#আলো_আঁধারের_লুকোচুরি
#Part_02
#Writer_NOVA
গাড়ি থামতেই রুহানি শাড়ি উঁচিয়ে কষিয়ে একটা লাথি মারলো তার পাশের জনকে। একদলা থুথু বাইরে ফেলে মুখ তেঁতো করে বললো,
‘তুই আরেকটু হলে আমাকে কেস খাইয়ে দিতি। শালা, ঠিকমতো ক্যারেক্টারে ঢুকতে পারিস না এখনো।’
মাসুম বাবরি পরচুলা খুলে কুইকুই করে উঠলো।
‘কোথায় ইয়াসফি, কোথায় আমি? আমার সাথে কি ঐ মন্ত্রীর যায়? তবুও আমি আমার সর্বস্ব চেষ্টা করেছি। আমি তো ইয়াসফির কন্ঠ নকল করতেই পারি। গলাটা ভেঙে তো বিপত্তি বাঁধলো।’
‘আরো খাইস চকবার আইসক্রিম।’
মাসুম লোভাতুর চোখে নিজের জিহ্বা চেটে উত্তর দিলো,
‘কিনে দিস।’
‘উ’স্টা দিবো।’
থেমে ফের বললো,
‘আরো ভালো অভিনয় করা উচিত ছিলো।’
‘একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো না রুহানি? ইয়াসফি জানতে পারলে ইনকাউন্টার করবে।’
‘ধূর, এসব ছোটখাটো বিষয়ে নজর দেওয়ার সময় আছে নাকি ওর। আর জানবেই বা কি করে?’
রুহানি কি মনে করে আবারো মাসুমের মাথায় চাটি মারলো। মাসুম চেচিয়ে উঠলো,
‘আবার কি করছি?’
রুহানি সাংঘাতিক একটা গালি দিয়ে বললো,
‘তোকে এতো ফুটানি করতে বলছিলাম? এতোগুলা গার্ড, গাড়ি, নকল বন্দুকের কি দরকার ছিলো? আমার সারা মাসের মাইনে তো বরবাদ করে দিলি।’
মাসুম ছোট করে ঢোক গিললো।
‘আসলে মন্ত্রী-মিনিস্টার মানেই বুঝোসই তো। গার্ড, বন্দুক, গাড়ি, পাওয়ার। এসব না দেখলে আসল ভাবতো নাকি? তোর ঐ চোগলখোর এক্স আমাকে ধরে প্যাদানি দিতো।’
‘তাই বলে আমার সব টাকা শেষ করে দিবি? সারা মাস চলবো কি করে?’
রুহানি অস্থির চিত্তে হাসফাস করতে লাগলো৷ টাকার মায়ায় তার এখন গাড়ি থেকে লাফ দিতে মন চাইছে। এই বেআক্কল ছেলেকে নিয়ে তার যত যন্ত্রণা!
‘ছেলেগুলোকে কি করবো?’
‘জলদী বিদায় কর।’
মাসুম গাড়ি থেকে নেমে সাঙ্গপাঙ্গদের পাওনা টাকা বুঝিয়ে বিদায় করে দিলো। গাড়ি ভাড়া মিটিয়ে সিএনজির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। মাসুম সিগারেট বের করে ধরাতে নিলে তা ছোঁ মেরে রুহানি নিয়ে গেলো।
‘মেয়ে মানুষের সিগারেট খাওয়া আমার পছন্দ না।’
রুহানি গ্যাস লাইট দিয়ে সিগারেটের মাথায় আগুন ধরিয়ে ধীরে টান দিলো।
‘তাতে আমার কি?’
মাসুম চুপ মেরে গেলো। এই মেয়েটাকে কিছু বলাও বৃথা। রুহানি সিগারেটে টান দিতে দিতে শাড়ি ঝাড়া মেরে হাসফাস করে উঠলো।
‘বুঝিনা বাপু, বাকি মেয়েরা ঘন্টার পর ঘন্টা শাড়ি পরে থাকে কি করে? আমার তো একটুতেই ফাপর লাগছে। এর থেকে জিন্স, টপস হাজারগুণ ভালো।’
‘তোর মধ্যে মেয়েলি কোন বৈশিষ্ট্য আছে যে এসব ভালো লাগবে?’
সরু চোখে চেয়ে রুহানি জিজ্ঞেস করলো,
‘কি বলতে চাইছিস তুই?’
‘কিছু না।’
খানিক সময় থেমে মাসুম কিছুটা ভয়ার্ত গলায় বললো,
‘হ্যাঁ রে রুহ! ইরফানকে যে ইনভিটেশন কার্ড দিয়ে এলি দুই সপ্তাহ পর হাজির হলে কি করবি? সব তো মিথ্যে!’
রুহানি বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেললো। ছেলেটা বড্ড বেশি ভীতু। সবকিছুতে ভয় পায়। রুহানি মেয়ে হয়ে এখনো কত স্ট্রং। অথচ তার সাথে থেকেও মাসুম ভীতুর ডিম।
‘বল না রুহ।’
রুহানির চেহারা হঠাৎ করে বদলে গেলো। মুখ টিপে হেসে উঠলো। মাসুম চোখ সরু করে রুহানির মতিগতি বোঝার চেষ্টা করছে। মেয়েটাকে সে বুঝে উঠতে পারে না। এই নরম তো এই গরম। রুহানি চোখ নাচিয়ে উত্তর দিলো।
‘কোথায় যাবে বাছাধনেরা? আমি তো কার্ডে কোন ঠিকানায় লিখিনি।’
মাসুম আৎকে উঠেলো,
‘তুই একটা চিজ মাইরি!’
পূর্ব দিগন্তে রক্তিম আভা মিলিয়ে গেছে বহু আগে। ডিমের কুসুমের মতো সূর্যটা তার খোলস থেকে বের হয়ে উদ্দীপ্ত আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে ধরার বুকে। ব্যস্ত পরিবেশ, কোলাহলে মেতে উঠছে শহর। যানবাহনের শব্দে বিছানায় শুয়ে থাকা দুষ্কর। ইচ্ছে না করলেও বিরক্তি নিয়ে উঠে যেতে হবে৷ তবুও এর মধ্যে উপুড় হয়ে বিছানায় ঘুমাচ্ছে চৌত্রিশ বছরের এক তেজী পুরুষ। রাত করে ফেরায় তার ঘুম এখনো ভাঙেনি। নয়তো এতখনে চা বলে চেচিয়ে উঠতো।
দরজার নব ঘুরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো ওমর। ইয়াসফি এখনো উঠেনি দেখে ছোট করে শ্বাস ফেললো। ডাকবে কি ডাকবে না ভেবে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পরে গেলো৷ কোন এক অজানা কারণে ওমরের ভীষণ ভয় করে ইয়াসফিকে। না, ইয়াসফি কখনো ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি। সচরাচর কারো সাথে করেও না। গৌড় বর্ণের এই মানুষটার মধ্যে এমন কিছু একটা আছে যা দেখলেই বুক কেঁপে ওঠে। চোখের দিকে তাকিয়ে তো কথাই বলা যায় না। কি তেজ! গম্ভীর্যের মধ্যে লুকিয়ে আছে রাজনৈতিক সত্ত্বা। এই যে বয়স তো কম হয়নি। তবুও দেখতে মনে হয় ছাব্বিশ বা সাতাশ বছরের যুবক। ব্যক্তিগতভাবে যতটা হাসিখুশি, রাজনৈতিকভাবে ঠিক ততটাই গম্ভীর, অটল, বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান। কোন পদক্ষেপ কোথায় নিতে হবে সেই বিষয়ে যথেষ্ট ধারণা আছে। রাজনীতি যেনো রন্ধ্রে রন্ধ্রে মেশা। হবেই না কেন? এমপি মামার ভাগ্নে বলে কথা! মামার মান রাখতে হবে না?
ওমর পা দুটোকে কোনরকম চালিয়ে বিছানার সামনে এলো। ছেলেটা কি নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। অথচ পুরো নেট পাড়ায় এখন তাকে নিয়ে জল্পনা, কল্পনায় মশগুল। জানতে পারলে রিয়াকশন কেমন হবে তা জানে না ওমর। তবে ভালো কিছু হবে বলে মনে হয় না। ইয়াসফিকে বলার সুযোগ পাচ্ছে না। এতো ব্যস্ত ছেলেটা যে দম ছাড়ানোর ফুসরত নেই। তার মধ্যে নতুন মুসিবত! রাতের পর অনলাইনে ঢুঁ মারেনি ওমর।তার ইচ্ছে করছে না। এতশত আলোচনা ভালো লাগে না তার। নিজের মোবাইল বন্ধ করে রেখেছে। নয়তো উপর মহলের ফোনের জ্বালায় টেকা যেতো না। বিপক্ষ দল ইয়াসফি চরিত্রে চুন কালি মাখতে ব্যস্ত৷ অথচ ইয়াসফি একবার জানলে সেই চুনকালিতে তাদের ডুবাবে৷
মৃদুস্বরে একবার ডাকতেই আড়মোড়া ভেঙে ইয়াসফি তাকালো। কপালের দুই পাশে আঙুল চেপে পিটপিট করে তাকালো৷
‘কয়টা বাজে ওমর?’
‘সাড়ে সাতটা।’
লাফ দিয়ে উঠে বসলো ইয়াসফি।
‘বলো কি? আমাকে ডাকবে না? আজ ঢাকায় যেতে হবে। নির্ঘাত যামে পরবো।’
‘আপনাকে ডাকতেই এসেছিলাম। আপনাকে ঘুমোতে দেখে ডাকতে ইচ্ছে হলো না। সকাল সাড়ে চারটায় ঘুমিয়েছেন।’
‘তাই বলে ডাকবে না?’
ওমর উত্তর দিতে পারলো না। ইয়াসফি ততক্ষণে বালিশের কাছে রাখা টি-শার্ট পরে নিয়েছে। হাতড়ে মোবাইলটাকে খুঁজলো।
‘আমার মোবাইলটা কোথায়?’
‘চার্জে।’
‘সেই যে সুইচড অফ করেছিলাম আর খুলিনি। মোবাইলটা দাও দেখি।’
ওমর দ্রুত গতিতে চার্জ থেকে মোবাইল নিয়ে আসতে গেলে ইয়াসফির কথায় থেমে গেলো।
‘থাক, দরকার নেই। ঢাকায় গিয়ে একেবারে সুইচড অন করবো৷ নয়তে দেখা যাবে পার্টি নতুন অযুহাত দাড় করিয়ে দিবে। কন্ফারেন্সটাই হবে না।’
বিছানায় কিছু সময় ঝিম মেরে বসে রইলো ইয়াসফি। শখের বর্শবর্তী হয়ে রাজনীতিতে ঢুকলেও এখন এতো দৌড়াদৌড়ি ভালো লাগে না। এই তো মাত্র তিন ঘন্টা ঘুমিয়ে আবার দৌড়াতে হবে ঢাকায়। ওমর গতকালের ভিডিওটা নিয়ে ইয়াসফিকে বলবে কি বলবে না ভেবে খুশখুশ করতে লাগলো। সেটা লক্ষ্য করে ইয়াসফি প্রথম বলে উঠলো,
‘কিছু বলবে?’
‘জ্বি স্যার।’
‘আমাকে স্যার বলতে মানা করেছি। ভাই বলবে।’
‘ঠিক আছে।’
‘আসলে…..
ইয়াসফি ছোট টেবিল ঘড়িটার দিকে দৃষ্টি দিয়ে তাড়া দিয়ে উঠলো।
‘নো মোর ওয়ার্ড। আমাকে এক কাপ চা দেওয়ার ব্যবস্থা করো। এখুনি বেরুতে হবে।’
ভ্যাপসা গরমে জান যায় যায় অবস্থা। ঘরের ভেতর ফ্যানের নিচে বসা দায় হয়ে পরছে সেখানে উত্তপ্ত সূর্যের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা মানে শরীরের রক্ত টগবগ করে ফুটতে সাহায্য করা। মাথার ক্যাপটা ঠিক করে রুহানির দিকে নজর দিলো মাসুম। মেয়েটার মাথায় নিশ্চয়ই সমস্যা আছে। নয়তো এই কাঠফাটা রোদে কেউ সং সাজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে? বিরক্তি নিয়ে রুহানির দিকে তাকালো মাসুম। রুহানি তখন ক্লিনিক্যাল মাস্কের ভেতর দিয়ে স্ট্র দিয়ে জুসে চুমুক দিতে মগ্ন। মাস্কের মাঝ বরাবর কাটা আছে। সেখান দিয়ে স্ট্র টেনে নীরবে জুস পান করছে। মাসুম একটা ছোট ইটের টুকরো তুলে রুহানির দিকে ছুঁড়ে মারলো। রুহানি ততক্ষণাৎ সরে যাওয়ায় রক্ষা। চোখ গরম করে তাকালো।
‘কি হয়েছে?’
‘আমি তোর মতিগতি বুঝতে পারছি না। কখন থেকে রোদে দাঁড় করে রেখেছিস।’
‘চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক।’
মাসুম এগিয়ে এলো। তার ফর্সা মুখটা লাল রঙ ধারণ করেছে। নাকের আগা গরমে ঘাম মুছতে মুছতে লাল হয়ে আসছে।
‘যেই ইরফানকে তুই ভালো বাসিস না তাকে দেখাতে এতকিছু কেন করলি বলতো?’
মাসুমের চোখে প্রশ্নের ফুলঝুরি। রুহানি জুস শেষ করে প্যাকেটটা দুমড়েমুচড়ে ফুটপাতে ফেলে মুখ মুছলো।
‘তোর জেনে কাজ নেই।’
মাসুম ক্ষীণ শ্বাস ফেললো। মেয়েটা আগেভাগে ওকে কিচ্ছু জানায় না। এরপর বিপদে পরে হাত-পা ধরে বলবে “দোস্ত আমাকে বাঁচা”।
‘তোর মোবাইলটা দে তো রুহ।’
‘কেনো?’
‘আমার মোবাইলে এমবি নেই, দে না।’
‘আমরটাও নেই।’
‘মিথ্যে কথা!’
রুহানি হঠাৎ চাপা স্বরে হিসহিস করে উঠলো,
‘হুশ!’
‘কি?’
রুহানির দৃষ্টি অনুসরণ করে মাসুম রাস্তার অপরপাশে তাকালো। স্যুট, কোর্ট পরিহিত এক মধ্য বয়স্ক লোক জেন্টস পার্লার থেকে বেরিয়েছে। দেখা বোঝাই যাচ্ছে এই বয়সে সে তার স্টাইল নিয়ে বেশ সচেতন। মাসুম বেশি কিছু জল্পনা করতে পারলো না। এর আগেই রুহানি শক্ত কন্ঠ শোনা গেলো।
‘ফলো হিম।’
#চলবে