এই অবেলায় তুমি পর্ব ১৩

0
1310

#এই_অবেলায়_তুমি

#পর্ব_১৩

লেখিকা #Sabihatul_Sabha

নূরঃ আপু বয়ফ্রেন্ড নিয়ে বাসায় চলে আসছোস!!!?

নূরের কথা শুনে মাহির ভয়ে হাত পা জমে গেছে। এখন ও কি বলবে?
পিছন থেকে রুদ্র বলে উঠলো, ” বয়ফ্রেন্ড মানে!?
মাহি এবার বুঝলো বেচারি ভালো ভাবেই ফেঁসেছে।ও পারে না এবার কেঁদেই দেয়।
ফায়াজ রুদ্রের কন্ঠ শুনে তারাতাড়ি ওঠে পিছন ফিরে তাকায়।
ফায়াজ কে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠে নূর।
নূরঃ স্যার আপনিইইই!!!
ফায়াজঃ তুমি!!
সব কিছু কেমন যেনো গুলিয়ে যাচ্ছে।
রুদ্র চোখ ছোটো ছোটো করে তাকিয়ে আছে। মাহি বলে উঠলো, ” এই নূর তুই উনাকে চিনিস নাকি?”
নূরঃ তার আগে তুই বল! স্যার তোর রুমে কি করছে?আর তোর উপর পরলো কেমনে!?
মাহিঃ আজব উনাকে তুই স্যার বলছিস কেনো?আর পরলো কেমনে মানে।তুই তো এসে ধাক্কা দিয়ে আমার উপর ফেললি।

নূরঃ স্যার ডাকবো না তো কি তাহলে জিজু বলবো?
মাহি এবার রেগে দাঁতে দাঁত চেপে বললো, ” বেশি পাকনা হয়ে গেছিস না।যেটা জিজ্ঞেস করেছি সেটার উত্তর দে?
নূরঃ হ্যাঁ উনি তো আমার স্যার হন। আমাদের ইংরেজি টিচার। কিন্তু উনি তোর রুমে কেনো? আল্লাহ আমি যা ভেবে ছিলাম তাহলে সব সত্যি!!

রুদ্র এতোক্ষন চুপচাপ সবার কথা শুনতে ছিলো,আর বোঝার চেষ্টা করছিলো আসলে কে কি বলছে, এবার রুদ্র বলে উঠলো, আজব নূর তুমি এটাকে এতো বড় করে দেখছো কেনো? ফায়াজ বাসার কিছুই চিনে না। তাই হয়তো ঘুরতে ঘুরতে এই রুমে চলে এসেছে।”
ফায়াজের কলিজায় এতক্ষনে মনে হয় পানি এসেছে। বেচারা দুই বোনের কথার মাঝ খানে ফেঁসে গিয়ে ছিলো।
ফায়াজঃ হুম রুদ্র একদম ঠিক ধরে ছিস আমি তো হাঁটতে ছিলাম আর বাসাটা দেখতে ছিলাম। হঠাৎ একটা কাকের কন্ঠ শুনতে পেলাম। আমার মনে হলো কাক ময়ূর সাজতে চাচ্ছে তাই একটু দেখতে আসলাম। এসেই ফেঁসে গেলাম।”
মাহি রেগে কটমট করে বলে উঠলো, ” এই বেয়াদব ছেলে একদম কাক বলবেন না। জানেন আমার ফ্রেন্ডরা কি বলে? আমার কন্ঠ অনেক সুন্দর।চাইলেই আমি অনেক বড় লেডি সিঙ্গার হতে পারনো।”
ফায়াজ হাসতে হাসতে বললো,” আপনার কথা শুনেই বুঝা যাচ্ছে। আপনার ফ্রেন্ডদের রুচি কেমন!! ”
মাহিঃ আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন!
ফায়াজঃ যার মান নেই তাকে আবার অপমান করে কিভাবে?
মাহিঃ ভালো হচ্ছে না কিন্তু!!
ফায়াজঃ কেনো ওই দিন যে আমাকে রাস্তায় সবার সামনে সার্কাসের জোঁকার বানিয়ে ছেন মনে নাই।
মাহিঃ তাহলে আজ ওই দিনের সুদ টা নিলেন বুঝি।

নূরঃ চুপ করবি তোরা!! আসলে আমার মাথায় ঢুকছে না কি হচ্ছে!! রুদ্র ভাইয়া আপনি স্যারকে চিনেন কিভাবে?
রুদ্রঃ ফায়াজ আমার বন্ধু। আর আজকে আমি ওকে আমাদের বাসায় নিয়ে এসেছি।
নূর আবার বলে উঠলো, ” মাহি আপু চিনো কিভাবে?
এবার মাহি প্রথম থেকে লাস্ট পর্যন্ত সব বললো।
সব শুনে নূর হাসতে হাসতে গিয়ে রুদ্রের কাদ জড়িয়ে ধরলো। যখন বুঝতে পারলে সে ভুল জায়গায় ভুল মানুষকে জড়িয়ে ধরেছে সাথে সাথে দূরে চলে গেলো।

মাহি ফোনে রিং হলো। মাহি ধরে “হ্যালো” বললো। সাথে সাথে উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো, ” তুই এখন কোথায়?”
……..
মাহিঃ তুই ওখানেই থাক। আমি এখনি আসছি!প্লিজ তুই কোথাও যাবি না।
……….
মাহিঃ তুই তাহলে আমার কথা শুনবি না?দেখ তুই যদি আমার কথা না শুনিস আমি একদম তোর সাথে আর কথা বলবো না।
……….
মাহিঃ আচ্ছা আমি আসছি!
মাহির চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। মাহি রুদ্রের দিকে তাকালো। না এইলোক কে নিয়ে যাওয়া যাবে না। এই লোককে দেখলেই ওর শ্বাস আটকে আসে। উনার সামনে কাউকে কিছু বলতে পারবে না। আর রাতের মধ্যে ওকে একা বাসা থেকে বের হতে দেবে না। কিন্তু সে তো এখন কারো কথা শুনবে না। এখন ওকে বের হতেই হবে।একা বের হওয়ার চেয়ে ভালো এই ফায়াজ ছেলেটাকে নিয়ে বের হবে। যা ভাবা তাই কাজ।
মাহি ফায়াজের হাত ধরে বললো, ” চলুন আমার সাথে ”
ফায়াজ অবাক হয়ে মাহির ধরা হাতটার দিকে তাকালো। কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না। এই মেয়েটার প্রতি সে প্রচুর দুর্বল। এই যে হাত ধরেছে তার বুকের ভেতর মনে হচ্ছে কেউ হাতুড়ি পিঠানো শুরু হয়ে গেছে।ফায়াজ কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না। চুপচাপ মাহির সাথে হাঁটা শুরু করলো।

পিছন থেকে নূর বলে উঠলো, ” এই আপু কোথায় যাচ্ছিস? প্রেম করার হলে সামনে বসে কর না। চিপা চাপায় যাচ্ছিস কেনো? স্যারের প্রেম দেখার ভাগ্য আমারও হোক!!..
রুদ্র নূরের কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বললো,” তুমি চাইলে আমি তোমাকে আমার সামনে বসিয়ে প্রেমের ক্লাস করাতে পারি.. ”
নূর অবাক হয়ে রুদ্রের দিকে তাকালো। এই বেটার কি মাথা ঠিক আছে, কি বলছে কি!!?

মাহি পিছন ফিরে কটমট দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলো ফায়াজ কে নিয়ে।

পুরো ঘটনা রুদ্রের সামনে ঘটলেও রুদ্র টু শব্দও করলো না।নূরের দিকে তাকিয়ে বললো,” তারাতাড়ি পাঁচ মিনিটের মধ্যে বই নিয়ে আমার রুমে আসো.. ”
নূর ঝটপট বলে উঠলো, ” কেনো আপনি কি এখন প্রেমের ক্লাস করাবেন আমাকে!!?
রুদ্রঃ কেনো তুমি কি করতে চাও নাকি?তুমি করতে চাইলে আমার কোনো সমস্যা নেই..
নূর কিছু বলছে না। কি বলবে আসলে সেটাই খুঁজে পাচ্ছে না।
রুদ্র আবার বলে উঠলো, ” তারাতাড়ি আমার রুমে বই নিয়ে আসো।বলেই নিজের রুমে চলে গেলো।

নূর নিজের রুমে যাওয়ার সময় খেয়াল করে রুহির রুমের দরজা খুলা।উঁকি মেরে বুঝলো রুহি ওয়াশরুমে।নূর এক দৌড়ে নিজের রুমে গেলো। আবার এক দৌড়ে রুহির রুমের সামনে আসলো।তারপর আসতে করে ওয়াশরুমের দরজার সামনে কলার ঠুসা রেখে নিজের রুমে চলে গেলো।

কিছুক্ষন পর ও বাবাগোওওওওও আমার কোমর গেলো গোওওওওওও। রুহির চিৎকার শুনে নূর নিজের রুমে বসে বসে হাসতে হাসতে অবস্থা খারাপ। আহা রুহি বেচারি যাক পা টা একটু ভালো হয়ে ছিলো। এখন আবার কোমর।এখন তো আবার এক সপ্তাহ খাট থেকে নামতে পারবে না।

রুদ্রের রুমে টেবিলে বই সাজিয়ে চুপচাপ চেয়ারা গালে হাত দিয়ে বসে আছে নূর।
রুদ্র আবার বলে উঠলো, ” কি হলো বলছো না কেনো? রেজাল্ট কবে দিবে?.
নূর পারে না হাত পা ছড়িয়ে কান্না করে। ও কিভাবে বলবে যে রেজাল্ট দিয়ে ফেলেছে। এখন যদি বলে। তাহলে রুদ্র বলবে রেজাল্ট কার্ড দেখাও!! তখন ও কি করবে!! এক বিষয় না, দুই বিষয় না, তিন বিষয় ফেল আসছে।আব্বু শুনলে কথা বলা বন্ধ করে দিবে।আম্মু শুনলে বকা দিবে। না! না! না রুদ্র কে বলা যাবে না। কিছু একটা ভেবে মিথ্যা বলে রুদ্র কে বুঝিয়ে নিতে হবে।
নূরঃ ভাইয়া রেজাল্ট তো এখনো দেয়নি।আর কবে দিবে তাতো জানি না। যেদিন দিবে আপনাকে সবার আগে বলবো।প্লাস্টিকের হাসি মুখে ঝুলিয়ে বললো।
রুদ্র নূরের মুখের রিয়াকশন আর কথার ধরন দেখেই বুঝে গেলো নূর মিথ্যা বলছে।
ফায়াজঃ আচ্ছা ঠিক আছে। আমি ফায়াজের কাছ থেকে নিয়ে নেবো।
নূরের মন চাচ্ছে ওই ফায়াজ বেটাকে উগান্ডায় পাঠায় দিতে।এখন যদি ফায়াজ সত্যি টা রুদ্র কে বলে দেয় ওর কি হবে!!..

———

দরজার কাছে এসেই হুঁচট খেয়ে পড়লো ফায়াজ।
মাহি বিরক্তকর দৃষ্টিতে ফায়াজের দিকে তাকিয়ে বললো,”সামনে তাকিয়ে হাঁটুন না। আমাকে কি আর কখনো দেখেন নি?
মাহির কথা শুনে ফায়াজ একটু লজ্জা পেলো।
আদিবা মুচকি মুচকি হাসছে।সেই গাড়ি থেকেই খেয়াল করেছে ফায়াজ একটু পর পর আরচোখে মাহির দিকে তাকাচ্ছে। আর এখন তো হুঁচট খেয়ে পড়লো।

মাহি ড্রয়িং রুমে আসতেই ওর আম্মু এসে বললো,” কি রে কোথায় গিয়ে ছিলি?”
মাহিঃ আম্মু আমি আদিবার বাসায় গিয়ে ছিলাম। তারপর আদিবা কে দেখিয়ে বললো, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আম্মু।
আদিবা ভয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। যেখানে নিজের মামা-মামি ওকে বের করে দিয়েছে। সেখানে ওনারা তো ওর কেউ না। এর আগে কখনো আসা হয়নি মাহিদের বাসায় আজ প্রথম তাই ঠিক কাউকে চিনে না। তবে ওর মনে চিনতা ঢুকে গেছে আজ রাতের জন্য যদি তারা ওকে জায়গা না দেয় ও কোথায় যাবে?

বাহ্ ভারি মিষ্টি মেয়ে তো।বলে আদিবার কাছে গিয়ে মাহির মেঝো আম্মু বলে উঠলো, ” নাম কি তোমার?

আদিবা ভয়ে ভয়ে বললো, ” আদিবা তাবাসসুম”
~বাহ্ খুব সুন্দর নাম তো। কিন্তু তুমি ভয় পাচ্ছো কেনো? তুমি মাহির বান্ধবী মানে, মাহি যেমন আমাদের মেয়ে তুমি ও মেয়ের মতোই।
আদিবা উনার কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো।
মাহিঃ মেঝো আম্মু শুনো না!..
~হুম বল?
মাহিঃ আম্মু আদিবা কিছু দিন এখানে থাকবে।
~তো কি হয়েছে যত দিন ইচ্ছা থাকুক।শুনো মা তোমার যত দিন ইচ্ছা নিজের বাসা মনে করে থাকবে।
মাহি ওর মেঝো আম্মুকে জড়িয়ে ধরে বললো, ” এই জন্যই তোমাকে আমি এত এত এত ভালোবাসি।

মাহির আম্মু বললো, ” কিন্তু তোমার আম্মু আব্বুকে বলে এসেছো তো? নাহলে তো উনারা টেনশন করবে।

সাথে সাথে আদিবার চোখ জলে টইটম্বুর হয়ে গেলো।
আদিবার চোখে জল দেখে বলে উঠলো, ” কি হয়েছে তোমার চোখে জল কেনো?”
আদিবাঃ আমার আম্মু আব্বু নেই… আমার যখন দশ বছর তখন একটা বালু ভর্তি ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে আব্বু আম্মু মারা যায়।আমার বাবা একজন উকিল ছিলেন। শত্রুরা আব্বুকে মারতে চেয়ে ছিলো কিন্তু সেই গাড়িতে আম্মুও ছিলো। আমি একদম এতিম হয়ে যাই। আমার আব্বুর ভাই বোন কেউ ছিলো না। আব্বু একজন ছিলেন। মাথার উপর থেকে সব ছায়া সরে যায়। আমি এত টুকু একটা মেয়ে কি করবো বুঝে পাই না। ছোট থেকেই আম্মু আব্বুর কলিজার টুকরো একটা মাত্র মেয়ে ছিলাম আমি। কষ্ট কি তা কখনো বুঝতে পারিনি। তখনি আমার ছায়া হয়ে পাশে এসে দাঁড়ালো আমার মামা-মামী। আমি তাদের সাথে থাকতে শুরু করি। প্রথম প্রথম কয়দিন খুব আদর করেন আমার মামী কিন্তু বেশি দিন আর মুখোশ পরে থাকতে পারেন নি। নিজের আসল রূপে ফিরে আসেন। আমাকে দিয়ে কাজ করাতো করতে না পারলে মারতো। আমি কোনো দিন কাজ করিনি কিছুই পারতাম না। তবুও ছোটো ছোটো হাত দিয়ে করর চেষ্টা করতাম। মামী আমার পড়াশোনা বন্ধ করে দিলো।অনেক কান্না করেছি।মামীর পায়েও ধরেছি কিন্তু আমার কথা শুনেন নি। আমি পড়াশোনায় খুবই ভালো ছাত্রী ছিলাম। কয়েক দিন স্কুলে না যাওয়াতে বাসায় পিন্সিপাল স্যার আসলেন আমার খুঁজ করতে। মামী সবার সামনে এমন ভাব করতেন যেনো উনি আমাকে চোখে হারান।পিন্সিপাল স্যারকে বলেন আমার শরীর ভালো না। তাই যেতে পারিনি কাল থেকে আবার যাবো।বিশ্বাস করেন ওই দিন আমি এতটাই খুশি হয়েছিলাম র‍্যে খুশিতে কান্না করে দেই। কিন্তু বেশিক্ষন আর আমার সেই খুশি রইলো না। মামী এসে আমার চুলের মুঠি টেনে বলে ছিলো,” দেহ রূপ দেখাইয়া সবাইরে হাত করে নিছস। পুরাই মার মতো বে*** হইছোস।তোর এই রূপ যদি আমি শেষ না করছি।কয়জন রে পাগল করছোস এই রূপ দেহাইয়া।যে খুঁজ নিতে বাড়িতে চইলা আইয়ে।পুরাই মারে উল্টাইয়া আইছোস।কয়না ময়লা ধুইলেও কয়লা যায় না।মা যেমন ছিলো জ্বি তো তেমনি হইবো।
মার নামে এমন কতা শুনে চুপ থাকতে পারিনি সেই দিন। প্রতিবাদ করেছিলাম তার বিনিময় মামী গরম তেল ঢেলে দিয়ে ছিলো আমার গায়ে। ব্যাথায় ছটফট করতে করতে জ্ঞান হারিয়ে ছিলাম ওই দিন।আমার যখন ১৬বছর তখন বাসার পুরো কাজ আমি একা হাতে সামলে স্কুলে যেতাম। একদিন মামীর ছোট বোনের ছেলে আসে মামীর কোনো ছেলে মেয়ে ছিলো না। এই ছেলেটাকে খুব আদর করতো। ছেলেটার চাহনি আমার ভালো লাগতো না।সব সময় কেমন করে যেনো তাকিয়ে থাকতো।একদিন বাসায় আমি একা ছিলাম। মামা মামী বাহিরে গিয়ে ছিলো।আমি রান্না ঘরে রান্না করছি আচমকা কেউ আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে….

চলবে….

ভুলত্রুটি মার্জনীয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here