#একান্নবর্তী
#সপ্তম
#শম্পাশম্পি চক্রবর্তী
#বড়গল্প
@copyright protected
কয়েকটা মাস কেটেও যায় । শিউলি কে আমি বা মা দুজনেই লক্ষ্য করতাম বেশ অন্য রকম। যে শিউলি সাজতে ভয় পেত কেউ যদি ওকে পেত্নি বলে সে ই মেয়ে মুখে পাউডার ঘষে, ভালো ভালো সালোয়ার কামিজ যা আমি একান্ত আমার জন্য কিনতাম সেগুলো আলমারি থেকে বার করে তা আমাকে না জানিয়েই পরে নিয়ে চোখে কাজল ,ঠোঁটে লিপস্টিক বলতে পারো নিজেকে যতদূর সুন্দর করে কারো সামনে দাঁড়ানো যায় তেমন ভাবেই সেজে কখনো কলেজে ,কখনো বন্ধু ‘র বাড়ির নাম করে বেরিয়ে যেত। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হতো। মা বেশ চিন্তা করতো। বাবা কে জানালে বাবা উদাসীন থাকতো। মেজো,সেজো বা ছোট কাকিমনি রা মা কে বলতো ” দিদি মেয়ে মানুষ কালো হোক্ আর কুলো হোক্ মেয়ে মানুষের শরীরের প্রতি পুরুষের নজর থাকেই। তাই শিউলি কে এতো স্বাধীনতা দিও না যা পেয়ে ও কোনো ভুল করে বসে। এতো রাত করে বাড়ি ফেরা কখনোই সমর্থন কোরো না।” মা সব শুনে আমাকে বোলতো ” তুই কী কিছু জানিস ইদানিং শিউলি কোথায় যায়? কার সাথে মেলামেশা করে ?” আমি সত্যিই জানতাম না। কারণ কোনো দিন এ প্রশ্ন আমার মনে অন্তত জাগেনি শিউলি কারো সাথে প্রেম করতে পারে। কোথাও গেলে শিউলি ওর কোনো বন্ধুর বাড়ি ই যাবে। কিন্তু সত্যি টা বেশি দিন চাপা থাকলো না। আমাদের পারিবারিক খুব ঘনিষ্ঠের বিয়ের অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ এলো সামনে। আমরা এইসব নিমন্ত্রণে বাড়ি দেখার দায়িত্ব পাড়ার কোনো দাদা কে দিয়ে চলে যেতাম। এই বিয়ের অনুষ্ঠানেও সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু হঠাত্ করে শিউলি জানিয়েছিল ও বিয়েতে যাবেনা। ওর না কী শরীরটা ভালো নয়। মা বলছিল ” তুই একা এতো বড় বাড়িতে থাকবি? তাছাড়া তুই থাকলে তো পাড়ার কোনো কারোকে বাড়ি দেখার দায়িত্ব দিয়ে ও যেতে পারবোনা। সোমত্ত মেয়ে তুই। ”
” মা আমি আর সোমদত্তা থাকবো কোনো চিন্তা কোরোনা। কলেজের কিছু লেখা বাকী আছে দুজনে লিখবো আর টিভি দেখবো সময় কেটে যাবে। তাছাড়া তোমরা তো রাত এগারোটা বা বারোটার মধ্যেই চলে আসবে। ” শিউলি এমনি জানিয়েছিল। অগত্যা দুই বন্ধু যখন থাকবে তখন না থাকার তো কিছু নেই। আর সত্যিই তো রাত এগারোটা বা বারোটার মধ্যেই চলে আসা। শিউলি কে রেখেই আমরা বাড়ির সকল সদস্য সেদিন চলে গিয়েছিলাম বিয়ে বাড়িতে । যখন ফিরি রাত বেশ প্রায় সারে এগারোটা তো হবেই। বাড়ি ঢুকেই মা আর আমি সোজা চলে আসি আমার আর শিউলির ঘরটাতে। দেখি ও অদ্ভুত সুন্দর সেজেগুজে বসে আছে। বিশেষ করে ও মায়ের বিয়ের লাল বেনারসি টা পরে বসে আছে যেন নতুন বৌ। কেমন যেন সন্দেহ হলো মায়ের, ওর সুন্দর সাজের মধ্যে কিছু যেন খুঁজে পাওয়াতে বলে উঠল ” শিউলি তোকে এমন লাগছে কেন? চুল,চোখ,মুখ এমন বিধ্বস্ত!”
” কৈ না তো আমি ঠিক আছি। এই তোমরা আসছিলেনা বলে কী আর করবো সাজছিলাম। আমার সাজতে খুব ভালো লাগে এখন। ”
” তুই এই শাড়িটা পরেছিস কেন? কে দেখতে আসবে তোকে যে এই শাড়িটা পরে ছিস এতো রাতে? সোমদত্তাই বা কোথায় গেল ? ওর তো তোর সাথে থাকার কথা ছিলো। ”
” ছিলো তো একটু আগেই চলে গেছে। বললো বাড়ি যাই। তোর বাড়ির সকলের ফেরার সময় হয়ে গেছে।” মা যেন শিউলির কোনো কথাই বিশ্বাস করতে পারছিলো না। আসলে শিউলির অদ্ভুত সাজটাই মা কে চিন্তিত করেছিল । কিন্তু কেন তা অনেক পড়ে বুঝেছিলাম ।
মাস খানেক বা তার বেশি সময়ের ঘটনা। সঞ্জীব দা একদিন এসে মা কে বা বাড়ির সকলকে ডেকে জানালো ” আর তার এই বঙ্গ রাজ্যে থাকা হচ্ছে না আগামী দু দিনের মধ্যেই সে আমেরিকায় চলে যাচ্ছে । ওখানে একটি কোম্পানিতে বড় চাকরি পেয়েছে। ” শুনে আমার মা তো বটেই বাড়ির সকলেই খুশি। সকলের মুখে একটাই কথা ” তুমি ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। তোমার মতো মেধাবী ছেলেরাই তো দেশের নাম উজ্জ্বল করতে বিদেশে পাড়ি দেয়।”
শিউলি তখন উপস্থিত ছিলো না।
সঞ্জীব দা যে বিদেশে চলে যাচ্ছে ও শুনেছিল কলেজ থেকে ফিরে মায়ের মুখে ” জানিস শিউলি আমাদের সঞ্জীব বিদেশে যাচ্ছে । আমেরিকায়। আজ মিষ্টি নিয়ে এসে ছিল। মেজো কাকিমনি ‘র কাছে যা মিষ্টি খেয়ে আয়। হবে না অমন ভালো ছেলে আমেরিকা যাবে না তো কে যাবে ?”
” মা, কে আমেরিকা যাচ্ছে বললে?” শিউলির চোখেমুখে ঘোর বিস্ময়।
” কেন সঞ্জীব । যে তোর দিদি কে অঙ্ক করাতে আসে। তোর বড় দা র বন্ধু । এখন ও চলে যাচ্ছে অন্য অঙ্কের টিচার রাখতে হবে রাইয়ের জন্য। ”
” মা তুমি ঠিক বলছো ? সঞ্জীব দা আমেরিকায় চলে যাচ্ছে ? কিন্তু আমার তাহলে কী হবে মা ? ” মা হতভম্ব ।
” এ সব কী বলছে শিউলি ? সঞ্জীব চলে যাওয়ার সাথে ওর কী আসে যায়?”
” মা এ হতে পারে না। আমি সঞ্জীব দা কে ভালোবাসি। সঞ্জীব দা ও আমাকে ভালোবাসে। বিশ্বাস করো মা আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি। সঞ্জীব দা আমাকে না জানিয়ে কোথাও যেতে পারে না।”
মা সজোরে একটা থাপ্পড় মেরে ছিল শিউলির গালে। থরথর করে কেঁপে উঠেছিল ওর ঠোঁট দুটো। কাতর কন্ঠস্বরে বলে উঠেছিল ” তুমি বিশ্বাস করছো না কেন ? তুমি একবার সঞ্জীব দা কে ডেকে পাঠাও। ও নিজে মুখে বলবে আমাদের ভালোবাসার কথা। এ তো চরম সত্য মা এতে কোনো মিথ্যা নেই। ”
” শিউলি সঞ্জীব দা একজন মেধাবী, সুচরিত্রের ছেলে তাকে নিয়ে এসব কথা বলা বন্ধ কর্। আমি কখনো বিশ্বাস করি না সঞ্জীব দা তোকে ভালোবাসতে পারে?” কথাগুলি আমি বলে উঠতেই ও চিৎকার করে বলে উঠেছিল ” কেন ও বুঝি তোকে একা পছন্দ করবে এটাই তুই চাস্ তাই তো দিদি? আমি কালো,কুৎসিত আমাকে কেন পছন্দ করবে? যদি আমাকে পছন্দ না ই করবে তাহলে সেদিন সারা সন্ধ্যেটা আমাকে ই ভালোবেসে গেল কী করে ?”
” শিউলি কী বলছিস তুই? কোন্ সন্ধ্যের কথা বলছিস যেদিন সঞ্জীব তোকে ভালোবেসে গেছে? আর সে ভালোবাসা কেমন ভালোবাসা ছিলো? তোর শরীরে হাত দেয় নি তো ও ? বল্ শিউলি বল্ সব খুলে বল্।” মায়ের কন্ঠস্বর ভীত।
” শিউলি’র চোখেমুখে অদ্ভুত খুশির ঝিলিক খেলে গেল। বলে উঠল” মা আমার দু মাস পিরিয়ড বন্ধ। সোমদত্তার সঙ্গে একজন লেডি ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম তিনি বললেন ” আমি ,,,,” বুঝলাম মা নিজেকে আর সামলাতে পারবেনা। এবং তাই হলো আবারো সজোরে একটা থাপ্পড় কষিয়ে দিলো শিউলির গালে মা।
বলে উঠল “,পেত্নি, হতচ্ছাড়ি তোর মরণ হয় না কেন? পরিবারের মুখ পুড়িয়ে ছাড়লি। যা মর্ গিয়ে । এ কী করলি তুই শিউলি?”
শিউলি মনে হয় বুঝে উঠতে পারে না মায়ের আচরণ তার প্রতি এমন রূঢ হলো কেন? সে তো কোনো ভুল করেনি। সে তো ভালোবেসেছে । ভালোবাসা তে অন্যায় কোথায়? এই পৃথিবীতে সকলেই তাকে কালী,পেত্নি, বলে আম্মার পর ওই একজনই তো আছে সে হলো সঞ্জীব দা যে তার সারা শরীরে ভালোবাসার ছোঁয়া এঁকে দিতে দিতে বলেছে ” কে বলেছে তুমি কুৎসিত,তুমি পেত্নি? আমার চোখে তুমি সুন্দর শিউলি খুব খুব সুন্দর।”
#ক্রমশ