এক বেরঙ চিলেকোঠায় পর্ব ৫৪+৫৫

0
365

#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৫৪

-বাবার বানানো এন্টিডোডের ফর্মুলা শশুড়ের ফার্মাইন্ডাস্ট্রিতেই তো দেবে সাফাত রওশনের মেয়ে। এটা তো আমরা সবাই জানি। কালিংয়ে এসে অন্য মেডিসিন ইন্ডাস্ট্রিকে চাহিদা বুঝিয়ে এতো ফর্মালিটি দেখানোর কি আছে? শেষমেষ তো সেই শশুড়ের কোম্পানিতেই যাবে ফর্মুলা!

আজকে দোয়া ফর্মুলা হ্যান্ডওভার করবে বলে বায়োমেডিতে মেডিসিন ইন্ডাস্ট্রির মালিকেরা এসেছে সবাই। সবে বায়োমেডিতে বাইক পার্ক করেছে আরাব। এরমাঝেই ওর বাইকের পেছনে দোয়াকে দেখে আশেপাশের মানুষগুলো কানাঘুষা করতে শুরু করলো। দোয়া কিছুই বললো না। শুধু মুচকি হেসে বাইক থেকে নামলো। হাতের ফাইলটা বুকে জরিয়ে দাড়ালো ও। একনজর তাকালো ওর জন্য উৎসুক হয়ে বসে থাকা বড়বড় বিজনেসম্যানদের ঢলের দিকে। খানিকটা তাচ্ছিল্যেও হাসলো। আজকে ওর মতো একটা সাধারন মেয়েকে নিয়ে কতো কি! যে মানুষটাকে সবাই মিলে অপমান করতে করতে সুইসাইডের দিকে ঠেলে দিয়েছিলো,তারই আবিষ্কার হাসিল করার জন্য কতো কি! আশেপাশের কথা শুনে আরাব শক্ত হয়ে বাইকেই বসে। ওর দিকে তাকালো দোয়া। বুঝলো ওর রাগের কারনও। ওর কাধে হাত রেখে বললো,

-নামুন?

বাইক ছেড়ে নামলো আরাব। দুজনে এগোলো ভেতরে। দোয়াকে অভ্যর্থনা জানানো শেষে বসতে বলা হলো। আশেপাশে আরাবকে খুজলো দোয়া। আরাব ততোক্ষনে এপ্রোন পরে ওর পাশে এসে দাড়িয়েছে। দোয়া কিঞ্চিত বিস্ময়ে তাকালো। আরাব মুচকি হেসে বললো,

-আমি এখানে তোমার বর বা রংধনুর প্রতিনিধি হয়ে আসি নি দোয়া। বায়োমেডিতে আমারও নিজস্ব কিছু দায়িত্ব আছে।

দোয়া সুন্দর একটা হাসি দিয়ে মাথা উপরনিচে নাড়ালো। চলে আসছিলো ও। আরাব পিছুডাক দিলো ওকে। দোয়া পেছন ফিরতেই আরাব বললো,

-এখনো অবদি তোমাকে বলেছি,এন্টিডোড কাকে দেবে,সেটা সম্পুর্ন তোমার সিদ্ধান্ত দোয়া। কিন্তু শেষমুহুর্তে আমি আমার সিদ্ধান্তটাও তোমাকে জানাতে চাই।

ঠোট আটকে হাসি আটকালো দোয়া। ও জানে আরাব কি বলতে চাইছে। মুখে বললো,

-হ্যাঁ বলুননা।

-আমি‌ চাইনা তুমি ফর্মুলা রংধনুকে হ্যান্ডওভার করো। রংধনু টাকা ছাড়া আর কিছু বোঝে না দোয়া। তোমার বাবার কষ্ট,ইচ্ছে কোনোটারই মুল্যায়ন হবে না রংধনুতে।

দোয়া মুগ্ধভাবে তাকিয়ে রইলো আরাবের দিকে। পাশ থেকে আরাবের এক কলিগ ডাক লাগালো ওকে। আরাব পেছনে তাকিয়ে দোয়াকে বললো,

-যে কোম্পানিকে দিচ্ছো,সেখানে যেনো তোমার বাবার ইচ্ছের প্রাধান্য থাকে। এন্টিডোড যেনো সর্বনিম্ন টাকায় সেল হয়,এটা এনশিওরের দায়িত্ব কিন্তু তোমার দোয়া। আর আমি জানি তুমি পার্ফেক্ট ডিসিশনটাই নেবে।

মাথা উপরেনিচে নাড়ালো দোয়া। আরাব বেরিয়ে আসলো ওখান থেকে। ওকে বলা হয়েছিলো দোয়ার অনুষ্ঠানে বিজনেসম্যানদের ফর্মুলা নিয়ে প্রেজেন্টেশন দেওয়ার জন্য। ও করেছেও‌ সেটা। তারপর যখন আলোচনা চলছিলো,ফর্মুলা কোথায় কিভাবে যাবে,গেলে উপকারিতা কি,তখনই চলে এসেছে আরাব। বাইরে খানিকটা দুরে দাড়ালো। বাইকে হেলান দিয়ে বুকে হাত গুজে চুপচাপ দাড়িয়ে রইলো মাথা নিচু করে। প্রোগ্রাম শেষে বেরোলো দোয়া। হাসিমুখে আরাবের দিকে এগোলো ও। দোয়াকে দেখেই আরাব বৃহৎ হাসির রেখা আঁকলো ওর ঠোটেও। দোয়া এগিয়ে বললো,

-আরাব এন্টিডোড…

-বাইকে ওঠো। একজায়গায় নিয়ে যাবো তোমাকে।

দোয়া কিছুই বললো না। অবাকও হলো না। মুচকি হেসে ব্যাকসিটে উঠে বসলো বাইকের। বাইক স্টার্ট দিলো আরাব। একটুখানি পথ চলার পরই বুকের দিকটায় দোয়ার হাত অনুভব করে সেদিকে তাকালো ও। বরাবর দোয়া ওর কাধে হাত রেখে বসে। আসার সময়ও কাধে হাত রেখেই বসে এসেছে। পাব্লিক প্লেস বিষয়টা সবসময় দোয়ার কাছে প্রাধান্য পায়,এটা জানে আরাব। কিন্তু এখন হুট করেই ওকে জরিয়ে ওর জ্যাকেটটা খামচে ধরেছে দোয়া। ওর পিঠে মাথাও ঠেকিয়েছে। হাসি প্রসারিত করে বাইক ছুটালো আরাব। দোয়া চুপচাপ ওভাবেই রইলো। গন্তব্যে পৌছে বাইক থামিয়ে আরাব বললো,

-ম্যাডাম আজকে লোকে কি বলবে নীতি উপেক্ষা করলেন যে?

দোয়া মাথা তুললো। আরাবের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,

-আপনাকে ভালোবেসে,আপনার হৃদস্পন্দন শুনে,নিজেকে সাহসী করে তুলেছি আরাব। সেখানে লোকে কি বলবে নীতি একেবারে তুচ্ছ!

দোয়া বাইক থেকে নামলো। কিন্তু সামনে থাকা দ্বিতল দালানের দিকে তাকিয়ে থমকে গেলো একপ্রকার। চোখ ভরে উঠলো ওর। ছলছল চোখে আরাবের দিকে তাকালো ও। আরাব পকেটে দুহাত গুজে হাসছে। দোয়া আরেকবার তাকালো সামনে। বড়বড় অক্ষরে দালানের সামনের দিকটাতে লেখা স্বপ্নরঙ আর্ট একাডেমি। একাডেমির ভেতরের প্রায় সবটাই দেখা যায় বাইরে থেকে। কাচের দেওয়ালের ওপারে রঙের মেলা বসেছে যেনো। ছোট বড় সবাই রঙ নিয়ে খেলতে ব্যস্ত,হাসিঠাট্টা,আড্ডামস্তিতে আকাতে ব্যস্ত। বাবা মারা যাওয়ার পর এই প্রথম এখানে আসলো দোয়া। আগে ইচ্ছে হলেই মনের সবটুকো রঙ এসে এটে দিয়ে যেতো এখানে এসে। এখানকার সব রঙ,তুলি,ক্যানভাস উন্মুক্ত ছিলো ওর জন্য। সাফাত রওশন নিজে এই ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। দোয়ার আর্টগুলো বিক্রির টাকা রাস্তার ছেলেমেয়েদের দিয়ে দেওয়া হতো। কতো সুন্দর ছিলো দিনগুলো! আরাব এগিয়ে এসে আস্তেকরে বললো,

-তোমার স্বপ্নের রঙ দোয়া। স্বপ্নরঙ!

ওকে জাপটে জরিয়ে ধরে দোয়া কেদেই দিলো। আরাবের প্রত্যেকটা কাজে প্রতিবার নিজেকে আটকানো দায় হয় ওর জন্য। দোয়া জানে,তখন ওই আশেপাশের লোকগুলোর কথা শুনে যাতে ওর মন খারাপ না হয়,ভবিষ্যতে যেনো ওকে এমন কোনো কটু কথা শুনতে না হয়,এজন্যই ও সরাসরি বলেছে এন্টিডোড রংধনুতে না দিতে। আরাবের কথায় এন্টিডোড অন্য কোম্পানিতে দেওয়ায় আরাবের মন খারাপ নেই এটা যে দোয়া বুঝবে,সেটাও জানে আরাব। তবুও এটা বুঝাতে আলাদা,কৃত্রিম হাসি ধরে রেখেছে আরাব। আর সবশেষে,এন্টিডোড অন্য কোম্পানিতে দেওয়ায় দোয়ার গিল্টিফিল কাটাবে বলে ওকে এই আর্ট একাডেমিতে নিয়ে এসেছে। দোয়া হুহু করে কাদতে লাগলো ওর বুকে মুখ গুজে। আরাব ওর চুল মুঠো করে নিয়ে কাতরভাবে বললো,

-কাদছো কেনো দোয়া? কেনো কাদছো? আমার কষ্ট হচ্ছে তো! প্লিজ কেদো না! প্লিজ!

একটা জোরে শ্বাস নিয়ে মাথা তুললো দোয়া। আরাবকে ছেড়ে হাতের পিঠে চোখমুখ মুছে দাড়ালো ও। আরাব মুচকি হাসলো। সালমা বেগমের কাছ থেকে দোয়ার এই আকাআকির সবটা শুনেছিলো ও। দোয়ার দুগাল ধরে বললো,

-তু‌মি এখানে আসবে দোয়া। আগে যেমন আসতে,তেমনই আসবে। আর ছবি আঁকবে। তোমার আঁকা ছবিগুলো যে টাকায় সেল হবে,সে সব টাকা ছেলেমেয়েদের দিয়ে দেওয়া হবে। ঠিক আগের মতো!

আরাবের হাতের উপর হাত রাখলো দোয়া। বললো,

-হ্যাঁ। আসবো আমি! আসবো! তবে তার আগে আমার আরো কিছু দায়িত্ব বাকি আছে আরাব।

আরাব হেসে বললো,

-দিয়ান সুস্থ্য হলেই ওকে বিকেএসপিতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে দোয়া। ডোন্ট ওয়ারি। আর মা যেহেতু চিলেকোঠাতেই থাকবেন,ওনার জন্য তোমার বাবার ব্যাংকব্যালেন্স,ফর্মুলা সেলের টাকা,তুমি,আমি আমরা সবাই আছি। তোমার পড়াশোনা বাদ দিয়ে এখানে আসতে হবে না। ফাইনাল এক্সাম পরই না হয় তুমি এখানে এসো? আর রওশন স্যারের ফর্মুলা তো শর্তসাপেক্ষেই মেডিসিন ইন্ডাস্ট্রিতে গেছে। তো ওখানে…

-বাবার ফর্মুলা রংধনু ফার্মাকেমিক্যালসে গেছে আরাব।

আরাব আটকে রইলো কিছুক্ষন। নিমিষেই বিষাদ ছেয়ে গেলো ওর চেহারায়। দোয়ার গাল ছেড়ে অন্যদিক ফিরে শান্তগলায় বললো,

-তোমাকে বলেছিলাম স্বজনপ্রীতি ভুলে যেতে।

দোয়া একদম সামনে এসে দাড়ালো ওর। আবারো ওর দুহাত নিজের গালে নিয়ে বললো,

-আমি স্বজনপ্রীতি দেখাই নি আরাব। আমি তো শুধু আমার বাবার স্বপ্নকে ভালোবেসেছি।

-কিন্তু রংধনু ফার্মাকেমিক্যালসে কোনোদিনও তোমার বাবার স্বপ্নপুরন পসিবল না দোয়া! ওরা কোনোদিনও লোয়েস্ট রেটে এন্টিডোড লঞ্চ করবে না!

-আপনার এই “ওরা” সম্বোধনের দায়িত্বে এখন আমি আরাব।

বিস্ফোরিতো চোখে আরাব তাকালো দোয়ার দিকে। দোয়া মুচকি হেসে বললো,

-আপনার মনে আছে? একবার বলেছিলেন,আপনার বাবাকে নাকি বোঝার কেউ নেই। আপনার বাবা তাকে বোঝার দায়িত্ব আমাকে দিয়েছে আরাব। গতকাল রাতে যখন তার ঘরে তাকে ওষুধ খাওয়াতে গিয়েছিলাম,উনি আমাকে মা বলে ডেকেছেন আরাব। উনি কেদেছেন আমার কাছে। স্বীকার করেছেন,তাকে বোঝার সত্যিই কেউ নেই। রংধনু ফার্মাকেমিক্যালসের এমডি পদবীটা তার এই মায়ের কাছে উনি দিয়ে দিয়েছেন আরাব। উনি চান আমি নিজের মতো করে এন্টিডোড লন্চের সবটা লিড করি। সেটা যতো স্বল্পদামে সম্ভব। বিনিময়ে তার এমন কাউকে চাই,যে তাকে বুঝবে,বুঝাবে। তার আমাকে চাই আরাব। তাকে বোঝার মতো এই মাকে চাই তার। আর আমি তাকে মানা করতে পারি নি আরাব। নিজেহাতে এন্টিডোড লন্চ করাবো,বাবাকেও পাশে পাবো,একসাথে দুটো জিনিস পাওয়ার লোভ আমি সামলাতে পারি নি আরাব। লোভী হয়ে গিয়েছি প্রচন্ড! প্রচন্ড লোভী!

আরাবের চোখ খুশির পানিতে ভরে উঠেছে। ঠোট কামড়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে সামলানোর চেষ্টা করছে ও সেই অশ্রুকে। দোয়া কান্নার মধ্যেও হেসে দিয়ে বললো,

-এবার বুঝুন সাইন্টিস্ট মশাই! খুশির কান্না আটকানো কতো কষ্টের!

কয়েকবার দোয়ার চোখেমুখে চুমো দিয়ে হেচকা টানে ওকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো আরাব। দোয়া ওর বুকে মুখ গুজে রেখে বললো,

-আমি লোকে কি বলে নীতিতে বিশ্বাসী নই আরাব। আমি তো যেটা ঠিক,সেটাই করনীয় নীতিতে বিশ্বাসী। আপনার মতো।

দোয়ার চুলে আরো দুবার চুমো দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো আরাব। কিছুক্ষন পর দোয়া বললো,

-লোকে কি বলবে নাইবা ভাবলেন,রাস্তায় এভাবে জরিয়ে থাকা কি করনীয় আরাব?

আরাব হেসে ছেড়ে দিলো ওকে। দোয়া মুগ্ধ হয়ে ওর হাসিমুখটা দেখতে লাগলো। দুদন্ড দৃষ্টিবিনিময়ের মাঝেই ফোন বেজে উঠলো আরাবের। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলো আরাব। খুশিতে আপ্লুত চেহারায় হঠাৎই কঠোরতা ফুটে উঠলো ওর।

#চলবে…

#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৫৪

-বাবার বানানো এন্টিডোডের ফর্মুলা শশুড়ের ফার্মাইন্ডাস্ট্রিতেই তো দেবে সাফাত রওশনের মেয়ে। এটা তো আমরা সবাই জানি। কালিংয়ে এসে অন্য মেডিসিন ইন্ডাস্ট্রিকে চাহিদা বুঝিয়ে এতো ফর্মালিটি দেখানোর কি আছে? শেষমেষ তো সেই শশুড়ের কোম্পানিতেই যাবে ফর্মুলা!

আজকে দোয়া ফর্মুলা হ্যান্ডওভার করবে বলে বায়োমেডিতে মেডিসিন ইন্ডাস্ট্রির মালিকেরা এসেছে সবাই। সবে বায়োমেডিতে বাইক পার্ক করেছে আরাব। এরমাঝেই ওর বাইকের পেছনে দোয়াকে দেখে আশেপাশের মানুষগুলো কানাঘুষা করতে শুরু করলো। দোয়া কিছুই বললো না। শুধু মুচকি হেসে বাইক থেকে নামলো। হাতের ফাইলটা বুকে জরিয়ে দাড়ালো ও। একনজর তাকালো ওর জন্য উৎসুক হয়ে বসে থাকা বড়বড় বিজনেসম্যানদের ঢলের দিকে। খানিকটা তাচ্ছিল্যেও হাসলো। আজকে ওর মতো একটা সাধারন মেয়েকে নিয়ে কতো কি! যে মানুষটাকে সবাই মিলে অপমান করতে করতে সুইসাইডের দিকে ঠেলে দিয়েছিলো,তারই আবিষ্কার হাসিল করার জন্য কতো কি! আশেপাশের কথা শুনে আরাব শক্ত হয়ে বাইকেই বসে। ওর দিকে তাকালো দোয়া। বুঝলো ওর রাগের কারনও। ওর কাধে হাত রেখে বললো,

-নামুন?

বাইক ছেড়ে নামলো আরাব। দুজনে এগোলো ভেতরে। দোয়াকে অভ্যর্থনা জানানো শেষে বসতে বলা হলো। আশেপাশে আরাবকে খুজলো দোয়া। আরাব ততোক্ষনে এপ্রোন পরে ওর পাশে এসে দাড়িয়েছে। দোয়া কিঞ্চিত বিস্ময়ে তাকালো। আরাব মুচকি হেসে বললো,

-আমি এখানে তোমার বর বা রংধনুর প্রতিনিধি হয়ে আসি নি দোয়া। বায়োমেডিতে আমারও নিজস্ব কিছু দায়িত্ব আছে।

দোয়া সুন্দর একটা হাসি দিয়ে মাথা উপরনিচে নাড়ালো। চলে আসছিলো ও। আরাব পিছুডাক দিলো ওকে। দোয়া পেছন ফিরতেই আরাব বললো,

-এখনো অবদি তোমাকে বলেছি,এন্টিডোড কাকে দেবে,সেটা সম্পুর্ন তোমার সিদ্ধান্ত দোয়া। কিন্তু শেষমুহুর্তে আমি আমার সিদ্ধান্তটাও তোমাকে জানাতে চাই।

ঠোট আটকে হাসি আটকালো দোয়া। ও জানে আরাব কি বলতে চাইছে। মুখে বললো,

-হ্যাঁ বলুননা।

-আমি‌ চাইনা তুমি ফর্মুলা রংধনুকে হ্যান্ডওভার করো। রংধনু টাকা ছাড়া আর কিছু বোঝে না দোয়া। তোমার বাবার কষ্ট,ইচ্ছে কোনোটারই মুল্যায়ন হবে না রংধনুতে।

দোয়া মুগ্ধভাবে তাকিয়ে রইলো আরাবের দিকে। পাশ থেকে আরাবের এক কলিগ ডাক লাগালো ওকে। আরাব পেছনে তাকিয়ে দোয়াকে বললো,

-যে কোম্পানিকে দিচ্ছো,সেখানে যেনো তোমার বাবার ইচ্ছের প্রাধান্য থাকে। এন্টিডোড যেনো সর্বনিম্ন টাকায় সেল হয়,এটা এনশিওরের দায়িত্ব কিন্তু তোমার দোয়া। আর আমি জানি তুমি পার্ফেক্ট ডিসিশনটাই নেবে।

মাথা উপরেনিচে নাড়ালো দোয়া। আরাব বেরিয়ে আসলো ওখান থেকে। ওকে বলা হয়েছিলো দোয়ার অনুষ্ঠানে বিজনেসম্যানদের ফর্মুলা নিয়ে প্রেজেন্টেশন দেওয়ার জন্য। ও করেছেও‌ সেটা। তারপর যখন আলোচনা চলছিলো,ফর্মুলা কোথায় কিভাবে যাবে,গেলে উপকারিতা কি,তখনই চলে এসেছে আরাব। বাইরে খানিকটা দুরে দাড়ালো। বাইকে হেলান দিয়ে বুকে হাত গুজে চুপচাপ দাড়িয়ে রইলো মাথা নিচু করে। প্রোগ্রাম শেষে বেরোলো দোয়া। হাসিমুখে আরাবের দিকে এগোলো ও। দোয়াকে দেখেই আরাব বৃহৎ হাসির রেখা আঁকলো ওর ঠোটেও। দোয়া এগিয়ে বললো,

-আরাব এন্টিডোড…

-বাইকে ওঠো। একজায়গায় নিয়ে যাবো তোমাকে।

দোয়া কিছুই বললো না। অবাকও হলো না। মুচকি হেসে ব্যাকসিটে উঠে বসলো বাইকের। বাইক স্টার্ট দিলো আরাব। একটুখানি পথ চলার পরই বুকের দিকটায় দোয়ার হাত অনুভব করে সেদিকে তাকালো ও। বরাবর দোয়া ওর কাধে হাত রেখে বসে। আসার সময়ও কাধে হাত রেখেই বসে এসেছে। পাব্লিক প্লেস বিষয়টা সবসময় দোয়ার কাছে প্রাধান্য পায়,এটা জানে আরাব। কিন্তু এখন হুট করেই ওকে জরিয়ে ওর জ্যাকেটটা খামচে ধরেছে দোয়া। ওর পিঠে মাথাও ঠেকিয়েছে। হাসি প্রসারিত করে বাইক ছুটালো আরাব। দোয়া চুপচাপ ওভাবেই রইলো। গন্তব্যে পৌছে বাইক থামিয়ে আরাব বললো,

-ম্যাডাম আজকে লোকে কি বলবে নীতি উপেক্ষা করলেন যে?

দোয়া মাথা তুললো। আরাবের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,

-আপনাকে ভালোবেসে,আপনার হৃদস্পন্দন শুনে,নিজেকে সাহসী করে তুলেছি আরাব। সেখানে লোকে কি বলবে নীতি একেবারে তুচ্ছ!

দোয়া বাইক থেকে নামলো। কিন্তু সামনে থাকা দ্বিতল দালানের দিকে তাকিয়ে থমকে গেলো একপ্রকার। চোখ ভরে উঠলো ওর। ছলছল চোখে আরাবের দিকে তাকালো ও। আরাব পকেটে দুহাত গুজে হাসছে। দোয়া আরেকবার তাকালো সামনে। বড়বড় অক্ষরে দালানের সামনের দিকটাতে লেখা স্বপ্নরঙ আর্ট একাডেমি। একাডেমির ভেতরের প্রায় সবটাই দেখা যায় বাইরে থেকে। কাচের দেওয়ালের ওপারে রঙের মেলা বসেছে যেনো। ছোট বড় সবাই রঙ নিয়ে খেলতে ব্যস্ত,হাসিঠাট্টা,আড্ডামস্তিতে আকাতে ব্যস্ত। বাবা মারা যাওয়ার পর এই প্রথম এখানে আসলো দোয়া। আগে ইচ্ছে হলেই মনের সবটুকো রঙ এসে এটে দিয়ে যেতো এখানে এসে। এখানকার সব রঙ,তুলি,ক্যানভাস উন্মুক্ত ছিলো ওর জন্য। সাফাত রওশন নিজে এই ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। দোয়ার আর্টগুলো বিক্রির টাকা রাস্তার ছেলেমেয়েদের দিয়ে দেওয়া হতো। কতো সুন্দর ছিলো দিনগুলো! আরাব এগিয়ে এসে আস্তেকরে বললো,

-তোমার স্বপ্নের রঙ দোয়া। স্বপ্নরঙ!

ওকে জাপটে জরিয়ে ধরে দোয়া কেদেই দিলো। আরাবের প্রত্যেকটা কাজে প্রতিবার নিজেকে আটকানো দায় হয় ওর জন্য। দোয়া জানে,তখন ওই আশেপাশের লোকগুলোর কথা শুনে যাতে ওর মন খারাপ না হয়,ভবিষ্যতে যেনো ওকে এমন কোনো কটু কথা শুনতে না হয়,এজন্যই ও সরাসরি বলেছে এন্টিডোড রংধনুতে না দিতে। আরাবের কথায় এন্টিডোড অন্য কোম্পানিতে দেওয়ায় আরাবের মন খারাপ নেই এটা যে দোয়া বুঝবে,সেটাও জানে আরাব। তবুও এটা বুঝাতে আলাদা,কৃত্রিম হাসি ধরে রেখেছে আরাব। আর সবশেষে,এন্টিডোড অন্য কোম্পানিতে দেওয়ায় দোয়ার গিল্টিফিল কাটাবে বলে ওকে এই আর্ট একাডেমিতে নিয়ে এসেছে। দোয়া হুহু করে কাদতে লাগলো ওর বুকে মুখ গুজে। আরাব ওর চুল মুঠো করে নিয়ে কাতরভাবে বললো,

-কাদছো কেনো দোয়া? কেনো কাদছো? আমার কষ্ট হচ্ছে তো! প্লিজ কেদো না! প্লিজ!

একটা জোরে শ্বাস নিয়ে মাথা তুললো দোয়া। আরাবকে ছেড়ে হাতের পিঠে চোখমুখ মুছে দাড়ালো ও। আরাব মুচকি হাসলো। সালমা বেগমের কাছ থেকে দোয়ার এই আকাআকির সবটা শুনেছিলো ও। দোয়ার দুগাল ধরে বললো,

-তু‌মি এখানে আসবে দোয়া। আগে যেমন আসতে,তেমনই আসবে। আর ছবি আঁকবে। তোমার আঁকা ছবিগুলো যে টাকায় সেল হবে,সে সব টাকা ছেলেমেয়েদের দিয়ে দেওয়া হবে। ঠিক আগের মতো!

আরাবের হাতের উপর হাত রাখলো দোয়া। বললো,

-হ্যাঁ। আসবো আমি! আসবো! তবে তার আগে আমার আরো কিছু দায়িত্ব বাকি আছে আরাব।

আরাব হেসে বললো,

-দিয়ান সুস্থ্য হলেই ওকে বিকেএসপিতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে দোয়া। ডোন্ট ওয়ারি। আর মা যেহেতু চিলেকোঠাতেই থাকবেন,ওনার জন্য তোমার বাবার ব্যাংকব্যালেন্স,ফর্মুলা সেলের টাকা,তুমি,আমি আমরা সবাই আছি। তোমার পড়াশোনা বাদ দিয়ে এখানে আসতে হবে না। ফাইনাল এক্সাম পরই না হয় তুমি এখানে এসো? আর রওশন স্যারের ফর্মুলা তো শর্তসাপেক্ষেই মেডিসিন ইন্ডাস্ট্রিতে গেছে। তো ওখানে…

-বাবার ফর্মুলা রংধনু ফার্মাকেমিক্যালসে গেছে আরাব।

আরাব আটকে রইলো কিছুক্ষন। নিমিষেই বিষাদ ছেয়ে গেলো ওর চেহারায়। দোয়ার গাল ছেড়ে অন্যদিক ফিরে শান্তগলায় বললো,

-তোমাকে বলেছিলাম স্বজনপ্রীতি ভুলে যেতে।

দোয়া একদম সামনে এসে দাড়ালো ওর। আবারো ওর দুহাত নিজের গালে নিয়ে বললো,

-আমি স্বজনপ্রীতি দেখাই নি আরাব। আমি তো শুধু আমার বাবার স্বপ্নকে ভালোবেসেছি।

-কিন্তু রংধনু ফার্মাকেমিক্যালসে কোনোদিনও তোমার বাবার স্বপ্নপুরন পসিবল না দোয়া! ওরা কোনোদিনও লোয়েস্ট রেটে এন্টিডোড লঞ্চ করবে না!

-আপনার এই “ওরা” সম্বোধনের দায়িত্বে এখন আমি আরাব।

বিস্ফোরিতো চোখে আরাব তাকালো দোয়ার দিকে। দোয়া মুচকি হেসে বললো,

-আপনার মনে আছে? একবার বলেছিলেন,আপনার বাবাকে নাকি বোঝার কেউ নেই। আপনার বাবা তাকে বোঝার দায়িত্ব আমাকে দিয়েছে আরাব। গতকাল রাতে যখন তার ঘরে তাকে ওষুধ খাওয়াতে গিয়েছিলাম,উনি আমাকে মা বলে ডেকেছেন আরাব। উনি কেদেছেন আমার কাছে। স্বীকার করেছেন,তাকে বোঝার সত্যিই কেউ নেই। রংধনু ফার্মাকেমিক্যালসের এমডি পদবীটা তার এই মায়ের কাছে উনি দিয়ে দিয়েছেন আরাব। উনি চান আমি নিজের মতো করে এন্টিডোড লন্চের সবটা লিড করি। সেটা যতো স্বল্পদামে সম্ভব। বিনিময়ে তার এমন কাউকে চাই,যে তাকে বুঝবে,বুঝাবে। তার আমাকে চাই আরাব। তাকে বোঝার মতো এই মাকে চাই তার। আর আমি তাকে মানা করতে পারি নি আরাব। নিজেহাতে এন্টিডোড লন্চ করাবো,বাবাকেও পাশে পাবো,একসাথে দুটো জিনিস পাওয়ার লোভ আমি সামলাতে পারি নি আরাব। লোভী হয়ে গিয়েছি প্রচন্ড! প্রচন্ড লোভী!

আরাবের চোখ খুশির পানিতে ভরে উঠেছে। ঠোট কামড়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে সামলানোর চেষ্টা করছে ও সেই অশ্রুকে। দোয়া কান্নার মধ্যেও হেসে দিয়ে বললো,

-এবার বুঝুন সাইন্টিস্ট মশাই! খুশির কান্না আটকানো কতো কষ্টের!

কয়েকবার দোয়ার চোখেমুখে চুমো দিয়ে হেচকা টানে ওকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো আরাব। দোয়া ওর বুকে মুখ গুজে রেখে বললো,

-আমি লোকে কি বলে নীতিতে বিশ্বাসী নই আরাব। আমি তো যেটা ঠিক,সেটাই করনীয় নীতিতে বিশ্বাসী। আপনার মতো।

দোয়ার চুলে আরো দুবার চুমো দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো আরাব। কিছুক্ষন পর দোয়া বললো,

-লোকে কি বলবে নাইবা ভাবলেন,রাস্তায় এভাবে জরিয়ে থাকা কি করনীয় আরাব?

আরাব হেসে ছেড়ে দিলো ওকে। দোয়া মুগ্ধ হয়ে ওর হাসিমুখটা দেখতে লাগলো। দুদন্ড দৃষ্টিবিনিময়ের মাঝেই ফোন বেজে উঠলো আরাবের। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলো আরাব। খুশিতে আপ্লুত চেহারায় হঠাৎই কঠোরতা ফুটে উঠলো ওর।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here