আষাঢ়ে প্রণয় পর্ব ২

0
474

#আষাঢ়ে_প্রণয়
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_২

সকাল হতেই সম্পূর্ণ বাসাটা বিয়ের রবে ভরে গেল। রিধি রুমে চুপচাপ খাটে হেলান দিয়ে বসে আছে। বাইরে আলোর ঝলকানিটাও আজ তার বড্ড বিরক্ত লাগছে। তার মোটেও ইচ্ছে করছে না রিহান ভাইদের ফ্ল্যাটে যেতে। রিহান ভাই অন্য কারোর জন্য বিয়ের সাঝে সাজবে সেটা রিধি যে সহ্য করতে পারবে না। রাতে না ঘুমানোর ফলে প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে। কিছু সময় পর দরজা ধাক্কানোর শব্দে রিধি এগিয়ে গেল।দরজা খুলতেই রিধির মা তড়িঘড়ি করে বলে উঠল,

-‘কী রে! ওই বাসায় কত কাজ আর তুই এখানে এখনো বসে আছিস!’

-‘আসছি মা। তুমি যাও।’

‘আর যাতে ডাকতে আসতে না হয়।’

রিধির মা সুলতানা বেগম আর কিছু না বলে চলে গেলেন।
রিধি চুপচাপ উড়নাটা জড়িয়ে বের হওয়ার সময় ভাইয়ের সাথে দেখা। সিহান তার বোনের রুমেই এগিয়ে আসছিলো।

-‘শোন রিধি। এই ডালাটা রিহানকে দিস তো। আমি একটু কাজে আসছি, কিছুক্ষন পর কাজ শেষ করে যাবো। রিহান অপেক্ষা করছে, তুই যাচ্ছিস যখন একেবারে নিয়ে যা।’ বলে সিহান রিধির দিকে বরের পাঞ্জাবী আর অন্যান্য কিছু জিনিসের একটি ডালা এগিয়ে দিল।

-‘তুমি নিয়ে যাও ভাইয়া। আমার একটু কাজ আছে।’

রিধির কথায় রিহান ভ্রু কুঁচকে তাকালো রিধির পানে।
-‘তোর কী কাজ আবার? সকাল থেকে তো মাত্র এখনই রুম থেকে বের হলি। মা ওই বাসায় তোকে ডাকতেছে। যা না বোন।’

রিধি নিজেই যাচ্ছিলো রিহান ভাইয়ের বাসায়। গিয়ে মা’কে একটু দেখা দিয়ে চলে আসবে ভেবে যাচ্ছিলো কিন্তু রিহান ভাইয়ের সামনে ভুলেও পড়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না। সিহান ভাই কাল থেকেই অনেক তাড়াহুড়োতে আছে। ব্যস্ত অনেক, হবেও না বা কেন! রিহান ভাই তার কাজিন কম ভাই বলে কথা! হয়ত সত্যিই অন্যদিকে কাজ আছে এই ভেবে রিধি সিহানের হাত থেকে ডালাটা হাতে নিতেই সিহান মুচকি হেসে বোনের গাল টেনে চলে গেল।

রিধি চুপচাপ সিহানের যাওয়ার পানে তাকালো। তার এই ভাইটা তাকে প্রচুর ভালোবাসে। যদি জানে, আজ তার বোনটা যার জন্য প্রচন্ড কষ্ট পাচ্ছে! তাহলে হয়ত এই বিয়েটাই সে হতে দিতো না। সবার সম্পর্ক এক ফলকে ছিন্ন হয়ে যেত।

রিধি এক ফলক হাতে থাকা ডালাটার দিকে তাকালো। সবকিছু কী সুন্দর করে সাজানো! এমন তো হওয়ার কথা ছিল না! আজ রিধির সবচেয়ে খুশির দিন হতে পারতো কিন্তু ভাগ্যের লিখন! শুধুই কী ভাগ্যের লিখন না-কি রিধি চাইনি বলে? রিধি বড়োসড়ো একটা শ্বাস ফেলল। না না সে কেন চাইবে না!রিহান ভাই তো বাস্তবতা না দেখেই সুখ পেতে চেয়েছিল! আজ যদি সে রিহান ভাইয়ের কথা শুনতো তবে একদিকে সুখ পেলেও প্রতি নিয়তে পরিবারের মুখে চুন’কালী মা’রা’র কষ্ট পেতো।
রিধি নিজেকে শক্ত করলো। সে যা করেছে কিছুই ভুল করেনি হ্যাঁ একটু কষ্ট হবে কিন্তু মানিয়ে নিবে। রিধি আবারো মলিন হয়ে গেল। কীভাবে মানিয়ে নিবে সে!

রিধি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত করে এগিয়ে গেল সিঁড়ির দিকে। এই বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় ফ্ল্যাটে রিহানরা থাকে আর এর উপরেরটাতে রিধিরা থাকে। সে সিঁড়ি বেয়ে নেমে রিহান ভাইদের ফ্ল্যাটে ঢুকলো।
সম্পূর্ণ বাসাটাতে অনেক মেহমানে ভরপুর। রিধি চারদিকে তাকাতেই চোখটা ঝাঁপসা হয়ে এলো। এই সবকিছু মেহমান তো তার উদ্দেশ্যে হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলো সে ! নিয়তি এমন কঠোর কেন হলো!

‘রিধি মা।’

কারো ডাকে রিধির হুশ ফিরতেই তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে নিলো। তাকিয়ে দেখল মকবুল শেখ ডাকছে ওকে।
‘কী হয়েছে মা! তোকে এমন মনমরা দেখাচ্ছে কেন! আর হাতের এগুলো রিহানের না-কি?’

‘কিছু হয়নি আঙ্কেল। হ্যাঁ, এগুলো রিহান ভাইয়ের। সিহান ভাই দিল।’

‘ওহ, তাহলে যা রিহানকে দিয়ে আয়। বউ আনতে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে। তোরাও রেডি হয়ে নেয়। আমি একটু গিয়ে এদিকে দেখি, সব কাজ ঠিকঠাক হচ্ছে কী না!’ বলেই সামনের দিকে মকবুল শেখ হাঁটা ধরলো।

রিধি রিহানের রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। রিহানের রুমের সামনে দরজার কাছে যেতেই তার ক’লি’জা কেঁপে উঠল। ওই যে, সব কাজিনরা মিলে রিহান ভাইয়ের বাসর সাঝাচ্ছে। আশেপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলো, রিহান ভাই নেই। রিধি ফুলগুলোর দিকে তাকাতেই চোখগুলো ঝাপসা হয়ে এলো।সে রিহান ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তাড়াতাড়ি ডালাটা রুমের কর্নারের টেবিলটাতে রেখে চলে আসতে নিতেই রিহানের চিৎকারে থেমে গেল।

‘কী হচ্ছে এসব? তোদের এসব কে করতে অনুমতি দিয়েছে?’ এক্ষুনি বেরিয়ে যা সবাই।’

রিহান তার কাজিনদের উদ্দেশ্যেই চিৎকারটা দিয়েছিল। রিধি বুঝতে পারলো হয়ত রিহান ভাই বাসর সাজাতে বারণ করেছিল কিন্তু এরা উনি গোসলে ঢোকার সুযোগটা লুফে নিয়েছে।
রিধি পিছু ফিরে তাকালো না। রিহানের ধমক শুনে মুহূর্তের মধ্যে রুমটা খালি হয়ে গেল। তার ধ্যান মগ্ন হতেই চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে গিয়ে থেমে গেল।

‘তোকে তো যেতে বলিনি। এভাবে চলে যাচ্ছিস কেন?’

রিধি কিছুই বলল না। এই রুমটাতে যতক্ষণ থাকবে ততক্ষন তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে থাকবে।

‘এই রুমের উপর অধিকার তোরে আমি অনেক আগেই দিয়ে দিয়েছি। তোর অধিকারটা রয়ে যাবে।’

রিধি দরজার সামনে থেমে গেল।

-‘জানিস রিধু? এখন আর বাবার কথাগুলোকেও মানতে ইচ্ছে হয় না। বাবার উপর কথা বলেছি কাল, হয়ত তিনি কষ্টও পেয়েছেন অনেক কিন্তু আমার অন্যসময়ের মতো বাবার উপর খারাপ ব্যবহারের জন্য আর আফসোস হচ্ছে না। আশেপাশের সবকিছুর প্রতি চরম বিতৃষ্ণা চলে আসছে। কেউ আমার মনের অবস্থা বুঝতে চাচ্ছে না রিধু, একমাত্র তুইই বুঝতি কিন্তু দেখ আমাদের নিয়তি! এই দেখ না, এদের বলছি আমার রুমে ফুলও না আনতে আর এরা আমার গোসলের সুযোগ নিয়ে এসব রুমে ঢুকিয়েছে। ওরা কেউই বুঝতে চাচ্ছে না, আমার মনের র’ক্ত’ক্ষরণ। আমার যে দমবন্ধ হয়ে আসছে রিধু। তোকে ছাড়া আমি কীভাবে থাকবো!’ রিহান কথাগুলো বলতে বলতেই তার কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল।
রিধির নিজেও চোখের পানি আটকাতে পারছে না, সে চোখ মুছে নিজেকে শক্ত করে পিছু ফিরলো।

‘ এগুলো অতীত। অতীত ভুলে বর্তমান আর ভবিষ্যতের কথা ভাবুন। নিয়তি যত তাড়াতাড়ি মেনে নিতে পারবেন ততই ভালো। এখন হয়ত বলছেন আমাকে ছাড়া থাকতে পারবেন না কিন্তু হয়ত একমাস পরেই তিশা আপুকে ভালোবেসে একই কথা বলবেন। সময়ের সাথে সাথে সব পরিবর্তন হয়ে যাবে রিহান ভাই।’

রিধির কথার প্রেক্ষিতে রিহান মৃদু শব্দ করে একটা তাচ্ছিল্য হাসি দিল।
‘এতো বছরেও তুই আমাকে চিনতে পারলি না রিধু? না-কি ইচ্ছে করেই এমন বলছিস! তুই কী মনে করিস? আমার পক্ষে এই মন অন্য কাওকে দেওয়া সম্ভব? আমার এই মন আজীবন তোর নামেই খোদাই করা থাকবে । তিশাকে আমি ভালোবাসতে পারবো না। শুধুমাত্র বাবার এই একটা কথায় আর মায়ের কথা ভেবেই এই বিয়েতে আমি রাজি হচ্ছি। বিয়ে হলেই কী সব ভোলা যায় রিধু!’

‘চল না রিধু? আমরা কোথাও চলে যায়? বাবার কথার মতো আমিও তো তোকে একসাথে থাকার কথা দিয়েছিলাম। আমার প্রতিশ্রুতি কী এতটাই তুচ্ছ!’

‘আমাকে ভুলে যান রিহান ভাই।’ কথাটি বলতে গিয়ে রিধির বুক ধড়ফড় করে উঠল। হঠাৎ করেই কান্না পেয়ে গেল তার। সে বুঝতে পারলো, কথাটি তার মুখ থেকে বের করা সম্ভব না।আর যদি সত্যিই এমন হয় সে কীভাবে থাকবে!

‘গাড়ি চলে এসেছে। আপনার বেরিয়ে পড়ার সময় হয়েছে। তৈরী হয়ে নিন।’ বলেই রিধি উড়না দিয়ে মুখ চেপে দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে দৌড়ে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গেল।

রিহান রিধির যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে ঝাঁপসা চোখে তাকিয়ে রইল। কেন হলো তাদের নিয়তি এমন!দুজন দুজনকে এতো ভালোবেসে তবুও কেন এমন হতে হলো! কী এমন ক্ষতি হতো যদি রিধি রিহানের হাতটা একটু ধরতো! কয়েকবছর পরে নাহয় আবারো সবাই মেনে নিতো কিন্তু এটা রিধি করলো না। তবে এই ভালোবেসে লাভ কী!

———-

রিহিলার মনে হচ্ছে সবকিছু তার সামনেই হচ্ছে। ডাইরির পাতা উল্টাতে উল্টাতে সে একটা ঘোরে চলে গেল। তার চোখ বেয়ে অনর্গল পানি ঝরতে লাগলো। বাস্তবতা এতো কঠিন কেন হলো ওদের জন্য! বাইর থেকে তার বিয়ের প্রচুর শোরগোল শোনা যাচ্ছে। এতদিন এই বিয়েটা নিয়ে এতো উৎফুল্ল ছিল অথচ এখন বিন্দুমাত্র তার আগ্রহ হচ্ছে না। এখন তার মূল আকর্ষণ এই ডায়রি।

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here