একান্নবর্তী পর্ব- ৬

0
426

#একান্নবর্তী
#বড় গল্প
#ষষ্ঠ
#শম্পাশম্পি চক্রবর্তী
@copyright protected
বাক্স টা এক সময় কী রঙের ছিল তা আজ আর মনে নেই রাইয়ের। আর এখন তো জং ধরে তার ওপর ধুলোর আস্তারণ সব মিলিয়ে কদাকার চেহারা নিয়েছে বাক্সটা। ঘরের এদিক ওদিক তাকিয়ে ও বাক্স টি মোছার মতো কোনো কিছু না পেয়ে নিজের দামী শাড়ির আঁচল দিয়েই ভালো করে সেটি মুছে ফেলল রাই। তারপর সেটি ছোট্ট চার চৌকো আকারের টেবিলটার ওপর থেকে তুলে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দ্রুত পা বাড়াতে গেলে প্রচণ্ড একটা ধাক্কা । ছিটকে পড়লো বাক্স টা সমেত রাই। সন্ধ্যে নেমে এসেছে। চাপ চাপ অন্ধকার ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে ঘরটা জুড়ে । কে যেন তার কাঁধে আলতো হাত ঠেকালো। কী হিমশীতল স্পর্শ । গলার ভেতরটা কাঠ হয়ে আসছে। জল জল একটু জলের খুব প্রয়োজন । অতিকষ্টে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে রাই বলে উঠল ” কে ? কে ?”
” দিদি আমি । আমি শিউলি । আমি যে বাঁচতে চেয়ে ছিলাম দিদি। আমি যে বাঁচতে চেয়ে ছিলাম। আমি কুৎসিত । তা বলে কী বাঁচার কোনো অধিকার আমার ছিলো না? আজ ও যে আমি বাঁচতে চাই দিদি।” থরথর করে কাঁপতে লাগল রাই। তার কন্ঠ রোধ হয়ে আসছে। ” শিউলি শিউলি এসেছে। না না তা কেমন করে হয়? শিউলি তো,,,,। সৌরভ সৌরভ”।
চিৎকার করে উঠলো রাই ”
সৌরভ তুমি কোথায় ।
সৌরভ।”
না তারপর আর কিছু মনে নেই রাইয়ের। জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। যখন জ্ঞান ফিরেছিল তখন সে তার কলকাতার বাড়িতে তার আর সৌরভের নিজস্ব বিছানায়। মেয়ে তৃণা আর তোর্সা মাথার শিয়রে দাঁড়িয়ে থেকে ছিল অনেকক্ষণ । কিছু সময় আগে সৌরভ ওদের চলে যেতে বলাতে ওরা নিজ ঘরে চলে যায় বিশ্রাম নিতে।
রাত বেশ গভীর।
এদিক ওদিক তাকালো রাই।
বলে উঠল ” শিউলি আমি শিউলি কে অনুভব করেছি। ওর কন্ঠস্বর শুনেছি। সৌরভ তুমি কোথায় বিশ্বাস করো শিউলি কে আমি অনুভব করেছি। ও আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিল ।” মেয়েরা নিজ ঘরে চলে যেতে সৌরভ রাইয়ের মাথার শিয়রে বসে এতো টা সময় ধরে রাইয়ের জ্ঞান আসার অপেক্ষায় ছিল। জ্ঞান ফিরতেই আলতো করে কপালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে ওঠে ” ওটা তোমার ভ্রম রাই। শিউলি মৃত। তাকে কেমন করে তুমি অনুভব করবে ? আর কন্ঠস্বর ! তা কখনো সম্ভব ! তোমরা ব্যারাকপুরে চলে যাওয়ার পর ও ওই বাড়িতে তোমার কাকাদের পরিবার বছর খানেক ছিল। তাহলে তারাও তো উপলব্ধি করতো কোনো না কোনো সময় । আসলে আজ সারা দিন ওই বাড়িতে তুমি শিউলিকেই খুঁজে গেছ আর তার থেকেই তোমার মনের মধ্যে শিউলির প্রবেশ ঘটেছে প্রবল ভাবে। আর তাতেই ওকে অনুভব করেছ, ওর কন্ঠস্বর শুনেছ বলে মনে হচ্ছে । ”
” না না সৌরভ মিথ্যা নয় শিউলি আছে ওই বাড়ির ওই ঘরটাতে। ও যে আজও কেঁদে চলেছে দুঃসহ অপমানের জ্বালা বয়ে নিয়ে । ও যে মরতে চায়নি। ওর মৃত্যুর জন্য যে আমরা সকলেই দায়ী সৌরভ। কেউ ওকে আমরা বিশ্বাস করিনি। সঞ্জীব দা যে অন্যায় করেছিল ওর ওপর তার প্রকৃত শাস্তি পাওয়ার কথা ছিল সঞ্জীব দা র অথচ শাস্তি পেল শিউলি। কারণ আমরা সঞ্জীব দা কে বিশ্বাস করেছি শিউলি কে নয়। ”
” মানে ? তুমি আমাকে বলতে পারো রাই শিউলি কেন সুইসাইড করেছিল বা তোমার মতে যা খুন। যদি তোমার কোনো অসুবিধা না থাকে। ”

সৌরভের কথাগুলির প্রত্যুত্তরে রাই একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। বলে উঠল ” বলবো সৌরভ বলবো। কারণ আজ না বললে আমরা যে সকলেই কোন না কোনো ভাবে শিউলির মৃত্যুর জন্য দায়ী তা কখনো বলা হবে না। মেয়ে টা যে সত্যিই বাঁচতে চেয়েছিল। আমরাই ওকে নিজেদের একান্নবর্তী পরিবারের কলঙ্ক চাপা দিতে মৃত্যুর পথ বেছে নিতে বাধ্য করেছিলাম । শুধু সঞ্জীব দা নয় আমরা সকলেই খুনী। আর সেই খুনের দায় আর বহণ করতে পারছি না। আজ তোমাকে সবটুকু বলে শান্তি পেতে চাই। শোনো তাহলে আজ থেকে তিরিশ বছর আগের বা তার থেকে একটু বেশি সময়ের ঘটনা। আমার মেজো কাকার ছেলে আমাদের পরিবারের যে বড় দাদা অংশুমান তারই বন্ধু ছিল সঞ্জীব দা। অসম্ভব সুন্দর দেখতে তেমনি পড়াশোনায়। বলতে গেলে সঞ্জীব দা যে কোনো মেয়ের হৃদয় এক মুহূর্তে দখল করে নিতে পারতো এমনি সুদর্শন আর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন । আমি বা শিউলি দু’জনেই তখন কলেজের প্রথম বর্ষ ।

মূলত আমার জন্যই সঞ্জীব দা আমাদের বাড়িতে আসতো। কারণ আমার তখন অঙ্কে অনার্স। আর আমাকে অঙ্ক বুঝিয়ে দিতেই সপ্তাহে দু’ দিন আসতো সঞ্জীব দা। তখন সঞ্জীব দা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। শিউলি বাংলা অনার্স । তাই বলা যেতেই পারে শিউলির সাথে কোনোভাবেই যোগাযোগ হওয়ার বা কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠার পথই ছিল না সঞ্জীব দা’র সাথে। কিন্তু তবুও কেমন করে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তা আমার জানার বাইরে থেকে গিয়েছিল । যতটুকু আমরা শিউলির মুখে শুনেছিলাম ওদের সম্পর্ক বিষয়ে তা অনেক পরে যখন শিউলির জীবন তছনছ হয়ে গেছে আর ও মনে মনে এক প্রকার আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়ে ছিল।

আসলে সঞ্জীব দা কে মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছিল শিউলি কখন আর কিভাবে তা ওর জানা ছিল না। সঞ্জীব দা আমাকে পড়াতে আসলে শিউলি নানা ছুতোয় বৈঠকখানা ঘরে ঢুকে আসতো। যেখানে মা চা করে এনে দেওয়ার কথা সেখানে শিউলি নিজে হাতে চা করে সঞ্জীব দা কে দিতে আসতো। নানা অছিলায় কথা বলার চেষ্টা করতো। প্রথম দিকে মনে হতো আমার, সঞ্জীব দা শিউলি কে মোটেও পছন্দ করে না। নেহাত মেয়ে টা কথা বলতে আসে তাই কথা বলে। কিন্তু ব্যাপারটা কিছুদিন বাদে থেকে উল্টো দেখলাম। সঞ্জীব দা আমাকে অঙ্ক শেখাতে যতো না মনোনিবেশ দেখাতো তার চাইতে ঢের বেশি শিউলির সাথে কথা বলতে ভালোবাসতো। মনে মনে বেশ অবাক হতাম। সঞ্জীব দা’র মতো অতো হ্যান্ডসাম, বুদ্ধিমান, সর্বোপরি ব্রিলিয়ান্ট ছেলে সামান্য শিউলির মতো অতি সাধারণ কালো পেত্নি ‘র মতো দেখতে মেয়ে টার সাথে কথা বলতে এতো ভালোবাসে? আশ্চর্য! কথাটা মা কে একদিন বলতেই মা বলে উঠেছিল ” কী বলছিস সঞ্জীব শিউলি কে পছন্দ করে ? ধ্যুৎ তা কখনো হতে পারে? আসলে শিউলি কথা বলতে ভালোবাসে আর ওর কথাগুলো তো জানিস কতো মিষ্টি সুরে তাই হয়তো সঞ্জীব শুনতে পছন্দ করে। ওসব আবোলতাবোল ভাবতেও যাস্ না। শিউলি কে সঞ্জীব পছন্দ করে যে কেউ শুনলে হাসবে।”

মায়ের কথাগুলো আমারো মনে হলো ঠিকই। শিউলি কে সঞ্জীব দা ভালোবাসা তো দূর নিজের কাছেই ঘেঁষতে দেবে না। আমি হলে না হয় কথা হতো। সঞ্জীব দা’র সাথে আমাকেই যে মানায়।”
#ক্রমশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here