#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
#পর্ব-৩৮
-তুমি জানো দোয়া? তোমার এই চোখের জলে আমার শার্ট তো ভিজছে,কিন্তু ভেতরটাতে এতোগুলো দিন হলো জ্বলতে থাকা যন্ত্রনার আগুন আরো দাউদাউ করে জ্বলে উঠছে। সে কষ্টটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। আমার জন্য যা বড্ড অসহনীয়! বড্ড অসহনীয়! তবুও বারন করছি না। কারন আজকের পর তোমার চোখে একফোটা জলও আমি এলাউ করবো না। এটা মাথায় রেখো!
দোয়া আরো শক্ত করে আরাবকে জরিয়ে ধরলো। আরো মিশে যেতে লাগলো ওর মাঝে। চোখ বন্ধ করে মুখ দিয়ে শ্বাস ফেললো আরাব। অনেকক্ষন আগেই দুজনে রাস্তা ছেড়ে পাশের নির্মানাধীন দালানের ছাদে উঠে বসেছে। অরুনাভ মুখার্জীকে ফোন করে জানিয়েছে আরাব। এতোটা সময় হলো দোয়া কেদেই চলেছে। ওকে বাধা দেয়নি। মিনমিনে গলায় ওর জীবনের সব চরাই উৎড়াইয়ের কথা শুনিয়েছে ওকে দোয়া। একটার পর একটা শুনে চলেছে আর হাত মুঠো করে নিজেকে সামলেছে আরাব। সন্ধ্যে শেষ হয়ে রাত গরিয়েছে। লালাভ রোদ্দুর পশ্চিমাকাশে ডুব দিয়ে আকাশে রুপালী থালার মতো চাঁদ একে দিয়ে গেছে। বাইকটা রোডেই পরে আছে। দোয়া কান্না থামালো। দুরের এক ব্যালকনির দিকে তাকালো দোয়া। আবছা আলোয় দুটো অবয়ব। বিনব্যাগে বসে থাকা পুরুষ অবয়বের কোলে এক নারী বসে। আরাবের বুকে মাথা রেখে ওর শার্ট মুঠো করে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। মুচকি হাসি ফুটেছে ওর মুখে। শীতল বাতাস শরীর ছুইয়ে দিতেই আরাব দোয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
-শীত করছে না?
চোখ তুলে তাকালো দোয়া। কাদতে কাদতে চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে ওর। আরাব ভেতরটা লুকোতে একটা কৃত্রিম হাসি দিলো। ওর ভেতরটাতে যে প্রলয় চলছে,তা বেশ বুঝতে পারলো দোয়া। দুহাত সোজা করে বারিয়ে দিলো সামনে। আরাব মুচকি হেসে সেদিনের মতোই জ্যাকেটের পেছনদিকটা সামনে দিয়ে পরিয়ে দিলো। আলতোভাবে জরিয়ে ধরে পেছনে পিটের চেইন লাগিয়ে দিলো দোয়ার। দোয়া বললো,
-আপনারও তো ঠান্ডা লাগছে।
-এতো মায়া হলে ছাড়তে দিতে না। জড়িয়েই থাকতে।
অভিমানের মতো করে আরাব বললো। পরমুহুর্তেই চকচকে চোখে তাকালো ও দোয়ার দিকে। বাকা হেসে বললো,
-আমার আগের জ্যাকেটটা ফেরত দিতে বলেছিলাম তোমাকে। দাওনি কেনো?
মুচকি হেসে এবার আরাবের বুকে মাথা রাখলো দোয়া। কিছুটা আটকে রইলো আরাব। দোয়া নিজে থেকে আরাবকে জরিয়ে ধরে বললো,
-সব সুদে আসলে দিয়ে দেবো সাইকো সাইন্টিস্ট।
আরাব নিজেও হেসে জড়িয়ে ধরলো দোয়াকে। উপরে তাকিয়ে মনেমনে শুকরিয়া আদায় করলো কয়েকবার। পৃথিবীর সব সুখ আজ ওর দুহাতের বাধনে ঢেলে দিয়ে গেছে উপরওয়ালা। দুর থেকে কোথাও গিটারের টুংটায় আওয়াজে ভেসে আসতে লাগলো,
‘ আমি হবো রাত আর,তুই হবি চাঁদ
জোসনায় ঘর আমাদের
তুই হলে রোদ আমি,রংধনু হই
ছিলো সে শহর আমাদের…’
গানটা শুনতে শুনতে একসময় আরাব গেয়েই উঠলো,
-তুই হবি ঢেউ আর,আমি হবো জল
বানাবো সাগর আমাদের
আমি হবো দোল আর,পুর্নিমা তুই
রাঙাবো শহর আমাদের।
এমনিতেও দুর থেকে ভেসে আসা গান শুনে দোয়া লজ্জায় নুইয়ে ছিলো। আরাব গেয়ে ওঠায় উঠে দাড়িয়েই গেলো ও। আরাব নিজেও উঠে দাড়ালো। পকেটে দুহাত গুজে আরামে দাড়িয়ে বললো,
-সত্যিই খুব তাড়াতাড়ি দুজন দুজনকে রাঙাবো আমরা। তোমার….
-বাড়ি ফিরবো।
দোয়া বলতে দিলো না আরাবকে। কেমন যেনো অস্থির লাগছে ওর এখন। আরাব মুচকি হেসে এগোলো ওর দিকে। বিনুনি ধরে তা খুলে দিতে দিতে বললো,
-আজ থামিয়ে দিলে। কিন্তু তোমাকে আরো আপন,আরো নিজের করার সে রাতে কিন্তু আমি বলবো। সামনে দাড়িয়ে বলবো। আমার সামনে লজ্জানত হবে তুমি। তখন কিন্তু এতোটুকো ছাড় দেবো না দোয়া। এতুটুকোও না!
আরাব দোয়ার বিনুনি পুরোটা খুলে দিলো আলতোভাবে। হাত ধরে নিচে নিয়ে আসলো। ফাইলটা বুকে জরিয়ে দাড়ালো দোয়া। পরে থাকা বাইকটা তুলে বসে স্টার্ট দিলো আরাব। বললো,
-আজকে এবং আজকের পর থেকে,আমাকে পার্সোনাল ড্রাইভার বলে আর এই বাইককে পার্সোনাল বাহন বলে স্বীকৃতি দিতে তুমি বাধ্য।
অতিকষ্টে হাসিটা আটকালো দোয়া। বললো,
-মুখার্জীবাড়ি এখান থেকে পায়ে হেটেই পাঁচমিনিট। আমি হেটেই যাবো।
দোয়া হাটা লাগালো। বাংলার পাঁচের মতো মুখ করে বাইক থেকে নামলো আরাব। বাইকটা ঠেলতে ঠেলতে মুখার্জীবাড়ির সদর দরজা অবদি আসলো ও। এটুকো সময়ে আর একবর্নও বলেনি দোয়া। দরজায় শব্দ করে দোয়া একপলক পিছনে তাকিয়ে বললো,
-সাবধানে যাবেন।
হাসি ফুটলো আরাবের চেহারায়। অরুনাভ মুখার্জী দরজা খুলে দিলেন। ফাইলটা বুকে জরিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো দোয়া। আরাব ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলো। অরুনাভ মুখার্জীর গলা ঝারার শব্দে হুশে ফিরে বললো,
-আ্ আদাব কাকাবাবু। স্বস্তিক কোথায়?
-ওর কথা আর বলো না। ক্যামেরা নিয়ে ছাদে বসেছে চাঁদের ছবি তুলবে বলে।
আরাব হাসলো। অরুনাভ মুখার্জী বললেন,
-এসো ভেতরে?
-না কাকাবাবু। আ্ আজ না। আজ আসি।
মাথা নেরে হেসে স্বীকারোক্তি বোঝালেন অরুনাভ মুখার্জী। আরাব বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে গেলো। দরজা লাগিয়ে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিলেন অরুনাভ মুখার্জী। মেসের দুজন ছেলে এসে তার সামনে দাড়ালো। একজন অনেকটা ইতস্ততবোধ নিয়ে বললো,
-কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি কাকাবাবু?
অরুনাভ মুখার্জী মুচকি হেসে বললেন,
-হ্যাঁ বলো।
-ছ্ ছেলেটা কে কাকাবাবু? দোয়ার আত্মীয়?
অরুনাভ মুখার্জী হেসে দিলেন শব্দ করে। ছেলেদুটো ভ্রু কুচকে রইলো। হাসি থামিয়ে অরুনাভ মুখার্জী বললেন,
-ও দোয়ার ভবিষ্যত বর।
ছেলেদুটো বিস্ময়ে তাকালো। অরুনাভ মুখার্জী বললেন,
-চিলেকোঠার কোনো খবর তো রাখো না। এবার বোনটার বিয়ে,একটু হাতেহাতে কাজ করার জন্য প্রস্তুতি নাও সবাই?
ছেলেদুটো হেসে দিলো। তারপর এসব নিয়েই আলোচনা শুরু করে দিলো অরুনাভ মুখার্জীর সাথে। সিড়িতে ওঠার সময় ছেলেদুটোকে দেখেছিলো দোয়া। ওরা কি ভাবলো আরাবকে দেখে সেটা শুনবে বলে দাড়িয়ে গিয়েছিলো ও। কিন্তু অরুনাভ মুখার্জীর কথা শুনে আবারো লজ্জায় পরে গেলো। ছুটে এসে ঘরে ঢুকতেই মা,ভাই,তন্নি,তৃষা,আর দুজন ভাড়াটিয়া ভাবির হাসিমুখ চোখে পরলো ওর। সালমা বেগম এগিয়ে এসে মেয়ের থুতনি ধরে বললেন,
-সুখী হ মা। তোর জন্য আরাবের চেয়ে ভালো জীবনসঙ্গী আর হয় না।
তন্নি ইশারায় বোঝালো সে এসেছিলো। কিছুটা অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো দোয়া। ওকে কিছু বলার আগে ওর পরিবারকে মানিয়ে গেছে আরাব। লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিলো ও।
•
-আপনারা ওই রায়নগর চিলেকোঠায় যাবেন আরাবের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে বাবা?
সোফায় বসা থেকে দাড়িয়ে গেলো মুফতাহির। একপলক ওর দিকে তাকিয়ে আরাব গা ছাড়া ভাবে মোবাইল স্ক্রল করতে লাগলো। মুখ ফিরিয়ে নিলো তৌফিকা। দোয়া রেপড্,এই কথাটা আরাবের সামনে আর উচ্চারন করবে না মুফতাহির এটা ও জানে। কিন্তু তবুও দোয়াকে মানবে না বলে এবার ওর আর্থিক অবস্থা নিয়ে কথা বলছে মুফতাহির। নিজের উপরই লজ্জা লাগছে ওর এখন। মিসেস ওয়াহিদ বললেন,
-কেনো মুফতাহির? আরাব দোয়াকে ভালোবাসে। দোয়াকে বিয়ে করতে চায়। এখন দোয়া যেখানে থাকে,সেখানেই তো বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেতে হবে আমাদের তাইনা?
-তারমানে আপনারা ঠিক করেই নিয়েছেন,দোয়ার সাথেই আরাবের বিয়ে হবে?
-আমি ঠিক করেছি,দোয়াই আমার বউ হবে। বাবা মা অনুমতি দিয়েছে মাত্র!
শীতল কন্ঠে বললো আরাব। মুফতাহির ওর দিকে তাকাতেই হেসে উঠে দাড়ালো ও। মুফতাহিরকে ধরে সোফায় বসিয়ে দিয়ে বললো,
-অনেকদিন হলো একসাথে ফ্যামিলি টাইম স্পেন্ড হয়না তাইনা মুফতাহির ভাইয়া? চলো আজ একসাথে টিভি দেখি।
গায়ের জোরেই মুফতাহিরকে বসিয়ে রাখলো আরাব। টিভি অন করেই নিউজ চ্যানেলে দিলো। মুফতাহির জোরাজোরি করছিলো উঠবে বলে। কিন্তু নিউজ দেখেই থেমে গেলো ও। বিস্ময়ে পূর্নমনোযোগে পুরো খবরটা দেখতে লাগলো ও। হেডলাইনে বড়বড় অক্ষরে লেখা,বায়োমেডির বিশিষ্ট সাইন্টিস্ট সাফাত রওশনের বিরুদ্ধে করা অভিযোগ ভুল প্রমানিতে হয়েছে। রিপোর্টাররা নিউজে বলছে, তার বানানো এন্টিডোড ভুল ছিলো না। বায়োমেডির স্টাফ আর বাচ্চাদেরকে পুশ করা সেই এন্টিডোডে তৃতীয়পক্ষ জড়িত ছিলো। আর তা অন্য কেউ নয়,তারই বিশ্বস্ত সহযোগী,এক্সপেরিমেন্ট স্পেশালিস্ট,ডক্টর সুমন। শোনা যায় পাঁচবছর আগেই ডক্টর সাফাত রওশন আত্মহত্যা করার পর ডক্টর সুমন বিদেশে পাড়ি জমায়। এরপর আর তাকে দেখা যায়নি এদেশে। কিছুদিন আগে পরিচয় জালিয়াতির জন্য তার নামে থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। এরপর পুলিশ নিজেদের সন্ধান জারি রাখে। গতকাল ডক্টর সাফাত রওশনের মেয়ে,তাকওয়াতুল দোয়া তার বাবার তৈরী এন্টিডোডের আসল ফর্মুলাসহ ডক্টর সুমনের বিরুদ্ধের সকল প্রমান পুলিশের হাতে তুলে দেয়। সত্যতা বিচার করে পুলিশ আপাতত ডক্টর সুমনকে খুজে চলেছে। আটটে নিস্পাপ শিশুহত্যা আর সাফাত রওশনের মৃত্যুর জন্য দায়ী করে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে রাষ্ট্রপক্ষ।….
মুফতাহির আস্তেধীরে দাড়িয়ে গেলো আবারো। বাইরের দিকে ছুট লাগাচ্ছিলো ও একপ্রকার। আরাব পেছন থেকে চেচিয়ে বললো,
-কোথায় যাচ্ছো মুফতাহির ভাইয়া?
মুফতাহির থেমে গেলো। নিজেকে সামলে পেছন ফিরে বললো,
-অফিসে। জরুরি কিছু…
-হুম? অফিসে? তোমার অফিসে কোনো কাজ নেইতো ভাইয়া! সব কাজ এখন অফিসের ভবিষ্যত উত্তরাধিকার,হুইচ মিনস্ আমি হ্যান্ডেল করে নিচ্ছি তো!
-হসপিটাল যাচ্ছি। পেশেন্ট…
মুফতাহির পা বাড়াচ্ছিলো। তৌফিকা শক্ত গলায় বললো,
-আজকাল দু দিন দোয়াদের ওখানে যাবো বলে আমি হসইিটালে কল করে দুজনেরই অফ ডে চেয়ে নিয়েছি।
চোখ বন্ধ করে শ্বাস ছাড়লো মুফতাহির। চারপাশ থেকে কোনো অদৃশ্য জাল ঘিরে ধরছে ওকে,এমনটাই অনুভব হচ্ছে ওর। তবে সে অদৃশ্য জালের মুল আরাব এটাও বেশ বুঝতে পারছে। আরাবের দিকে এগিয়ে এসে নিচু গলায় বললো,
-দোয়াকে এসব ডিটেইলস্ কে দিয়েছে আরাব?
আরাব কিছু না বলে মুচকি হাসলো শুধু। তৌফিক ওয়াহিদ উঠে দাড়ালেন এবার। বললেন,
-আরাব দোয়াকে পছন্দ করেছে মুফতাহির। আমার অমত থাকলেও বিয়েটা হতোই আমি জানি। আর একমাত্র ছেলেকে আলাদা করে দেওয়ার সাহস আমার নেই। তাই সম্মতি দেওয়াটাই বেটার বলে মনে হলো আমার। আরাবের বিয়েটা দোয়ার সাথেই হচ্ছে। কাল সবাই চিলেকোঠায় যাচ্ছি আমরা।
কথা শেষ করে চলে গেলেন তৌফিক ওয়াহিদ। আরাব আবারো হাসলো। ফিসফিসিয়ে বললো,
-বাবার কথার পুরোটা কিন্তু সত্যি না। তার অমত না করার অন্যতম কারন,দোয়া সাফাত রওশনের মেয়ে। আর আমি এটাও জানি,এটাই তোমার অমত করার মুখ্য কারন। তাইনা?মুফতাহির? ভাইয়া?
মুফতাহির তৌফিকার দিকে তাকিয়ে বললো,
-বাসায় ফিরবে না?
-তোমরা কেউই ফিরছো না। কাল এখান থেকেই সবাই চিলেকোঠায় যাচ্ছো,বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করতে।
আরাবের কথা রাগী শ্বাস ফেললো মুফতাহির। স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বললো,
-আমার কাজ আছে।
-এটা কেমন কথা মুফতাহির? আরাবের বিয়ের পাকা কথা,আর তুমি বলছো কাজ আছে?
মায়ের দিকে তাকালো তৌফিকা। এটুকোতেই ওর মায়ের এতোটা বিস্ময়। তবে ওর সাথে মুফতাহির যে ব্যবহারগুলো করছে,তাতে ওর বিস্ময় কোনো অতিরিক্ত না। আরাব বললো,
-সব কাজ এখন গিয়ে সেরে আসো। কাল সবার সাথে তুমিও চিলেকোঠায় যাচ্ছো,মানে যাচ্ছো।
আদেশের মতো করে বললো আরাব। পরপরই হেসে দিয়ে বললো,
-আরেহ্ একমাত্র বোনের একমাত্র বর,তোমায় ছাড়া চলে আমার?বলো মুফতাহির? ভাইয়া?
মুফতাহির বেরিয়ে গেলো। ওর চলে যাওয়া দেখে বাকা হাসলো আরাব। পেছন ফিরতেই বোনের দিকে তাকিয়ে চারপাশ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো ওর। হাত মুঠো করে সামলালো নিজেকে। মনেমনে আওড়ালো,
-এতো সুখ বুঝি সইলো না তোর আপু। আমিই বা কি করবো বল? চেষ্টা করেছিলাম তো! কিন্তু ওইযে,পাপ যে বাপকেও ছাড়ে না! আমি নিরুপায়। আমার হাতের বাইরে সবটা। ক্ষমা করে দিস আমাকে আপু। ক্ষমা করে দিস!
•
টিভিতে ব্রেকিং নিউজ দেখে স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইলো তাজীন। ও ঠিক কতোটা অবাক হবে,কতোটা খুশি হবে বা কতোটা রাগ করবে,নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না। দোয়া ডক্টর সাফাত রওশনের মেয়ে, সাফাত রওশন নির্দোষ,সবটার জন্য দায়ী সেই ঠকবাজটাই যে ওকে ঠকিয়েছে। তারচেয়েও বড় কথা,নিরবের কলিগ ছিলো সুমন। নিরব সবটাই জানতো ওর বিষয়ে। তবুও কিছুই বলেনি ওকে। এরমধ্যেই শব্দ করে দরজা খুলে ঘরে ঢুকলো নিরব। তাজীন জলভরা চোখে ওর দিকে তাকালো। নিরব হাপাচ্ছে। হাতের এপ্রোনটা চেয়ারে রেখে এগোতে যাচ্ছিলো ও তাজীনের দিকে। কিন্তু টিভি অন দেখে থেমে গেলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে বললো,
-আ’ম…আ’ম সরি তাজ। আমি….
-তুমি সবটা জানতে।
-তাজ…
-দোয়ার আসল পরিচয়,সুমনের আসল পরিচয়, তুমি সবটাই জানতে নিরব।
-হ্ হ্যাঁ তাজ। কিন্তু…
তাজীন একছুটে এসে ওর শার্ট খামচে ধরলো। চেচিয়ে বলে উঠলো,
-আমাকে কেনো বলোনি সবটা? কেনো?
নিরব ছোট একটা শ্বাস ফেলে বললো,
-এসবে তোমাকে জড়ানোর কোনো মানে ছিলো না। তাছাড়া আরাব স্যারের বারন ছিলো। বিষয়টা যাতে কাউকে না জানাই আমি। তাই…
-মিথ্যে বলছো তুমি। তুমি আমাকে বলোনি,কারন তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না। তুমি আমাকে সহধর্মীনী বলে এখনো মানো না নিরব। তোমার ধারনা,আমি এখনো ওই ঠকবাজকে ভালোবাসি। আর তুমি এসব আমাকে বললে আমি কোনো না কোনোভাবে সবটা ওকে জানিয়ে দিতাম। তাই আমাকে কিছু বলোনি তুমি। তাইনা?
বিস্ফোরিত চোখে তাকালো নিরব। এতোটুকো বিষয়কে তাজীন এভাবে নেবে,ভাবতে পারে নি ও। ওর দুগাল ধরে ব্যস্তভাবে বললো,
-না তাজ! এমনটা নয়! আমি জানি তুমি সুমনকে অনেক আগেই ভুলে গেছো। আমি জানি তুমি সবটা স্বাভাবিক করে নেওয়ার চেষ্টায় আছো। আমি….
-কিন্তু তুমি সবটা মানতে পারছো না তাইতো? তুমি মানতে পারছো না,আমি তোমাকে মানতে শুরু করেছি। এই সম্পর্ককে মানতে শুরু করেছি। তাইতো এতো আড়াল। তাইনা নিরব? তোমার মনে এখনো সন্দেহ,আমি এখনো সুমনকেই….
তাজীনকে আর বলার সুযোগ দেয়নি নিরব। ঠোটের স্পর্শে আটকে দিয়েছে ওর ঠোট। ওকে ছেড়ে শক্তভাবে মুঠো করে নিলো ওর চুলগুলো। কপালে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে বললো,
-আ’ম সরি তাজ। শুধুমাত্র আরাব স্যারের কথাতেই সবটা আড়াল করেছি তোমার থেকে। নইলে আমার তোমার মাঝের আড়ালটা আমার জন্য কতোটা যন্ত্রনার,সেটা আমিই জানি। আমি জানি তুমি আমার। আমি মানি তুমি আমার। আর তাই আমার মনে যে তোমাকে নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই,এ নিয়ে কোনো সন্দেহ তোমার মনে আমি থাকতে দেবো না। তোমাকে ভালোবাসি।
নিরবকে শক্ত করে জরিয়ে ধরলো তাজীন। ভালোবাসার নতুন অধ্যায়কে সাদরে আপন করে নিলো ও।
#চলবে…
#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
#পর্ব-৩৯
ভার্সিটি থেকে ফিরে সদর দরজার সামনে বড়বড় দুটো গাড়ি দেখে কপাল কুচকে এলো দোয়ার। এতোবড় বড় দু দুটো গাড়ি নিয়ে এদিকে আসার মতো কেউ আছে বলে মনে পরছে না ওর। রাস্তার পাশে মোটামুটি পাশের বাসার আন্টিরা সারি ধরে দাড়িয়ে থেকে মুখার্জীবাড়ির ভেতরে উকিঝুকি দিচ্ছে। দোয়াকে দেখে বলাবলি বাড়লো তাদের। কারনটা ওর পিত্যৃপরিচয় ভেবে ক্ষুদ্রশ্বাস ফেললো দোয়া। গাড়িদুটোর দিকে তাকিয়েই এগোতে লাগলো ও। বাড়ির ভেতর ঢুকতেই খাবারের ঘ্রান নাকে এসে লাগলো ওর। ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখতে পেলো উঠোনের এককোনে মেসের চারপাঁচজন ছেলে মিলে রান্না বসিয়েছে। এরা কাজ ছেড়ে রান্নায় কেনো? চিন্তায় কপালে ভাজ পরলো দোয়ার। আশেপাশে তাকালো ভালো করে। উপরতলা থেকে আওয়াজ আসছে,নিচে সবাই ব্যস্ত,অরুনাভ মুখার্জী ফোনে কাউকে মিষ্টি পাঠানো নিয়ে হাক ছাড়ছেন,মুখার্জীবাড়ি কেমন একটা উৎসবে গমগম করছে যেনো। ওকে দেখে তন্নি-তৃষা দৌড়ে আসলো। তন্নি বললো,
-দোয়াপু? এখনো এভাবে দাড়িয়ে আছো? চলো চলো,চেন্জ করে নেবে চলো!
ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো দুজন। দোয়া থেমে গিয়ে বললো,
-চেন্জ করার জন্য আমাকে টানছিস কেনো? যাচ্ছি তো ঘরে।
-তোমার ঘরে তো যাওয়া যাবে না! চলো আমাদের ঘরে চলো!
তৃষার কথায় কপাল আরো কুচকে এলো দোয়ার। তন্নির দিকে তাকিয়ে ভারী গলায় বললো,
-কি হচ্ছে রে এ বাড়িতে তন্নি?
তন্নি একটা শুকনো ঢোক গিললো। যাই কিছু হয়ে যাক,দোয়াকে ওরা দুজনেই যথেষ্ট ভয় পায়। আমতা আমতা করতে করতে বললো,
-ওই আসলে…
-আরাব ভাইয়ার বাসা থেকে ওর পরিবারের সবাই এসেছে,তোমাদের বিয়ের পাকাকথা বলতে।
স্বস্তিকের কথায় পেছন ফিরলো দোয়া। নিমিষেই অস্বস্তিতে পরে গেলো ও। আরাব এভাবে হুট করে ওর বাড়ির সবাইকে নিয়ে চলে আসবে,ধারনায় ছিলো না ওর। চোখ বন্ধ করে রইলো খানিকক্ষন। আশেপাশে চোরের মতো তাকালো আরেকবার। সবাই যার যার মতো ব্যস্ত। আরাবদের না জানিয়ে আসার কোনো লক্ষন নেই ওদের মাঝে। স্বস্তিক আবারো বললো,
-আমরা আগে থেকেই জানতাম আজ আসবে ওরা। শুধু তোমাকেই জানাই নি।
চোখ বন্ধ রেখেই শ্বাস ফেললো দোয়া। এটাই আরাব! এটার ওর কাজের ধরন! সরু চোখে তাকিয়ে রইলো তন্নি স্বস্তিকের দিকে। মনেমনে কয়েকটা গালিও দিলো। চেয়েছিলো দোয়াকে কিছুই বলবে না। কিন্তু এই লোক সবটা বলে দিলো। স্বস্তিক দোয়ার দিকে এগিয়ে ওর সামনে একটা ব্যাগ তুলে ধরে বললো,
-দিভাই? আমার তো বড় বোন নেই,যদি তোমাকে বড়দিদি ভেবে কিছু দেই,নেবে না এই ছোট ভাইটার কাছ থেকে?
দোয়ার চোখ ভরে উঠলো। এ কয়দিনে স্বস্তিক অনেকটাই মিশে গেছে চিলেকোঠার সবার সাথে। দু একসময় তন্নির সাথে ঝগড়া ব্যাতিত মেসের ছেলেগুলো ফিরলে বসে আড্ডা দেওয়া,মা দিয়ানের সাথে আড্ডা এসবে বেশ ভালোমতোই মানিয়ে নিয়েছে বিদেশী ধারায় বড় হওয়া ছেলেটা। অরুনাভ মুখার্জী কোমড়ে গামছা বেধে চুলোর কাছে দাড়িয়ে ছিলেন। ডাক ছেড়ে বললেন,
-তৃষা? দোয়াকে নিয়ে উপরে যা তো তাড়াতাড়ি! সবাই এসে গেছে। অপেক্ষা করছে ওর জন্য!
ধ্যান ভাঙলো দোয়ার। স্বস্তিকের কাছ থেকে ব্যাগটা নিলো ও। বললো,
-আজ থেকে আমার আরো একটা ভাই হলো। দিভাইকে এতোটা ভালোবাসো,দিভাই আর তোমাকে বিদেশে ফিরতে দিচ্ছে না কিন্তু!
স্বস্তিক হাসলো। তৃষা দোয়াকে নিয়ে উপরে চলে গেলো। মাথা নিচু করে পা বাড়ালো দোয়া। তন্নি পুরোটা সময় সরু চোখে তাকিয়ে ছিলো স্বস্তিকের দিকে। দোয়ারা চলে যেতেই ও খিচে উঠে বললো,
-আরাব ভাইয়ারা এসেছে এটা দোয়াপুকে বলা খুব দরকার ছিলো?
বিরক্তিতে তাকালো স্বস্তিক। বললো,
-তো আপনি কি চাচ্ছিলেন?
-দোয়াপুকে সারপ্রাইজ দেবো ভেবেছিলাম।এই আপনি নামক বিলেতি কদুর জন্য হলো না!
-হোয়াট ননসেন্স? আমি বিলেতি কদু?
-তো কি বলবো? ইশ! ভেবেছিলাম দোয়াপুকে সাজিয়ে আরাব ভাইয়ার সামনে নিয়ে গিয়ে দাড় করাবো। আরাব ভাইয়াকে দেখে স্তব্ধ হয়ে যাবে ও একদম! তা না,আপনি মুখফোটা বাদরটা সব বলে দিলেন?
-হেই! কিসব বলছো তুমি?
-ভুলটা কি বললাম? আপনি সবটা কেনো বলে দিলেন দোয়াপুকে?
-কজ আ’ম নট পিওর লেইম লাইক ইউ!
তন্নি রুশে উঠলো যেনো। একপা এগিয়ে বললো,
-কিইই? আপনি আমাকে লেইম বললেন?
-না তো! পিওর লেইম বললাম আপনাকে! পি ওর লেইইইম! একজনের বিয়ে,আর ইনি বলছে তাকে না জানিয়ে বরপক্ষের সামনে নিয়ে যাবে! আর দোয়া দিভাই যে মেয়ে,ও জিজ্ঞাসা তো করতোই,বাড়িতে কি উপলক্ষে এতো রান্নাবান্না হচ্ছে! অকারনে সাজার মেয়ে ও না,এটা জানেন না আপনি? তারপরও ওকে না জানিয়ে,সাজিয়ে ও বাড়ির সবার সামনে নিয়ে যাওয়ার মতো লেইম প্লানিং হয়তো আপনার দ্বারাই সম্ভব! হ্যাটস্ অফ!
তন্নিকে ইচ্ছামতো বলে ‘বাবা,মিষ্টি আমি আনতে যাচ্ছি’ বলে বেরিয়ে গেলো স্বস্তিক। রাগে পা ছুড়ে উপরে আসলো তন্নি। স্বস্তিকের দেওয়া শাড়িটা পরে বিছানায় বসে আছে দোয়া। নীল শাড়িটাতে বেশ মানিয়েছে ওকে। তৃষা কয়েকটা সাজগোজের জিনিস বের করেছে। দোয়া সেদিকেই তাকিয়ে। যেই দোয়া প্রসাধনী গায়ে লাগানো তো দুর,চোখ মেলে দেখতোও না,আজ সেই দোয়াই একধ্যানে সেগুলোর তাকিয়ে। চোখজোড়ায় যেনো সম্মতি,আজ সাজাও আমাকে। সে প্রেমিকপুরুষের চোখ যেনো আমাতেই আবদ্ধ থাকতে বাধ্য হয়। তন্নি এগোলো। একজোড়া ঝুমকো সবে পরাতে যাবে,দোয়া ওর হার ওর হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে বললো,
-সে যে আমায় সাধারন বেশেই ভালোবাসে তন্নি।
-একটু ভুল বললে দোয়াপু। তোমায় ভালোবাসে। তা তুমি যে বেশেই থাকো না কেনো। তোমাকেই ভালোবাসে আরাব ভাইয়া। আজকের এটুকো সাজ তো সাজা উচিত তোমার দোয়াপু। মানুষটা তার পৃথিবীকে তোমার পৃথিবীর সাথে জুড়তে এসেছে। তুমি এটুকো পারবে না?
দোয়া আর বাধা দিলো না। সাজ বলতে দোয়ার ওই কানে ঝুমকা আর ঠোটে লিপস্টিক দিয়ে দিলো তন্নি। ছাড়া কোকড়ানো চুলগুলো ছড়িয়ে দিলো পিঠজুড়ে। ওকে দাড় করালো। ছোট আয়নাটা সামনে ধরে বললো,
-দেখো তো,কেমন লাগছে?
আয়নার দিকে না তাকিয়ে নিজের দিকে তাকালো দোয়া। শাড়িটা পরেই নিজের কাছেই নিজেকে কোনো রাজ্য ফিরে পাওয়া রাজকন্যার মতো লাগছে। মনেমনে কয়েকবার নিজেকে প্রশ্ন করলো ও,সত্যিই তা নয় কি? ওর সবচেয়ে বড় চাওয়া,ওর বাবার নির্দোষ হওয়ার প্রমান আরাব দিয়েছে ওর জীবনে। ওর বাবা নিজের সম্মান ফিরে পেয়েছে। হোক তা মৃত্যুর এতোগুলো বছর পর। তবুও,পেয়েছে তো! দিয়ান এসে বললো,
-আপুনি? ও ঘরে দেখ গিয়ে! তোর স্টুডেন্ট আমার বই নিয়ে বলছে আর ফেরত দেবে না!
হেসে দিলো তন্নি তৃষা। সালমা বেগম ঘরে ঢুকলেন। চোখের কোনে থাকা আনন্দঅশ্রু মুছে বললেন,
-ওকে নিয়ে চল তন্নি।
এগিয়ে এসে মায়ের হাত ধরলো দোয়া। কিছু বলার আগেই সালমা বেগম বললেন,
-আজ আমাদের নিয়ে কোনো কথা বলিস না দোয়া। আজ শুধু তোকে নিয়ে কথা হোক। আরাবকে নিয়ে কথা হোক। আমি শুধু এটুকোই চাই।
দোয়া চুপ রইলো। তন্নি তৃষা দুজনে মিলে ওকে পাশের ঘরে নিয়ে আসলো। ঘরভর্তি মানুষের উপস্থিতি মাথা নিচু রেখেই টের পেলো দোয়া। দুজন পুরুষের একজন মোবাইলে ব্যস্ত। আরকেজনকে ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না। তবে যে অনুভুতি সবার আগে ওর মন তোলপাড় করে দিয়ে গেছে,তা ছিলো জানালার ধারে উল্টোপাশ হয়ে দাড়িয়ে থাকা নীল শার্ট পরিহিত এক অবয়ব। ওটা আরাব। তৌফিকা এগিয়ে এসে ওকে বসিয়ে দিয়ে বললো,
-মাশাল্লাহ্! কি মিষ্টি লাগছে তোমাকে দেখতে দোয়া!
টুইঙ্কেল দৌড়ে এসে দোয়ার কোলে পিঠ ঠেকিয়ে বললো,
-উইশমামকে আজ রংধনুতে নিয়ে যাবো আম্মু?
-না টুইঙ্কেল। আজ না। তবে কবে নিয়ে যাবো,সেটা ঠিক করতেই এসেছি আজ।
দোয়া পাশে তাকলো। মিসেস ওয়াহিদ ওর পাশে এসে বসেছেন। দোয়া ঘাড় ঘুরাতেই উনি ওর থুতনি ধরে বললেন,
-মাশাল্লাহ্! কেমন আছো মা?
-জ্বী আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি?
-তোমাকে দেখে ভালোর অন্য পর্যায়েই চলে গেলাম।
দোয়া মাথা নিচু করে নিলো। মোবাইলে ব্যস্ত থাকা ভদ্রলোককে বেরিয়ে যেতে দেখলো ও। টুইঙ্কেলের সাথে কথা বলতে বলতেই শুনতে পেলো,
-মেয়ের বিয়েটা কি এখান থেকেই দেবেন মিসেস রওশন?
তৌফিক ওয়াহিদের কথায় একপলক ভেতরে তাকালেন সালমা বেগম। নিচু স্বরে বললেন,
-কেনো মিস্টার ওয়াহিদ? আমরা তো এখানকারই বাসিন্দা। দোয়ার বিয়েটা তাই এখান থেকেই হবে। যেমনটা আপনারা প্রস্তাব নিয়ে এই চিলেকোঠাতেই এসেছেন,তেমনটা বরযাত্রীও এই চিলেকোঠাতেই আসবে না হয়?
মায়ের জবাবে খুশি হলো দোয়া। পরপরই আরাবের কন্ঠে শুনতে পেলো,
-এন্ড ইউ নো হোয়াট বাবা? তোমার অফিসের সব বড়বড় কলিগ,তোমার আত্মীয়স্বজন সব যারা আছে,আমার বিয়ের বরযাত্রী হয়ে এই বেরঙ চিলেকোঠাতেই কবজি ডুবিয়ে বিয়ের ভোজ খেয়ে যাবে। দেখে নিও।
ছেলের কথায় আর একদন্ড দাড়ালেন না তৌফিক ওয়াহিদ। বেরিয়ে আসলেন ওখান থেকে। মুফতাহির এতোক্ষন সবটা মুখ বুজে সয়ে নিলেও আর থাকলো না। একই গাড়িতে চলে গেলো ওউ। আরাব সালমা বেগমের সামনে এসে বললো,
-আপনার অনুমতি থাকলে আংটিবদলটা হয়ে যাক আন্টি?
মাথা উপরনিচ করলেন সালমা বেগম। আরাব সোজা এসে দোয়ার সামনে দাড়ালো। হাত বাড়ালো দোয়ার হাত ধরবে বলে। দোয়া নির্বোধভাবে মানুষদুটোর চলে যাওয়া দেখছিলো। তৌফিকা বললো,
-সম্পর্কের শুরুতেই মিথ্যে চাইনা দোয়া। বাস্তবতা এটাই,আমার বাবা,বর দুজনেই টাকার বাইরে কিছু চেনে না। তোমার ওদেরকে এভাবেই মানিয়ে নিতে হবে। কিন্তু ওইযে,আরাব ভালোবাসে তোমাকে। তুমি ভালোবাসো আরাবকে। এই ভালোবাসা শব্দটাকে সম্মান করো দোয়া। তৃতীয় পক্ষকে এর মাঝে ঢুকতে দিও না।
মিসেস ওয়াহিদ দোয়ার কাধে হাত রেখে বললেন,
-আমি বলছি তোকে,তুই রংধনুতে গেলেই দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। এসব নিয়ে একদম ভাবিস না মা!
সবার দিকে তাকিয়ে আরাবের দিকে এতোক্ষনে তাকালো দোয়া। ওর সেই তৃপ্তির হাসি। ওই হাসির দিকে তাকিয়ে থেকে হাত বারিয়ে দিলো দোয়া। আরাব মুচকি হেসে আংটি পরিয়ে দিলো ওর হাতে। তারপর সালমা বেগম মেয়ের হাতে আংটি দিয়ে ইশারা করলেন আরাবকে পরিয়ে দিতে। মাথা নিচু করে আংটি পরিয়ে দিলো আরাবকে।
আংটিবদল শেষে তৌফিকা,দিয়ান,তন্নি,তৃষার ঘরেই কথা বলছিলো। মিসেস ওয়াহিদ সালমা বেগমের সাথে কথা বলছিলেন বারান্দায়। দোয়া নিজের ঘরে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে। ওর ঠিক সামনেই জানালার ধারে দেয়ালে এক পা উচিয়ে পিঠ ঠেকিয়ে আরাব দাড়িয়ে আছে। ওদের কথা বলার জন্য একা ছেড়েছে সবাই এ ঘরে। শুধু টুইঙ্কেল আছে ওদের সাথে। ঘরের এটা ওটা নেড়েচেড়ে দেখছে আর লাফাচ্ছে ও। অনেকটা সময় হলো ওভাবেই দাড়িয়ে আরাব। দোয়া মাথা তুলেই তাকায়নি এখনো। বাহাতের আংটিটা ডানহাতে সমানে ঘুরিয়ে চলেছে নিচদিক তাকিয়ে। আরাবের কোনো হেলদোল নেই। একটা শুকনো ঢোক গিলে ধীর গলায় বললো,
-ব্ বাইরে যাই?
আরাব সোজা হয়ে দাড়িয়ে শার্টের গুটানো হাতাটা ঠিক করতে লাগলো। দোয়া নিজেও নড়েচড়ে দাড়ালো। আরাব একপা এগিয়ে আবারো চুপচাপ দাড়িয়ে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। দোয়া একরাশ অস্বস্তি নিয়ে বললো,
-ব্ বলছিলাম যে…
কিছু বলে ওঠার আগেই একহাতে ওর কোমড় জরিয়ে ধরলো আরাব। দোয়া বিস্ফোরিত চোখে তাকালো ওর দিকে। বুকের দিকটায় হাত রেখে কোনোমতে দুরুত্ব গুজে দেওয়ার চেষ্টা করলো। আরাব একহাতে ওর কপালের চুলগুলো কানে গুজে দিয়ে বললো,
-চোখ ফেরানো দায় আমার।
চোখ নামিয়ে নিলো দোয়া। আরাব ওর গালে হাত রেখে আলতো করে ঠোট ছোয়ালো ওর কপালে। দোয়া খামচে ধরলো ওর শার্ট। টুইঙ্কেল এরমধ্যেই চেচিয়ে বলে উঠলো,
-আরাব মামা? এখানেই আমাকে ছেড়ে উইশমামকে কিসি দিচ্ছো? উইশমাম রংধনুতে গেলে আমার কি হবে তাহলে?
#চলবে…