#আসল_সম্পর্ক
#পর্ব_৮
#ইশরাত_জাহান
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে যে যার মত নামাজ পড়ে নিলো।অনুপম ও মিস্টার অরুণ নামাজ পড়ে মাঠে যায়।সেখানে দেখতে পায় প্রিয়তা ও মিসেস পুরোভি দাড়িয়ে আছে।মিস্টার অরুণ তাদেরকে দেখে জিজ্ঞাসা করেন,”তোমরা এখানে?”
মিসেস পুরোভি হালকা হেসে বলেন,”তোমাদের সাথে মর্নিং ওয়াক করবো তাই।”
অতঃপর চারজনে হাটা শুরু করলো।মিস্টার অরুণ ও মিসেস পুরোভি একসাথে আগে হাঁটছেন।পিছনে প্রিয়তা ও অনুপম পাশাপাশি হাঁটছে।শীতে একসাথে হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছে দুজনের।
মিস্টার অরুণ ও মিসেস পুরোভি নির্বিকারে হাঁটতে থাকে।কোনো কথা নেই তাদের ভিতরেও।হঠাৎ মিসেস পুরোভি বলেন,”আমাদের দিনগুলো কিভাবে যেনো ফুরিয়ে যাচ্ছে তাই না?”
মিস্টার অরুণ তাকালেন মিসেস পুরোভির দিকে।তারপর সামনের দিকে অনুসরন করে বললেন,”এখন আমরা হাঁটছি।একটু পর বাসায় যাবো।এই বর্তমান তখন অতীত হয়ে যাবে।আমাদের প্রত্যেক মোমেন্ট প্রত্যেক স্মৃতি তেমন।অতীত হয়ে থাকে শুধু।পিছে ফেলে আসা দিনগুলো তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়।”
“তুমি অনেক সুন্দরভাবে সবকিছু গোছাতে পারো।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিস্টার অরুণ বললেন,”তোমাকে কি গোছাতে পেরেছি আমি?”
থমকে গেলেন মিসেস পুরোভি।মনে মনে আওড়ালেন,”এতদিনেও বুঝলে না এই ভালোবাসা! নিরবেও ভালোবাসা যায়।আমি প্রকাশ করতে পারিনি।কিন্তু ভালো তো বেসেছি।
কিছুটা দূরে থাকা অনুপম ও প্রিয়তা হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছে।প্রিয়তা বলে,”ফুফু আম্মা ও ফুফা আব্বাকে কত সুন্দর লাগছে তাই না?”
অনুপম তাদের দিকে তাকিয়ে বললো,”নরমাল লাগছে।স্বামী স্ত্রীর মতই আছে কিন্তু মনের মিল দেখা যাচ্ছে না।”
প্রিয়তা অনুপমের দিকে তাকিয়ে বলে,”এমন মনে হওয়ার কারণ!ওদের তো ঠিকই লাগছে।”
হালকা হেসে অনুপম বললো,”কিছু কিছু সম্পর্কের গভীরতা অনেক।কিন্তু মনের মিলন খুবই কম।এই সম্পর্ক বয়ে বেড়ানোতে খালি পুড়তে হয়।তাও এক তরফা ভাবে।”
প্রিয়তা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,”কিছু ভালোবাসা গোপন থাকে।যেগুলো প্রকাশ করা যায় না।”
প্রতিবাদ করে অনুপম বলে,”কে বলেছে প্রকাশ করা যায় না!আমি তো বলবো প্রকাশ করা উচিত।তাহলে এই দূরত্ব থাকে না।যত বেশি অপ্রকাশিত থাকে দিন শেষে ওপর মানুষটা তত বেশি পুড়তে থাকে।”
এ যেনো এক রেড সিগনাল পেলো প্রিয়তা।প্রিয়তার মনে হলো আজ অনুপমকে মনের কথা বলা উচিত।যেই ভাবা সেই কাজ।আজ রাতেই বলে দিবে সে।তার স্টাইলে সম্পর্কের শুরু করবে।
আজ অনুপম দুপুরে খেতে আসবে না বলে।তার নাকি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে।এটা তাকে করতেই হবে।প্রিয়তা বাসায় তাড়াতাড়ি রান্না সেরেছে।তারপর কলেজ গেলো একটু কাজ আছে।সেখান থেকে নীলক্ষেতে গেলো।গল্পের বই কিনতে হবে।নীলক্ষেত থেকে বই নিয়ে ফুলের দোকানে গেলো।একটি লাল গোলাপ ও বেলি ফুলের মালা কিনলো।রাতে প্রোপজ করার সময় সাজগোজ করবে সে।
সবকিছু কেনার পর খুদা তার।তাই একটি রেস্টুরেন্টে যায়।খুব খুশি মনে রেস্টুরেন্টে ঢুকেই দেখতে পায় অনুপম ও রুহি একটি টেবিলে বসে আছে।টেবিলে দুইপাশে দুজন মিটমিট হাসি দিয়ে একে ওপরের সাথে কথা বলতে ব্যাস্ত।রুহি অনুপমকে বলে,”কত তাড়াতাড়ি সম্পর্কগুলো তৈরি হতে যাচ্ছে তাই না।আমরা সবাই এবার একটি হ্যাপি লাইফ পাবো।খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করবো আমরা।”
সাথে সাথে প্রিয়তার হাত থেকে গোলাপ পড়ে গেলো।মন ভেঙ্গে গেলো তার।সাথে সাথেই বাইকে উঠে চলে এলো বাসায়।
বাসায় আসার পথে আবার ভাবলো,”অনুপমকে এই সুযোগ তো আমিই দিয়েছিলাম।ডিভোর্সের কথাও বলেছিলো সে।তাই হয়তো এই মেলামেশা।আজই অনুপমকে বলবো এসব বাদ দিতে।আমি এই বৈবাহিক সম্পর্ক অটুট রাখতে চাই।”পুণরায় ফ্যাকাশে মুখ খুশিতে জ্বলজ্বল করে।
বাসায় এসে প্রিয়তা দেখলো সোফায় এক ভদ্রলোক বসে আছে।ফুফু আম্মা ও ফুফা আব্বা কথা বলছে তাদের সাথে।সবাই সিরিয়াস মুডে আছে।প্রিয়তা জিজ্ঞাসা করে,”কি হয়েছে?”
মিসেস পুরোভি বলেন,”এই দেখ না ইনি কি উল্টা পাল্টা বলছে।বলছে তোরা নাকি ডিভোর্স ফাইল করেছিস।আজ পেপার রেডি।”
বাজ পড়লো প্রিয়তার মাথায়।ডিভোর্স এত তাড়াতাড়ি!সাথে সাথে বললো,”এত তাড়াতাড়ি কিভাবে সম্ভব?”
যে লোকটি এসেছে সে সীমান্তের অ্যাসিস্টেন্ট।প্রিয়তার প্রশ্নে তিনি সাথে সাথে বললেন,”আসলে অনুপম সাহেব ডিভোর্সের জন্য একবার অফিসে যান।আপনাদের বনিবনা হয় না আরো ভিন্ন কথা বলেন।আমরা আপনার কথা জিজ্ঞাসা করাতে উনি বলেন আপনি রাজি।”
বাকি কথা বলার আগেই প্রিয়তা আবার বলে,”হ্যা আমি রাজি হয়েছিলাম।কিন্তু আপনাদের থেকে জানানো হয় সময় লাগবে অনেক।”
“ম্যাডাম যেহেতু তেমন কোনো ঝামেলা নেই।এটি একটি মিউচুয়াল সেপারেশন।তাই পেপার রেডি হতে সমস্যা হয় নি।সীমান্ত স্যার খুলনাতে গেছেন।
তিনি আমাকে তিনদিন আগে ফোন দিয়ে বললেন,”অনুপম নামে একজন কেস ফাইল করেছে।তার এই কাজটি আর্জেন্ট করতে হবে।তুমি যত দ্রুত সম্ভব সলভড করো।”
আমিও রাজী হয়ে যাই।”
বলেই প্রিয়তার হাতে কাগজগুলো দেয়।
কাগজটি হাতে নিয়ে দেখে প্রিয়তা।কাগজের উপরে ডিভোর্সের কারণ হিসেবে দেখে প্রিয়তা পরকীয়া করে।মেজাজ গরম হয়ে গেলো তার।অনুপম তাকে দোষারোপ করলো কিভাবে?সাথে সাথে বলে,”আপনাদেরকে বলা হয়েছে মিউচুয়াল সেপারেশন।আপনি এখানে আমার নামে মিথ্যা অ্যালিগেশন কেনো দিচ্ছেন?”
“দুঃখিত ম্যাডাম এটা আমি না। স্যার নিজেই আপনার নামে এই কেস করেছেন।আপনাকে ও আপনার শশুড় শাশুড়িকে দেখে মনে হচ্ছে আপনারা শকড।তাই আমি বলছি আপনাকে। স্যার ফরম পূরণ করার সময় কারণ হিসেবে এটাই লিখেছিলো।আমরা তো উকিল।আমাদের কাজ হচ্ছে টাকা নিয়ে মিথ্যাকে সত্য আর সত্যকে মিথ্যা বানানো।যেহেতু আপনারা একে অপরকে মুক্তি দিবেন।আমার মনে হয় এটা না করলেও হতো।তবে অনুপম সাহেব কোর্ট অব্দি যেতে চান না।তাই পেপার নিয়ে এখানে আসা।”
তেতে উঠলেন মিসেস পুরোভি,”কিসের ডিভোর্স!কোনো ডিভোর্স হবে না।আগে আমি অনুপমের সাথে কথা বলবো।তারপর যা করার করবেন।”
ঘড়িতে সময় দেখলো সীমান্তের অ্যাসিস্ট্যান্ট।বললো,”আমার আরেক জায়গায় যেতে হবে।আপনাদের কাছে পেপার দিয়ে গেলাম।আপনারা বোঝাপড়া করে নিবেন।আমি আসি তাহলে।সিদ্ধান্তটি তাড়াতাড়ি জানিয়ে দিবেন।”বলেই চলে গেলেন তিনি।
মিস্টার অরুণ তাড়াতাড়ি কল দিলেন অনুপম কে।অনুপম কল রিসিভ করতেই মিস্টার অরুণ জিজ্ঞাসা করে,”কোথায় তুমি?”
ওপাশ থেকে অনুপম বলে,”মাত্র অফিসে আসলাম।কেনো কি হয়েছে?”
বাকি কথা বলার আগেই মিসেস পুরোভি লাউড স্পিকারে দিয়ে বলে,”তুমি কি আজ প্রিয়তাকে
বাকি কথা বলার আগে অনুপম বলে,”হ্যা মা আমি পাঠিয়েছি প্রিয়তার কাছে।ওকে ওটা গ্রহণ করতে বলো মা।আমি সম্পর্কটাকে এভাবে আগাতে চাই না।সম্পর্কের পরিবর্তন দরকার।আমাকেও একটু বুঝো প্লিজ।”
মিসেস পুরোভি তাকালেন প্রিয়তার দিকে। অনুপমকে জিজ্ঞাসা করলেন,”তাহলে এটাই তোমার শেষ সিদ্ধান্ত?”
নির্দ্বিধায় অনুপমের উত্তর আসে,”হ্যা।”
সাথে কল কেটে দেয় মিসেস পুরোভি।প্রিয়তা ভাবতে লাগলো সকালে তাহলে অনুপম এই কথাগুলোর ইঙ্গিত দেয়।সে কত বোকা যে অনুপমের কথাগুলোর অন্য মিনিং করে। আর প্রিয়তাকে ডিভোর্স দিবে বলে মিথ্যা মামলা দিলো।এত বড় মিথ্যা তার নামে।ঘৃণা এসে গেছে প্রিয়তার মনে।চোখে পানি চলে আসে তার।ঘোলা ঘোলা লাগে সবকিছু।কোনো কিছু না ভেবে সাথে সাথে প্রিয়তা সই করে দেয় ডিভোর্স পেপারে।মিসেস পুরোভি ও মিস্টার অরুণ কিছুই বলতে পারে না।বলার আগেই যে সই করে দেয় চোখের নিমিষে।
সই করে প্রিয়তা তাদেরকে বলে,”আমি আজ গ্রামে চলে যাচ্ছি ফুফু আম্মা।ডিভোর্স পেপার বেডরুমে রেখে দিচ্ছি।”
বলেই ব্যাগ গোছাতে লাগে।মিসেস পুরোভি বাধা দেয় না। কোন মুখে দিবে সে।তার ছেলেই তো সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটালো।
ব্যাগ গুছিয়ে প্রিয়তা ডায়নিংয়ে আসলো।মেইন দরজার দিকে পা বাড়ানোর আগে বললো,”তোমাদের ছেলেকে বলে দিও মুক্ত করেছি তাকে।সে তার রুহিকে তাড়াতাড়ি বিয়ে করে সুখে থাকুক। মিথ্যে দায়ভার দিয়ে দূর করলো আমাকে।দূর হলাম আমি।সুখে থাকুক সে।আমি আসছি।”বলেই চলে গেলো।
মিসেস পুরোভি কল দিয়ে জানিয়ে দেয় প্রিয়তার বাবাকে,”আজ প্রিয়তা যাচ্ছে বাসায়।ওকে বাসস্ট্যান্ড থেকে নিয়ে বাসায় যেও।এখানে অনেক বড় ঝামেলা হয়েছে।আমরা কাল আসছি ভাই।”
প্রিয়তার বাবা কোনো প্রশ্ন করলেন না।তার মেয়ে একা একা আসতে পারে।প্রায়ই আসতো আগে পড়াশোনার মাঝে।যেহেতু বোন কল দিয়ে বললো ঝামেলা হয়েছে।তাই সে তাড়াতাড়ি বাসায় যায়।বাসায় যেয়ে রওনা দিবে বাসস্ট্যান্ডে।ভদ্রলোক তখন বাজারে ছিলো।
ভাইকে সাবধান করে একটু শান্তি পেলেও রুহি কে নিয়ে ভাবতে লাগলেন।রুহির বিষয়ে কিছুই জানে না অনুপমের বাবা মা।
সন্ধায় অনুপম বাসায় আসে।এসে দেখতে পায় বাবা মার মুখ কালো করে বসে আছে।অনুপম কিছু বলার আগে মিসেস পুরোভি বলেন,”রুহির কথা তুমি আমাদের বলনি কেনো?”
অনুপম অবুঝের মত তাকিয়ে থাকে।রুহির কথা তার বাবা মা কিভাবে জানলো?ছেলেকে চুপ দেখে বিরক্ত অনুপমের বাবা মা।মিসেস পুরোভি আবারও জিজ্ঞাসা করলেন,”কি হলো বলো?কেনো বলোনি আমাদেরকে?তোমাকে আমি অনেকবার জিজ্ঞাসা করতাম তোমার কোনো মেয়ে পছন্দ কি না।তুমি কি বলতে মনে আছে?বলতে আপাদত নেই মা।ভবিষ্যতে বলবো।এখন রুহি কোথা থেকে আসে?”
অনুপম বুঝে যায় তার বাবা মা সব জেনে গেছে।তাই বলে,”আসলে মা তখন রুহির বড় বোনের বিয়ে হয় না।ওর বড় বোনের বিয়ে না হওয়া অব্দি ওর বাবা ওর বিয়ে দিবে না।এদিকে তোমাকে বলতে লজ্জা লাগতো।ভেবেছিলাম রুহির বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেলে রুহিকে নিয়ে তোমার সাথে কথা বলবো ।”
ঠাস করে চর দেয় অনুপমের গালে মিস্টার অরুণ। রাগে গা কাপছে তার।অনুপমের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,”এই শিক্ষাদীক্ষা পেয়েছো তুমি!নিজে পরকীয়ায় জড়িয়ে কিনা বউকে মিথ্যা দোষারোপ করো?ছিঃ তুমি এত নিচ। কালই আমরা চলে যাবো।সম্পর্ক রাখবে না আমাদের সাথে।”বলেই ঘরে গেলেন তিনি।অনুপমের মা কিছু বললো না।অনুপম অনেক বার ডেকেছে কিন্তু সাড়া দেননি।তিনি তার মত ঘরে চলে যান।
চলবে,