তা দিয়েছেন এটাই যা বিষয় ছিলো। ইগ্নোর করে গেছি পুরোটাই।
আমার প্রাপ্তি কোথায় জানেন? আপনাদের সবগুলো কমেন্ট এতোটা যুক্তিগত আর শালীন ছিলো যে,আমি ভাবতেও অবাক হয়ে যাই আমার লেখনী নিয়ে আপনাদের পজিটিভিটি কতোটা। এতেই আমার স্বার্থকতা বলে আমি মনে করি। গল্পের প্লট তো আগে থেকেই ঠিক করা। এখানে স্বস্তিক চরিত্রটা তন্নির সাথে জুড়ে দেওয়ার একমাত্র কারন সমাজের একটা বাস্ততাকে তুলে ধরা। দ্যাটস্ ইট। আর কিছুই নয়। আপনাদের মাঝে একটু অনুরনন তৈরীর জন্য আমার গত পর্বে ইঙ্গিত যাই থাকুক,পরিনতিতে কি ছিলো সেটা বিবেচনায় আশা করবো প্রত্যেকেই গল্পে “ধর্মকে টানা” প্রসঙ্গের উত্তর খুজে নেবেন। উক্ত প্লট কারো ব্যক্তিমনে আঘাতের কারন হলে,আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আর এতোটা সাপোর্টিভ হওয়ার জন্য আবারো ভালোবাসা❤ ]