এক ফাগুনের গল্প part 2

0
514

এক_ফাগুনের_গল্প
পর্বঃ-০২

সানজিদা চলে গেল, না না সানজিদা নয় সেই মেয়ে চলে গেছে। নামটা জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল কিন্তু জিজ্ঞেস করা হয়নি, সবকিছু শুনে কেমন একটা অচেতন ঘোরের মধ্যে গেছিলাম।

– রকি বললো, মেয়েরা কতটা রূপ ধারণ করতে পারে দেখলি তো সজীব? এ জন্য এসব প্রেম কেন যেন তুচ্ছ মনে হয়, মনে হয় ভালবাসা বলতে কিছু নেই জগতে।

– বললাম, সানজিদা আমার সাথে এমনটা করবে কেন রকি? আমি তো তার কোন ক্ষতি করিনি তবে কেন সে এমন করলো আমার সাথে?

– বহুরূপী মেয়েদের কাছে এগুলো জিজ্ঞেস করে লাভ নেই সজীব, চল বাসায় যাই। আজকে ভালবাসা দিবস সেটা মন থেকে মুছে ফেল, আর মনে কর যে আজকে ফাগুনের শুভেচ্ছা নিতে এসেছি। চট্টগ্রাম থেকে যখন এসেছিস তখন কিছুদিন থাক এখানে তারপর সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখে চলে যাবি।

– আমি সানজিদার সাথে একটু মুখোমুখি দেখা করে কিছু প্রশ্ন করতে চাই।

– কি লাভ? শুধু শুধু কেন এসব নিয়ে থাকবি? দেখ সজীব সবকিছু স্বাভাবিক ভাবে মনে কর তাহলে দেখবি সব ভালো লাগবে। কিন্তু যত বেশি এসব নিয়ে ভাবতে যাবি ততই কিন্তু কষ্ট হবে।

– তবুও এসেছি যখন আমি তার সাথে দেখা করে আমার অপরাধ জেনে তারপর যাবো।

– ঠিক আছে দেখ তোর যেটা ভালো মনে হয় সেটাই কর সমস্যা নেই আমি তোর সাথে আছি।

– ধন্যবাদ বন্ধু।

রকির সাথে বেশি তর্কে জড়িয়ে লাভ নেই কারণ রকিও একটা মেয়েকে ভালবেসে অনেক বড় আঘাত পেয়েছে। আমরা যখন চট্টগ্রামে পড়াশোনা করতাম তখন রকি আমাদের ডিপার্ট্মেন্টের একটা মেয়ের সাথে রিলেশন করতো। আড়াই বছর প্রেম করার পর মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেল একটা জার্মান প্রবাসীর সঙ্গে। সেই মেয়ে বিয়ে করে স্বামীর সাথে জার্মান চলে গেল আর রকি তখন এতটা ভেঙ্গে পরেছিল যেগুলো এখনো মনে পরলে খারাপ লাগে।

যেহেতু ফেব্রুয়ারী মাসের মাঝামাঝি তাই শীতের প্রকোপ নেই বললেই চলে। হয়তো গ্রামের বাড়িতে হালকা শীতের আবহ থাকতে পারে কিন্তু শহরে আর তেমন ঠান্ডা নেই। তবুও রাস্তার পাশে নানান মানুষ শীতের পিঠা বানিয়ে বসে আছে, এদের মধ্যে হয়তো বেশিরভাগ গরীব পরিবারের। এরা দিনরাত লড়াই করে যাচ্ছে শুধু দুবেলা পেট ভর্তি করে খাবার খেয়ে রাতে একটু শান্তিতে ঘুমানোর জন্য।

বাসায় ফিরে রাতের খাবার খেতে ইচ্ছে করছে না তবুও রকি আর তার মা-বাবার অনুরোধে না খেয়ে পারলাম না। শুধু বারবার সানজিদার এমন নিষ্ঠুর আচরণ মনে পরছে, চোখ দিয়ে পানি আসতে চায় কিন্তু আসে না। মনের মধ্যে ঠিকই কান্না এসেছে, রুমের মধ্যে এসে বেলকনিতে বসে বসে পিছনের কিছু স্মৃতি মনে পরছে।

আট মাস আগে “স্নিগ্ধ শিশির” নামের একটা আইডি থেকে ফেসবুকে একটা গ্রুপের মধ্যে ভালো সচেতনতা মূলক পোস্ট করা হয়েছিল। আমি সেই পোস্টে একটা রচনা মূলক মন্তব্য করেছিলাম, আর তারপর সেই কমেন্ট রিপ্লাই করতে করতে মেসেজ করা আরম্ভ। তারপর থেকে বন্ধুত্ব আর সেই বন্ধুত্ব থেকে ভালবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।

কতক্ষণ পেরিয়ে গেছে জানি না, মোবাইলের শব্দে চমকে উঠে তাকিয়ে দেখি বাবা কল দিয়েছে। আমি রিসভ করে বললামঃ-

– হ্যালো বাবা?

– কিরে কেমন আছো? কোথায় তুই?

– বাবা আমি একটু খুলনা শহরে এসেছি, একটা বন্ধু আছে এখানে তার সাথে দেখা করতে আসলাম।

– আমি তো ভেবেছিলাম তোর কোন বন্ধুর কাছে চট্টগ্রামেই আছিস, তোর মা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে কি যেন বললো বুঝতে পারলাম না।

– চিন্তা করো না বাবা, আমি চলে আসবো কিছুদিন দেরি হতে পারে।

– চাকরির কোন ব্যবস্থা হলো?

– না বাবা।

– আচ্ছা আমি আমার এক পরিচিত ব্যক্তির সাথে কথা বলেছিলাম, সে তোকে দেখা করতে বলেছে। তুই চট্টগ্রামে ফিরেই তার সাথে দেখা করবি, মনে হয় ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

– এর আগেও তোমার তিনজন বন্ধুর সাথে চাকরির জন্য যোগাযোগ করেছি বাবা, সবাই কিন্তু দেখছি, দেখি ইত্যাদি বলে রেখেছে।

– তবুও চেষ্টা করেছে তারা।

– তাদের সেই চেষ্টা করার জন্য আমি চিরকৃতজ্ঞ।

– আচ্ছা ভালো থাকিস বাবা।

– তুমিও ভাল থেকো, নিজের যত্ন নিও।

মনটা শক্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করছি তবুও তাকে কোনরূপে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। জগৎ সম্পুর্ণ অদ্ভুত, এখানে দিনশেষে কেউ কেউ একাকীত্বে সুখ খুঁজে নেয় আবার কেউ বা ব্যস্ততায় খুঁজে পাচ্ছে তার সকল সুখ। হঠাৎ করে কেউ হারিয়ে গিয়ে অনেকটা ভালো থাকে, কেউ কেউ খুব প্রিয়জন হারিয়ে যাবার বেদনায় কষ্টের সঙ্গে বাস করে। একটা কথা চিরন্তন সত্য তা হচ্ছে, আমি আপনি সবাই মিলে সুখে থাকার অভিনয় করে যাই মাত্র। আর কি আশ্চর্য দেখুন..!
“সুখের ব্যাখ্যাগুলো আমাদের সবার জীবনে ভিন্ন!”

রাত এগারোটার কিছুক্ষণ পরে বইমেলায় দেখা হওয়া সেই সানজিদার বান্ধবী কল দিল। আমি একটু অবাক হলাম, পরক্ষণেই মোবাইল রিসিভ করে কানের কাছে ধরে চুপ করে রইলাম।

– মেয়েটা বললো, শুনতে পাচ্ছেন?

– হ্যাঁ পাচ্ছি, বলেন।

– কি করছেন?

– একা একা বাতি বন্ধ করে ভাবনার জগতে বিচরণ করছি, জগতের সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার নিয়ে ভেবে দেখি।

– আপনি তো আবার কবি মানুষ তাই আপনাদের চিন্তা চেতনা একটা ভিন্ন ধরনের, তাই না?

– সম্পুর্ন সঠিক না, তবে কিছুটা সত্যি।

– ডিনার করেছেন?

– হ্যাঁ করেছি, আপনি?

– হ্যাঁ।

– আপনার বান্ধবী মানে রুমমেইট করেছে?

– হ্যাঁ আমরা দুজনেই একসাথে খেয়ে তারপর এই মাত্র ফ্রী হলাম, সানজিদা পাশের রুমে গিয়েছে তাই সুযোগ পেয়ে কল দিলাম আপনার কাছে।

– কেন? যার জন্য এতটা কষ্ট করেছি, সুদূর চট্টগ্রাম থেকে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি সেই মানুষটা যখন আমার কষ্ট বুঝলো না তখন আপনি আর কেন শুধু শুধু।

– আসলে আপনার কাছ থেকে চলে আসার সময় আপনার দুচোখ ভর্তি প্রচুর মমতা দেখতে পেলাম। সেই চোখের মধ্যে অসংখ্য কষ্ট লুক্কায়িত মনে হলো আমার কাছে তাই কৌতুহল বোধ থেকে কল দিলাম। এতে যদি আপনি বিরক্ত হন তাহলে আমি দুঃখিত, ক্ষমা করবেন আমাকে।

– প্লিজ ভুল বুঝবেন না, আমি এভাবে কথাটা বলতে চাই নাই।

– ঠিক আছে সমস্যা নেই, আসলে আপনার মনের অবস্থা ভালো না তাই এই মুহূর্তে আপনার তিক্ত ব্যবহারেও কিছু মনে করবো না।

– ধন্যবাদ আপনাকে।

– একটা কৌতুহল জনিত প্রশ্ন করবো?

– হ্যাঁ অবশ্যই।

– আপনি বইমেলায় আমাকে তুমি তুমি বলে ডেকে এখন মোবাইলে আপনি করে বলছেন কেন?

– আমি তো ভেবেছিলাম আপনি সানজিদা তাই তো তুমি করে বলা হয়েছে নাহলে তো বলতাম না।

– ওহহ আচ্ছা।

– একটা সাহায্য করবেন আমাকে?

– কিরকম সাহায্য? আপনি বলেন, আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।

– সানজিদার সাথে একটিবার দেখা করতে চাই, আপনি যেভাবেই হোক ব্যবস্থা করে দিবেন প্লিজ?

– কিন্তু ও রাজি হবে না।

– আপনি বাসায় যাবার পর আমার কথা কিছু কি জিজ্ঞেস করেনি?

– নাহহ তেমন কিছু না, আপনার বিষয় সানজিদার কোন আগ্রহ নেই।

– আপনি কি একটু ব্যবস্থা করবেন? আমি একটা বার তাকে দেখতে চাই।

– দেখুন আমি বুঝতে পারছি আপনার আবেগ কিন্তু কি করবো বলেন? আমি নিরুপায়।

– আচ্ছা ঠিক আছে সরি।

– ভালো থাকবেন সবসময়, রাখলাম।

– আপনিও ভালো থাকবেন।

রাতের বেলা সানজিদার নাম্বারে কয়েকবার কল দিলাম কিন্তু রিসিভ করলো না। তারপর একটা খুব ইমোশনাল মেসেজ দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা আরম্ভ করে দিলাম।

★★

সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে দৈনিক পত্রিকা পড়ছিলাম। রকির বাবা রিটায়ার্ড সরকারি চাকরিজীবি, তাই তিনি নিয়মিত দৈনিক পত্রিকা পড়েন। বেশিরভাগ সরকারি অফিসে দৈনিক পত্রিকা রাখা হয় আর সেখান থেকেই তাদের অভ্যাস হয়ে যায়। রকির বাবা সৎ লোক, নিজের সন্তানকে চাইলে ঘুষ দিয়ে একটা সরকারি চাকরি ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। কিন্তু তিনি সেটা করবেন না কারণ যেই চাকরি হারাম টাকা লেনদেন করে শুরু হবে সেটা সারাজীবন হারাম বয়ে আনবে এটাই তার বিশ্বাস।

সকাল সাড়ে নয়টার দিকে সানজিদার বান্ধবী কল দিল আবারও, আমি অবাক হলাম না, মনে হয় ধরে নিয়েছিলাম তিনি কল দিবেন। কিন্তু তার নামটা জানা হচ্ছে না, আমি রিসিভ করে আবারও চুপ করে রইলাম।

– সে বললো, শুনছেন?

– গতকাল রাতের মতো আবারও সেই বাক্য, আমি বললাম হ্যাঁ শুনছি কেমন আছেন?

– শুভ সকাল, আমি ভালো আছি আপনি?

– আমিও ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ, নাস্তা করা হয়েছে?

– হ্যাঁ অনেক আগেই করেছি।

– ওহহ আচ্ছা।

– একটা কথা বলার জন্য কল দিলাম।

– জ্বি বলেন।

– আপনি চট্টগ্রামে যাচ্ছেন কবে?

– সানজিদার সাথে দেখা না করে আমি যাবনা, আমি জানি তাকে আমি কোনদিন পাবো না তবুও তার সাথে একটা বার দেখা করতে চাই।

– আমি যদি আজকে আরেকবার আমার সাথে দেখা করতে বলি তাহলে আপনি কি আমার সঙ্গে দেখা করবেন?

– আপনি দেখা করতে চান?

– হ্যাঁ যদি আপনি চান তবে।

– ঠিক আছে দেখা হবে, কিন্তু কোন যায়গা? কালকে যেখানে গেছিলাম সেই বইমেলায়?

– নাহহ, রূপসা ব্রীজের উপর। আপনার মনে আছে সানজিদা আপনাকে বলেছিল যে আপনি আসলে আপনাকে সে রূপসা সেতু ঘুরিয়ে দেখাবে? আপনি নাকি সবসময় অনলাইনে দেখেছেন, তাই আপনার খুব ইচ্ছে রূপসা সেতু দেখবেন।

– হ্যাঁ বলেছিলাম কিন্তু আপনি?

– আমি তো ওর রুমমেইট তাই এসব কিছু কিছু জানি আমি।

– ওহহ আচ্ছা, আসলে ২০১৩ সালে আমি প্রথম বিটিভিতে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান “ইত্যাদি”এর মধ্যে হানিফ সংকেতের উপস্থাপনায় রূপসা সেতু দেখি। সেবার ইত্যাদি অনুষ্ঠান ধারণ করা হয়েছিল ব্রীজের নিচে। তারপর যখন আমার বন্ধু রকি চট্টগ্রামে বসে তার সাথে পরিচয় হলো। তার মোবাইলে একদিন দেখি অনেক গুলো ব্রীজের উপর দাঁড়িয়ে ছবি তোলা হয়েছে, তখন থেকে অনেক ইচ্ছে ছিল।

– ঠিক আছে তাহলে আজকে বিকেলে সেখানে আমাদের দেখা হচ্ছে।

– আমি আপনাকে পাবো কীভাবে? আর আমি তো চিনিনা।

– আপনার বন্ধুর বাসা কোথায়?

– জোরাগেট, আমি তো গতকাল জোরাগেট বলে রিক্সায় উঠেছিলাম।

– ঠিক আছে আপনি বিকেলে ঠিক সাড়ে চারটার দিকে জোরাগেটের ওখানে দেখবেন একটা বিমান এর প্রতিক আছে সেখানে দাঁড়াবেন। আমি এসে আপনাকে সেখান থেকে নিয়ে যাবো।

– আমার বন্ধু যদি সাথে যায়?

– তাকে না নিলে হয় না?

– আচ্ছা ঠিক আছে আমি একাই আসবো।

– ওকে রাখলাম তাহলে?

– ঠিক আছে ভালো থাকবেন।

★★

রকির কাছে সবকিছু খুলে বললাম, সব শুনে রকি বললো, ” সমস্যা নেই তুই চলে যা দেখা করতে, মনে হয় মেয়েটা ভালোই আছে। যদি সেখানে গিয়ে কোন সমস্যা হয় তবে কোনরকমে একটা কল দিবি আমি উড়তে উড়তে চলে যাবো। ”

বললাম, ” ঠিক আছে বন্ধু তাই হবে। ”

বিকেল বরাবর সাড়ে চারটার দিকে আমি বাসা থেকে বেরিয়ে জোড়াগেটের সামনে বিমানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তাটা তিন মুখো, শহরের ভিতর থেকে এসে এখান থেকে দু’দিকে বিভক্ত হয়ে গেছে। মেয়েটার আসতে দেরি হচ্ছে, সকালে কল দিয়েছে তখনও নাম জিজ্ঞেস করা হয়নি। তার সাথে কথা বলতে গেলে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায় নাকি? কি সাংঘাতিক ব্যাপার, এটা কেন হচ্ছে?

মেয়েটা আসলো চারটা পঞ্চাশ মিনিটে, ইজিবাইক থেকে নেমে আমার সামনে এসে বললো, চলুন এখন আবার নতুন করে গাড়িতে উঠতে হবে।

আমরা রাস্তার এপাড়ে এসে একটা মাহিন্দ্রায় উঠে গেলাম, মেয়েটা বললো রূপসা যাবো।

আজকে সে নীল রঙের ড্রেস পরে এসেছে, একদম সবকিছু নীল। পা থেকে মাথা পর্যন্ত যা কিছু চোখে দেখতে পাচ্ছি সবকিছু মনে হয় নীল। নীল রঙের ড্রেস পরে মেয়েটাকে খুব সুন্দর লাগছে, চলন্ত মাহিন্দ্রার মধ্যে বাতাসে তার চুল গুলো বাতাসে উড়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে আমার মুখে পরছে, সে একটু পর পর সেগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাচ্ছে। আমার মনে নামটা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে না, কেন করছে না জানিনা। তাই কিছু না বলে চুপচাপ বসে রইলাম দুজনেই।

রূপসা এসে সেখান থেকে আবার ইজিবাইকে করে যেতে হচ্ছে, ব্রীজের কাছে যখন নামলাম তখন ঘড়ি বলছে বরাবর পাঁচটা ত্রিশ।

আমি মুগ্ধ হয়ে খুলনা শহরের অন্যতম সৌন্দর্য রূপসা সেতু চোখের সামনে দেখছি। পাশে একজন নীল রঙের ড্রেস পরা সুন্দরী রমণী, যদিও তার সাথে আমার আপনি বলা সম্পর্ক তবুও কেউ তো আর সেটা জানছে না। আশেপাশে আরো কয়েকটা প্রেমিক প্রেমিকা দেখা যাচ্ছে, আমরা আস্তে আস্তে সিড়ি দিয়ে ব্রীজের উপর উঠলাম। হাঁটতে হাঁটতে ব্রিজের ওপারে গিয়ে নামার আগেই মাগরিবের আজান দিয়ে দিল। ফেব্রুয়ারী মাস দিন অনেকটা ছোট, প্রায় এক কিলোমিটার এর বেশি পথ দুজনেই কথা বলতে বলতে পার করে দিলাম। ওপাড়ে গিয়ে আবারও সিড়ি বেয়ে নিচে নামলাম।

– মেয়েটা বললো, আমি যতদুর জানি আপনি মনে হয় নিয়মিত নামাজ পড়েন। ওইযে দেখুন পুরুষেরা মাগরিবের নামাজ পড়ছে, আপনি তাদের সাথে গিয়ে নামাজ পড়ুন।

– দেখলাম সত্যি সত্যি ব্রিজের নিচে একটা পিলারের পাশে খানিকটা স্থানে নামাজে দাঁড়িয়ে গেছে সবাই। তার পাশেই একটা ড্রামের মধ্যে পানি দিয়ে কেউ কেউ অযু করছে। আমি সেখান থেকে অযু করে সবার সাথে জামাতে নামাজ আদায় করলাম আর মেয়েটা একটু পাশেই দাঁড়িয়ে রইলো।

নামাজ শেষ করে দুজনেই হাঁটতে হাঁটতে একটু পিছনে সবুজ ঘাসের উপর গিয়ে বসলাম। মেয়েটা ব্যাগের ভেতর থেকে একটা বাটি বের করলো, আমি তাকিয়ে আছি, তারপর আমার হাতে দিয়ে বললো,

– সানজিদা আপনার জন্য নুডলস রান্না করে পাঠিয়ে দিয়েছে, আপনি খেলে খুব খুশি হবে সে।

– সে দেখা করবে না?

– জানিনা আমি।

– তাহলে খাবো না।

– প্লিজ খেয়ে নিন, আমি চেষ্টা করবো আপনার সাথে ওর দেখা করিয়ে দিতে।

– সত্যি বলছেন?

– হ্যাঁ সত্যি বলছি এবার খান, সানজিদা বলছিল নুডলস আপনার নাকি খুব পছন্দের তাই সে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে।

– ওহহ আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?

– করুন।

– আপনার নাম কি?

– হাহাহা, দুদিন পর আপনার নামের দরকার?

– না আসলে জিজ্ঞেস করা হয়নি।

– অন্য একদিন বলবো।

– আপনার ইচ্ছে।

নুডলস রান্না খুবই ভালো হয়েছে, ব্যাগের ভেতর চামচ পানির বোতল সবকিছু ছিল। একা একা সম্পুর্ণ বাটি খালি করে দিলাম, মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে নাকি অন্যদিকে তা জানিনা।

খাবার শেষে তার মোবাইলে কল এলো, আমার দিকে নাম্বার দেখিয়ে বললো সানজিদা কল দিয়েছে। তারপর রিসিভ তার সাথে কথা বললো।

কথাগুলো এমনঃ-

হ্যাঁ দেখা হয়েছে, আমরা একসাথে আছি, সে এখন নুডলস খাচ্ছে, না না তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো। ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।

খাবার শেষ করে আমরা উঠে আবারও হাঁটতে শুরু করেছি, সিড়ি বেয়ে উঠে পিছনের দিকে যাচ্ছি। সে বললো, ” চলুন তাহলে ফেরা যাক? ” আমিও তার সাথে সম্মতি দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। সেতু পার হয়ে নিচে এসে আমরা আবারও ইজিবাইকে করে রওনা দিলাম।

আমরা সরাসরি বাসার দিকে না গিয়ে সানজিদার বান্ধবী আমাকে নিয়ে একটা মার্কেটের দিকে এলো। আমাকে বললো, এটা নাকি ডাক বাংলােরমোড় হিসেবে পরিচিত। আমি তার পিছনে পিছনে হাঁটছি, হঠাৎ করে একটা কাপড়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। ভিতরে একটা হিন্দু মহিলা (মাথায় সিঁদুর পরা, হাতে সাখা) বসে আছে এবং সাথে দুটো লোক আছে। আমি বাহিরে দাঁড়িয়ে রইলাম আর সে মহিলার কাছে গিয়ে একটা হাতের ব্যাগে নিয়ে এলো। ব্যাগ দেখে মনে হচ্ছে এর মধ্যে হয়তো কাপড় আছে, কিংবা অন্য কিছু।

আমরা ইজিবাইকে করে জোড়াগেট এসে নামলাম, মেয়েটা আমার হাতে ব্যাগটা দিয়ে বললোঃ- এগুলো সবকিছু আপনার জন্য।

– মানে কি?

– আজকে সকালে আপনাকে কল দিয়ে দেখা করতে বলার পর আপনি যখন রাজি হলেন। তখন আমি সানজিদা আর আমাদের একটা বান্ধবী এসে এগুলো কিনেছিলাম। সবকিছু আপনার সানজিদা আপনার জন্য পছন্দ করে কিনেছে।

– কি কি আছে এর মধ্যে?

– দুটো প্যান্ট, দুটো শার্ট, দুটো গেঞ্জি, একটা ঘড়ি, এক জোড়া জুতা, একটা সানগ্লাস, আর একটা পারফিউম।

– এতকিছু?

– কেন নিবেন না?

– না।

– কেন?

– সানজিদাকে বলবেন আমি তার সাথে দেখা করার জন্য এতদূর এসেছি। সে যদি আমার সাথে দেখা না করে তাহলে কি লাভ এতকিছু দিয়ে মিথ্যা কষ্ট বৃদ্ধি কর?

– আপনি সত্যি সত্যি নিবেন না?

– নাহহ।

– যদি সানজিদার সাথে দেখা করিয়ে দেই তাহলে কি নিবেন?

– হ্যাঁ।

– ঠিক আছে সানজিদার সাথে দেখা হবে, কিন্তু তার আগে একটা শর্ত থাকবে।

– কি শর্ত?

– সানজিদা আপনার সাথে দেখা করবেবে, তারপর থেকে সানজিদাকে আপনার ভুলে যেতে হবে এবং তার সাথে কিংবা আমার সাথে কখনো দেখা করতে বা কথা বলতে চাইতে পারবেন না।

– আমি রাজি, সানজিদার সাথে একটাবার দেখা করে তারপর আমি চলে আসবো। কথা দিচ্ছি আর কোনদিন আপনাকে কিংবা আপনার বান্ধবীকে আমি সজীব বিরক্ত করবো না।

– ঠিক আছে চলুন তাহলে।

আমরা আবারও ইজিবাইকে করে রওনা দিলাম, মিনিট পনের পরে আমরা নামলাম। সামনে একটা রাস্তার পাশে কলেজ দেখতে পাচ্ছি, কলেজের গেটে লেখা “সিটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট”। আমরা কলেজের পাশ দিয়ে হেঁটে একটু ভিতরে একটা মাঠে প্রবেশ করলাম। বুঝতে পারলাম এটা একটা স্কুল মাঠ, স্কুলের নাম লেখা আছে “রোটারি স্কুল”।

– সে বললো, আপনি এখানে অপেক্ষা করুন আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে সানজিদাকে নিয়ে আসবো।

আমি ‘আচ্ছা’ বলে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিন্তু পাঁচ মিনিটে কেউ আসলো না বরং কুড়ি মিনিট পরে মোবাইলে কল এলো। তাকিয়ে দেখি সানজিদা কল দিয়েছে, আমি রিসিভ করে হ্যালো বলার আগেই পিছন থেকে একটা মেয়ে বললো,

– আপনার নাম সজীব তাই না?

– আমি তাকিয়ে দেখি একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, বললাম, হ্যাঁ আমি সজীব, আপনি?

– আমি ফারজানা মুন্নী, আপনি সানজিদার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন তাই না?

– জ্বি।

– সানজিদা আসবে না।

– কেন? আর তার বান্ধবী কোথায়?

– ভাইয়া আপনি সানজিদা নামের যাকে চিনেন আসলে সেই সানজিদা নামে বাস্তবে কেউ নাই। যার সাথে আপনি এতদিন কথা বলেছেন তার না অন্য কিছু।

– মানে?

– ঠিকই বলছি, আপনি গতকাল যার সাথে দেখা করেছেন আর আজকে বিকেল থেকে এতক্ষণ যার সাথে ছিলেন সেই আপনার কথিত সানজিদা। তবে তার নাম অন্য কিছু।

– নামের মধ্যে কিছু যায় আসে না কিন্তু আমার সাথে যার দেখা হয়েছে সেই যদি সানজিদা হয় তাহলে সে আমার সাথে লুকোচুরি করছে কেন?

– কারণটা অনেক বড় ভাইজান।

– আমি কি জানতে পারি?

– আপনি যাকে সানজিদা নামে জানেন ওর নাম অর্পিতা বিশ্বাস মানে সে হিন্দু। আর ও হিন্দু এবং আপনি মুসলমান তাই অর্পিতা আপনাদের এই সম্পর্কে এগিয়ে নিতে চায় না। অর্পিতা ভাবতে পারে নাই প্রেমটা এত গভীর হয়ে যাবে, কিন্তু যখন সে বিষটা শেষ করতে চেয়েছে তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। যার ফলে আজকের এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, আমি অর্পিতার হয়ে ক্ষমা চাই। আপনার সাথে গতকাল আপনার ভালবাসার মানুষ দেখা করেছে, আজকে সকালে আমি আর অর্পিতা গিয়ে আপনার জন্য এগুলো কিনেছি। সবকিছু অর্পিতা পছন্দ করে কিনেছে, আপনার জন্য ও খুব কষ্ট পাচ্ছে। কালকে দেখা করে এসে অনেকক্ষণ কান্না করেছে, আজকে যখন পছন্দ করে কিনেছে তখনও চোখের পানি ফেলেছে। বিশ্বাস করুন ভাই, আপনি সানজিদা নামটা যতটা ভালবাসেন অর্পিতা ঠিক ততটাই আপনাকে ভালবাসে। কিন্তু হিন্দু মুসলিমের এর দুই ধর্মের দুজনের ভালবাসা যখন সফলতা পাবে না তখন রেখে কি লাভ? তাই অর্পিতা আপনার কাছ থেকে সরে যেতে চাচ্ছে। আপনি ওর এই সামান্য উপহার গ্রহণ করে এগুলো নিয়ে চলে যান। আবারও বলছি তাকে ক্ষমা করবেন প্লিজ, অর্পিতা আপনাকে ওর নিজের চাইতেও বেশি ভালবাসে। এখন আমি রুম থেকে আসার সময় দেখেছি রুমের মধ্যে বসে বিছানায় শুয়ে চিৎকার করে কান্না করছে।

চলবে….

লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here