আমার বিয়ের সমন্ধ আনলেন সেজ মামা। উনি পুরান ঢাকায় থাকেন। পাত্রী মামার প্রতিবেশীর মেয়ে। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছেন। তাই মেয়ের সব ব্যাপারে মামার একশো পারসেন্ট গ্যারান্টি।
আব্বার শরীর বেশ কিছুদিন যাবৎ খারাপ যাচ্ছে। তাই আব্বা আর বিয়ে নিয়ে বেশি তথা বার্তায় গেলেন না। এক শুক্রবার রুহির সাথে আমার আকদ হয়ে গেল। আব্বা, আমার শ্বশুরকে বলে আসলেন – মেয়ে আপাতত আপনার বাড়িতেই থাকুক, শুভক্ষণ দেখে মেয়ে একেবারে নিজের ঘরে নিয়ে তুলবো।
এরপর আমরা নানান সমস্যায় পড়ে গেলাম। আব্বার অসুখ বেড়ে গেল। ডা. বললেন – আব্বার কিডনি ঠিকমতো কাজ করছে না। ফ্লাটের ইন্সটলমেন্ট দিতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠলো। আমি নতুন চাকরিতে জয়েন করেছি। আমি নিজের হাত খরচ কিছু রেখে পুরো টাকাই আম্মার হাতে তুলে দিতে থাকলাম। তারপরেও আম্মার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল আম্মা কিছুতেই কুলিয়ে উঠতে পারছেন না।
একদিন অফিস থেকে ফিরে দেখি আব্বা যেন কেমন করছেন। দ্রুত আব্বাকে হসপিটালে নিলাম। এতো ব্যস্ত ছিলাম। রুহিকে একটা খবর পর্যন্ত দেয়া হয়নি।
আমার ছোট বোন দীপা, এসব দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করে। এই মাঝরাতেও রুহি এলো ওর বাবার সাথে।
বিয়ের প্রায় পাঁচ মাস হয়ে গেছে। এরপর রুহির সাথে আজ আমার প্রথম দেখা। আমি অস্বস্তি নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম।
– রুহি আমার সাথে এককাপ চা খাবে? রুহি ঘাড় নাড়লো, তারমানে সে খেতে চায়। আশেপাশে কোনো ভাল চায়ের দোকান নেই। একটা টংঘর মতো দোকান দেখা যাচ্ছে,, সেখানে দুটি মাস্তান টাইপ লোক শব্দ করে চা খাচ্ছে, আর হাসাহাসি করছে। ওখানে রুহিকে নিয়ে বসতে ইচ্ছে হয়না।
রুহি এগিয়ে যায় তাই আমারো যেতে হয়। ওর হাতে ছোট্ট একটা ব্যাগ, ভ্যানিটির চেয়ে একটু বড়। আমার সেটা নেয়া উচিৎ কিনা বুঝতে পারিনা। ছোট ছোট পা ফেলে রুহি আগাচ্ছে। সামনে একটা জায়গায় কাদা। রুহি শাড়িটা একটু তুলে জায়গাটা পার হলো। এতেই রুহির ফর্সা পা খানিকটা দেখা গেলো। শেষ যেবার দেখা হয়েছিলো। রুহির পায়ে আলতা পড়া ছিলো। আজে পায়ে আলতা নেই, তবে নুপুর আছে। নুপুরজোড়া আমিই ই কিনে দিয়েছিলাম ।
বিয়ের দিন রুহিকে দেয়া আমার প্রথম উপহার।
প্রথম আর শেষ নয় কি?
রুহি চা খাচ্ছে, মাথায় ঘোমটা দেয়ায় ওকে বউ বউ লাগছে। বউই তো মাত্র কিছুদিন আগেই আমরা আয়নায় মুখ দেখাদেখি করার সময় লজ্জা পাচ্ছিলাম । বিয়ের পরে মাত্র একবার দেখা।। অনুষ্ঠান হয়নি, তাই বউ তুলে আনা হয়নি। সেই বউয়ের সাথে সবার সামনে কথা বলা যায়না।
পরদিন দুপুরে খুব ইচ্ছে হচ্ছিল দুজন একসাথে কোথাও খাই। লজ্জায় বলতে পারিনি। দীপা হঠাৎ খেয়াল করে ব্যাপারটা। মায়ের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বলে। দাদা তুই ভাবিকে নিয়ে আব্বার বাকি ওষুধগুলো কিনে নিয়ে আয়।
সেই ওষুধ কিনতে গিয়েও এক লজ্জা ১২০ টাকা কম পড়লো। কী লজ্জা ! বললাম – ঠিক আছে পরে নেই। – ওমা পরে নেবে কেন, এখুনি নাও। বলে দুটি ১০০ টাকার নোট বের করে দিলো রুহি। রুহির কাছ থেকে টাকা নিতে লজ্জা লাগছিল। এখনতো টাকাও শেষ, দুপুরের খাওয়া যায় কি করে? অবশ্য সাথে এটিএম কার্ড আছে।
এমন সময়ে, রুহি নিজেই বলে – আমি যদি তোমার সাথে আজ দুপুরে ভাত খেতে চাই, কোন সমস্যা আছে? আমিই দাওয়াত করলাম তোমায়। বিয়ের সময় শাড়ি কেনার জন্য বড়খালা পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। পুরোটাই আছে। আসো দুজন কিছু খাই। ভাতের রেস্টুরেন্টগুলো সাধারণত নোংরা হয়। এই রেস্টুরেন্টটা বেশ পরিস্কার। রুহি চার্ট দেখে অর্ডার দিলো। ভাত চার পদের ভর্তা, ছোট মাছ, গরুর মাংস আর ডাল।
ও খাচ্ছে খুব আস্তে আস্তে, একসময় লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল- আমি যদি একবার তোমার মুখে ভাত তুলে দেই, তুমি কি রাগ করবে? আমি মৃদু হেসে মাথা নাড়লাম। – না রাগ করবো না। আমার মুখে খুব সাবধানে ভাত তুলে দিতে দিতে রুহি কাঁদছিল। ওকে সান্তনা দেবার ভাষা আমার নেই। আমি বুঝি একা ও খুব কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু আমি কি করবো। আমি আজকাল স্বপ্ন দেখতেও ভয় পাই। আসলে স্বপ্ন না দেখতে পারার মাঝেও বাস্তব কিছু কারণ থাকে।
প্রায় নয় মাস হাসপাতাল, বাড়ি করে, আব্বা মারা গেলেন। আমি যথাসাধ্য আব্বার চিকিৎসা করিয়েছি। এর মাঝে রুহির সাথে দুবার দেখা হয়েছে । সে ভাবে কথা হয়নি। একদিন আব্বার ভীষণ শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। আমার অফিসে ফোন গেলো। বাসায় এসে দেখি রুহিও এসেছে। আমাদের বাড়িতে ও প্রথম এলো। আমি আব্বার অক্সিজেন আর ডাঃ আনা নিয়ে ব্যস্ত। ডাঃ এসেই হাসপাতালে নিয়ে আসতে বললেন। এম্বুলেন্স ভর্তি মানুষ। শুধু আমি বাইরে। রুহি বললো আসো আমরা রিক্সায় যাই।
রিক্সায় যাচ্ছি, মাথায় দুশ্চিন্তা, কি দিয়ে কি হবে।
রুহি একসময় কথা বলে উঠলো। – জানো আজ একটা বিশেষ দিন।
– মনে নেই, কি দিন আজ?
– আজ আমাদের বিয়ে বার্ষিকী। জানো আল্লাহ্র কাছে বলেছি, আল্লাহ আজ যেন আমাদের দেখা হয়।
– হুম, দেখা তো হলো। কিন্তু কি বিপদ না জানি কপালে আছে।
– কিচ্ছু হবেনা। বলে রুহি ওর ভ্যানিটিব্যাগ খুলে আমার হাতে একটা প্যাকেট দেয়। – কি এটাতে?
– একটা শার্ট, তোমায় খুব মানাবে। আমার বুকের মাঝে ব্যাথা হতে থাকে। বেচারি কতো আশা করে থাকে। অথচ, আমি উপায়হীন। আজকের দিনটির কথা পর্যন্ত মনে ছিল না।
– সেবারের ধাক্কা বাবা সামলাতে পারলেন না। আমার প্রিয় বাবা, আমার শিক্ষক বাবা, বন্ধু বাবা, পৃথিবীতে নেই ভাবলেই বুকটা শুণ্য হয়ে যায়। সেদিন আর সবার মতো রুহিও খুব কাঁদছিল। কিন্তু মা কাঁদতে কাঁদতে এমন সব কথা বলতে লাগলেন যে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।
– বাবার মৃত্যুর জন্য নাকি রুহিই দায়ী। এমন বৌয়ের জন্যই আজ তার সোনার সংসার ছারখার হয়ে গেল। রুহি কান্না থামিয়ে অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে থাকলো। ওর চোখে রাগ না, আমি আহত পাখির ছটফটানো কষ্ট দেখতে পেলাম।
আজ চল্লিশ দিন আব্বা মারা গেছেন। রুমে ঢুকে দেখি একটা খাম। মনিরুল ইসলাম তার প্রথমা কন্যা, সাবিহা ফাতেমা রুহির পক্ষ থেকে আমাকে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন। উনি মিচ্যুয়াল ডিভোর্স চান উনার মেয়ের জন্য। কারণ চারটি- আমি স্ত্রীর ভরণ পোষণে অপারগ। আমার স্ত্রীর সম্মান রক্ষার ক্ষমতা নেই। আমি অসামাজিক। আমি অত্যন্ত বদ মেজাজি।
আমি কাপড় বদলে খানিকক্ষণ ফ্যানের নিচে শুয়ে থাকি। আমার কিছুই ভাল লাগেনা। অনেকদিন পরে ছাদে আসি। আর কিভেবে ছাদের সিমেন্টের মেঝেতেই শুয়ে পড়ি। রুহি তুমি কখনো জানলেই না কতখানি ভালবাসা তোমার জন্য জমা ছিল।
সকালে নাস্তার টেবিলে আমি মুখ তুলে তাকাতে পারিনা। আমার মনে হচ্ছে মুখ তুললেই মা আর দীপা সব বুঝে ফেলবে। ঘরে আরো ছোট দুটি ভাই আছে। ওদের কাছে আমি কি জবাব দেবো !
আমি কি আসলেই এমন। সারাদিন কেটে যায়। একসময় আমার বিশ্বাস হতে থাকে। আমার আসলেই বৌ নামের অলিক বস্ত ধরে রাখার ক্ষমতা নেই, আমি আসলেই বদমেজাজি, মন্দ মানুষ আমি। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে এলোমেলো ঘুরে বেড়াই। সারাদিন রোদে রোদে হাঁটি। সন্ধ্যায় পার্কের বেঞ্চিতে বসে থাকি। রাতে আবার রাস্তায় নামি। শ্যামলী থেকে হাঁটতে হাঁটতে টোলারবাগ আসি।
রাত প্রায় দশটা বাজে, সবাই হয়তো ঘুমিয়ে গেছে। ঘুমাক। কারো সাথে দেখা করতে চাইনা আমি। বাসায় বিদুৎ নেই।
আইপিএস ও নষ্ট। ছোটভাই দরজা খুলে দিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। আমি মোবাইলের আলোয় কাপড় বদলিয়ে বাথরুমে যাই। রুমটা ভর্তি পারফিউমের গন্ধ, দীপার কাজ। আজ হয়তো বাইরে যাবার সময় আমার রুমে এসে রেডি হয়েছে। অনেকখানি সময় নিয়ে সাবান ঘষে ঘষে গোসল সারি। সারাদিনের মন খারাপ আর রোদে পোড়া শরীরটাকে পানি দিয়ে ধুয়ে ধুয়ে সতেজ করতে চাই।
মাথা মুছে সোজা বিছানায়। বিছানায় আবার গন্ধ কিসের। আমি সোজা হয়ে শুতেই একটা নরম হাত এসে আমার হাতের উপর পড়ে। আর তখুনি রুমে আলো জ্বলে ওঠে। আমি নিশ্বাস বন্ধ করে চেয়ে দেখি আমার সামনে বসে আছে রুহি। আমার মিচ্যুয়াল ডিভোর্স চাওয়া মিষ্টি চেহারার স্ত্রী। আমি কিছু বোঝার আগেই সে আমাকে জড়িয়ে ধরে। ফুলের গন্ধের চেয়ে যে একটি মেয়ের গায়ের গন্ধ আলাদা, সেটা আমি প্রথম বুঝতে পারি। এদিকে দুমদাম দরজায় শব্দ হচ্ছে। দরজা খুলে দেখি দীপা দাঁড়িয়ে।
ও হাসতে হাসতে আমার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দেয়। – নাও ভাইয়া, ঢাকা টু কক্সবাজার টিকিট। রাত সারে এগারোটায় কল্যানপুর থেকে ছাড়বে। হাবিব ট্যাক্সি ডাকতে গেছে। তোমরা এখুনি বাসা থেকে বের হও। তোমার কাপড় ভাবি লেদারে ভরে নিয়েছে। আমি চুপচাপ তাকিয়ে থাকি।
বাস ছুটছে কক্সবাজারের দিকে। আমার কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে আছে রুহি। আজো ওর মাথায় ঘোমটা দেয়া। ওর ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখের দিকে চেয়ে অঝোরে কাঁদছে ওর অযোগ্য, অসামাজিক আর বদমেজাজি স্বামী।
#একদিন যদি
নিতু ইসলাম।