আষাঢ়ি পূর্ণিমা পর্ব ৬

0
363

#আষাঢ়ি_পূর্ণিমা
#পর্ব_৬
✍️ খাদিজা আক্তার-??????? ????? (Diza)

কথা শেষ করেই রাত্রির চিবুকে আলতো করে হাত রাখল ময়না বেগম। তার গলায় আদুরে ভাব, কিন্তু রাত্রি গম্ভীর আর স্থির দৃষ্টিতে আম্মাকে দেখল। মিনিট দুই সময় নিয়ে আম্মার হাত সরিয়ে আবারও বলল,

—আমি ঘরে যাচ্ছি, আম্মা।

রাত্রি আর দাঁড়াল না। মেয়ের চলে যাওয়ার পথে তাকিয়ে থেকে ময়না বেগম দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন। নিজের গর্ভের সন্তানকেও সর্বদা চেনা যায় না ও জানা যায় না— এ সত্য তার মনের দরজায় টোকা দিতেই সে কেমন বির্মষ হয়ে পড়ল।

*

সব কিছু ঠিকঠাক। গোসল শেষে লা”শের জানাযা এবং কবর দেওয়া হবে। কিন্তু এর মাঝেই হঠাৎ এক অজানা তথ্য সম্মুখে এলো। স্বর্ণালির লা”শকে ঘিরে সৃষ্টি হওয়া রহস্যের মারপেঁচ নিয়ে এখন থমথমে পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। মিজান তালুকদারের বাড়িতে জল্পনা কল্পনা চলছে।

মিজান তালুকদার হলেন আদীর বাবা। স্বর্ণালির লা”শ নিয়ে গ্রামে ফিরতে গিয়ে প্রায় মধ্য রাত হয়ে গেছে। তাই মিজান তালুকদার সিদ্ধান্ত নিয়ে সবাইকে জানিয়েছিলেন,

—রাত অনেক হয়েছে। তাছাড়া সবাইকে খবর দেওয়া হয়নি। মাঝ রাতে তো আর এসব… কালকে সকাল দশটায় জানাযা হবে।

বড়ো কষ্ট নিয়ে এ কথা বলেছেন মিজানুর তালুকদার। একমাত্র বোনের একমাত্র মেয়ের এমন পরিণতি তাকে বেশ শোকাহত করেছে। তবে পুরুষ মানুষের মন খারাপ করা বড়োই লজ্জার ব্যাপার বলে তিনি মনে করেন। তাই শক্ত গলায় ক্রন্দনরত বোনকে কান্না করতে বারণ করে আদীকে বলেছিলেন,

—আদী, ইমাম সাহেবকে খবর দিয়ে রাখো। কালকে সকাল দশটায় জানাযা হবে।

আদী কেবল ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিল। মিজানুর তালুকদারের কথা মতো সকালে সমস্ত ব্যবস্থা হয়েছে। স্বর্ণানলির লা”শ যথারীতি মেয়েরা গোসল করিয়েছিল, কিন্তু গোসলের এক পর্যায়ে বিভিন্ন কানাঘুষা শুরু হয়। বাড়িময় চলতে থাকা কানাঘুষা যখন রাত্রির কানে পৌঁছায়, তখন সে বিচলিত হয়ে আদীর সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। রাত্রিকে দেখে আদী নিজের মনে একটুখানি স্বস্তি পেয়েছিল, কিন্তু গম্ভীরমুখের দিকে তাকিয়ে ব্যথিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল,

—কল রিসিভ করা হয়নি কেন?

সারাদিন স্বর্ণালির লা””শ নিয়ে অনেক ভুগতে হয়েছিল আদীকে। এত সব করেও রাত্রির জন্য তার মন কেমন করছিল। লা”শবাহী গাড়িতে বসেই সে রাত্রিকে বারংবার কল করেছিল, কিন্তু রাত্রি তার কথামতো আদীর সাথে যোগাযোগ করেনি; কলও রিসিভ করেনি। রাত্রির এমন আচরণে আদীর তখন প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল, কিন্তু এখন তার অন্তরে কোনো রাগ নেই। এ নিষ্পাপ মেয়েটির মুখ দেখলে আদী রাগ করতে ভুলে যায়।

—আমার কথা তোমার কান পর্যন্ত যাচ্ছে না?

রাত্রি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সে আদীর ঘরে এসেছে কথা বলতে; চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে নয়। কিন্তু আদীর ঘরে পা দিয়েই রাত্রি সিগারেটের গন্ধ পেয়েছে যা তার মাঝে চাপা রাগের সৃষ্টি করছে। আদীর সিগারেটের নেশা জোড়ালো ভাবে নেই। তবে প্রায়শই নিকোটিনে বুক ভরাতে হয়— এ বিষয়ে রাত্রি অবগত। কিন্তু অপছন্দ হলেও বলার সাহস কই?

গত দুই দিনের মনোমালিন্যের বিষয়টি এখন মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। তাই সিগারেটের গন্ধ পাওয়ার মতো বিষয় রাত্রির মাঝে রাগ অভিমান আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। আগুনে ঘি ঢালা যাকে বলে।

বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে থাকা আদী এবার উঠে এসে রাত্রির সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল,

—কথা বলছ না কেন?

রাত্রির চোখ মেঝেতে ছিল, কিন্তু এখন আদীর কথা শুনে আচম্বিতে আদীর চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করল,

—এমন শরীর খারাপ হওয়া সত্ত্বেও আপনি সিগারেট খান কেন?

প্রশ্ন করতে গিয়ে রাত্রির গলা ধরে এলো। চোখে একটু একটু করে জল এসে জমছে। রাত্রির ইচ্ছা করছে এ মুহূর্তে ছুটে পালিয়ে যেতে আর কোনো এক নির্জন নদীর তীরে হাত-পা ছড়িয়ে চিৎকার করে কান্নাকাটি করতে। কিন্তু রাত্রি কিছুই করল না। স্থির দৃষ্টিতে আদীর দিকে তাকিয়ে রইল। রাত্রির এমন প্রশ্নে আদী অবাক হলো। অন্য সময় হলে দু’টি কড়া কথা শোনাত৷ কিন্তু এখন সে হেসে ওঠল; বিষাদের হাসি।

—কল করলে রিসিভ করো না। তাহলে আমার শরীরের ভালো মন্দ নিয়ে কেন ভাবছ? আমি মরে গেলে তো তোমার খুশি হওয়ার কথা।

—চিন্তা আমি করছি না। এসব নিয়ে চিন্তা করার মতো লোক আপনার আছে। একটা মেয়ের মরণ হয়েছে। লা””শ এখনো মাটি পায়নি। বাড়ি ভর্তি মানুষ রেখে সিগারেট খেতে আপনার বিবেকে বাঁধেনি?

—এত কাণ্ড করে বেড়ানো লোকের মাঝে তুমি বিবেক খুঁজে বেড়াচ্ছ? তা তোমার তো বিবেক আছে, তাই না? তাহলে সেই বিবেক কি একবারও বলেনি আমার কল তোমার রিসিভ করা উচিত?

—সম্পর্কে সমাপ্তি চেয়েছে কেউ। কারো চাওয়া আমি অপূর্ণ রাখি না।

—তাই না কি রাত্রি? এত মহান তুমি কবে হলে রাত্রি? তোমার মহত্ত্ব অন্ত নেই যখন, সেটা সবার ক্ষেত্রেই দেখালে পারো। সবাইকে খুব মহত্ত্ব দেখিয়ে বেড়ালে। তবে আমার বেলায় তোমার মহত্ত্ব গেল কোথায়? এত করে চাইছি যে জিনিস তা তুমি দিচ্ছ না কেন?

শেষ বাক্যে আদীর গলা ওপরে ওঠল। ক্রমশ সে উত্তেজিত হয়ে পড়ছে; না, রাগ নয়। রাত্রির প্রতি অভিমানে তার অন্তরে ক্রমাগত ছুরি মারা হচ্ছে। রাত্রি আজ বড়ো স্থির হয়ে আছে। মেয়েটি বোধহয় শিখে গেছে, কীভাবে মনের মধ্যে রাগ অভিমান চেপে পাথর হয়ে কথা বলতে হয়।

—তোমার চাওয়া আমি অপূর্ণ রাখিনি। তুমি সম্পর্কের সমাপ্তি চেয়েছিলে। আমি দিয়েছি। এখন আর কিছু বাকি নেই দেওয়ার মতো।

রাত্রি কথাগুলো বলে মেঝেতে চোখ সরিয়ে নিলো। তার চোখেমুখে স্পষ্ট বিরক্তি দেখতে পাচ্ছে আদী। এক গাল হেসে তাচ্ছিল্যের সুরে আদী বলল,

—এটি আমার চাওয়া ছিল! Grand! কিন্তু এতগুলো বছরে রোজ যে একটা জিনিস চাইতাম, সেটা কি পূরণ করবে না কোনোদিন? না কি সেই যোগ্যতা তোমার নেই?

চট করে আদীর দিকে তাকিয়ে রাত্রি বলল,

—এমন একটি দিনে এসব প্রসঙ্গ টানা খুব দরকার ছিল?

—এমন কঠিন গলায় তোমায় কখনো কথা বলতে দেখিনি। সেজন্যে প্রসঙ্গ নিজে থেকে সামনে এসে যাচ্ছে। এত দিন আমি তোমায় কড়া কথা বলতাম, কিন্তু সময়ের স্রোতে তুমিও…

—আমার অন্য কিছু বলার ছিল। আমি মোটেও আমাকে দেখতে ছুটে আসিনি।

কথাগুলো বলতে গিয়ে রাত্রির গলা একটু কাঁপলো না। আদী এমন রাত্রিকে দেখে ভেতরে বড়ো বেশি দূর্বল হয়ে পড়ছে। তাই বিছানায় আবারও হেলান দিয়ে বসে পড়ল। কিছু সময় ঘরে পিনপতন নীরবতা চলল। এরপর আদী বলল,

—বেশ। তাহলে বলো কী বলতে ছুটে এলে।

—স্বর্ণালির সাথে কিছু হয়েছে।

অবাক চোখে তাকিয়ে আদী শুধালো,

—কিছু হয়েছে বলতে?

—আপনাদের বাড়িতে আসার আগেই শুনেছি, স্বর্ণালির লা””শ পেতে অনেক ঝামেলা হয়েছে। পোস্টমর্টেম করার জন্য ওকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তা নিয়েও অনেক রহস্য হয়েছে। অবশেষে না কি ঢাকা মেডিক্যালে ওর লা””শ পেয়েছেন। কিন্তু একটু আগে যারা ওকে গোসল করিয়েছে, তারা অন্য কিছু বলছে।

—অন্য কিছু! অন্য কিছু বলছে; কী বলছে তারা?

—স্বর্ণালির শরীরে পোস্টমর্টেমের সামান্য পরিমাণ চিহ্নও নেই।

—What!

আদী বড়ো বেশি অবাক হলো এবং বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। এরপর বলল,

—তুমি কি আন্দাজে কথা বলছ? পোস্টমর্টেম করলে শরীরে চিহ্ন থাকবে না কেন? আর এ পোস্টমর্টেমে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টিই তো এত যন্ত্রণা দিয়েছিল। এখন বলছ চিহ্ন নেই। কে বলেছে? কার কাছে তুমি এমন কথা শুনেছে?

—আপনি উত্তেজিত হবেন না। আগে ঠাণ্ডা মাথায় আমার কথা শুনুন। সবাই এটি নিয়ে আলোচনা করছে। কারো মাথায় এ বিষয় ঢুকছে না। তাই আমাকে পাঠিয়েছে আপনাকে জানাতে। তাছাড়া আরও একটি বিষয় আছে।

—কী বিষয়?
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here