ইফ্রিতে মুসনাত পর্ব ১২

0
406

#ইফ্রিতে_মুসনাত
#পর্বঃ১২
#লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

আয়ানা সাদের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে, আয়ানার নিঃশ্বাস লেগে সাদের বুকের সোনালী বর্ণের লোমগুলো হালকা নড়ছে। সাদ আয়ানার হাতের পিঠে হালকা চুমু একে দিল। তারপর আঙ্গুলের ফোকরে আঙ্গুল ঢুকিয়ে বলল,
” আয়ানা আমার কাছে তোমার অনেক ইচ্ছে অপূর্ণ থেকে যাবে। তোমার জীবনের বড় প্রাপ্তিটুকু আমি তোমায় দিতে পারবনা।”
আয়ানা সাদের সেই জ্বলজ্বল করা চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
” কিসের কথা বলছো তুমি? আমার জীবনের বড় প্রাপ্তি ই তো তুমি।”
” প্রত্যেক মেয়ের জীবনে আরেকটা প্রাপ্তি থাকে, সেটা হল মাতৃত্বের স্বাদ অনুভব করা।” আয়ানা আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে বলল,
” এই কথা কেন বলছো তুমি?”
” মানুষ আর জ্বীনের মিলনে সাধারণত কোনো সন্তান হয়না। হওয়ার সম্ভাবনা হলেও ভ্রূণ গর্ভে মারা যায় কিংবা মৃত সন্তান প্রসব হয়। খুব কম ক্ষেত্রেই একটা পরিপূর্ণ সন্তান হয়, আর সেই সন্তানটাও হয় জ্বীন।
আমাদের ক্ষেত্রেও তাই হবে। কিন্তু যদি আমার দুটো রুপেই তোমার সাথে মিলন হয় সেক্ষেত্রে আমাদের পূর্ণাঙ্গ সন্তান হতেও পারে। আর আমিও চাইনা আরেকটা ইফ্রিতে মুসনাতের জন্ম হোক। ”
আয়ানা বিস্ফোরিত চোখে সাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
” কেন? ”
” জ্বীন দ্বারা কোনো সন্তানের জন্ম হলে জ্বীনরা তাকে নিয়ে যায়। মানুষের আবাসস্থলে তাকে রাখা হয়না, তাদের নিয়মেই তাকে বড় হতে হয়। আর ইফ্রিতে মুসনাতের সন্তানের জন্ম আরেকটি মানুষের গর্ভে হলে সেটা আরো বড় বির্পযয়ের কারণ হবে। তিন শ্রেণীর শক্তি আর বুদ্ধিমত্তা তার মধ্যে বিরাজমান থাকলে ইফ্রিত আর মারিদ গোত্রে তাকে নিয়ে আবার কোনো সংঘর্ষ সৃষ্টি হবে। যার প্রথম বলি হব আমরা দুজন।
আর আমি চাইনা, আমার সন্তানের কারণে এমন বিপর্যয় হোক। তাকে ব্যবহার করে দুনিয়ায় কোনো বিশৃঙখলা সৃষ্টি হোক। জ্বীনরা বরাবর ই মানুষকে হিংসে করে। কারণ, আল্লাহ তায়ালা কেবল মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাতের উপাধি দিয়েছেন। তাই তারা প্রতিনিয়ত মানুষকে বিপথে চালনা করার- ক্ষতি করার সর্বাত্মক চেষ্টা করে। এইক্ষেত্রে তারা আমার সন্তানকেও কাজে লাগাবে।”
সাদ একটু থেমে আয়ানার মুখ দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল,
” আমাকে ক্ষমা করো। আমি তোমাকে পূর্ণাঙ্গ মাতৃত্বের সুখ দিতে পারবনা। হয়ত ভ্রুণ তোমার গর্ভে স্থাপিত হওয়ার আগেই নষ্ট হয়ে যাবে কিংবা তুমি মৃত সন্তান প্রসব করবে।”
বলে সাদ নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলল। আয়ানা হালকা মুচকি হেসে বলল,
” সব আল্লাহর ইচ্ছে। এতে আমার কোনো দুঃখ নেই। আমি তোমাকে স্বামীরুপে পেয়েছি এটাই আমার জন্য যথেষ্ট। যাই ই হোক, আমি কোনোকিছুতেই কষ্ট পাবনা। আর মাতৃত্বের স্বাদ অনুভব করার জন্য কি গর্ভে সন্তান ধারণ করা অতীব জরুরী? দত্তক নেওয়া কোনো এতিম সন্তান কি পারবেনা আমাকে মাতৃত্বের সুখ দিতে? তুমি এত দুর্বল হচ্ছো কেন! যা হবার তাই হবে। শুধু আমরা দুজন যেন সারাটি জীবন এভাবে কাটাতে পারি এইটুকুই চাই।”
সাদ আয়ানাকে আলিঙ্গন করল। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ভাবতে লাগল,
আয়ানা জানেনা সাদ খুব বেশীদিন তার কাছে থাকতে পারবেনা। একটা সময় আয়ানা কে ফেলে বাধ্য হয়ে সাদ কে চলে যেতে ই হবে। এখন শুধু সাদের প্রার্থনা সেই সময় টা যেন খুব তাড়াতাড়ি না আসে।
খারাপ মূহুর্তটা কাটিয়ে আয়ানা আর সাদ এক সুখের সময়ে গা ভাসিয়ে দিল। দুজন দুজনকে খুব কাছে টেনে নিল যাতে কোনো দূরত্ব থাকার অবকাশ রইলনা।
সবকিছু পিছনে ফেলে রেখে পরিপূর্ণ দাম্পত্য জীবনের সূচনা করল তারা।
.
মাঝরাতে আয়ানার ঘুম ভেঙ্গে গেল শীতল স্পর্শে। অন্ধকারে আয়ানা অনুমান করতে পারলনা স্পর্শটা কার। আস্তে করে সাদের নাম ধরে ডাকতে লাগল। পরক্ষণে আয়ানার খেয়াল হল, সাদ তার পাশে নেই।
ব্যালকুনির দরজায় চোখ পড়তেই হালকা আলোয় এক তরুণীর অবয়ব স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেল আয়ানা। টের পেল তার গায়ে সেই গরম নিঃশ্বাস পড়ছে, তাতে মনে হচ্ছে তার চামড়া ঝলসে যাচ্ছে। কিছু বুঝে উঠার আগে আয়ানার উপর ঝাপিয়ে পড়ল লাল চক্ষুর অন্য এক অবয়ব। আয়ানার চিনতে দেরী হলনা, “সাদ” নামটা উচ্চারণ করার সাথে সাথে কিছু একটা গলায় ফাস হয়ে জড়িয়ে রইল। আয়ানা বিপদ বুঝতে পেরে নিজেকে বার বার ছাড়ানোর চেষ্টা করছে, সূরা-দরুদ কিছুই পড়তে পারছেনা। তার গলা দিয়ে কেবল ঘো ঘো শব্দ বের হচ্ছে। শেষ রক্ষা হলনা, আয়ানার শরীরের বিভিন্ন স্থানেই আপত্তিকর স্পর্শ ছড়িয়ে পড়েছে। তার সাথে জোর করে শারীরিক সঙ্গম করা হচ্ছে। আয়ানা যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে একসময় বেহুশ হয়ে গেল।
যখন আয়ানার হুশ ফিরল, সে নিজেকে নগ্ন অবস্থায় দেখতে পেল। তার পুরো শরীর ভর্তি লাল লাল ছোপ, গভীর কামড়ের দাগ আর নখের আচড়। ক্ষতগুলো থেকে বের হওয়া রক্তগুলো শুকিয়ে এসেছে প্রায়। আয়ানা বিভ্রান্তের মত সাদের নাম ধরে ডাকতে লাগল। কিন্তু কোথাও সাদের সাড়াশব্দ নেই। কোনোরকম নিজেকে সামলে রুম থেকে বেরিয়ে রেশমা সুলতানার রুমে এল আয়ানা।
আয়ানার এমন অবস্থা দেখে রেশমা সুলতানা চমকে উঠল। তিনিও সারা বাড়ী খুজে সাদের কোনো খোজ পেলেন না। আয়ানা একনাগাড়ে কেদেই যাচ্ছে, রেশমা সুলতানা তাকে কি বলে শান্ত্বনা দিবেন তা বুঝতে পারলেননা। এইটুকুই তার মাথায় এল, হয়ত সাদ কে মেরে ফেলা হয়েছে। যেহেতু সাদ বলেছিল, সে এখান না থেকে কোথাও যাবেনা। তাকে যদি ইফ্রিত জ্বীনরা না নিতে পারে তাহলে তাকে জায়গায় ই হত্যা করবে। আয়ানার অবস্থা দেখে উনি উপলব্ধি করতে পারলেন, রাতে ওদের উপর কোনো হামলা হয়েছে।
আয়ানাকে এই কথা বলার সাহস হচ্ছেনা রেশমা সুলতানার। তাও কোনোরকম বুঝ দিয়ে আয়ানাকে শান্ত করলেন। পারিবারিক ডাক্তার ডেকে আয়ানার শরীরের ক্ষতের চিকিৎসা করালেন।
কয়েকদিন কেটে যাওয়ার পরও আয়ানা স্বাভাবিক হলনা। মাঝরাতে চিৎকার দিয়ে উঠে, যতক্ষণ জেগে থাকে ততক্ষণ ই সাদকে খুজতে থাকে। জেসমিন এবং তার স্বামী বার বার শ্বশুড়-শ্বাশুড়িকে জিজ্ঞেস করতে থাকে, “সাদ কোথায়?”
উনারা কেউ ই সত্যি টা বলতে পারলেননা। এক পর্যায়ে উনারা সিদ্ধান্ত নিলেন আয়ানাকে তার মা-বাবার কাছে পাঠিয়ে দিবেন। এখানে থাকলে আয়ানা সবকিছু দেখে সাদের স্মৃতিচারণ করে আরো অসুস্থ হয়ে যাবে। মেয়েটার কষ্ট উনারা আর সহ্য করতে পারছেননা, তাকে ভালো রাখার সব চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছেন। তাই আয়ানার ভালোর জন্য আয়ানাকে তার বাবার কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন উনারা।
আয়মান শাফি তার মেয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রুমাল দিয়ে চোখ মুছে নিলেন। আয়ানা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে গেছে। ডাক্তার দেখিয়েও কোনো লাভ হচ্ছেনা। হঠাৎ করেই চুপ হয়ে যায়, কাদে আর মাঝরাতে চিৎকার করে উঠে। সারাদিন ভর সাদের নাম ধরে ডাকাডাকি করে, একা একা কথা বলে।
সালমা আরা আয়মান শাফির সামনে এসে বসলেন। আয়মান শাফি চোখ দুটো ভালো করে মুছে বললেন, “কিছু বলবে?”
” আয়ানা ২-৩ ধরে ঘন ঘন বমি করছে।”
আয়মান শাফি চমকে উঠে সালমা আরার মুখের দিকে তাকালেন।
” আমার মনে হচ্ছে আয়ানা গর্ভবতী।”
” তুমি কি নিশ্চিত সালমা?”
” গর্ভবতীদের সব লক্ষণ ই আমি ওর মাঝে দেখছি। তাও নিশ্চিত হওয়ার জন্য একটা টেস্ট করানো দরকার। এই সময়ে এটা কি হওয়ার ছিল!”
বলে সালমা বেগম শাড়ির আচলে মুখ চেপে ধরলেন। আয়মান শাফি উদ্বিগ্ন হয়ে কপালে হাত দিয়ে বসে রইলেন।
টেস্ট করানো হল, রেজাল্ট পজিটিভ এসেছে। আয়মান শাফি সব চিন্তা জলাঞ্জলি দিয়ে বুকে পাথর চেপে আয়ানার সন্তান নষ্ট করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই ব্যাপারে পরিচিত ডাক্তারের সাথে কথা বললেন, কিন্তু যেদিন এবোরেশন করানোর ডেট আসে ডাক্তার মানা করে দেয়। নিরুপায় হয়ে আয়মান শাফি আরো কিছু ডাকার আর ধাত্রীর শরণাপন্ন হলেন। সবাই ই অদ্ভুত কারণে পরেরদিন না করে দেয়। সবাই চোখে-মুখে আতঙ্ক নিয়ে বলে, “আয়মান সাহেব, বাচ্চাটা নষ্ট করার সিদ্ধান্ত বাদ দিয়ে দিন। বাচ্চার কিছু হলে সে কাউকে ছাড়বেনা।”
আয়মান শাফি খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। এদিকে আয়ানার শরীর ফুলে গেছে, পেট টা হালকা বড় দেখে মনে হবেনা তার ডেলিভারির সময় পেরিয়ে এসেছে। গর্ভবতীদের গর্ভাবস্থায় যেসব উপসর্গ দেখা দেয়, তার কিছুই আয়ানার বেলায় ঘটেনি। উলটো এই সময় তাকে আরো বেশী উৎফুল্ল আর স্বাস্থ্যবতী মনে হচ্ছে। কোনোরকম অসহ্যকর ব্যথা তার অনুভূত হচ্ছেনা। খুব ই স্বাভাবিক সে।
সালমা আরা আয়ানার অবস্থা দেখে কয়েকবার আয়মান শাফি কে বললেন,
” ওগো, বাচ্চাটা কি গর্ভেই মারা গেল নাকি? আমার কিন্তু কিছুই ঠিক লাগছেনা।
.
আয়ানাকে হস্পিটালে ভর্তি করা হয়েছে। সন্ধ্যার দিকে তার খুব বেশী পেইন উঠেছে, বোধহয় একটু বাদে সন্তান প্রসব হবে। আয়ানাকে আলাদা কক্ষে ঢুকানো হয়েছে। ডাক্তার রা একবার বেরিয়ে এসে আরেকবার ঢুকছেন। আয়মান শাফি আর সায়মা উদ্বিগ্নমুখে করিডোরে বসে আছেন। সায়মা উঠে এসে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করল, ” আমার বোনের কি অবস্থা ডাক্তার?”
” অবস্থা খুব ই ক্রিটিক্যাল। নরমালে সম্ভব হচ্ছেনা, সিজারেই বাচ্চা বের করতে হবে। আল্লাহ কে ডাকুন।”
প্রায় অনেকক্ষণ বাদে একটা বাচ্চার অন্যরকম কান্না আয়ানার কানে ভেসে এল। সে চোখ মেলে দেখার চেষ্টা করল বাচ্চাটাকে। নার্সদের একজন বাচ্চাটাকে তোয়ালে মুড়িয়ে আয়ানার পাশে রাখল। আয়ানা বাচ্চাটাকে ছুয়ে দেখার চেষ্টা করল, কিন্তু তার পুরো শরীর ই অবশ হয়ে আছে। চোখের দৃষ্টিও ঘোলা ঘোলা হয়ে আসছে। বাচ্চার মিষ্টি মুখটা তার দেখা সম্ভব হচ্ছেনা। তবে বাচ্চাটার কান্নার শব্দ তার কানে আসছে।
ডাক্তার বাহিরে বেরিয়ে আসতেই আয়মান শাফি বিচলিত কন্ঠে বললেন,
” আমার মেয়ে আর সন্তানের কি অবস্থা?”
” দুঃখিত, আপনার মেয়ে মৃত সন্তান প্রসব করেছে। তবে আপনার মেয়ে ভালো আছে। রেস্টে আছে আপাতত।”
আয়মান শাফি সায়মার দিকে তাকালেন। সায়মা এগিয়ে এসে তার কাধে বুলাতে বুলাতে বললেন, ” কষ্ট পেয়োনা আব্বু। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য ই করেন।”
আয়ানার খুব ইচ্ছে হচ্ছে বাচ্চাটার সাথে খেলতে, তার ছোট্ট ছোট্ট হাত-পা গুলো ছুয়ে দিতে। বাচ্চাটা খানিকবাদেই হাতটা একটু একটু নাড়াচ্ছে আর হাসি-কান্না মিশ্রিত অদ্ভুত শব্দ করছে। আয়ানার চোখ লেগে আসছে খুব। খুব চেষ্টা করেও চোখ খোলা রাখতে পারছেনা। এমনসময় এক নারী অবয়ব এসে বাচ্চার সামনে দাড়াল। বড় বড় নখযুক্ত হাত দিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে প্রচন্ড বিশ্রী শব্দে হাসতে লাগল, তার হাসির শব্দে যেন চারদিকটা কেপে উঠল।
বাচ্চাটাকে অবয়বটা কালো চাদরে ঢেকে দিল। আয়ানা হাত উচিয়ে হয়ত বাধা দেওয়ার চেষ্ট করছিল, তার ঠোট দুটো ভীষণ ভাবে কাপছে।
” তোমার প্রয়োজন আমার কাছে ফিরিয়ে গেছে আয়ানা। এখন এই ইফ্রিতে মুসনাত আমার কাছেই থাকবে।”
বলে অবয়বটা খুব ভারী কিছু দিয়ে আয়ানার মাথায় আঘাত করল। আয়ানা সাথে সাথে জ্ঞান হারাল, তার মাথার সদ্য হওয়া ক্ষত থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়তে লাগল। অবয়বটা আরেকবার বিশ্রী হাসি দিয়ে বাচ্চাটাকে নিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল!!
(চলবে…..)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here