#আষাঢ়ি_পূর্ণিমা
#পর্ব_৯
✍️ খাদিজা আক্তার (Diza)
—আইচ্ছা আমি মানলাম আমাগো সম্পর্ক শেষ। কিন্তু একটা কথা তোমার আইজকা কইয়া দেই। তোমার লগে আমার এক সম্পর্ক শেষ হওয়ার লগে লগে অন্য সম্পর্ক শুরু হয়। এ কারণে সম্পর্ক শেষ, সম্পর্ক শেষ কইয়া আমার মাথা খাইয়ো না। পারলে আমারে একটু বুঝার চেষ্টা কইরো; আমি কী চাই, আমার মন কী চায়।
কথা শেষ করে আদী চলে গেল। এদিকে রাত্রির মনে হচ্ছে সে এখন পৃথিবীর বুকে নেই। চারপাশের সবকিছু কেমন লণ্ডভণ্ড মনে হচ্ছে। নিজের শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণও যেন হারিয়ে যাচ্ছে। আচমকা রাত্রি মেঝেতে বসে পড়ল। অন্য সময় হলে হয়তো বুক ফাটিয়ে আর্তনাদ করত, কিন্তু এখন রাত্রির কিছু করতে ইচ্ছে করছে না। ঝিম ধরা মাথায় হাজারো চিন্তা আর কথাবার্তা ঘুরছে। তবে অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাত্রির চোখের জলে কপোল ভিজতে লাগল অবিরত।
*
প্রায় এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে অথচ স্বর্ণালির মৃত্যু নিয়ে সৃষ্টি রহস্যের সমাধান এখনো হয়নি। তবে অনেক তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্য হলো স্বর্ণালির মাথায় না কি মগজ নেই এবং দুই পশুতুল্য মানুষ দ্বারা স্বর্ণালি শারীরিক নির্যাতনের স্বীকার হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে স্বর্ণালির মৃত দেহের সাথে পাশবিক নির্যাতন করা হয়েছে। লা””শ গোসল করানোর ফলে অনেক আলামত বিলুপ্ত হলেও সব হারিয়ে যায়নি। ফলে তথ্যগুলো পেতে সাজ্জাদের কোনো অসুবিধা হয়নি। সাজ্জাদ জানিয়েছে,
—দেখ আদী, স্বর্ণালির আগে পোস্টমর্টেম হয়নি। পোস্টমর্টেমের নাম করে ওকে নিয়ে গিয়ে প্রথমে ওকে শোষণ করেছে। মানুষের মস্তিষ্ক বিকৃত হলেই সে মৃত মানুষের সাথে এমন জঘন্য আচরণ করে থাকে। তুই নিশ্চয়ই শুনেছিস, কিছুদিন আগে এক ডোমের তথ্য প্রকাশ পায় যে কিনা মৃত মানুষের সাথে এসব করত। এটি মূলত এক ধরনের অসুখ, কিন্তু কথা হচ্ছে এরপর স্বর্ণালির মগজ বের করে সেটি নিয়ে করেছেটা কী? কারণ ঢাকা মেডিক্যালের কেউ স্বীকার যায়নি এ বিষয়ে। এসব দেখে আমার মনে হচ্ছে ওর সুই””সাইডের পিছনে কারো হাত আছে।
—তুই কি নিশ্চিত যে স্বর্ণালি সুই””সাইড করেছে? এমনও তো হতে পারে ওকে খু””ন করা হয়েছে। এরপর সুই”””সাইডের বিষয়টি সাজানো হয়েছে।
—না রে। এ ব্যাপারে আমি একশো ভাগ নিশ্চিত। পোস্টমর্টেম অনুযায়ী রাত নয়টার সময় স্বর্ণালি সুই””সাইড করেছে। এরপর যা হওয়ার একের পর এক হয়েছে। ওর বিষয়ে তদন্ত করতে গিয়ে আরও কিছু তথ্য সামনে এসেছে।
—কীসের তথ্য?
—স্বর্ণালির সাথে যা হয়েছে তা এর আগেও বেশ কয়েকবার অন্যদের সাথে হয়েছে।
—কী কছ?
—হ্যাঁ, আরও মেয়ে এমন সুই””সাইড করেছিল। এরপর তাদের সাথেও পাশবিক নির্যাতন হয় এবং তাদের মাথা থেকে মগজ বের করে নেওয়া হয়।
—কী সাংঘাতিক ব্যাপার!
—হুঁ, সাংঘাতিক। তবে জটিলও বটে। মূল হোতা পর্যন্ত যেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে।
এ পর্যন্ত আদী জানতে পেরেছিল। এর বেশি আর জানা যায়নি। পোস্টমর্টেম করে স্বর্ণালির লা””শ ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। স্বর্ণালির ক্ষতবিক্ষত দেহ আদী নিজ হাতেই কবরস্থানে বয়ে নিয়ে গিয়েছিল। আর প্রতি মূহুর্তে স্বর্ণালির প্রতি কৃতজ্ঞতায় তার বুক কান্নায় ভরে ওঠেছিল। মনে মনে সে বলেছিল,
—তুই আমাকে বদলে দিয়ে গেলি, স্বর্ণালি। আমার মাঝে যে হিংস্রতা ছিল তা কেড়ে নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলি। তোর এ ঋণ আমি আমৃত্যু শোধ করতে পারব না বোন।
*
আদীর শরীর ভালো নেই। জ্বর, সর্দি ও মাথা ব্যথা একসাথে তার দেহে অতিথি হয়ে এসেছে। নিমন্ত্রণ শেষে কবে নাগাদ যাবে তা আদীর অজানা। অসুখ বিদেয় করার তাড়া আদীরও নেই। অসুখ জিইয়ে রাখার মাঝে এক ধরনের নেশা আছে। সেই নেশার সন্ধান আদীকে অবশ্য দিয়েছিল রাত্রি। গা যখন জ্বরে পুড়ে যেত রাত্রির তখনও দিব্যি ওষুধ ছুঁড়ে দিয়ে বলত,
—আমার ওষুধ খেতে ভালো লাগে না, আদী।
আদী চুপ করে থাকত আর অবাক হয়ে ভাবতো,
—জ্বরের ঘোরে তোমার মুখে আমার নাম কী যে অদ্ভুত লাগে রাত্রি! আব্বা আম্মার দেওয়া নামটি যে তোমার মুখেই বড়ো বেশি আদুরে লাগে।
মনে মনে বললেও মুখে বলতে পারত না আদী। তাছাড়া ওষুধ ছুঁড়ে দেয় বলেও রাত্রির মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারত না; বুকের ভেতর ভাঙচুর হতো।
আদী জেগে ওঠল। তার চোখে এখন আধো ঘুম। ঘুমের জন্যই এতক্ষণ সে রাত্রিকে নিয়ে এতসব কল্পনা করছিল।
বাইরে চকচকে রোদ, কিন্তু আদীর শীত করছে। মনে হয় জ্বর আবার বাড়ছে। হঠাৎ করে জ্বর হওয়ার কারণ আদী বুঝতে পারছে না। তবে এ নিয়ে এখন সে ভাবতেও চায় না। আদী এখন রাত্রিকে নিয়ে ভাবতে চায়। কিন্তু রাত্রির তো বিয়ে হয়ে যাবে। তখন সে অন্যের বউ হয়ে যাবে। আদীর মনে হঠাৎ প্রশ্ন এলো,
—অন্যের বউকে নিয়ে কি ভাবা যায়? আর আমি কি রাত্রিকে ভালোবাসি?
এ প্রশ্ন করার পরই চোখের সামনে রাত্রিকে দেখতে পেল আদী। সে বুঝতে পারছে এ তার কল্পনা করা আস্ত এক রাত্রি যার সাথে বাস্তবের রাত্রির কোনো তফাত নেই। আর রাত্রি তার ঘরেই বা কেন আসবে? সেদিন ওকে চড় মেরে চলে আসার পর আদী তো আর রাত্রির খবর নেয়নি। রাত্রিও ফোন করে জিজ্ঞাসা করেনি, সে কেমন আছে। তাছাড়া আজ অনেক মাস হলো রাত্রি তাদের বাড়িতে আসে না। আদীর জ্বর আর ঘুমের ঘোরে হঠাৎ এক অদ্ভুত ইচ্ছে নিজের মাঝে সৃষ্টি হলো। চট করে শরীর থেকে কাঁথা সরিয়ে আদী বিছানা ছাড়ল। অসুস্থ আর ঘুমের জন্য তার চলনবলনে কোনো তাল। কিন্তু বেসামাল হয়েও আদী তার কাল্পনিক রাত্রির দিকে ছুটে গিয়ে শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করল,
—রাত্রি, আমি কি তোমায় ভালোবাসি?
কপালে ঠাণ্ডা কিছুর স্পর্শ পেয়ে চোখ খুলল আদী। চোখ খুলে সময় আন্দাজ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। কপালে ঠাণ্ডা লাগার কারণ খুঁজতে গিয়ে বুঝতে পারল তার কপালে কেউ জলপট্টি দিচ্ছে। চোখ ফিরিয়ে দেখল তার আম্মা মুখ মলিন করে বসে আছে।
—এখন কেমন লাগছে আব্বা?
মায়ের উদ্বিগ্ন কণ্ঠ শুনে আদী নিঃশব্দে মাথা নাড়িয়ে বোঝাল এখন সে ভালো বোধ করছে। আদীর শরীর বেশ দূর্বল লাগছে। তাই আম্মার দিকেও সে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না। চোখ বুজে দিলো, কিন্তু চোখ বুজে দিতেই মনে পড়ল সে কাল্পনিক রাত্রিকে জড়িয়ে ধরেছিল। তবে এরপর কী হয়েছিল আদী মনে করতে পারছে না। তার ক্লান্ত শরীর মনকেও ক্লান্ত করে দিচ্ছে।
*
বাড়িতে বিয়ের আমেজ। তবে যার বিয়ে, তার এসবে মন নেই অথচ সেই বিয়েকে কেন্দ্র করে পাড়াপড়শির ঘুম নেই। বিয়ের সব আয়োজন খুব দ্রুত গতিতে চলছে কারণ বিয়ের আর মাত্র দশ দিন বাকি। দিন যত ফুরিয়ে যাচ্ছে, রাত্রির চিন্তা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। রাত্রি কী করবে বুঝতে পারছে না অথচ তার মনের কথাগুলো বলার মতো কেউ নেই। আদী ছিল আগে পরম বন্ধু, কিন্তু সেদিনের পর ওকে শত্রু ছাড়া রাত্রি অন্য কিছু ভাবতে পারে না। তবে একটি চিন্তা রাত্রিকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। আদীর বলা একটি কথা সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না,
—তোমার লগে আমার এক সম্পর্ক শেষ হওয়ার লগে লগে অন্য সম্পর্ক শুরু হয়।
সত্যিই কি তাই? রাত্রি ভাবতে গেলে কেমন যেন পাগল হয়ে যায়। এছাড়া আদীর দাবি, এক বছরে তাদের মাঝে সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু কোন সম্পর্ক সৃষ্টি হলো তাদের মাঝে এক বছরে?
—রাত্রি আপু?
(চলবে)