একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব ৩২+৩৩

1
2360

#একটি_নির্জন_প্রহর_চাই
৩২+৩৩
#WriterঃMousumi_Akter
ওনি দুটো হাত দিয়ে আমাকে কী দারুণ ভাবে আগলে ধরে রেখেছেন ওনার বুকের সাথে! নেশাক্ত আঁখিজোড়া আটকে আছে আমার মুখশ্রীতে।একবার ওনার এমন সর্বনাশা চাহনিতে চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নিলাম।লজ্জায় সম্পূর্ণ মিইয়ে যাচ্ছি আমি। লজ্জা আর ভালো লাগা দুটোই বিরাজমান আমার মাঝে।ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি নিয়ে ওনার বুক থেকে মাথা তুললাম।কিছুতেই ওনার মুখপানে তাকাতে পারছি না।এত লজ্জা!আমি এত লাজুক স্বভাবের সেটা ভাবতেই পারিনি!বিয়ের আগে ভাবতাম জামাই-এর সাথে জ্যোৎস্না বিলাসের সময় তার মুখপানে চেয়ে চেয়ে বলব, ‘ভালবাসি! ভীষণ ভালবাসি!আরও বেশি ভালবাসা এত দারুণ একটা রাত্রী উপহার দেওয়ার জন্য।’ কিন্তু না-একেবারেই সেটা হচ্ছে না।কল্পনা আর বাস্তবতার মাঝে কত তফাত তা অনুধাবন করতে পারছি।কল্পনায় প্রিয় মানুষের সাথে হাজারো ভালবাসার গল্প বলা গেলেও বাস্তবে তা ভিন্ন।সে পাশে এলে যে এত ভয়ানক লজ্জা ঘিরে ধরে জানা ছিল না।তাকিয়ে আছি অন্যদিকে।ফুরফুরে বাতাসে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছি।সেই সাথে নাকে ভেসে আসছে ওনার শরীরের পারফিউমের মিষ্টি ঘ্রাণ।পারফিউম উপেক্ষে করে ওনার শরীরের মিষ্টি ঘ্রাণটা যেন বেশি অনুভব করতে পারছি।মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকিয়ে দেখি ওনি তাকিয়েই আছেন আমার দিকে।এবার আমার আরও লজ্জা করছে!কোমর থেকে ওনার হাত সরাতে কোমরে ওনার হাতের উপর হাত রাখলাম।হাত সরানোর চেষ্টা করতেই ওনি আমার হাত চেপে ধরলেন। আস্তে আস্তে আঙুলের ভাঁজে আঙুল দিয়ে চেপে ধরে রাখলেন।কী ভয়ানক শিহরণ বইছে শরীরে!আমি হঠাৎ ওনার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম।মানুষটার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি।আবারও মুখে পড়া চুলগুলো আরেক হাত দিয়ে কানের নিচে গুজে দিলেন।তাতে লাভের লাভ কিছুই হলো না।সেকেন্ডের মাঝে চুল এসে আবার মুখের উপর পড়ল।ওনি ফুঁ দিয়ে চুল সরানোর চেষ্টা করছেন।আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছি সব।এই মানুষটাকে সম্পূর্ণ প্রেমিক লাগছে এখন।কে বলবে,এই মানুষটা সারাক্ষণ গম্ভীর থাকে!এই প্রেমিক পুরুষটির এমন প্রেমিকসুলভ আচরণ দেখলে যে- কোনো মেয়েই মুগ্ধ হবে।দু’জনের কারো মুখে কথা নেই;অথচ কথা না বলেই শরীর-মন জুড়ে বয়ে যাচ্ছে প্রেমময় কিছু অনুভূতি!কিছুটা মনের কাছাকাছি আসার গল্পের মতো।যার সাক্ষী এই নির্জন প্রহর আর আমরা দু’জন।

রিক্সা চলছে তার আপন গতিতে।চাঁদের নরম আলো,খোলা হাওয়া,চুল উড়ছে,আঙুলের ভাঁজে আঙুল,সাথে প্রিয় মানুষটার মায়াবী চাহনি!এই দৃশ্যটুকু আজীবন মনে রাখার মতো।এমন কোনো মুহূর্ত পেলে প্রতিটা মানুষের জীবনের-ই সেটা শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত হবে ।রিক্সা চলতে চলতে অনেক দূর এগিয়ে গেল।এখনো বেশি রাত হয়নি।অবশ আর ভারি হয়ে আসা কন্ঠে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘আমরা কতদূর যাচ্ছি?’
‘আমাদের আজ কোনো গন্তব্য নেই।’
‘গন্তব্য নেই?’
‘নাহ!পাশে তুমি আছো মানেই পৃথিবীর সব জায়গা সুন্দর, প্রতিটা স্থান সুন্দর, প্রতিটা মুহূর্ত সুন্দর। তাই নির্দিষ্ট কোনো গন্তব্য নেই।আমার পেছনে তাকানোর মতো কিছুই নেই।’
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি।ওনি সত্যি এসব বলছেন!আমাকে বলছেন!আমি অনিমেষ তাকিয়ে আছি ওনার দিকে।বাকরুদ্ধ,স্তব্ধ আমি!পৃথিবীর কিছুই আমার কাছে বোধগম্য হচ্ছে না।
এর-ই মাঝে রিক্সাটি একটা বাজারে প্রবেশ করল।বাজারটা বেশ বড়োসড়ো।এখনো সব দোকান খোলা।প্রতিটা দোকানে দোকানে লাইট জ্বলছে।চারদিক কেমন চকচক করছে।সামনেই চায়ের দোকান।এই এলাকার বিখ্যাত দুধ চা এই দোকানেই পাওয়া যায়।মানুষ যাতায়াত পথে গাড়ি থামিয়ে এক কাপ চা খেয়ে আবার যাত্রা শুরু করে।রিক্সাওয়ালা নেমে বললেন,
‘চা খাবেন?আলাউদ্দিনের বিখ্যাত চায়ের কথা শোনেননি?এটাই সেই দোকান।আইছেন যখন এক কাপ চা খেয়ে যান দু’জন।আমি খাওয়াব আপনাদের দু’জনরে।আসেন নেমে আসেন।’
ওনি মিহি কন্ঠে বললেন,
‘আপনি খেতে থাকুন।আমরা আসছি।’
রিক্সাওয়ালা নেমে চায়ের অর্ডার দিলো।ওনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘চা খাবে?’
‘চা খেতে আমার বেশি ভালো লাগে না।’
‘তাহলে কী ভালো লাগে বলো;সেটাই এনে দিচ্ছি।’
‘যা ভালো লাগে তা নেই এখানে।’
‘যেখানেই থাকে হুকুম করলে হাজির হয়ে যাবে।হুকুম তো করো।’
‘হুকুম করব?’
‘অবশ্যই রাণীরা সারাজীবন হুকুম-ই করে এসছে।’
‘আমি কি রাণী না-কি?
‘রাণী-ই তো।’
‘কীভাবে রাণী আমি?না আমি রাজকন্যা,না কোনো রাজপ্রসাদ আছে,না কোনো রাজার বউ আমি।’
মৃদু হেসে জবাব দিলেন,
‘রাণী হতে রাজ্য,রাজকন্যা,রাজার বউ কিছুই হওয়া লাগে না।নির্দিষ্ট কারো মনের রাজ্য দখল করে নিতে পারলে আর সেই রাজ্যর রাজার রাণী হতে পারলেই সেই আসল রাণী।এসব রাজাদের কিন্তু একাধিক রাণী থাকে না।কিন্তু যে রাজাদের কথা বললে তাদের একাধিক রাণী থাকত।আর এসব রাজারা মাত্র একজন রাণীকে বুকের মাঝে লালন-পালন করে।অসম্ভব ভালবাসে কখনো প্রকাশ করতে পারে আবার কখনো পারে না।তবে তার মুগ্ধতায় আটকে থাকে।এমন ভাবে আটকে থাকে আজীবনে আর বের হতে পারে না। পারে না আবার কী এরা তো বের-ই হতে চাই না!’আমি আবারও নিষ্পলক চাহনিতে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে।আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবারও প্রশ্ন করলেন,
‘কী চাই বলো।’
‘একটি নির্জন প্রহর চাই।’
‘এটুকু?’
‘হুম।এনে দিবেন?এত কোলাহল ভালো লাগছে না।চারদিকে কোলাহল ঝামেলা! কেমন অতিষ্ট হয়ে উঠেছি আমি।’
‘আমার সাথে একটি নির্জন প্রহরে যাবে?ভ** য় লাগবে না?’
‘কীসের ভ**য়?’
‘একটা প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের সাথে এত রাতে কোনো এক নির্জন নিরালয়ে যাবে!অনেক কিছুই তো হতে পারে।কী করবে তখন?’
‘অনেক কিছু হতে গিয়ে যদি দারুণ কিছু হয়ে যায় তাহলে তাই হোক।’
‘আপত্তি নেই তাহলে তোমা’
‘এত কঠিন কথার তো উত্তর দিতে পারব না।’
‘বুঝেছি এটাই সম্মতির লক্ষণ।একটি নির্জন প্রহর উপহার দিতেই তোমাকে আজ নিয়ে এসেছি।’
ওনি নেমে গেলেন।চায়ের দোকানের সামনের বেঞ্চে বসলেন।ধোঁয়া ওড়া চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন আর আমার দিকে তাকাচ্ছেন।কী সাংঘাতিক চাহনি!আমি এদিক সেদিক তাকাচ্ছি।চোখ গেল একটা দারুণ মনোমুগ্ধকর দৃশ্যতে।রোশান স্যারের বয়সী একজন লোক আর সাথে তার ওয়াইফ আর একটা বছর তিনেক বয়সের একটি মেয়ে।দাঁড়িয়ে আছে ফুলের দোকানের সামনে।সেখানে ঝুলছে বেলি ফুলের মালা।লোকটা কয়েকটা ফুলের মালা।নিয়ে ওনার ওয়াইফের হাতে পেঁচিয়ে দিলেন।হাতে একটু চুমু দিলেন সবার চোখ এড়িয়ে।ইশ! কী সুন্দর সেই দৃশ্য!আমারও ওনার হাত থেকে এভাবে মালা পরতে ইচ্ছা করছে।এর-ই মাঝে দেখি আরেকটি বাচ্চা ছেলেও কয়েকটা মালা কিনল।ওইটুকু একটা বাচ্চা কার জন্য মালা কিনল!হয়ত শখের বশেই কিনেছে।

এরই মাঝে আমার ফোনটা বেজে উঠল।ফোনের স্ক্রিনে ভাসছে তরীর নাম্বার।ফোনটা রিসিভ করে কানে দিতেই তরী বলল,

‘ভাবি ভালো আছেন?’
‘হ্যাঁ, তোমার কী অবস্থা বেবি?’
‘ভালো, বাট আজ একটা ভুল করে ফেলেছি।নিজের কাছে খারাপ লাগছে।’
‘কী ভুল?’
‘ট্রেনিং সেন্টার তো খানিকটা ভেতরে,ওখান থেকে কোনো অটো রিক্সা কিছুই পাচ্ছিলাম না।কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দেখি আপনার বন্ধু মৃন্ময় বাইক নিয়ে যাচ্ছে।আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল।খানিকটা দূরে চলে গিয়েও আবার ব্যাক এলো।’
‘হুম তারপর?’
‘তারপর আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ‘এখানে দাঁড়িয়ে আছেন,বাসায় যাবেন না?’
‘যাব বাট কিছুই পাচ্ছি না।রোহান আবার কাঁদবে!’
‘ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড,আমার বাইকে উঠতে পারেন।এগিয়ে দিয়ে আসি।’
‘না থাক ভাইয়া আমি যেতে পারব।’
‘পারবেন বাট,আপনার ছেলে কাঁদছে। ‘
‘কীভাবে জানলেন?’
‘পিহু বলল।’
‘আমাকে এক্ষুণি বাসায় যেতে হবে।’
‘বাইকে উঠুন, না হলে রাত হয়ে যাবে।’

কোনো উপায় না পেয়ে আমি তার বাইকে উঠলাম।আসার সময় একটা বাচ্চা ডাবের খোলা ছুঁড়ে মারল।বাইকের চাকার নিচে পড়তেই বাইক কাত হয়ে গেল।আমি ভ**য় পেয়ে তোমার বন্ধুর শার্ট খামছে ধরেছিলাম।যখন বাইক কাত হয়ে যাচ্ছিল ওনি আমাকে বাঁচাতে বলছিল তরী আমাকে শাক্ত করে ধরুন।আমার নিচে পড়লে আপনার ব্যাথা লাগবে,ছুলে যাবে।ওনাকে শক্তভাবে ধরায় ওনি রোডের উপর পড়লেন আর আমি ওনার উপরে।ওনার বেশ কিছু জায়গা ছুলে গিয়ে র* ক্ত বের হয়েছে।অথচ সেদিকে খেয়াল না দিয়ে বললেন, ‘আর ইউ ওকে?কোথাও লাগেনিত?’
বললাম নাহ লাগেনি।আপনি তো আমাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজে আঘাত পেলেন!’
‘আপনি আঘাত পেলে আমি বেশি ব্যাথা পেতাম।ব্যথা কম পেতেই আঘাত নিলাম। এতেও শান্তি!’
‘বুঝলাম না!’
‘এটা একটা জটিল সমীকরণ।বোঝা ইজি নয়।তবে সহজটা বলি।আপনি কারো পৃথিবী মানে আপনার ছেলের;আর আমি দায়িত্ব নিয়ে এসেছি আপনাকে। সো,আপনার কিছু হলে আমার খারাপ লাগবে,ব্যাথা অনুভূত হবে।’
‘আচ্ছা উঠুন এইবার।’
‘একটু হাত টা ধরে হেল্প করবেন?’
‘কেন করব না?’উঠুন।’

তারপর কী হলো তরী বেবি?মৃন্ময়ের হাত ধরে উঠালে?
‘হুম ভাবি উঠালাম।কী করব!আমাকে বাঁচাতেই তো সে আহত হলো।’
‘মৃন্ময় ও দিকে কী জন্য গেছিল?’
‘কোনো কাজ ছিল মনে হয়।’
‘কোনো কাজ নাকি উদ্দেশ্য কাউকে ড্রপ করা?’
‘হতে পারে ওনার কেউ ছিল এদিকে।’
‘আমার তো অন্য কিছু মনে হয়।’
‘কী ভাবি?’
‘না থাক কিছু না।’মৃন্ময়ের বেশি লাগেনিতো?’
‘না।’
‘খোঁজ নিয়েছ আর?’
‘না নিইনি।’
‘কেন?’
‘একজন পুরুষকে ফোন করা কি উচিত হবে?’এমনি তার বাইকে উঠে ভুল করেছি।খারাপ লাগছে।’
‘আচ্ছা!এটাকে ভুল মনে হচ্ছে?’
‘হ্যা ভাবি।’
ভুল থেকে যদি দারুণ কিছু হয় তাহলে এমন ভুল রেগুলার কোরো।’
‘ভাবি কী-সব বলেন?’জানেন কী হয়েছিল?’
‘আবার কী?’
‘সেদিন আমি বাইরে বের হয়েছিলাম।’বেখেয়ালি ভাবে রাস্তা পার হচ্ছিলাম।হঠাৎ একটা ভ্যানের চাকা উঠে গেছিল।কোত্থেকে এসে যেন আমাকে ধরলেন।ঘামে ভেজা মুখ,ঘামে ভেজা শার্ট মারাত্মক ক্লান্ত ছিল।আমাকে একটা দোকানের সামনে বসিয়ে, দোকান থেকে বরফ চেয়ে পায়ে ডলে দিচ্ছিল;আর কেমন উত্তেজিত ভাবে বলছিল”‘দেখেশুনে রাস্তা পার হবেন না?”এত বেখেয়ালি কেন আপনি?”
আমি বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম আপনার বন্ধুর দিকে।মানুষের বিপদে কীভাবে এগিয়ে আসে তাই দেখলাম!
‘আরে বাহ! এত কিছু হয়ে যাচ্ছে!’
‘হচ্ছেই তো।রোহানের জন্য প্রতিদিন খাবার কিনে দিচ্ছে।আমিতো ঋণী হয়ে যাচ্ছি।’
‘ঋন একদিন শোধ করে দিয়ো।’
‘এখানেই শেষ নয় ভাবি;আরো একটা বিষয়ে অবাক হয়েছি।’
‘কী বিষয় বেবি?’
‘আমি যখন তোমার বন্ধুর সাথে বাসায় আসছিলাম তখন দেখি ওশান রোহানের জন্য বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।আমাকে আর মৃন্ময়কে দেখে একটা বিশ্রী ভাষা দিয়ে বলল, ‘এসেই নাং ধরা হয়ে গিয়েছে?সব কি ফ্রিতে দিয়ে টাকা ইনকাম করছিস?’
মৃন্ময় মানে তোমার বন্ধু ওনি খুব রেগে গেলেন।ওশানকে কয়েকটা ঘু* ষি মে***রে বললেন, ‘মাদারির বা’ চ্চা সবাইকে নিজের মতো ভাবিস?এখানেই পু* — তে দেবো তোকে আজ!’
ওশান মৃন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “মৃন্ময় তোর এত বড়ো সাহস আমার বউ নিয়ে ফূর্তি করছিস?”
মৃন্ময় আরও বেশি রেগে গিয়ে বলল, “ডিভোর্সের পর কী-সের বউ?”
‘আমি তখন তোমার বন্ধুকে টানতে টানতে নিয়ে এলাম।কারণ ঝামেলা হোক আমি চাচ্ছিলাম না ভাবি।’কিন্তু ওরা দু’জন দু’জনকে
চেনে কীভাবে বলুন তো?’
‘তরী তোমাকে কিছুর বলার আছে পরে বলব সময় নিয়ে।এখন রাখি।’
ওনি চা শেষ করে আমার ফোনে কথা শেষ হওয়ার অপেক্ষা করছিলেন।ফোন কেটে দিতেই ওনি এসে রিক্সায় বসলেন।আবারও চেয়ে আছেন আমার দিকে।আমি দেখতে পাচ্ছি ওনার দু’চোখে হাজারো কথা;যা ওনি বলতে চাইছেন।যদিও আমি কিছুটা আন্দাজ করছি।কেননা যাকে ভালবাসা হয় তার চোখের ভাষা বোঝা খুব একটা কঠিন ব্যাপারও নয়।ওই চোখ নিশ্চয়ই ভালবাসার গল্প শোনাবে,যে গল্পে প্রেমালিঙ্গণ করতে আর কোনো বাঁধা থাকবে না।আমার কাঁধের উপর হাত রাখলেন,উষ্ণ এক স্পর্শ অনুভূত হলো;কিন্তু আমার অস্বস্তি ফিল হলো না।বরং মনে হলো এই পথ যেন না শেষ হয়।ওনার এই স্পর্শটুকু যেন আজীবন লেগে থাকে।

রিক্সা চলতে চলতে একটা নির্জন জলাশয়ের কাছে পৌঁছাল।ছোট্ট একটা রিসোর্ট।এখানে নাকি মানুষ প্রায় রাতে ঘুরতে আসে।ঘুরতে আসার আগের দিন বুকিং দিয়ে রাখতে হয়।শুধু বিবাহিত দম্পত্তির জন্য প্রযোজ্য।ওনি রিক্সাওয়ালাকে টাকা দিয়ে বিদায় দিয়ে দিলেন।রিসোর্টের ভেতরে মোটামুটি ভালোই জায়গা আছে।ছোট্ট একটা বিল্ডিংও আছে।বিল্ডিং-এর নিচতলায় আলো জ্বলছে,ওখানে একটা দোকান আছে।এখানে যারা আসে তাদের আপ্যায়নের জন্যই দোকানটা।বিল্ডিংটা দো’তলা বিশিষ্ট। নিচতলা আর দো’তলা দিয়ে চারজোড়া দম্পতি এখানে থাকতে পারবে।এখানে বড়ো একটা জলাশয়।জলাশয়ের অপরপ্রান্তে বড়ো একটা গাছ।সে গাছের সাথে দোলনায় দুলছে একজোড়া আদুরে দম্পতি প্রিয় মানুষকে আলিঙ্গন করে। ভালবাসা সত্যি সুন্দর! দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়।আমরা জলাশয়ের পাড়ে গিয়ে বসলাম।জলাশয়ের ভেতরে পদ্মপাতা,সাথে বড়ো বড়ো লাল পদ্ম ফুটে আছে।আমি পানিতে পা ভিজিয়ে বসলাম।আমাকে দেখে ওনিও পানিতে পা ভেজালেন।আমি পা দুলাচ্ছি;পানিতে পানিতে খলখল শব্দ হচ্ছে।ওনি আস্তে করে ওনার পা আমার পায়ের উপর তুলে দিলেন।আমার চঞ্চল পা’দুটো থেমে গেল।পানি থেকে দৃষ্টি সরে ওনার মুখপানে গিয়ে স্থির হলো।অনেকক্ষণ ধরে একটা প্রশ্ন মনের মাঝে উঁকি দিচ্ছে।এবার প্রশ্নটা করেই ফেললাম।মিহি কন্ঠেই বললাম,
‘আমরা এখানে কেন এসেছি?এখানে তো মানুষ প্রেম করতে আসে;আমরা কেন এসছি?’
ওনি সহজভাবেই উত্তর দিলেন,
‘আমরা অন্যকিছু করতে এসেছি।’
‘অন্যকিছু মানে কী?’
ওনি হেসে ফেললেন।ওনার প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে কিছু একটা বের করতে করতে ওনার দিকে আমার একটা হাত টেনে নিলেন।আমি আবারও অবাক হলাম।এই মানুষেটার এত পরিবর্তন কেন?এত পপরিবর্ত!ওনি কয়েকটা বেলি ফুলের মালা বের করলেন।দেখা মাত্রই আমি সহসাই হেসে দিলাম।ইশ!এটাই চাচ্ছিলাম তখন আমি মনে মনে।ঠোঁট কামড়ে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে।প্রচন্ড উত্তেজিত আমি!ভীষণ আনন্দিত!ওনি বেলি ফুলের মালা আমার হাতে পেঁচিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘আমি তখন দেখেছিলাম তুমি বেলি ফুলের মালার দিকে তাকিয়ে ছিলে।আমার সর্বক্ষন খেয়াল থাকে তুমি কখন কী করছ!মনে মনে ভাবছিলে তোমার বর একজন বুড়ো,বয়স্ক,আনরোমান্টিক মানুষ এসব বুঝবে না তাইতো?হুম আমি রোমান্টিকতা বুঝি না এটা ঠিক তবে এসব টুকটাক সারপ্রাইজ বউকে দিতেই পারি।বউকে নিয়ে একটা নির্জন প্রহর কাটাতে পারি।একটা নয় আরও হাজারটা প্রহর কাটাতে পারি।যদি বউ চাই আরকি।’
একটু রাগী মুডেই বললাম,
‘আপনি বুড়ো? ‘
‘হুম বুড়ো আরও কালো।’
‘আর কতবার বলব,আপনি কালো নন।আপনি শ্যামসুন্দর পুরুষ। ‘
এই মানুষটা নিজেও জানেন না সে কত হ্যান্ডসাম আর সুন্দর আমার চোখে।জানলে বোধহয় সব ছেলে শ্যামপুরুষ হয়ে না জন্মানোর জন্য আফসোস করত।
‘আচ্ছা বুঝলাম,আমার বউ-এর চোখে আমি শ্যামসুন্দর। ‘
ওনার মুখে বউ সম্মোধনটাও আমাকে আরও লজ্জা দিচ্ছে।জীবনে প্রথম বার এমন আচরণ ওনার মাঝে দেখছি।
আমি তাকিয়ে আছি আমার হাতের দিকে।ওনি বললেন,
‘কী দেখছো?’
‘আমার হাত’
‘নিজের হাতে কী দেখছো?’
‘আমার হাত আজ এত সুন্দর লাগছে কেন?’
‘সুন্দরের কমতি ছিল কবে?’
‘ছিল আগে।’
‘আজ সুন্দর বেশী লাগার কারণ?’
‘শ্যামসুন্দর পুরুষের ছোঁয়াতে আমার সব-ই অন্য রকম হয়ে যায়।’
‘তাই-না?’
‘হুম’

আবার ও কিছুক্ষণ দু’জন তাকিয়ে রইলাম জলাশয়ের দিকে।একটা ফুটন্ত পদ্মের পাশে চাঁদ দেখা যাচ্ছে।জলাশয়ের পানিকে যেন আয়নার মতো দেখাচ্ছে।ওনার গায়ে হাত দিয়ে বললাম,
‘দেখুন পানিতে আমার মুখ দেখা যাচ্ছে।একদম আয়নার মতো তাই-না?’
‘তুমি আসবে বলেই জলাশয়ের পানি আজ শুভ্র পবিত্র আয়না।’
‘জলশয়ের খেয়ে কাজ নেই আমার জন্য শুভ্র পবিত্র হতে যাবে।আমি কে তার?’
ওনি আমার কাঁধে হাত দিয়ে আমাকে টেনে ওনার সম্পূর্ণ কাছাকাছি নিয়ে নিলেন।মাথা গিয়ে ওনার বুকে ঠেকল।ওনার বুকের সাথে আমাকে চেপে ধরে আমাকে আদুরে কন্ঠে ডাকলেন,
‘সারাহ!’
‘হুম।’
‘একটা কথা বলতে চাই।’
‘বলুন।’
‘আমাকে কি সব সময় স্যারের নজরে দেখতে?’
‘স্যারকে কি ক্রাশের নজরে দেখব?’
‘আমি কিন্তু তোমাকে কখনো স্টুডেন্টের নজরে দেখতাম না।’
‘তাহলে?’
‘আমি অনেক আগে থেকেই তোমাকে বউ-এর নজরে দেখতাম।’
‘আমাকে?’
‘হুম,আমি জানতাম এই চঞ্চল প* *রী টা আমার বউ হবে।’
‘আমিতো আপনাকে আগে কখনোই দেখিনি।’
‘কিন্তু আমি দেখেছি বহুজনম আগে।’
‘বলুন আগে কীভাবে চিনেন।’
‘ওসব বলে সময় নষ্ট করতে চাইনা।’
‘তাহলে কলেজে ওমন খারাপ ব্যবহার করেছিলেন কেন?’
‘খারাপ ব্যবহার করেছিলাম?’
‘হুম।’
‘রাগ করেছিলে?’
‘খুউউব।’
‘এখনো রাগ আছে?’
‘বলব না।’
‘আচ্ছা কান ধরলাম সেদিনের জন্য।এবার বলো রাগ কমেছে কী-না।’
‘রাগ-ই নেই।’
‘তোমাকে কিছু বলার চেষ্টা করছি,কিন্তু পারছিনা।’
‘কেন?’
‘এই বয়সে যদি অপমানিত হতে হয়।’
‘এসব কী বলছেন?’
‘হুম!যদি আমাকে ফিরিয়ে দাও।’
‘আপনার কি মনে হয় ফিরিয়ে দিবো?’
‘এখন মনে হচ্ছে না।তাই আজ সাহস করে নিয়ে এসেছি।আজ একটা বিশেষ দিন এইজন্য।বিশেষ দিনে বিশেষ মানুষকে বিশেষ কথাটা বলা জরুরি।’
‘আমি বিশেষ মানুষ?’
‘শুনেছি মেয়ে মানুষ এসব বিষয়ে একটু বেশিই ট্যালেন্টেড হয়।তাহলে তুমি কেন বোঝো না?’
‘আপনাকে বোঝা কি সহজ কথা?’
‘তোমার জন্য তো আমি সহজ-ই।’
‘আচ্ছা বলুন না কী বলবেন?’
‘ভালোবাসি সারাহ!তোমার ভালবাসার আঁচলে বাঁধবে আমাকে?আমার পিপাসিত হৃদয়কে তোমার ভালবাসা দিয়ে শিতল করবে?’
মুহূর্তের মাঝে মনে হলো আমার সমস্ত পৃথিবী ভূমিকম্পনের মতো কাঁপছে।ওনি আমাকে ভালবাসেন!এর থেকে খুশি আর আনন্দ কী আমার জীবনে আছে!আমি ঠিক কী উত্তর দিবো জানি না।ওনি আমার মুখে হাত বুলিয়ে বললেন,
‘কী হলো উত্তর দাও।’
ভীষণ লজ্জায় আমি ওনাকে ধাক্কা মেরে ছুটে চলে এলাম বিল্ডিং-এর কাছে।ওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দুই হাতে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছি।ওনিও কিছুক্ষণের মাঝে চলে এলেন।
‘পালাচ্ছো কেনো সারাহ?উত্তর নেই তোমার কাছে?’
চোখ মেলে দেখি ওনি তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।কাতর কন্ঠে প্রশ্ন করলেন।
আমি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললাম,
‘আগে বলুন আজ বিশেষ দিন কেন?’
‘আজ আমার জন্মদিন।’
‘আগে বলবেন না?’
‘নিজের জন্মদিন কেউ নিজে বলে?’
‘কেউ বলে না বলে আপনি বলবেন না?’
‘না।’
‘আমি এখন কীভাবে উইশ করব আপনাকে!আমার কাছে কোনো গিফট নেই।’
‘জীবনের শ্রেষ্ঠ দামি গিফট চাইলেই দিতে পারো
কী?’
‘তোমার আদর আর ভালোবাসা।’
আমি ড্যাবড্যাব করে তাকালাম।
‘লজ্জা পেলে?’
‘না’
‘তোমার চোখে মুখে ভীষণ লজ্জা দেখছি আমি।’
‘মাথা ঘুরছে, চা খাব।’
‘চা খাবে?’
‘হুম।’
‘তুমি না খাও না?’
‘খাই না মানে কখনো খাবননা তাতো নয়।’
ওনি বিল্ডিং-এর নিচে দোকানে গিয়ে বললেন,
‘দুটো চা পাঠিয়ে দিন আমাদের রুমে।’
আমার হাত ধরে রুমের দিকে রওনা হলেন।নিচ তলার দুটো সিঁড়ি পার হতেই আমাকে কোলে তুলে নিয়ে আমাদের কক্ষে প্রবেশ করলেন।
পাঁচ মিনিট পরে চা দিয়ে গেল।চা খাওয়া বাহানা মাত্র।আমি কী বলব তখন বুঝতে পারছিলাম না।
চায়ের কাপে ধোঁয়া উড়ছে।ওনি চা খেতে খেতে বললেন,
‘কি খেতে পারছো না?’
‘না গরম।’
ওনি আমার চায়ের কাপে ফুঁ দিতে দিতে আমার গালে ওষ্ঠ ডুবিয়ে বললেন, ‘চা খেতে হবে না চুমু খাও।’
আমি বড়ো বড়ো চোখ করে আবার তাকালাম ওনার দিকে।ওনার ঠোঁটে দুষ্টুমি দেখছি।ঠোঁটের কোনে দুষ্টুমির ছড়াছড়ি নিয়ে বললেন, ‘বার্থডে গিফট দিতে চাও?’
আমি মাথা নিচু করলাম।
ওনি আরেক গালে ওষ্ঠ ডুবিয়ে বললেন, ‘দিতে চাও না?’
আমার ঠোঁট জোড়া কাঁপছে লজ্জায়।কম্পিত ঠোঁটে বললাম, ‘দি দিতে চাই।’
ওনি নেশাভরা কন্ঠে বললেন, ‘তাহলে দাও।’
‘আজ নয় বাড়ি ফিরে দেব।’
‘আজকের মতো এমন নির্জন প্রহর আর পাবে না দেওয়ার জন্য।’
‘আজকের প্রহর আপনার, আর পরের প্রহরটা আমি আপনাকে দিবো।’
‘তাহলে আমাকে অপেক্ষা করতে হবে?’
‘জি।’
‘তাহলে কী বুঝব?ভালোবাসো না-কি বাসো না?’
‘বাসি।’
বুকের সাথে শক্তভাবে আলিঙ্গন করে বললেন,
‘বেঁচে থাকার প্রার্থনাতে ইহকাল পরকাল তোমাকেই পাশে চাই।’
আমি যেন একজন্মের প্রশান্তি পেলাম ওনার বুকে মাথা গুঁজে।
কতশত আদর আর ভালবাসায় ভরিয়ে দিলেন!ভালবাসায় মুখরিত রাতটা আজীবন মনে রাখব।
চলবে?
(সবাইকে রেসপন্স করার অনুরোধ রইল।রেসপন্স না করলে কিন্তু আর বড় পার্ট দিতাম না।সবাই কমেন্ট করলে অনুপ্রাণিত হতে পারি।)

1 COMMENT

  1. ইসস…. ….পর্বটা বড়‌ই হ‌ইছে কিন্তু মনে হ‌ইতাছে আর‌ও পরতে পারলে ভালো লাগতো। ধন্যবাদ। পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় র‌‌ইলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here