#আষাঢ়ি_পূর্ণিমা
#পর্ব_১৭
✍️ খাদিজা আক্তার (Diza)
আদী আঁতকে ওঠল,
—কী বলছিস তুই এসব?
—ঠিকই বলছি। ওর লা””শের অবস্থা একদম হুবহু স্বর্ণালির মতো। আর আমার ধারণা এটি সিরিয়াল কি””লিং কারণ লা””শের সংখ্যা কাউন্ট করে প্রায় ৭/৮ হয়ে যায়।
—৭/৮ জনকে একই প্রসেসে মারা হয়েছে আর কেউ খবর পায়নি?
—কী করে পাবে? লা””শের তো অন্য গতি করা হতো। স্বর্ণালির জন্য এ রহস্য সামনে এলো।
—তারমানে কি স্বর্ণালির লাশও গু””ম করার চেষ্টা চলছিল?
সাজ্জাদ মাথা নেড়ে বলল,
—হ্যাঁ, কিন্তু তোর জন্য পারেনি আর আমিও কেঁচো খুঁজতে গিয়ে সাপ পেয়ে গেলাম। ইনভেস্টিগেশনে অনেক কিছু জানতে পেরেছি। তবে এখনো অনেক কিছু জানা বাকি।
—সে আমি জানি যে তুই ঠিক সব খুঁজে বের করেই ফেলবি। কিন্তু জহিরের বিষয়টি কী হলো? ও আমার সাথে ঝগড়া ঝামেলা করলেও ছেলে হিসাবে ভালো। তবে জহির যে আমার বাসার সামনে থাকা মেয়ের সাথে প্রেম করে সেটি অবশ্য আমি জানতাম না। দেখ আমি ওর হয়ে সাফাই গাইছি না। ছেলেটি সত্যিই ভালো। ওর জন্য কেন মেয়েটি সুই””সাইড করতে যাবে? এ মেয়ের তো ক’দিন আগে বিয়ে ভেঙে গেছে। ওর বাপ ভাইয়ের বিষয় নিয়ে ওর জীবন নরক হয়ে ওঠেছে। আমার মনে হয় ওর মৃত্যুর পিছনে অন্য কেউ আছে যারা স্বর্ণালি এবং অন্য লা””শগুলোর সাথে জড়িত। তবে বাপ ভাইয়ের প্রতি প্রতিশোধ নিতে ওকে সুই””সাইড করতে বাধ্য করেছে আর সে দায় জহিরের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে।
আদীর কথা শুনে সাজ্জাদ আচমকা ভ্রুকুটি করে বলে ওঠল,
—কী বললি? বাধ্য করেছে! আরে শালা এ বিষয়টি কেমন করে আমার মাথায় এলো না?
—কী হয়েছে?
—Thanks রে। কেস নিয়ে আরও ২০% তুই খোলাসা করতে সাহায্য করলি। বাকি কথা পরে তোকে জানাব। এখন বাড়ি যা। তোর প্রেসার বাড়লে অন্য সমস্যা হতে পারে। তুই গিয়া একটা লম্বা ঘুম দে আর আমি চললাম ঢাকায়।
অবাক হলো আদী,
—এখন আবার ঢাকায় যাবি!
সাজ্জাদ মৃদু হেসে জবাব দিলো,
—ঢাকায়ই তো সব রহস্য কচুরিপানার মতো ভাসছে। নে নে যা এবার। দেরি করিস না।
*
চোখ খুলল আদী। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে তা সে জানে না। ঘরময় অন্ধকার হয়ে আছে। জানালার পর্দায়ও অন্ধকার লেপ্টে আছে মানে দিন ফুরিয়ে রাত হয়ে গেছে। ঘুমানোর আগে সে তার আম্মাকে বলেছিল,
—আমার ক্লান্ত লাগছে আম্মা। দুই দিন অনেক ঝড় গেছে। এখন আমি ঘুমাব। আমায় যেন কেউ বিরক্ত না করে।
—কিছু খেয়ে তারপর না হয় ঘুমা। প্রেশারের ওষুধও তো খাওয়া দরকার।
—আমার এখন কিছু ভালো লাগছে না। ঘুম থেকে ওঠে তারপর খাব।
—কিন্তু বাপ…
আদী তার আম্মার আপত্তি শোনেনি। ঘুমিয়ে পড়েছিল খাবার আর ওষুধ না খেয়ে। এখনো সে ঘুমিয়ে থাকত, কিন্তু হঠাৎ ফোন বেজে ওঠল বলে ঘুমের সমাপ্তি হলো।
বালিশের পাশে থাকা ফোনটি হাতে নিয়ে আদী দেখল অপরিচিত নম্বর থেকে কল এসেছে। ঘুম চোখেও অবাক হলো সে এবং রিসিভ করে বলল,
—হ্যালো।
—আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া।
একটি মেয়েলি কণ্ঠস্বর শুনতে পেল আদী। আরও অবাক হয়ে জবাব দিলো,
—ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কে আপনি? আমি…
আদী আরও প্রশ্ন করার আগে মেয়েটি বলল,
—ভাইয়া, আমি রাত্রির বান্ধবী; শর্মি। কালকে আপনি যার বাসায় রাত্রিকে রেখে গেলেন।
এবার চিনতে পেরে আদী বলল,
—ও আচ্ছা।
জবাব দিতে গিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসল আদী। এরপর গা ঝেড়ে বলে ওঠল,
—হ্যাঁ, আপু। চিনতে পেরেছি। বলুন কী জন্যে কল করলেন।
শর্মি একটু সময় নিলো এরপর আমতা আমতা করে বলল,
—ভাইয়া, আপনি কি এক্ষুনি একবার আমাদের বাসায় আসতে পারবেন?
শর্মির এমন প্রশ্ন শুনে হতবাক হয়ে গেল আদী,
—কেন? কী হয়েছে?
এ প্রশ্ন করেই হঠাৎ আদীর মন কেমন করে ওঠল,
—রাত্রি! রাত্রি ঠিক আছে তো?
—আপনি আসুন আগে। এখনই একবার আসুন। আমি ফোনে ঠিক করে সব বলতে পারব না।
—কিন্তু আপনি আমাকে ফোনে কিছু তো বলুন। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
—হ্যাঁ আমি আসছি।
*
—আদী, বাপ আমার। এমন অনিয়ম করিস না। তোর ব্লাডপ্রেশার কিন্তু কমার নামই নিচ্ছে না। এমন চলতে থাকলে একটা অঘটন ঘটতে কিন্তু বেশি দেরি হবে না। তুই চাইছিস আমার ভরা বুক খালি করে দিতে?
আদী বিছানায় শুয়ে আছে কপালে হাত ঠেকিয়ে। তার জীবনে একের পর এক কাণ্ড ঘটে চলেছে। ফলে সে বারংবার দিশেহারা হয়ে পড়ছে। নাওয়াখাওয়া সব যেন উঠে গেছে প্রায়। ফলে ব্লাডপ্রেশারে দেখা দিচ্ছে অস্বাভাবিক তারতম্য। এতে আদীর আম্মা অস্থির হয়ে ওঠছেন, কিন্তু তা নিয়ে আদী কিছু ভাবতে চায় না। বিক্ষিপ্ত মনে আর কতক্ষণ ভাবা যায়?
হঠাৎ ফোন বেজে ওঠল। আদী তার আম্মার কথাবার্তা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ফোন রিসিভ করল। এতে ক্ষুণ্ণ মনে আদীর আম্মা চলে গেলেন।
—বল সাজ্জাদ।
—কী বলব? তোর মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে? আমি এত মানা করা সত্ত্বেও তুই কেন ইব্রাহিমের সাথে মারপিট করলি?
আদী চুপ করে আছে। তাই সাজ্জাদ জিজ্ঞাসা করল,
—চুপ করে আছিস কেন?
আদী পালটা প্রশ্ন করল,
—কী বলব?
—কী বলবি মানে? তুই একজন নামি-দামি ডাক্তারের সাথে মারপিট করেছিস। বিষয়টি এত আগে ঘটেছে অথচ আমি কিছু জানলামও না। কেন এমন করলি?
—তো কী করতে বলছিস তুই আমাকে? ওই শালার জন্য আমার রাত্রিকে আমি হারিয়েছি। এরপরও একে ছেড়ে দিবো সে চিন্তার করছিস তুই?
—যা জানিস না তা নিয়ে কথা বলতে আসবি না।
—কোনটি জেনে তোর সাথে আমাকে কথা বলতে হবে? আর তুই আমার বন্ধু হয়ে ওই শালার সাইড নিয়ে কেন কথা বলছিস? রাত্রির বিষয়ে জেনেও তুই…
—তোর মাথা ঠিক নেই আদী। আমি এখন এ বিষয়ে কিচ্ছু বলতে চাই না। আগে স্বর্ণালির কেস মিটে যেতে দে। এরপর জহিরের বিষয় তারপর না হয় তোর বিষয়ে ফয়সালা করব।
আদী কিছু বলতে চেয়েছিল, কিন্তু সাজ্জাদ তাকে সে সুযোগ দিলো না। রাগ-ক্ষোভ নিয়ে আদী হাতের ফোন বিছানায় ছুঁড়ে দিলো। বেশ কিছু দিনের অস্বাভাবিক ব্লাডপ্রেশার আবার চড়চড় করে বাড়ছে। আদীর অস্থির লাগছে। মনে হচ্ছে পৃথিবী যেন শেষ হয়ে যাবে। দ্রুত সে বাথরুমে ঢুকে পড়ল। বরাবরের মতো ঝরনা কলে মাথা রেখে নিজের তপ্ত রক্তকে শীতল করতে লাগল। এত উত্তেজনা আর বুকের জ্বালা নিয়েও রাত্রির সে মুখখানা আদীর চোখের সামনে ভেসে ওঠল। খয়েরি রঙের শাড়ি পরা, চোখে কাজল দেওয়া আর ভেজা চুলের এক আস্ত রাত্রিকে এ মূহুর্তে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে আদী ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠল। কাঁদতে কাঁদতে বিড়বিড় করল,
—এমন কেন করলে রাত্রি? আমার কথা একবারও ভাবলে না? আমি যে শেষ হয়ে যাচ্ছি। এত বড়ো শাস্তি দেওয়ার আগে একটিবার ভাবলেও না?
*
রাতের আকাশ আর আকাশে মস্ত বড়ো চাঁদ। স্নিগ্ধতা ছেয়ে আছে সমস্ত চরাচরে। কিন্তু স্নিগ্ধতা সবসময় মনে প্রশান্তি আনে না। মাঝেমধ্যে একরাশ কান্নাও ডেকে আনে। আদীর আজ কাঁদতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু ছেলেরা হুটহাট কাঁদতে পারবে না। সমাজে ছেলেদের কান্নাকে কাপুরুষের সরূপ মনে করা হয়। তাই বুকফাটা কান্নাকে আদী আজ পূর্ণিমার রাতে জায়গা দিতে চায় না।
একটি দীর্ঘশ্বাস আচমকা বেরিয়ে এলো আদীর বুক চিরে। আজ সকালে আচমকাই বুশরা মারা গেল। কতশত কষ্ট নিয়ে মেয়েটি পৃথিবী ছেড়ে ভাবতেই আদী যেন ভেঙে পড়ল। মেয়েটি বারবার আদীর কাছে মিনতি করেছিল,
—শুধু একটি দিনের জন্য আমাকে গ্রহণ করো; শুধু একটি দিন।
(চলবে)