পর্ব ১৪+১৫
এক_ফাগুনের_গল্প
পর্বঃ-১৪
একটু পরে বুঝতে পারলাম জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কেউ নাই, বাহিরে ঝড় আরম্ভ হচ্ছে। এমনিতেই খুন হবার জন্য সবকিছু থমথমে বিরাজ করছে তারমধ্যে আবার ঝড়ের আরম্ভ। আমি তাড়াতাড়ি জানালা বন্ধ করে দিলাম, ফাহিম আমার পাশে চুপচাপ বসে আছে। তার চোখে মুখে কিছু জিজ্ঞেসা করার মতো ভাব ফুটে উঠেছে।
পরদিন সকালে বাড়িতে আবার পুলিশ এলো, সেই অল্পবয়সী পুলিশের নাম তামিম হাসান। সকাল বেলা টেবিলে নাস্তা খেতে খেতে এলাকার বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিল। আমি সেখানে উপস্থিত হয়ে তাদের আলাপ আলোচনা শুনছিলাম, তামিম হাসান বললোঃ-
– আপনি বাহিরের মেহমান আমাদের এলাকায় এসে একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনার সম্মুখীন হলেন। আপনার মনে হতে পারে যে সবসময় মনে হয় আমাদের এই এলাকার মধ্যে এমন হয়ে থাকে। সত্যি বলতে এমন ঘটনা কিন্তু অনেক বছর পরে ঘটলো।
– আমি বললাম, আমি তেমন কিছু মনে করিনি তবে আসল খুনি ধরা পড়ুক সেটাই প্রত্যাশা করি। আমার মনে হয় আপনারা একটু সচেতন হলেই বিষয়টা খুব তাড়াতাড়ি সমাধান করতে পারবেন।
– আপনার কাছে কি বিষয়টা খুব স্বাভাবিক ভাবে মনে হচ্ছে? মানে সহজে উদঘাটন হবে?
– জ্বি হবে, কারণ এই রহস্যের সমাধান পাবার পথ অনেক গুলো আছে মনে হয়। সবগুলো পথ যদি সঠিক ব্যবহার করা যায় তাহলে গন্তব্যে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু সঠিক স্থানে যাবার পথ ব্যবহার না করে যদি ভুল রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যান তবে গন্তব্যে যাওয়া সম্ভব না। বছরের পর বছর শুধু মামলা ঘুরতে থাকবে, আস্তে আস্তে পুরাতন মামলা চাপা পরে যাবে নতুন সকল মামলার মাঝে।
– আমরা যথেষ্ট চেষ্টা করছি আর তাছাড়া যেহেতু চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতে খুন হয়েছে তাই তিনি নিজেই এর শেষ দেখে ছাড়বেন।
– শুনে অনেক খুশি হলাম।
– আপনি শহরের মানুষ, আর আপনাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে আপনি বিচক্ষণ ব্যক্তি। তবে কথা বলে চট করে বোঝা যায় কারণ আপনার সব কথা স্পষ্ট।
– জ্বি ধন্যবাদ।
★★
এগারোটার দিকে মোহনার সাথে কথা হলো, তার ভাবসাব দেখে মনে হয় সে আমাকে নিয়ে খুব চিন্তার মধ্যে আছে। কিন্তু আমার মনের চিন্তা হচ্ছে গতকাল রাতের চিঠি কে দিয়েছে?
– মোহনা বললো, তোমাকে নিয়ে আসাই সবচেয়ে বড় ভুল হয়ে গেছে। যদি জানতাম এমন বিপদের মধ্যে পরবে তাহলে কোনদিন তোমাকে আসতে দিতাম না। আর আমি নিজেও এই বরিশালে এসে ঝামেলার মুখ দেখতাম না।
– বিপদ কখনো বলে আসে না মোহনা, এরা হঠাৎ করে এসে মানুষের জীবনে উপস্থিত হয়। বিপদের আরেকটা নাম দিতে পারো, তাদেরকে সারপ্রাইজ হিসেবে বলা যায় কারণ তারা হঠাৎ করে আসে।
– তোমার টেনশন হচ্ছে না?
– মোটেই না।
– কিন্তু কেন?
– আমি গতকাল রাতে একটা চিঠি পেয়েছি আমার রুমে, আর সেটা পড়ে আমি মোটামুটি অনেক কিছু বুঝতে পারছি।
– কিসের চিঠি?
– তুমি পড়বে?
– হ্যাঁ।
– আচ্ছা ঠিক আছে।
মোহনা চিঠি পড়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে গেছে, তার মুখ থেকে শব্দ বের হচ্ছে না। আমার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো, তারপর বললোঃ-
– বাবা তাহলে তোমাকে আমার পথ থেকে সরানোর জন্য এতকিছু করতে চাচ্ছে?
– সেটা তো জানিনা আমি কিন্তু জানার চেষ্টা করবো অবশ্যই কারণ শেষ দেখার অপেক্ষা।
– তোমার কিন্তু এখান থেকে চলে যাওয়া উচিৎ, চল আমি তোমাকে নিয়ে ঢাকা চলে যাই।
– না মোহনা সেটা সম্ভব না, এখানে থেকে সবকিছু ভালো করে সবার সামনে আনতে হবে। সবাই যেন সত্যি ঘটনা নিজের চোখে দেখে আসল অপরাধীকে চিনতে পারে।
– যদি তুমি ফেঁসে যাও? তাহলে আমার কি হবে তা ভেবে দেখো।
– কিছু হবে না, একটা চিঠির লেখা পড়ে পালিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না।
– একটা কথা বলতে চাই।
– বলো।
– রাগ করবে না তো?
– না করবো না।
– আমাকে কি ভালবাসা যায় না?
– কেন যাবে না? অবশ্যই যাবে।
– তাহলে একটু ভালবাসা দাও না, কতবার রাগ করে থেকেছি, কতবার ভুলে যাবার জন্য চোখের সামনে পরিনি। কিন্তু সবকিছুর ফলাফল শূন্য।
– ঢাকা গিয়ে ভেবে দেখি কি করা যায়।
– আমাকে নিয়ে ভাববে তুমি?
– হ্যাঁ।
– তুমি তো চট্টগ্রামে চলে যাবে।
– সমস্যা নেই, ফিরে আসার অজস্র পথ আছে।
– বাড়ি থেকে বের হবে না বেশি, কে কোনভাবে যে তোমাকে খুনের সাথে জড়িয়ে দেবে টেরই পাবে না। মাঝখানে আমার কপাল পুড়বে, নিজের জন্য না হোক কিন্তু আমার জন্য সাবধানে থেকো।
– ঠিক আছে।
★★
চারদিন পরের কথা।
বাড়ির মধ্যে বিয়ের অনুষ্ঠান করা হবে না, পাত্রপক্ষ উপজেলার একটা কমিউনিটি সেন্টারে সামান্য কিছু অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মেয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু মোহনা আর আন্টি ঢাকা যাবার জন্য অস্থির হয়ে গেছে এর কারণ হচ্ছে বিয়ে উপলক্ষে আসা কিন্তু সেখানে এসে এমন ঝামেলা কেউ সহ্য করতে পারে না। মোহনার বাবা মানে স্যার আর আসলেন না, যেখানে আমরা আছি ঝামেলার মধ্যে সেখানে তার এসে কাজ কি?
সকাল থেকে আমি প্রচুর টেনশনে আছি, সামিহার সেই পুরনো ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর সাথে যোগাযোগ করেছি আরো দুদিন আগে। তার গ্রামে গিয়ে প্রতিবেশী আর বাজারের মধ্যে অনেক কিছু জানলাম। তবে আমি ভেবেছিলাম সবকিছু গোপনে করতে পেরেছি কিন্তু গতকাল রাতে আবার একটা চিঠি পেয়ে বুঝতে পারছি যে আমাকে কেউ অনুসরণ করেছে। আমার সকল চলাফেরা ও অনুসন্ধান সেই চিঠি প্রদানকারী ব্যক্তি চোখে চোখে রেখেছেন।
সামিহার বাবার মোটামুটি অনেক জমিজমা ছিল, তাদের পুরনো ঘরের মধ্যে কিছু ব্যাঙ্কের কাগজপত্র দেখে অবাক হলাম। আমি তেমন বুঝতে পারিনি বলে সেই ব্যাঙ্কে গেলাম, তাদের কাছে মোটামুটি তথ্য পেলাম কিন্তু বুঝতে পারলাম না। সবকিছু বাদ দিয়ে আমি গতকাল রাতে পাওয়া দ্বিতীয় চিঠি নিয়ে বেশি চিন্তা করছি।
চিঠি হলো।
কেমন আছেন মিঃ সজীব?
আগের চিঠিতে সালাম দিলাম কিন্তু এই চিঠিতে সালাম দিলাম না। কারণ সালাম শব্দের অর্থ হচ্ছে শান্তি বর্ষিত হোক, তাই গত চিঠিতে আপনার জন্য শান্তি কামনা ছিল। কিন্তু আজকের চিঠিতে কোন শান্তি কামনা নেই কারণ আপনার কাজকর্ম।
ভেবেছিলাম আপনি প্রথম চিঠি পড়ে যেকোনো উপায়ে অত্র গ্রাম ত্যাগ করবেন। কিন্তু আপনি সেটা না করে উল্টো অনুসন্ধান করে যাচ্ছেন, যেটা কিন্তু মেনে নিতে পারছি না। আপনি শিক্ষিত ব্যক্তি তাই সহজ করে বলছি, আগামীকাল আপনি আপনার সাথে আসা মেহমানসহ এলাকা ত্যাগ করবেন। যদি না করেন তাহলে সামিহার সাথে ঘটিত ঘটনা আবার মোহনার সাথে ঘটবে। তাই আমি চাই দ্বিতীয় কোন অপ্রত্যাশিত ঘটনার সম্মুখীন হবার আগেই আপনি তাদের নিয়ে শহরে ফিরে যান।
ইতি,
মোহনার শুভাকাঙ্ক্ষী।
চিঠির জন্য যতটা চিন্তা ছিল তারচেয়ে বেশি চিন্তা হচ্ছে কারণ একটু আগে জানতে পারলাম আজকে রাতের লঞ্চে নাকি আমরা ঢাকা ফিরছি। আন্টি নিজে চলে যেতে চাচ্ছেন, মোহনা আর ফাহিম দুজন মিলে সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছে। মোহনা একটু আগে এসে আমাকে বলে গেল ” খুব ভালো হচ্ছে আমরা চলে যাচ্ছি, আগামীকাল সকালে সদরঘাট পৌঁছতে পারলে হাফ ছেড়ে বাঁচি। ”
আপনি তার কথার উত্তরে একটু হাসলাম, মনে মনে ভাবলাম ” তুমিও এমনটা করতে পারো মোহনা? ”
নিরুপায় হয়ে সন্ধ্যার আগেই আমরা সবাই লঞ্চ ঘটের দিকে রওনা দিলাম। রওনা দেবার কিছুক্ষণ আগে পুলিশ তামিম হাসান এসেছিলেন। সামান্য কথাবার্তা বলে আমাদের যাত্রার শুভ কামনা করে তিনি চলে গেলেন।
মালামাল সবকিছু কেবিনে রাখা হয়েছে, আন্টি ফাহিম মোহনা সবাই চেয়ারম্যান আঙ্কেলের কাছে বিদায় নিয়ে কেবিনে চলে গেছে। আমি চেয়ারম্যান আঙ্কেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, লঞ্চ ছাড়ার এখনো বিশ মিনিট বাকি আছে।
– আঙ্কেল বললেন, ভালো ভাবে যেও বাবা আর বাসায় পৌঁছে কল দিও। সবার জন্য আমরা কিন্তু চিন্তা করবো, তাছাড়া ঝড় তুফান কিছু হলে তখন টেনশন আরো বেড়ে যায়।
– বললাম, যে ঝড় তুফান আপনার এলাকায় দেখে গেলাম সেটাই ভুলবো না অনেকদিন। কত সুন্দর নিপুণ কৌশলে প্ল্যান করে আমাকে এলাকা ত্যাগ করানো হচ্ছে। প্রতিবাদ করতে গিয়েও করতে পারি না কারণ সাথে দুজন মহিলা আর একটা বাচ্চা। তবে আমি সকাল বেলা যখন বুঝতে পেরেছি যে আমার এই এলাকায় থাকার মেয়াদ শেষ। তখন সেই সকাল থেকেই আমি আমার অসমাপ্ত কাজগুলো অন্য কাউকে বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি।
– মানে কি বাবা?
– আঙ্কেল আমি খুনিকে চিনতে পেরেছি, কে খুনটা করেছে সেটা জানি আমি। আর আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে সেই খুনিও জেনে গেছে আমি তাকে চিনতে পেরেছি। কিন্তু প্রমাণ করতে আরো দুদিন সময় দরকার ছিল তাই সেই সুযোগ খুনি আমাকে দিতে চাচ্ছে না।
– কে খুন করেছে?
পর্বঃ-১৫
– এত অধৈর্য হলে হবে না আঙ্কেল, আমি যার কাছে দায়িত্ব দিয়ে এসেছি সে নিশ্চয়ই তার দায়িত্ব পালন করবে। আর তখন আপনিসহ সকল কৌতূহল প্রিয় এলাকাবাসী জানতে পারবে।
– তোমার কথা গুলো সব কেমন যেন রহস্যময়, তবে ইন্টারেস্টিং খুব তাই ভালো লাগে। কিন্তু আমি যদি জানতে না পারি তাহলে মনের মধ্যে খচখচ করবে তাই আমাকে বলে দাও। অথবা যার কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয়েছে তার সন্ধান বলো, আমি তার কাছ থেকে জেনে নেবো।
– না আঙ্কেল, আমি চাই না তাকেও আমার মতো করে নিরুপায় হয়ে এলাকা ত্যাগ করতে হয়। তাই তার পরিচয় আপাতত গোপনীয়, তবে কথা দিচ্ছি সেই ব্যক্তি অবশ্যই সবকিছু সামনে উন্মোচন করতে সফল হবে।
– একজনের কাজ আরেকজন করতে পারবে?
– হ্যাঁ পারবে।
– কীভাবে?
– সবকিছু প্রায় কমপ্লিট, এখন শুধু সাজিয়ে সাজিয়ে সম্মুখে আনতে হবে। আমি তাকে সমস্ত কিছু ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছি এবং কীভাবে কি করতে হবে তা সে জানে।
– ওহ্হ আচ্ছা।
– জ্বি আঙ্কেল, মনে করুন রান্না করার মতো। আমি বাবুর্চির মতো সবকিছু রান্না করে থরে থরে সাজিয়ে রেখে দিয়েছি। এখন শুধু পরিবেশক সেটা সুন্দর করে পরিবেশন করবে তাছাড়া কোন কাজ নেই। যদি কিছু রান্না করতে হয় তাহলে সেটাও আমি করবো আর যেহেতু আমি অনুপস্থিত থাকবো তাই ফোনেই সবকিছু মেনু বলবো, সে সেই মোতাবেক রান্না করে দিবে। মানে হচ্ছে কাজ করবে, সম্পুর্ন আমার মতো না হলেও কাছাকাছি যেতে পারবে।
– তাহলে তুমি বলবে না?
– না আঙ্কেল।
– কিন্তু কেন?
– কারণ এখন সময় হয়নাই, তাই অনুসন্ধানের স্বার্থে সচলায়তন নীতিমালা অনুযায়ী আপাতত সবকিছুই গোপন করতে হবে।
– তাহলে তো কিছু করার নেই, কৌতূহল নিয়ে আমি ছটফট করে অপেক্ষা করবো। সাবধানে যেও সবাই, আর বিশেষ করে তুমি সাবধানে থেকো কারন মনে হয় তোমার উপর দিয়ে হামলা যেতে পারে।
– হাহাহা আপনার এমনটা মনে হবার কারণ?
– তুমিই তো বললে খুনিরা আমাকে সবসময় নজরে রেখেছে আর তারা তোমাকে চিনে। তাই যদি লোক লাগিয়ে রাখে তাহলে তো বিপদ হতে পারে তাই না?
– হুম সেই সম্ভবনা আছে।
– তাই বলছি সাবধানে থেকো।
– জ্বি আঙ্কেল ধন্যবাদ, ভালো থাকবেন সবসময়।
– আল্লাহ হাফেজ।
★★
লঞ্চের চিরপরিচিত হর্ন বাজিয়ে যাত্রা শুরু করলো, এই মুহূর্তে ভিতরে সামান্য হইচই হচ্ছে। লঞ্চ ছাড়ার সময় অনেকে হাত নেড়ে তীরে দাঁড়িয়ে থাকা আত্মীয় স্বজনরে বিদায় জানায়। সেই সময় তারা মুখ দিয়ে কিছু আবেগি কিংবা মাঝে মাঝে উপদেশমূলক বানী শোনাতে শুরু করে।
ভালো করে থাকিস, আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো, সবকিছু খেয়াল রাখিস, ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করিস ইত্যাদি ইত্যাদি।
আর যারা তীরে দাঁড়িয়ে থাকে তারা বলে, সাবধানে যেও, বাসায় পৌঁছে কল দিও, পথে কেউ কিছু দিলে খাবে না, ব্যাগের ভেতর যে খাবার দিয়েছি সেগুলো শুধু খাবে, তাড়াতাড়ি করে খেয়ে নিও নাহলে কিন্তু নষ্ট হতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি আস্তে আস্তে কেবিনের কাছে যাচ্ছি, সামনে গিয়ে মোহনার সাথে দেখা হয়ে গেল। মোহনা বেগুনি রঙের শাড়ি পরেছে, এতক্ষণ লক্ষ্য করিনি কারণ আমি তো অন্য কিছু মাথার মধ্যে রেখেছি। বেগুনি রঙের শাড়ি পরে তাকে সত্যি মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ করে দিয়েছে।
– এতক্ষণ কোই ছিলে?
– ঘাটে ছিলাম, আঙ্কেল তো দাঁড়িয়ে ছিল তাই তার সাথে কথা বলছিলাম।
– কিসের কথা?
– অনেক কিছু তো বললাম তোমাকে কোনটা বলবো বলে দাও।
– হয়েছে কিছু বলতে হবে না, চা খেতে ইচ্ছে করছে, চলোনা দুজনে মিলে লঞ্চের ক্যান্টিনে গিয়ে গরম চা খেয়ে আসি।
– আচ্ছা ঠিক আছে।
– চা খেতে খেতে বললাম, তোমার খালু আজকের রাতে মনে হয় ঘুমাতে পারবে না।
– কেন কেন?
– যে সব কথা আমার কাছে শুনে গেছে তাতে তার এই রাতে ঘুম না আসারই কথা।
– এখন তো সম্পুর্ন কথাগুলো শুনতে ইচ্ছে করছে, প্লিজ বলো না।
– তেমন কিছু না, আচ্ছা একটা প্রশ্ন করবো?
– করো।
– আমরা হঠাৎ করে ঢাকা চলে যাচ্ছি কেন?
– এখানে থাকতে বোরিং লাগছে তাছাড়া বিয়ে বাড়ি এসে এমন অস্বস্তিকর পরিস্থিতি ভালো লাগে না।
– কিন্তু যেখানে একটা খুন হয়েছে সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়া কি ঠিক?
– কে পালিয়ে যায়? আমরা?
– হ্যাঁ আমরা।
– মোটেই না, খুন হয়েছে খালার বাসায় তাই পুলিশ সেগুলো নিয়ে কাজ করবে। কিন্তু শহর থেকে এসে আমরা কেন ঝামেলা ভোগ করবো?
– গতকাল রাতে আমি আরেকটা চিঠি পেয়েছি।
– মানে কি? (মোহনার মাঝে অপ্রস্তুত ভাবাপন্ন)
– হ্যাঁ, সেই চিঠি পড়ার পরে আমি মোটামুটি খুনির সবকিছু জানতে পেরেছি। কিন্তু খুনি খুব চালাক তাই আমার বাকি কাজ শেষ করার আগেই আমাকে পরিকল্পনা করে সরিয়ে দিছে।
– তুমি জানো সেই চিঠি কে দিয়েছে?
– হ্যাঁ মোহনা জানি আমি।
– কে সেই ব্যক্তি?
– হাহাহা কেন জানতে চাও?
– আশ্চর্য হলাম সজীব, আমার কি কৌতূহল বলতে কিছু থাকতে পারে না? আমি কি জানতে পারি না এ বিষয়?
– তুমি নিজেকে খুব বুদ্ধিমান মনে করো কিন্তু তুমি আমাকে এতটা বোকা ভাবলে কেন? আমি কি সত্যি সত্যি খুব বোকা?
– আমার কিন্তু রাগ হচ্ছে সজীব।
– সত্যি কথা বললে রাগ তো হবেই, একটা সহজ কথা জেনে রাখো মোহনা। খুনিকে ধরা হবে অবশ্যই আর সে যে হোকনা কেন, তাকে কোন ভাবেই ছাড় দেয়া হবে না।
– মোহনা শুষ্ক মুখে বললো, তোমার যা খুশি তাই করো আমার কিছু বলার নেই। গেলাম আমি।
মোহনা হনহন করে কেবিনে চলে গেল, ভাবলাম এই মুহূর্তে লঞ্চের ছাদে গিয়ে ঘুরে আসা যাক। চারিদিকে ঘোরাঘুরি করে মনোরম পরিবেশ আর নিস্তব্ধ রাতের নদীর তীর দেখার মজাই আলাদা। আকাশে পূর্ণ চাঁদ উঠেছে, নদীর ঢেউয়ের তালে তালে চিকচিক করে মনোযোগ আকর্ষণ করে যাচ্ছে। মোবাইলে কল এল, বের করে দেখি স্যার কল দিয়েছে ঢাকা থেকে।
– স্যার আসসালামু আলাইকুম।
– ওয়া আলাইকুম আসসালাম, কেমন আছো তুমি?
– জ্বি আলহামদুলিল্লাহ,
– কতদূর এসেছো তোমরা?
– ঘন্টাখানিক হলো বরিশাল ঘাট থেকে ছেড়েছে তাই পথের অনুমান আমার পক্ষে বলা অসম্ভব।
– সবাই সাবধানে থেকো।
– কেন স্যার?
– ঝড়ের সৃষ্টি হতে পারে তাছাড়া বিপদআপদ তো কখনো বলে আসে না, তাই না?
– জ্বি স্যার ঠিক বলেছেন।
– যেভাবেই হোক ভালোয় ভালোয় মোহনা আর তার মা ভাই ফিরে আসলেই বাঁচি।
– আর আমি?
– তোমার ঢাকা আসাও যা, না আসাও তাই কারণ তুমি তো চট্টগ্রামে চলে যাবে।
– তা ঠিক।
– আচ্ছা রাখলাম তাহলে?
– ঠিক আছে ভালো থাকবেন স্যার।
|
|
– মোবাইল কাটার সাথে সাথে একটা লোক আমার সামনে দাঁড়িয়ে বললোঃ- আরে স্যার আপনি?
– বললাম, আমাকে বলছেন?
– হ্যাঁ স্যার, চিনতে পারছেন না আমাকে? আমি তো আপনাদের কোম্পানিতে কাজ করি।
– আমি মনে করার চেষ্টা করছি কিন্তু সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিকে চিনতে পারছি না। তবুও বললাম, আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে কারণ আমি আপনাকে চিনতে পারছি না।
– আরে না স্যার, আমি সাভারের ফ্যাক্টরিতে কাজ করি, ছোটখাটো স্টাফ তাই চিনতে পারছেন না। কিন্তু আপনি যখন মাঝে মাঝে আমাদের অফিসে যেতেন তখন দেখতাম আপনাকে। আপনি তো সেই উত্তরা হেড অফিসে থাকেন তাই আমাদের সাথে দেখা কম হয়। কিন্তু মাঝে মাঝে যখন যেতেন তখন তো দেখা হতো।
– লোকটার কথা মোটামুটি ঠিক আছে কারণ সাভার এর অফিসে আমি সত্যি সত্যি মাঝে মাঝে যাই। হতে পারে সেখানে কাজ করে কিন্তু আমি চিনতে পারছি না তাকে। বললাম, হতে পারে এমন তা আপনি কি কারণে এখানে? আর এখনো কি জব করেন?
– হ্যাঁ স্যার, ছুটিতে আসছিলাম বাড়িতে কারণ মা’র শরীর বেশি ভালো না। তিনদিনের ছুটিতে বাড়িতে এসে আজকে চলে যাচ্ছি, আগামীকাল সকালে গিয়ে অফিস করতে হবে।
– সারারাত ভ্রমণ করে আগামীকাল ডিউটি করতে পারবেন? কষ্ট হবে না?
– কিন্তু কিছু করার নেই স্যার গরীব মানুষের জীবন তাই চলছে কষ্টের মাঝে।
– আচ্ছা তাহলে চলুন আমার কেবিন বুকিং করা আছে সেখানে বসে গল্প করতে করতে যাবো। আর আমাদের এমডি স্যারের পরিবার এই লঞ্চে আছে।
– তাই নাকি স্যার? কিন্তু আমার কাছে তো লঞ্চের ছাঁদে বসে যেতে খুব ভালো লাগে। তাই এখানেই বসে বসে গল্প করতে চাই, আপনার ঘুম পেলে আপনি চলে যাবেন।
– তাহলে চলুন আগে ক্যান্টিনে গিয়ে গরম চা খেয়ে আসি তাহলে জমবে জবর।
– ক্ষমা করবেন স্যার আমি চা খেতে পারি না তবে বেশিরভাগ সময় দুধ খাই। আমার স্ত্রী ফ্লাক্স ভর্তি করে গরুর দুধ দিয়েছে আর ময়দা দিয়ে রুটি তৈরি করে দিয়েছে। আপনার আপত্তি না থাকলে আপনি আর আমি সেই দুধ দিয়ে ভিজিয়ে ভিজিয়ে রুটি খেতে পারি।
– না না আপনি খান সমস্যা নেই কারণ আপনার জন্য দিয়েছে সেখান থেকে আমি খেলে কম হবে আপনার।
– না স্যার কম পরবে না, বরং আপনার সাথে বসে বসে খেতে পারলে ভালো লাগবে। প্লিজ না করবেন না স্যার।
– কিন্তু…
– কোন কিন্তু নেই স্যার, আমার ব্যাগের ভেতর সব আছে।
লোকটা সাথে সাথে বসে গেল, ব্যাগ থেকে একটা একটা করে সবকিছু বের করছে। আমার হাতে একটা পানির বোতল দিয়ে বললোঃ- সাইডে গিয়ে হাত ধুয়ে ণসেন স্যার। আমি বোতল নিয়ে লঞ্চের পাশে গিয়ে নদীর দিকে হাত বাড়িয়ে পানি ঢেলে ধুয়ে নিলাম। তারপর তার কাছে ফিরে তাকিয়ে দেখি সবকিছু সাজিয়ে বসে আছে।
চলন্ত লঞ্চে মাথার উপর চাকচিক্যময় চন্দ্রের উজ্জ্বল আলোয় বসে তিরতির করে বাতাসে ভ্যাপসা গন্ধে বসে খাবার প্রোগ্রাম। ছোট্ট একটা বাটিতে গরম দুধ আর পাশে তিনটা রুটি, আমি হাত বাড়িয়ে ছিড়ে ছিড়ে খেতে আরম্ভ করেছি। খেতে খেতে তার সাথে অনেক গল্প হলো, এতক্ষণ পরে তার নাম জিজ্ঞেস করে জানলাম। তার নাম সালাউদ্দিন ফিরোজ।
রুটি শেষ করে অবশিষ্ট দুধটুকু চুমুক দিয়ে শেষ করে নিলাম, তারপর তার দিকে তাকালাম। সে সবকিছু গুছিয়ে রাখতে ব্যস্ত।
– বললামঃ- এমন ভ্রমণ সবসময় কপালে থাকে না সালাউদ্দিন সাহেব, ধন্যবাদ এমন একটা সুন্দর মুহূর্ত স্মৃতি কর দেবার জন্য। বহুদিন পেরিয়ে গেলেও আমি আপনার কথা স্মরণ রাখবো।
আধা ঘণ্টা পরে মনে হচ্ছে আমার চারিদিকে সব ঘুরে যাচ্ছে, হঠাৎ করে হাত পা অবশ হয়ে গেছে মনে হয়। বসা থেকে ইচ্ছে করে চাইলেও উঠতে পারি না। ক্রমে ক্রমে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি, বমি করতে পারলে মনে হয় ভালো হতো। আমি বসা থেকে আস্তে আস্তে লঞ্চের ছাঁদে শুয়ে পরলাম। চারিদিকে সালাউদ্দিন ফিরোজকে দেখা যাচ্ছে না, সে আমার জন্য একটা পান কিনতে গেছে কিন্তু এখনো আসে নাই।
– হঠাৎ করে মাথার কাছে সালাউদ্দিনকে দেখতে পাচ্ছি কিন্তু তার কথা শুনে অবাক হলাম। আমাকে বললেন, কি খবর সজীব সাহেব? এতক্ষণে তাহলে ঔষধে কাজ শুরু করেছে?
– বললাম, মানে কি?
– ক্ষমা করবেন স্যার, আমি আপনার খাবারের মধ্যে কিছু ওষুধ মিশিয়ে আপনাকে আধমরা করার ব্যবস্থা করেছি।
– কিন্তু কেন? আমি তোমার কি করেছি? তোমার সাথে তো আমার শত্রুতা নেই তাই না? কেন করলে এমনটা?
– আপনাকে যাতে সহজে হাত পা বেধে নদীতে ফেলতে পারি তাই এমনটা করেছি। যদি সুস্থ থাকতে তাহলে তো ফেলতে পারবো না তাই না? সেজন্যই আগে থেকেই দুর্বল করে নিলাম, এখন আপনার হাত পা বেধে নদীতে ফেলে দেবো।
– আমার অপরাধ?
– চেয়ারম্যান বাড়ির খুনের রহস্য সমাধানের জন্য বেশি চালাকি করার জন্য এ শাস্তি। নিজেকে বড় গোয়েন্দা মনে করেন তাই না? এখন আপনার লাশ এই নদীর মধ্যে পচে যাবে, নদীর মাছ আপনার শরীর খাবে।
– কে পাঠিয়েছে তোমাদের?
– আছে একজন, তার নামটা জানতে চান?
– আমি তার নাম জানি।
– তবুও মৃত্যুর আগে তার সাথে একটু ফোনে কথা বলেন কারণ তিনি আপনাকে মরার আগে কিছু উপদেশের বানি বলবেন।
আমি লঞ্চের ছাঁদে শুয়ে আছি নিরুপায়, সবাই মনে হয় ভাবছে আমি এমনিতেই শুয়ে আছি। চিৎকার করে কাউকে ডাকতে পারছি না, জিহ্বা নড়ানোর শক্তি অবশিষ্ট নেই। চারিদিকে মৃত্যুর আগমন দেখা যাচ্ছে মনে হয়।
লোকটা পকেট থেকে মোবাইল বের করে কল দিয়ে আমার কানের কাছে ধরলো। আমার ধারণা সঠিক ছিল, অপরপ্রান্তে যিনি কথা বলছেন তাকে সত্যি সত্যি চিনতে পেরেছি।
চলবে…..
লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)