#আষাঢ়ি_পূর্ণিমা
#পর্ব_৭
✍️ খাদিজা আক্তার-??????? ????? (Diza)
রাত্রি ইতস্ততভাবে জবাব দিলো,
—স্বর্ণালির শরীরে অন্য দাগ আছে।
—অন্য দাগ মানে? কী যা-তা বকছো তুমি?
—আপনি… আপনি বাইরে গিয়ে দেখুন। সবাই কীসব বলাবলি করছে।
—সে না হয় দেখব। কিন্তু আমায় এত পর করে দিলে?
অবাক চোখে তাকিয়ে রাত্রি শুধালো,
—মানে?
—সারাজীবন তুমি করে ডাকতে। আর আজকে সম্পর্কে সমাপ্তি টেনে আমাকে আপনি করে ডাকছ? এত পর করে দিলে আমায়? আমি তোমাকে রাগে ওসব কথা বলি তারমানে কি আমি তোমায় কিছু ভাবতাম না, রাত্রি? আমাদের সম্পর্ক এত তুচ্ছ কবে ছিল?
রাত্রি নিজেও জানে না সে কখনো সম্বোধন পরিবর্তন করেছে। তবে একবার কিছুর পরিবর্তন হলে তা ঠিক করা বড়ো কঠিন বিষয়। এরপরও রাত্রি নিজেকে স্থির রেখে আদীকে পূর্বের সম্বোধনে বলল,
—তোমার সাথে আমার তো দুইটি সম্পর্ক ছিল। প্রথম সম্পর্কে তুমি আমার ফুপাতো ভাই আর দ্বিতীয় সম্পর্কে আমার খুব ভালো বন্ধু। কিন্তু এসব সম্পর্ক তো তুমি রাখতে চাও না। তাহলে আমি কী করব?
আদী মুখোমুখি হলো রাত্রি। খুব কাছ থেকে চোখে চোখ রেখে নরম কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল,
—শুধু কি এ দু’টি সম্পর্ক ছিল আমাদের মাঝে? গত এক বছর ধরে দু’টি মানুষ যে একে অপরকে খুব কাছ থেকে জেনেছে তাকে তুমি কী বলবে?
রাত্রি তীক্ষ্ণ চোখে আদীকে দেখে বলল,
—এ দু’টি সম্পর্কের বাইরে আর কী থাকতে পারে? থাকার মতো আমি তো দেখছি না। আর তুমি হয়তো ভুলে গেছ, তোমার ইচ্ছে নেই আমার সাথে সম্পর্ক রাখার। সে সম্পর্ক বন্ধুত্বের হোক বা অন্য কিছুর। তারপর তোমার প্রেমিকা…
—রাত্রি…
আদী ধমকে ওঠল। এতে রাত্রি কিঞ্চিৎ ভয় পেলেও আহামরি কিছু প্রকাশ করল না। আদী সামনে থেকে সরে গিয়ে বলল,
—বুশরা আমাকে ভালোবাসে, কিন্তু আমি তাকে ভালোবাসি কিনা জিজ্ঞাসা করেছ আমায়?
—এসব জেনে কী করব আমি? তারচেয়ে স্বর্ণালির বিষয়টি নাড়াচাড়া করে দেখো। তোমার সম্মুখীন হতেও এখন আর আমার ইচ্ছে করে না। অথচ একসময় আমি কত…
সুদীর্ঘ সময় ধরে চেপে রাখা কান্না এবার বাঁধ ভেঙেছে। সেটি লুকানোর জন্য ব্যাকুল রাত্রি নিমিষেই আদীর চোখের আড়াল হলো। কিন্তু এতেও আদীর চোখ এড়ালো না। আদী স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে রাত্রির চোখের নোনা জল। এতে কি তার কষ্ট হচ্ছে? হলেই বা কী। আদী তো আজ পর্যন্ত রাত্রিকে বোঝাতে পারেনি তার অন্তরের চাওয়াটি। তবে একেবারেই চেষ্টা করেনি বললে ভুল বলা হবে। কারণ আদী প্রায়শই রাত্রিকে বলেছে,
—হয়তো তোমার মতো একটি মেয়ে পারে আমার জীবন বদলে দিতে।
*
পুলিশ ইন্সপেক্টর সাজ্জাদকে খবর দেওয়া হয়েছে কারণ সকলে অনুমান করছে স্বর্ণালির সাথে খারাপ কিছু হয়েছে। পোস্টমর্টেম করার কথা উল্লেখ করলেও ঢাকা মেডিক্যালে স্বর্ণালির পোস্টমর্টেম হয়নি আর এ বিষয়টি সবাইকে অনেক বেশি অবাক করেছে। সাজ্জাদ তার সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে আসল তথ্য খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করবে। কিন্তু তার আগে স্বর্ণালির শরীরের দাগগুলোর রহস্য উন্মোচন করতে হবে। সেটি করার জন্য স্বর্ণালির লা””শ সাজ্জাদ পোস্টমর্টেম করতে পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন বসার ঘরে বসে সাজ্জাদ সমস্ত বিষয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করছে।
—আদী, আমাকে শুরু থেকে আবার বল। জানিস তো একটি কথা দুইবার না শুনলে সেটি আমি ধরতে পারি না।
স্বর্ণালির সুই””সাইড, লা”শের হদিস পাওয়া নিয়ে ঝামেলা, রাত্রির সাথে মনোমালিন্য, স্বর্ণালির মৃত্যু নিয়ে নতুন রহস্য— এসব বিষয় একের পর এক ঘটে গেছে বলে আদী এখন বিমর্ষ হয়ে পড়েছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার দেহে প্রাণ আছে, কিন্তু মন নেই।
—আদী? ওই শালা, ঝিম মেরে আছিস কেন?
আদী নড়েচড়ে বসে সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
—ভাবছি।
—ভাবিস না। আমি দেখছি কী করা যায়।
—কী আর করবি? কতদিন খুব ইনভেস্টিগেশন হবে। এরপর সব শেষ। ফুপু কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মেয়ে মৃত্যুর চেয়ে এ সংবাদ তাকে বেশি কষ্ট দিচ্ছে। এত পরিমাণ দূর্বল হয়েছে যে এখন স্যালাইন দিয়ে বিছানায় ফেলে রাখতে হচ্ছে।
আদীর কথা শুনে সাজ্জাদের মুখ লজ্জায় রক্তিম হলো। চোখ জোড়া আপনাআপনি নেমে গেল। পুলিশ সম্পর্কে এ ধরনের চিন্তা অধিকাংশ মানুষের আছে। তাই সাজ্জাদ বিতর্কে না গিয়ে বলল,
—আমাদের ডিপার্টমেন্টের বদনাম আছে— এ আমি জানি। কিন্তু আমি চেষ্টার কমতি রাখব না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলিস না। দয়া করে আমাকে সবটুকু বল।
আদী দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে রাজি হলো,
—ঠিক আছে। আমি গোড়া থেকে বলছি। তুই মনোযোগ দিয়ে শুনিস।
—হুঁ।
—স্বর্ণালির সাথে ফুপুর কথা হয়েছিল দুই দিন আগে। ও জানিয়েছিল ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা; স্কয়ার হসপিটালে। বলেছিল বোডিঙে ফিরে এসে ফুপুকে জানাবে, কিন্তু ওর কোনো খবর নেই। এরপর যেমন করেই হোক ফুপু জানতে পারে ও সুই””সাইড করেছে। ফুপু বোডিঙে ছুটে যায়, কিন্তু ওর লা””শ না পেয়ে আমাকে খবর দেয়। আমি গিয়ে সবাইকে জিজ্ঞাসা করি, কিন্তু কেউ ওর হদিস দিতে রাজি হয়নি। এরপর নানা ভয় দেখানোর পর বোডিং সুপার মুখ খোলে। জানতে পারি ওকে ঢাকা মেডিক্যালে নেওয়া হয়েছে। সেখানে গিয়েও একই সমস্যা। কেউ ওর সম্পর্কে কিছুই জানে না। এরপর সেখানেও অনেক হাঙ্গামা করার পর লা””শ পাই। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায় তাই বাবা বলেছিল আজকে দাফন করতে। সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল, কিন্তু হঠাৎ জানতে পারি ওর শরীরে কাটাছেঁড়ার পরিবর্তে অন্য দাগ রয়েছে। আমার মাথায় কিছু ঢুকছিল না। আচমকা তোর কথা মনে পড়ল আর কল করলাম।
এ বলে আদী থামতেই সাজ্জাদ বাহবা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে ওঠল,
—পারফেক্ট কাজ করেছিস। দেখ, আমি ওর ডেড””বডি দেখেছি। গলায় মারাত্মক একটি লালচে দাগ আছে। আপাতত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে ও গলায় দড়ি দিয়েছে। তবে শরীরের দাগ নিয়ে যা আশংকা করা হচ্ছে। এতে কেস দুই দিকে যেতে পারে। এক, হয় ওকে কেউ পাশবিক নির্যাতন করার পর ছেড়ে দিয়েছে আর ও বোডিঙে ফিরে গলায় দড়ি দিয়েছে। দুই, কেউ ওকে নির্যাতন করেও স্বস্তি পায়নি তাই শেষ শান্তি খুঁজে পেতে গলায় দড়ি পরিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছে।
—এমন জঘন্য বিষয় আমি ভাবতেই পারছি না। ও বড়ো মেধাবী ছাত্রী ছিল। অনেক শখ করে ফুপু ওকে ঢাকায় পড়তে পাঠিয়েছিল। কিন্তু শেষে এমন হবে তা কি তিনি জানতেন?
সাজ্জাদ উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এলো আদীর কাছে। একটু ঝুঁকে কাঁধে হাত রেখে বলল,
—আমাদের ভাবনা সবসময় আমাদের মতো করে চলে না রে। Life is so difficult. চিন্তা করিস না পোস্টমর্টেমে কিছু জানতে পারলে আমি তোকে জানিয়ে দিবো। বন্ধুর বোন তো আমারও বোন।
সাজ্জাদের শেষ বাক্যে দরদ ভেসে এলো আর সেটি শুনে আদী অবাক চোখে তাকাল। সাজ্জাদ আদীর চেয়ে দুই মাসের বড়ো। আদীর কৈশোর কেটেছিল সাজ্জাদের সাথে। এরপর সাজ্জাদ তার নানার বাড়ি চলে যায় লেখাপড়া করতে। যোগাযোগ ছিল, কিন্তু বড়োই অল্প। কথা হতো প্রায়শই আর কথা বলতে গিয়ে আদীর মনে হতো সাজ্জাদের মন মাটির তৈরি নয়, পাথরের তৈরি। এত বছর ধরে আদী মেনে এসেছে সাজ্জাদ এক পাথুরে মানবের নাম। কিন্তু আজকে এ পাথুরে মানবের মাঝে নরম একটি মন দেখে আদী বড়ো বেশি অবাক হলো। তবে স্বস্তিতে তার মন ভরে গেল। মনে মনে আদী ভাবল,
—তাহলে তোর মন পাথুরে নয়, মাটির তৈরি। কিন্তু সাজ্জাদ, আমি কীসের তৈরি রে? রাত্রির প্রতি আমার মন কীরূপে প্রকাশ পায়? পাথর না কি মাটি?
(চলবে)