#আলো_আঁধারের_লুকোচুরি
#Part_08
#Writer_NOVA
চোখে পানির ঝাপটা পরতেই পাতা নড়ে উঠলো ইরফানের। ঘাড় ধরে ধীরে ধীরে মাথা উঠিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো সে কোথায় আছে। ঝাপসা চোখে চারিদিকে অচেনা, অজানা মানুষ দেখে ধরফরিয়ে উঠে বসলো৷ সবাইকে না চিনলেও তার সামনে মগ হাতে যেই ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে তাকে এক নিমিষেই চিনে ফেলছে। ওমরকে চিনে না এমন মানুষ আছে নাকি? মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহযোগী বলে কথা। শুকনো ঢোক গিলে আমতাআমতা করে জিজ্ঞেস করলো,
‘আমাকে উঠিয়ে এনেছেন কেনো?’
ওমর গ্লাসটা সামনের এক ছেলের হাতে ফেরত দিয়ে দুই পায়ে ভর দিয়ে ইরফানের মুখোমুখি বসলো। চোখে চোখ রেখে শান্ত কন্ঠে শুধালো,
‘ছেলেটা কোথায়?’
ইরফানের কপাল কুঁচকে এলো। কার কথা জিজ্ঞেস করছে ওমর? টলটলে চোখ দুটো স্বাভাবিক করে ফের প্রশ্ন তাক করলো।
‘কোন ছেলে?’
‘যে ভিডিওতে ইয়াসফি ভাইয়ের মতো সেজে ছিলো।’
মুহুর্তে ইরফানের শ্বাস-প্রশ্বাস ভারী হয়ে গেলো। মুখের আদল বদলে গেলো। চাপা রাগে সারা মুখ ছেয়ে গেলো। চোয়াল শক্ত করে উত্তর দিলো।
‘আমি জানি না।’
‘তাহলে কে জানে?’
‘ভিডিওতে থাকা মেয়েটা।’
‘কোথায় পাবো?’
‘তাও জানি না। আমি নিজেও ওকে খুজছি। সামনে পেলে জ্যন্ত সমাহিত করবো। আমাকে ঘোল খাওয়ানো! বন্ধু সমাজে মুখ দেখানো লায়েক রাখেনি।’
ওমর তীর্যক দৃষ্টিতে ইরফানকে অবলোকন করছে। মুখ হলো মনের দর্পন। মনের ভাব মুখে ফুটে ওঠে। না ছেলেটার মুখ তো মিথ্যে বলছে না। তাহলে ঘাপলাটা কোথায়?
‘কার কথায় এমনটা করেছো?’
ইরফান অবাক গলায় বললো,
‘মানে?’
‘ভাইয়ের রেপুটেশন নষ্ট করতে কে বলেছে তোমাদের?’
ইরফান চোখ দুটো বড় করে ফেললো। এরপর দ্রুত মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললো,
‘আল্লাহর কসম আমি কিছু করিনি। যা করার সব করেছে রুহানি। ও দাবার গুটি চেলেছে। আমাকে ফাঁসিয়েছে। নকল ইয়াসফি সাজিয়ে সবাইকে বোকা বানিয়েছে।’
ওমরের কপাল কুঞ্চিত হয়ে গেলো। চোখে গম্ভীরভাব তুলে শুধালো,
‘রুহানি কে?’
‘যেই মেয়েটাকে খুঁজছেন তার নামই রুহানি। আমি হলফ করে বলতে পারি সকল নষ্টের গোড়ায় মেয়েটা।’
ওমর সন্দিহান গলায় বললো,
‘একটা সাধারণ মেয়ে এতকিছু কিভাবে করবে?’
ইরফান চেচিয়ে উঠলো,
‘ওকে সাধারণ ভেবে আমার মতো ভুল করবেন না। ও মোটেও সাধারণ মেয়ে নয়। আপাদমস্তক রহস্যয় মোড়ানো। এমনভাবে কাজ করে কোন চিহ্নই রাখে না।’
অপুর দিকে রক্তলাল চোখ করে তাকিয়ে আছে ইয়াসফি। এই মুহুর্তে তার মন চাইছে অপুকে খুন করতে। এতবড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে আর তাকে রাতে জানানো হয়েছে। এতো এতো কড়া নিরাপত্তা, লোক থাকার পরেও ছেলেটা পালালো কিভাবে? দুই দিন আগেও গোডাউনে ধুলোবালির ওপর কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা অবস্থায় পরে ছিলো। আর আজ সে আজাদ। অপু মাথা নিচু করে কুইকুই করে বললো,
‘সরি ভাই!’
‘ইউর সরি ইজ মাই ফুট!’
রুক্ষ স্বরে ধমকে উঠলো ইয়াসফি। সেই ধমকের তোড়ে কেঁপে উঠলো অপু। নিজের বলদামির জন্য এখন তার নিজেরই আফসোস হচ্ছে। গতকাল যদি হেলামি না করে কড়া নিরাপত্তা দিতো তাহলে ছেলেটা পালাতে পারতো না। কিন্তু নিজের দোষের কথা ইয়াসফিকে জানালো না। জানালে আস্ত রাখবে না।
‘ভাই আমরা খোঁজ খবর নেওয়া শুরু করেছি। কিন্তু সম্ভব্য কোন জায়গায় নেই।’
‘ওকে এখন খুঁজতে যাওয়া আর খড়ের গাদায় সূচ খোঁজা একই কথা। হাতের নাগালে পাওয়া দুষ্কর। ওর টিকিটার সন্ধান পাবে না। তুমি যে আমার কতবড় ক্ষতি করলে অপু তুমি নিজেও জানো না।’
ইয়াসফির শেষ কথায় অসহায়ত্ব ফুটে উঠলো। ধুলোময়লা পরা মলিন মেঝের দিকে তাকিয়ে ইয়াসফি ভাবনায় ডুব দিলো। ভেতরে ভেতরে ভয়ে মুষড়ে পরলো। তবে কি তার পতন ঘনিয়ে আসছে? পতনের কথা মাথায় আসতেই মৃদু কেঁপে উঠলো। একটু পরই চোখের মধ্যে দাবানল খেলে গেলো। না, এতো সহজে হেরে যাবে না। যে হারে সেই মরে৷ নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে হলেও তাকে লড়াই করতে হবে।
অপু একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে উসখুস করতে লাগলো। কিন্তু কিভাবে বলবে তা বুঝে উঠতে পারছে না। গতকাল ইয়াসফির সবচেয়ে বড় শিকার নাকে খড় দিয়ে পালিয়ে গেছে। আজ আবার নতুন ঘটনা। ইয়াসফি এতকিছু নিতে পারবে তো? কিন্তু না বললেও নয়। সে না বললে অন্য কেউ বলে দিবে। তখন সে তোপের মুখে পরবে। অন্য জনের মুখ থেকে শোনার থেকে তার মুখে শুনলে বিষয়টা ভালো দেখায়। ভয়ে ভয়ে ডাকলো,
‘ভাই!’
‘হু!’
‘সালমান দুদিন আগে লাপাত্তা হয়েছে।’
ইয়াসফি ভুত দেখার মতো চমকে তাকালো। অপু মাথা চুলকে বোকা ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো। ইয়াসফি সামনে থাকা চেয়ার দূরে ছুঁড়ে মেরে চেচিয়ে উঠলো,
‘তুমি আমাকে আজ বলছো?’
‘ভাই আপনি শান্ত হোন। আমি আজই জেনেছি।কে বা কারা তুলে নিয়েছে তা বের করে ফেলবো। তবে ওকে আজকে সকালে সরকারি হসপিটালের সামনে পাওয়া গেছে। চোখ দুটো নষ্ট করে দিছে। আর জিহ্বা কেটে নিছে। যাতে কিছু দেখতে বলতে না পারে।’
‘ওর খবর পেলে কোথা থেকে?’
‘শফিক গাজী পলাতক। আমার মনে হয় ঐ শালাই সালমানের খবর দিছে। শালারে পাইলে কাইট্টা নদীতে ভাসিয়ে দিবো।’
‘বাতিল মাল দিয়ে আমি কি করবো?’
ইয়াসফি অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে খেঁকিয়ে উঠলো। অপু ইতস্তত করতে লাগলো। সে এখন মনে মনে আফসোস করছে। ইয়াসফিকে কথাটা বলা ঠিক হয়নি। ইয়াসফি রাগে নিজের চুল টেনে ধরে চিৎকার করে উঠলো।
‘শেষ করে দাও। বাতিল জিনিস দিয়ে আমি কোন কাজ করি না।’
অপু কেঁপে উঠলো। ইয়াসফি ভয়ানক রেগে গেছে। এখন যে কি করবে তা সে নিজেও জানে না। আপাতত এখান থেকে ভাগতে হবে। নয়তো চরম বিপত্তিতে পরবে। এমনকি জান খোয়াতে পারে।
‘ঐটা তো এমনি মরা ভাই। মরা মেরে খুনের দায় নিবেন? তাছাড়া যা বলার তাতো বলেই দিছে। সালমান আমাদের বিষয়ে কমবেশি ভালোই জানতো।’
ইয়াসফি ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে তাকালো। শীঘ্রই ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাবে। তার সবকিছু লণ্ডভণ্ড হতে খুব বেশি দেরী নেই। এতো ক্ষমতা, টাকা-পয়সা, নিজের মানুষ সব কি তাহলে হারাতে চললো?
হাসপাতালের বেডে বসে আরাম করে আপেল চিবুচ্ছে রুহানি। তার ধ্যানজ্ঞান শুধুমাত্র এখন আপেলের দিকে। বাকি সব চুলোয় যাক। এক হাতে ব্যান্ডেজ। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে মাসুম। ওর মুখটা চুপসে আছে। অথচ রুহানি সেদিকে একটিবার নজরও দেয়নি। মাসুম কাচুমাচু করে লঘুস্বরে বললো,
‘একটু বসতে দে।’
রুহানি ভ্রু উঁচু করে তাকালো। তার চোখে মুখে বিরক্তি। ভেংচি কেটে সারা শরীর টান টান করে বললো,
‘রোগী কে আমি নাকি তুই?’
‘তুই!’
‘তাহলে বেডে কে থাকবে?’
‘তুই থাকবি।’
‘চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক।’
‘দুই ঘন্টা যাবত দাঁড় করিয়ে রাখছিস। পা দুটো একটু পর অবশ হয়ে যাবে।’
‘হোক! তোর শাস্তি এটা। তোকে কি বলেছিলাম আমি হসপিটালে নিয়ে আসতে?’
মাসুম মুখ ভোঁতা করে বললো,
‘এর জন্য বলে ভালো করলে ভালো নাই, সালাম করলে দোয়া নাই।’
রুহানি মুচকি হাসলো। সকালে রাস্তায় এক পিচ্চিকে বাঁচাতে গিয়ে হাতে আঘাত পেয়েছে। অনেকাংশ কেটে গিয়েছিলো। রুহানি কিছুতেই হাসপাতালে আসবে না। কিন্তু মাসুম জোরজবরদস্তি করে নিয়ে এসেছে। কাটাছেঁড়ায় তিনটা সেলাই লেগেছে। অথচ এই মেয়ে নাকি সেটা নিয়ে বাসায় থাকার চিন্তাভাবনা করেছিলো। হাতের ব্যান্ডেজে টান পরায় সেদিকে তাকিয়ে নাক সিটকালো রুহানি। রক্তের দাগ দেখা যাচ্ছে। এটা বড়জোর দুই থেকে তিন দিন হাতে থাকবে। তাও মাসুমের চিল্লাচিল্লিতে। এরপর এই ব্যন্ডেজ খুলে কোথায় ফেলে দিবে তার হদিস রুহানি নিজেও জানে না। ছোটখাটো আঘাতে নজর দেওয়ার সময় আছে নাকি তার? এর থেকে কতবড় আঘাত তার বুকের ভেতর হয়েছে। প্রতিনিয়ত হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। সেটা কে দেখেছে?
মাসুম এক পর্যায়ে রুহানিকে ঠেলেঠুলে সরিয়ে বেডে জায়গা করে বসলো। এতে যেনো সে ভারতবর্ষ জয় করে ফেলেছে। মেকি হাসি দিয়ে মোবাইলে গেমস খেলতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। রুহানি আপেল শেষ করে ঝুড়ি থেকে কমলা হাতে নিয়েছে। মনোযোগ সহকারে কমলার চোকলা (খোসা) ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। তখুনি রুমে ঢুকলো ডাক্তার। বয়স বেশি না। সবেমাত্র ইন্টার্নি করছে। এগিয়ে এসে রুহানির হাত চেক করতে লাগলো।
‘ব্যাথা কমেছে?’
‘জ্বি!’
‘আপনাকে দেখে অবাক হচ্ছি। অনেক সাহসী মেয়ে আপনি। এতো রক্তক্ষরণ হলো তবুও আপনি স্ট্রং।’
রুহানি চুপচাপ কমলার এক কোয়া মুখে পুরলো। আগ বাড়িয়ে কথা বলা তার পছন্দ না। তাই নীরবতা শ্রেয়। ডাক্তার অনেক কিছু জিজ্ঞেস করছে আর রুহানি হু হা করছে। মাসুম মিটমিট করে হাসতে লাগলো। তবে একটু চিন্তায় আছে৷ এতো কথা শুনে রুহানি আবার ডাক্তারের নাক বরাবর ঘুষি না মেরে বসে।
রুহানিকে দেখা শেষ করে ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন,
‘আপনার রক্তের গ্রুপ কি?’
রুহানি ডাক্তারের দিকে না তাকিয়ে কমলার আঁশ ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,
‘সি পজিটিভ।’
ডাক্তার থতমত খেয়ে গেলো। এ্যাঁ, সি পজিটিভ! রক্তের গ্রুপ আবার সি পজিটিভ হয় নাকি?
চরম অস্বস্তিতে দিনটা কেটেছে ইয়াসফির। সারাদিন কোন কাজে মন দিতে পারেনি। উদাস মনে আসন্ন বিপদের কথা ভেবেছে। কত চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এতদূর এসেছে। একটা ভুলে সব শেষ হয়ে যাবে সেটা সে কিছুতেই মানতে পারছে না। তার স্বপ্নের সম্রাজ্য এক নিমিষে ধূলিসাৎ হবে এটা তার দেহ, মন মানতে রাজী নয়। পার্টি অফিস বাকি আনুষাঙ্গিক কাজকর্ম এক প্রকার ফেলে বাসায় চলে এসেছে। এখানে এসেও শান্তি পাচ্ছে না। বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠছে। এখন তার ভীষণ করে মানসিক শান্তি প্রয়োজন। যেটা সে একটা মাত্র মানুষের কাছেই পেতে পারে। পাঞ্জাবি পাল্টে টি-শার্ট পরে নিলো। জলপাই রঙের প্যান্টের সাথে ম্যাচিং করে ক্যাপটা হাতে নিলো। বাবরি চুলাগুলো এলোমেলো করে চোখের সামনে ফেলে মাস্ক পরতে পরতে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো।
ওমর বাসায় নেই। আজ তার কাজগুলো যতটুকু পারবে ওমর সামলাবে। গাড়িতে ওঠে গন্তব্যের উদ্দেশ্য গাড়ির স্টিয়ারিং ঘুরালো। পৌঁছাতে প্রায় আড়াই ঘন্টা লাগবে। রাস্তায় রাতের খাবার খেয়ে নিবে। অপুকে কল করে রাস্তা থেকে পিক করে নিয়ে নিলো।
গন্তব্যস্থল যত সামনে আসছে ইয়াসফির বুক তত হাতুড়িপেটা করছে। ইচ্ছে করছে ছুটে চলে যেতে। সামান্য পথটুকুর দুরত্বের তর সইছে না। গাড়ির হেডলাইট ধরিয়ে হর্ণ দিতেই দারোয়ান এগিয়ে এলো। ইয়াসফি প্রয়োজনীয় আলাপ সারতেই দারোয়ান সালাম ঠেকিয়ে হন্তদন্ত গতিতে সদর দরজা খুলে দিলো। ইয়াসফি গাড়ি থেকে বেরিয়ে দৌড়ে ভেতরে ঢুকলো। গাড়ি পার্ক করলো অপু। পরিচিত দরজায় কড়া নাড়লো। চেনা মানুষগুলো ইয়াসফিকে এখানে দেখে অবাক হলো না। সেখানে কর্মরত রবিন কপালে সালাম ঠেকালো।
‘স্যার!’
‘চাবি দাও।’
এলোমেলো চাবির গোছা থেকে রবিন একটা চাবি বের করে এগিয়ে দিলো,
‘নিন স্যার।’
ইয়াসফি দাঁড়ালো না। চাবি নিয়ে দৌড়ালো কাঙ্খিত স্থানে। লাইট জ্বালিয়ে হিমশীতল রুমে ঢুকতেই শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেলো। পাতলা শার্টের ফাঁক দিয়ে হির হির করে শীতল বাতাস ঢুকছে। যাতে ইয়াসফি থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। তবে ঠান্ডা তাকে দমিয়ে রাখতে পারলো না। এগিয়ে গিয়ে চাবি ঘুরিয়ে বড় ফ্রিজিং ড্রয়ারটা খুললো। হাতল ধরে টান দিতেই চোখের সামনে অনিন্দ্য সুন্দরি মেয়ের মুখ খানা দৃষ্টি গোচর হলো। ইয়াসফি চোখ দুটো খুশিতে টলমল করে উঠলো। বরফের মতো ঠান্ডা গালে হাত রেখে হিসহিসিয়ে বলে উঠলো,
‘আমার স্লিপিং বিউটি!’
#চলবে