এক বেরঙ চিলেকোঠায় পর্ব ৫০+৫১

0
380

#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৫০

-আপনি আমাকে এভাবে অন্ধকারে রাখবেন,এটা আমার ধারনাতেও ছিলো না আরাব।

দোয়া একদম শান্তভাবে বললো। ওর চোখজোড়া ছলছল করছে। আরাব মাথা নিচু করে দাড়িয়ে। চোখ প্রচন্ডরকম ভাবে চুলকাচ্ছে ওর। জোরে শ্বাস ফেলে যেনো কান্নাকে আটকে দিচ্ছে কোনোমতে। দোয়া একপা দুপা করে এগোলো ওর দিকে। আরাবের সামনে দাড়িয়ে বললো,

-আপনাকে মাথা নিচু করে থাকা মানায় না আরাব।

আরাব মাথা তুললো। ওর চোখমুখ দেখে শাড়ির আঁচল খামচে ধরলো দোয়া। নাকচোখ লাল হয়ে আছে। এই বুঝি কান্না বেরিয়ে আসবে। আর সেই কান্নাকে আটকে রেখেছে আরাব। দোয়ার চোখে চোখ রেখে আরাব বললো,

-যা শুনেছো,ঠিকই শুনেছো। হ্যাঁ,আমিই…এ্ এই আমিই অন্ধকারে রেখেছি তোমাকে। তোমার বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ী দুজনের একজনের সত্যিটা সবাইকে জানিয়ে তাকে পুলিশের কাছ থেকে আড়াল করেছি,আরেকজনের সত্যিটাই পুরো দুনিয়া থেকে আড়াল করেছি। হ্যাঁ দোয়া,আমি করেছি এমনটা! আমি করেছি!

বলে আবারো চোখ সরিয়ে নিলো আরাব। নাকটা ডলে একটা শুকনো ঢোক গিললো ও। ভয় করছে ওর। দোয়াকে হারানোর ভয়! দোয়ার মতো একটা মেয়ে,যার বিশ্বাস ভালোবাসা জিততে ওকে এতোগুলো পরীক্ষা দিতে হয়েছে,আজ বুঝি তা নিমিষেই শেষ। নিজের বাবার অপমান ঘুচাবে বলে এতোদিন কতোটা অস্থির ছিলো দোয়া,তা জানে ও। সুমনের প্রতি ঠিক কতোটা ঘৃনা দোয়ার,তাও জানে। আর সেই সুমনকে,ওর বাবার বিরুদ্ধে চক্রান্তকারীদেরকে পুলিশ থেকে সরিয়ে রেখেছে আরাব। এর প্রতিত্তরে দোয়া কতোটা কঠোর হতে পারে,আন্দাজে আসছে না আরাবের। সাহস জুগিয়ে আবারো দোয়ার দিকে ফিরতেই দোয়া বললো,

-আমার কাছ থেকে এই মুহুর্তে ঠিক কি আশা করছেন আপনি আরাব? কি করা উচিত আমার এখন?

আরাবের চোখেমুখে বিস্ময়। দোয়া কাতরভাবে বললো,

-আপনাকে এতোটা ভালোবাসি যে আপনার করা কোনো কাজ অন্যায় সেটা ভাবার আগে নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে আরাব!

-নাহ্! দোয়া তুমি…

-কিন্তু আপনি যা করেছেন তা তো অন্যায়,আইনবিরোধী! আপনি অপরাধীকে পুলিশের কাছ থেকে আড়াল করেছেন আরাব! অপরাধকে লুকিয়েছেন আপনি! আপনি অন্যায় করেছেন আরাব! আপনি অন্যায় করেছেন! আপনি এই মুফতাহিরকে…

দোয়ার উচ্চস্বর। আরাব আশেপাশে তাকিয়ে একহাতে কোমড় জরিয়ে ধরলো ওর। আরেকহাতে ওর মুখ চেপে ধরে বললো,

-হ্ হ্যাঁ হ্যা দোয়া! আমি! আমি অন্যায় করেছি! যা করার সব আমি করেছি! সুমনকে আমি‌ গুম করে রেখেছি! ওকে পুলিশের নাগালের বাইরে আমি রেখেছি! ক্ কিন্তু মুফতাহির কিছু করেনি! তুমি কিছু শোনোনি দোয়া! ও কিছু করেনি!

বিস্ফোরিত চোখে তাকালো দোয়া। আরাবের এই রুপের সাথে ওর একদমই জানাশোনা নেই। একদমই না! আরাব চোখ বন্ধ করে সামলালো নিজেকে। দুহাতে দোয়ার দুগাল ধরে কপালে কপাল ঠেকালো ওর। চোখ বন্ধ করে বললো,

-আমাকে একটু বোঝো দোয়া। প্লিজ একটু বোঝো? আমার আর কোনো উপায় ছিলো না বিশ্বাস করো! আর কোনো উপায় ছিলো না! আমি…আমি সুমনকে সাজা দেবো! কঠিন সাজা দেবো ওকে। যখন ও মুফতাহিরের নাম নেবে না এ শর্তে রাজি হয়ে যাবে,তখন ওকে পুলিশের হাতেও তুলে দেবো। কিন্তু মুফতাহিরকে এসবে জড়াতে দিতে পারবো না আমি দোয়া! ওকে…ওকে প্লিজ ক্ষমা করে দাও তুমি দোয়া! প্লিজ ক্ষমা করে দাও! আমার বোনটার জীবন…

দুহাতে আরাবের বুকে মৃদ্যু শক্তিতে ওকে দুরে সরিয়ে দিলো দোয়া। টপটপ করে পানি গরাচ্ছে ওর চোখ দিয়ে। আর তাতে আরাবের ভেতরটা যেনো কেউ টুকরো টুকরো করে কাটছে এমন অনুভব হচ্ছে। কিছুক্ষন চুপচাপ থাকার পর মুফতাহির এগিয়ে বললো,

-আমার কিছু বলার ছিলো। দ্…

-থামুন! একটা কথা বলবেন না আপনি! একটা শব্দও না!

চেচিয়ে মুফতাহিরকে থামিয়ে দিলো দোয়া। মুফতাহির বিস্ময়ে দোয়াকে দেখছে,দোয়ার কঠোরতাকে দেখছে। ওর দিকে ফিরে দোয়া জোর গলাতেই বললো,

-লজ্জা করছে না আপনার এখানে দাড়িয়ে থাকতে? লজ্জা করছে না? আপনি আর আপনার ভাই শুধু এন্টিডোড চুরির প্লান করেন নি,খুন করেছেন আমার বাবাকে! আপনার জন্যই আমার বাবা সুইসাইড করেছিলো! আপনার জন্য আমার পুরো পরিবার শেষ,আপনার জন্য তাজীনের জীবনটা নষ্ট হতে যাচ্ছিলো,আপনার জন্য রংধনুতে এতো ঝামেলা,আর সবচেয়ে বড় কথা,তৌফিকা আপুকে ঠকিয়েছেন আপনি! ঠকিয়েছেন আপুকে! শুধু খুনি নন আপনি! একটা ঠকবাজও! ঠকবাজ!

একশ্বাসে বললো দোয়া। আরাব ওর দিকে এগিয়ে দিশেহারার মতো করে বললো,

-প্লিজ দোয়া,প্লিজ এসব বলো না। আপু শুনলে…

দোয়া আরাবের দিকে এগিয়ে গিয়ে একদম কাছে দাড়ালো আরাবের। দুহাতে ওর শার্ট মুঠো করে নিয়ে বললো,

-সত্যিটা সত্যিই হয় আরাব! তা একদিন না একদিন প্রকাশ পাবেই! আর ভালো এতেই,এই জঘন্য লোকটার সাথে আরো বেশি জরিয়ে যাওয়ার আগে তৌফিকা আপু সবটা জানুক!

আরাব দোয়ার হাত সরিয়ে দিলো। চুল উল্টে ধরে এদিকওদিক হাটলো। তারপর আবারো দোয়ার সামনে দাড়িয়ে জিভ দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে বললো,

-আপুর সবটাই ওর সাথে জড়িয়ে আছে দোয়া। সবটাই! তুমিও জানো তা।

দোয়া আটকে গেলো। ও চায় আরাব আইনবিরোধী কিছু না করুক। ও সুমন-মুফতাহিরের শাস্তি চায়,এটা যেমন সত্য,তেমনি তৌফিকাকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে সুখী রাখতে চায় এটাও চরম সত্য। মুফতাহির একটা ছোট শ্বাস ফেলে বললো,

-আরাব? দোয়া ঠিকই বলছে। তৌফিকার সবটা জানা উচিত।

দোয়া আরাব দুজনেই চরম বিস্ময়ে তাকালো ওর দিকে। মুফতাহির মাথা নিচু রেখে বললো,

-আমি নিজেকে নিয়ে কোনো এক্সপ্লেনেশন দিতে চাইনা। হ্যাঁ,মিথ্যে দিয়েই সবটা সাজিয়েছিলাম আমি। তৌফিকাকে বিয়ের কারন,তৌফিক ওয়াহিদের ধনসম্পদ হাত করা। তৌফিকাকে ভালোবেসে বিয়ে করিনি আমি। মিথ্যে বলেছিলাম।

একটু থামলো মুফতাহির। তারপর মাথা তুলে বললো,

-এসব মিথ্যের মাঝেও একটা সত্য ছিলো আরাব। আমি তৌফিকাকে,টুইঙ্কেলকে ছেড়ে থাকার কথা ভাবতেও পারিনা। কোনোদিনও ভাবিনি,ওদের থেকে দুরে থাকবো। টুইঙ্কেলকে ছাড়া নিজেকে ভাবতে পারি না। তৌফিকার অভিমান সহ্য করতে পারি না। তাই প্রতিবার যখনই ওর সাথে ঝগড়া হতো,আমি আমার অজান্তেই ওকে গিয়ে সরি বলতাম। আমার অজান্তেই ওকে মানিয়ে বুকে জরিয়ে ধরতাম। বিশ্বাস করো,ওগুলো আমার ইচ্ছাকৃত ছিলো না। হয়তো তাই…হয়তো তাই ওগুলো নাটক ছিলো না!

….

-দোয়ার আত্মসম্মানের দিকে আঙুল তুলেছিলাম বলে তৌফিকা অনেকগুলো দিন আমার সাথে কথা বলেনি আরাব। ঠিকমতো তাকায়নি পর্যন্ত আমার দিকে। তখন আমিও জেদ করে ছিলাম। এই মেয়েটার জন্য সুমনের সত্যি,আমার সত্যি বেরিয়ে আসতে পারে। ওকে রংধনুতে বউ হয়ে আসতে দিতে পারি না আমি। জেদ করে কথা কাটাকাটি করতাম তৌফিকার সাথে। ঝগড়া করতাম। কিন্তু দিনশেষে আমার ভেতরটা কতোটা ফাকাফাকা লাগতো,তা আমিই জানি। তবুও বলবো,ওকে ঠকিয়েছি আমি। ঠকাচ্ছি! ওকে আমি ভালোবাসতে পারি না।

দোয়া আরাব স্তব্ধ হয়ে গেছে। মুফতাহিরের চোখও ভরে উঠেছে এবার। মুখে একটা কৃত্রিম হাসি টেনে বললো,

-ভুল করেছি। আর তার শাস্তিও আমি পাচ্ছি। আমাকে তো ছেড়ে দিয়েছে আরাব। কিন্তু সুমন ঠিক কি অবস্থায় আছে,আরাব ওকে কেমন রেখেছে তার ধারনা আছে আমার। একমাত্র ভাইয়ের যন্ত্রনা আন্দাজ করতে প্রতিমুহুর্তে মরছি আমি। প্রতিমুহুর্তে! আর আমার সাথে এমনটাই হওয়া উচিত। কিন্তু আমি যেমন দোয়ার অপরাধী,তেমন তৌফিকারও। তাই দোয়ার সাথে তৌফিকারও সবটা জানা উচিত আরাব। তুমি…তুমি সুমনকে ছেড়ে দিও। আমার দিকটা পুলিশ দেখে নেবে। তোমার কিছুই বলতে হবে না তৌফিকাকে।

দোয়া আরাবের বিস্ময় কাটছেই‌ না। দুজনের করনীয় কি তাও বুঝে উঠছে না কেউই। আরাব নিজেকে শক্ত করে বললো,

-চলে যাও এখান থেকে।

-কিন্তু আরাব…

-চলে যাও মুফতাহির! প্লিজ গেট লস্ট!

একটু উত্তেজিতভাবে বলে আরাব দেয়ালে একহাত রেখে দাড়ালো। ঠোট কামড়ে চোখ বন্ধ করে কয়েকবার ঘুষি ছুড়লো দেয়ালে। আগের কাটা জায়গাটা আরো আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে উঠলো মুহুর্তেই। বাধা রুমালটা রক্তে ভিজে উঠেছে পুরোটা। দেয়ালেও রক্ত লেগে যাচ্ছে। দোয়া ছুটে গিয়ে থামিয়ে দিলো আরাবকে। সর্বোশক্তিতে ওকে ঠিক পাশের চেয়ারটায় বসিয়ে দিয়ে মিশিয়ে নিলো নিজের সাথে। ওর কাটা হাত আঁচলে চেপে ধরে বললো,

-আপনি এমন করলে কি করে হবে আরাব? আমি তো জানি,আপনি সবরকম পরিস্থিতি সামলাতে জানেন। আপনাকে এমন কি করে দেখবো আমি?

আরাব একহাতে দোয়ার কোমড় জরিয়ে ধরে ওর পেটে মুখ গুজলো। ডুকরে কেদে দিলো আচমকাই। এই মুহুর্তে ওর নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। দোয়া নিজেও ঠোট কামড়ে কাদছে। কাদতে কাদতে আঁচলে আরাবের হাত বেধে দিলো ও। মুফতাহির খানিকটা এগিয়ে বললো,

-নিজেকে কষ্ট দিও না আরাব। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব,তৌফিকাকে সত্যের মুখোমুখি হতে দাও। এতেই সবার ভালো।

-আরেকটা কথা বলার ছিলো। দিয়ানের ওটিতে কম্প্লিকেশনস্ তৈরী হয়নি। তৈরী করা হয়েছিলো।

ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো দোয়া। আরাবও মুখ তুলে তাকিয়েছে। মুফতাহির বললো,

-দিয়ানের অন পান্প সার্জারি ছিলো। কেউ একজন ইচ্ছে করে হার্ট লাং মেশিনের রেশিও কমবেশি করেছিলো। আর তাতেই…

আরাব উঠে দাড়ালো। দোয়া বিমুঢ়। একবার মুফতাহিরের দিকে তাকিয়ে আবারো আরাবের দিকে ফিরলো ও। আরাব চোখমুখ মুছে,হাত মুঠো করে পা বাড়াচ্ছিলো ওটির দিকে। পেছন থেকে মুফতাহির বলে উঠলো,

-ওটিতে ঢুকে সবটা চেক আপ দেওয়ার পর এক সুপরিচিত এসিটেন্টকে দেখেছি আরাব। এন্ড ইট ওয়াজ জারা।

মুফতাহিরের কথায় দোয়া যেনো রিয়্যাক্ট করাই ভুলে গেছে। ফাকা মস্তিষ্কে আরাবের দিকে তাকালো ও। আরাবের চেহায়ায় ফুটে ওঠা তীব্র রাগটা দেখে আরো এলোমেলো হয়ে ওর চারপাশ।

#চলবে…

#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৫১

দিয়ানকে ওটি থেকে বের করে বেডে দেওয়া হয়েছে। কেবিনের সামনে দোয়া,সালমা বেগম,তন্নি,তৃষা,অরুনাভ মুখার্জী,স্বস্তিক,তৌফিকা,মিসেস ওয়াহিদ সবাই আছেন। আরাব ব্যতিত। দোয়া একধ্যানে নিচের দিকে তাকিয়ে। ওকে ধরে পাশেই তাজীন বসে। নিরবও আছে এককোনে। অপেক্ষা। কখন দিয়ানকে দেখতে পারবে সেই অপেক্ষায় সব। অনেকটাসময় পর মুফতাহির আসলো। ওকে দেখেই উঠে দাড়ালেন সালমা বেগম। তৌফিকা বললো,

-কি ব্যাপার মুফতাহির? দিয়ানের সেন্স ফেরেনি এখনো?

মাথা নেড়ে না বুঝালো মুফতাহির। সালমা বেগম কিছুটা ভিতু কন্ঠে বললেন,

-ক্ কোনো সমস্যা বাবা? আমার ছেলেটা…

-কোনো সমস্যা নেই আন্টি। দিয়ান একদম ঠিকাছে। যখনতখনই সেন্স চলে আসবে ওর। আপনি ব্যস্ত হবেন না।

দোয়া তাকালো মুফতাহিরের দিকে। এই মানুষটার জন্যই ওর মা আজ বিধবার বেশে। আর এই মানুষটাই আজ ওর মাকে আশ্বাস দিচ্ছে,ব্যস্ত না হতে। তৌফিকা বললো,

-দেখা করতে দেবে কখন?

-ডক্টর চেক আপ করে জানাবে। শান্ত হও।

তখনই‌ করিডরে ডক্টর আসলো। কোনোদিক না তাকিয়ে কেবিনে ঢুকে গেলো সে। করিডরের সবাই নড়েচড়ে উঠে দাড়ালো। কিছুটা সময় পর ডক্টর বেরিয়ে হাসিমুখে বললো,

-দিয়ানের জ্ঞান ফিরেছে। দেখা করতে চাইছে ওর মা আপুনির সাথে।

খুশিতে কেদে দিলেন সালমা বেগম। তন্নি বললো,

-আমিও দেখবো দিয়ানকে।

-আপাতত আমরা দুজনের বেশি কাউকে এলাও করবো না। বাকিসবকে বলবো,বাইরে থেকেই দেখার জন্য।

ডক্টরের কথায় তন্নি আর কিছু বললো না। ডক্টর দোয়াকে বললো,

-দিয়ানের সামনে কিন্তু একদমই ইমোশনাল হওয়া যাবে না দোয়া।

দোয়া মাথা উপরনিচে নাড়ালো। দু ফোটা চোখের জল ফেলে আস্তেধীরে মাকে নিয়ে কেবিনে ঢুকলো ও। চোখ আবারো জলে ভরে উঠলো ওর। ছোট্ট ভাইটা হাসপাতালের বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে। মাথায় হাইজিন ক্যাপ। পাশেই কতোরকমের ডাক্তারী যন্ত্রপাতি। স্যালাইন চলছে। দোয়ার কথা ভেবে সালমা বেগম নিজেকে অনেকটাই সামলে নিয়েছেন। কাধে হাত রেখে দোয়াকে বললেন এগোতে। একটা শুকনো ঢোক গিলে দোয়া এগোলো। ভাইয়ের কাছে গিয়ে ওর হাত মুঠো করে ক্ষীন কন্ঠে বললো,

-দিয়ান? এই দিয়ান? আপুনি এসেছে দেখ? দিয়ান?

একদমই ধীরে ধীরে চোখ মেললো দিয়ান। বোনকে দেখেই হাসির রেখা আকা হয়ে গেলো ওর শুকনো ঠোটে। কোনোমতে মুখ দিয়ে বের করলো,

-আ্ আমি ভ্ ভালো হয়ে গেছি। তাইনা আপুনি?

কাদতে কাদতে ওর হাত তুলে ধরে কয়েকবার হাতে চুমো দিলো দোয়া। কান্না থামিয়ে আবারো ওর কপালে চুমো দিয়ে বললো,

-হুম। একদম ঠিক আছিস তুই!

-আ্ আমাকে আর ক্রিকেট খেলতে মানা করবি না তো আপুনি?

দোয়া মাথা নেড়ে নেড়ে বললো,

-না। কোনোদিনও মানা করবো না! কোনোদিনও‌ না! তুই খেলবি! যতো খুশি ক্রিকেট খেলবি তুই! আমি বলছি!

দিয়ান হাসলো। চোখ গেলো আচলে মুখ গুজে কাদতে থাকা ওর মায়ের দিকে। ঠোটের হাসিটা রেখেই বললো,

-আমি ঠিক আছি তো মা! কাজলা দিদির পরিবর্তে দিয়ান কবিতার পরিবেশ তৈরী করছো কেনো?

সালমা বেগম এগিয়ে এসে ছেলের চোখেমুখে কয়েকটা চুমো দিয়ে‌ বললেন,

-আর এইসব বলিস না বাবা! মাকে আর কষ্ট দিস না তোরা!

দিয়ান ইশারা করলো মাকে। সালমা বেগম মুখ এগোলেন। মায়ের গালে চুমো দিয়ে দিয়ান ফিসফিসিয়ে বললো,

-মেয়েকে বিয়ে দিয়েছো। ও আর জ্বালাবে না। ছেলেরও একটা ব্যবস্থা করো?

সালমা বেগম হেসে দিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দিয়ানকে ঘুমোতে বললেন তারপর। দিয়ান চোখ বন্ধ করে নিলে ছেলের পাশে বসে মেয়েকে বুকে জরিয়ে রইলেন সালমা বেগম। বুকজুরে শান্তি তার। চুপচাপ মায়ের বুকে মুখ গুজে রইলো দোয়া। আরাব বেরিয়েছে অনেক আগেই। মুফতাহির জারাকে নিয়ে যা বলেছে,তারপর আরাব কি করবে,কোনোকিছু ভাবতে পারছে না ও। না নিজে পেরেছে এখান থেকে সরতে,না পেরেছে আরাবকে আটকাতে। ওর মাথা জুড়ে শুধু একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে,ঠিক কি করতে চলেছে এখন আরাব?

ক্লাস থেকে বেরোচ্ছিলো জারা। একদমই আচমকা ওর সামনে এসে দাড়ালো আরাব। চমকে দুপা পিছিয়ে গেলো জারা। ঘাড় কিঞ্চিত ঘুরিয়ে আরাব নিচদিক তাকিয়ে। জারা বুকে হাত গুজে দাড়িয়ে বাকা হেসে বললো,

-বাবাহ্? বায়োমেডির সাইন্টিস্ট তাহসানুল আরাব আজ হঠাৎ মেডিকেল কলেজে? আমার সামনে?

আরাব চুপ। আরেকটু এগুলো জারা। মুখ এগিয়ে কিছুটা ফিসফিসিয়ে বললো,

-আমার…কাছে?

আরাব রক্তচক্ষু করে তাকালো ওর দিকে। দাতে দাত চেপে সামলেছে নিজেকে ও। জারা ঠোট কামড়ে হেসে পিছিয়ে গেলো। আরাব বললো,

-দিয়ানের ওটিতে কেনো ঢুকেছিলে তুমি জারা?

জারা ওভাবেই ঠোট টিপে হেসে বললো,

-কি? কে দিয়ান? আর আমি কেনো ওটিতে ঢুকবো?

-কারন তুমি চেয়েছিলে দিয়ানের ক্ষতি হোক। আর তাতে আমার আর দোয়ার মাঝে মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং ক্রিয়েট হোক। তাই দিয়ানের হার্ট লাং মেশিনের রেশিও কমবেশি করেছিলে তুমি!

-কিন্তু আমি তো সবে স্টুডেন্ট! সবে পড়ছি ডাক্তারি। আমাকে তো ওটিতে এলাউ করবে না আরাব!

-ঠিক সেজন্যই তুমি আমার কনসাল্টেন্টের এসিসটেন্ট সেজে ওটিতে ঢুকেছিলে। ওকে সেন্সলেস অবস্থায় ওর কেবিনে পাওয়া গেছে।

জারা দুহাতে আরাবের নজর না লাগে এমন একটা ভঙিমা করে বললো,

-হায়য়য়! এজন্যই তোমাকে এতো ভালোবাসি। সব বুঝে যাও! কেনো যেনো আমার বিষয়ে কোনো কিছুই লুকানো থাকে না তোমার কাছে।

এটুকো বলে আগেরবারের মতোই আরেকটু এগিয়ে বললো,

-তা,নিজের বউয়ের বিষয়ে এভাবেই গভীরে খোজ খবর নাও তো?

-স্টপ সেয়িং ননসেন্স জারা!

-ওকে। ওকে। রিলেটেবল কিছু বলি হুম? তো রিলেটেবল বলতেই মনে পরলো,এসব প্রথমে কে বললো তোমাকে?

আরাব চুপ করে ওর ভঙিমা দেখছে শুধু। জারা আবারো বললো,

-ডক্টর সজল মুফতাহির। তাইতো?

-আর তার সাথে রিলেটেড? উমমম…ডক্টর সুমন!

-আর তার সাথে রিলেটেড…দোয়া। সুমনের প্রায় হয়ে যাওয়া,বা কোনো না কোনোভাবে হয়ে যাওয়া…বউ!

আরাব আর সহ্য করতে পারলো না। সর্বশক্তিতে,সশব্দে চড় লাগিয়ে দিলো জারাকে। ও গিয়ে দেয়ালে লেগে গেছে। গালে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে রইলো জারা। পাশ দিয়ে ওর ক্লাসমেটরা যাচ্ছিলো। আরাবের কাজে ওরা থেমে গেছে। আরাব ওদের উদ্দেশ্য করে জারার দিকে তাকিয়ে থেকেই বললো,

-স্টে এওয়ে ফ্রম হেয়ার।

মেয়ে দুটো চুপচাপ চলে গেলো। চুলগুলো ঝাড়া মেরে মাথা তুললো জারা। ঠোটে বৃদ্ধাঙুল ছুইয়ে বুঝলো রক্ত পরছে ওর ঠোট থেকে। কিন্তু মুচকি হাসিটা কমলো না ওর। একহাতে চুলগুলো ঘাড়ের সামনে এনে চুল ঠিক করতে করতে বললো,

-তুমি এভাবে আমাকে ছোবে,ভাবিনি আরাব। কিন্তু একটা প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে ঢুকে,ওখানকারই এক স্টুডেন্টের গায়ে হাত তোলার পরিনতিটা,তোমার ভাবা উচিত ছিলো।

আরাব বাকা হাসলো। কপাল কুচকে এলো জারার। ও ইচ্ছে করেই দোয়াকে নিয়ে কথাটা বলেছে,যাতে আরাব ব্যস্ত হয়ে ওর সাথে কিছু করে বসে আর তার দায়ে ওকে ফাসাতে পারে। কিন্তু আরাবের হাসিটায় বিস্ময় ধরা পরলো‌ ওর চোখে। কিছু বলতে যাবে, তখনই এক পিয়ন এসে একটা কাগজ ধরলো ওর সামনে। জারাকে লক্ষ্য করে বললো,

-প্রিন্সিপাল এটা দিয়েছে তোমাকে।

আরো বিস্মিত হলো জারা। আরাব ওটা নেওয়ার জন্য ইশারা করলো জারাকে। কাগজটা হাতে নিয়ে পড়তেই চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম ওর। ওকে কলেজ থেকে রাস্টিকেট করা হয়েছে। সাথে ওর ছাত্রীত্বও বাতিল করা হয়েছে। কারন হিসেবে লেখা,ডাক্তার না হয়েও ওটিতে ঢোকা,ডাক্তারকে অজ্ঞান করা আরো অনেককিছু। চোয়াল শক্ত করে ওর দিকে একপা এগোলো আরাব। বললো,

-আরাবের পরিনতি,দোয়া। আর দোয়ার পরিনতি আরাব। আমাকে পরিনতি শেখাতে এসো না জারা।

জারা রাগে কাপছে। আরাব মুচকি হেসে পকেটে দুহাত গুজে বললো,

-এটা তো স্টার্টিং জারা। যে মেডিকেল কলেজের স্টুডেন্ট নামে দু সেকেন্ড আগে আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছিলে,সেটাই আগে কেড়ে নিলাম তোমার থেকে। এবার বাকি হিসেব মেটানোর পালা। সেদিন দোয়ার হাতে আঘাত করেছিলে তুমি,সেটা দোয়ার কথাতেই ভুলে গিয়েছিলাম আমি। কিন্তু দিয়ানের ওটিতে ঢুকে সেটাকে তুমিই সুদসমেত মনে করিয়ে দিয়েছো। এন্ড নাও,আরাব ইজ নট গোয়িং টু স্পেয়ার ইউ জারা! যা করেছো,তার পরিনতি আমিই কড়ায় গন্ডায় বুঝিয়ে দেবো তোমাকে! পাক্কাওয়ালা প্রমিস!

আরাব বেরিয়ে আসলো ওখান থেকে। টপটপ করে চোখের পানি পরতে লাগলো জারার। রাগে হাতের কাগজটা মুচড়ে মুঠো করে নিলো ও। অপমান,রাগে যেনো শরীর ফেটে যাচ্ছে ওর। চেচিয়ে কাদতে কাদতে হাটুতে বসে পরলো ওখানেই।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here