আমি_মায়াবতী #পর্ব_১৫

0
1371

#আমি_মায়াবতী
#পর্ব_১৫
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা

কবিতা ঘুমন্ত মায়ার কাছে গিয়ে বললো,”হ্যাঁ গো মায়া, তুমি তো বলেছিলে আমার বাসায় বেড়াতে আসতে তোমার বাবা-মায়ের পার্মিশন লাগবে। এখন তো কারো পার্মিশন না নিয়েই বিনা নোটিশ এ আমাদের বাড়িতে সারাজীবনের জন্য চলে আসলি।”
কাব্য অবাক হয়ে তার মা আর বোনের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার বোন আসলেই তার মায়ের মতো হয়েছে। দুইজনই একইরকম। কোনোকিছু না জেনেশুনে একা একাই সবকিছু ভেবে নিয়েছে।
“ভাইয়া শোন, বিয়ে তোরা যেভাবেই করিস না কেন, তোদের কিন্তু আবার বিয়ে হবে। রিসিপশনের অনুষ্ঠানে আমি কিন্তু খুব করে সাজবো। আমাকে একদম ডানা কাটা পরির মতো লাগতেই হবে। গায়ে হলুদ এর দিন আমি শাড়ি পড়বো, বিয়ের দিন কুর্তি আর বৌভাতের দিন ল্যাহেঙা।আর শোন, তুই কিন্তু শেরোয়ানিটা মোটেও সাদা রঙের পড়বি না। বুঝলি?”
“হ্যাঁ রে কাব্য,বাবা আমার, ওর বাবা মাকে কষ্ট দিয়ে কিভাবে নিয়ে আসলি ওকে? তোর বাবাকে বলতে না পারলে আমাকে আগে বলতি৷ প্রয়োজন হলে আমি নিজে আজই তোকে বিয়ে করিয়ে আনতাম। এখন তোর বাবাকে আমি কিভাবে এতো সহজে মানিয়ে নিব?আর তোর নানী আর খালা? তোর খালা তো ভেবেই রেখেছে তার মেয়ের সাথে তোর বিয়ে দিবে। আমি অবশ্য ওকে কোনো কথা দিইনি। আর তোর কাকার মেয়ে সোনালী, সে তো তোকে স্বামী ভেবেই বসে আছে। আর তুই কাউকে কিছু না জানিয়ে হুট করে বিয়ে করে ফেললি। আমি কিভাবে যে এতোকিছু সামলাবো বুঝতে পারছিনা।”
“উফফ, মা। ওদের কথা রাখো তো। ফালতু একটা মেয়ে সোনালী। আমি মরে গেলেও ওকে নিজের ভাবী বলে মেনে নিব না। আর রইলো রিশা, তুমি জানো ওর বয়ফ্রেন্ড আছে? খালা বললো ওকে তোমার ছেলের বউ বানাবে, আর আমরা মানবো নাকি?”
কাব্য দুহাতে কান চেপে ধরলো। মা আর বোনের কথার অত্যাচারে সে এখানে টিকতে পারবে না সে বুঝতে পেরেছে। সে কিছু বলতেও পারবে না। বললেও এরা বুঝতে পারবে না। কাব্য বের হওয়ার পরেই ঘরে ঢুকলো কাব্যর বন্ধু নিবিড়। নিবিড়কে দেখেই কবিতা চুপ হয়ে যায়। এই ছেলেটাকে দেখলে তার কি হয় কে জানে। সে যেন কথা বলতে ভুলে যায়। থমকে যায় তার পৃথিবী। কবিতার মা এগিয়ে এসে নিবিড়কে বলে,”বাবা, তুমিও সব জানো নাকি? ও এইরকম একটা কাজ কিভাবে করলো?ও আমাকে না জানাক, তুমি তো আমাকে জানাবা। ”
“কি জানাবো আন্টি?”
“আরেহ, কাব্য যে বিয়ে করে এনেছে সেটা।”
“কাব্য?আর বিয়ে?কাকে?”
“ওমা?তুমিও জানো না?হায় আল্লাহ, তোমাকেও জানায়নি। আমি মানছি ওরা হয়তো একে অন্যকে পছন্দ করে কিন্তু তাই বলে কি আমাদের না জানিয়েই এমন একটা কাজ করে ফেলবে? মেয়েটার বাবা-মাও নিশ্চয়ই এতোক্ষণে ওকে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছে। আমাদের উচিত এখন ওনাদের এখানে নিয়ে আসা। তোমার কাছে কি মায়ার বাবা-মায়ের নাম্বার আছে?তোমার কাছে থাকলে তুমি কল দাও। না হলে কাব্যকে দিতে বলো।”
“আন্টি, এইসব কি বলছেন?কাব্য মায়াকে বিয়ে করেনি। মায়াকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল। আমরা উদ্ধার করে এনেছি।”
এতোক্ষণ কবিতা চুপ ছিল। কিন্তু সে হঠাৎ লাফিয়ে সামনে এসে বললো,”কিহ? মায়াকে ভাইয়া বিয়ে করেনি?তাহলে কি হবে?”
“কি হবে আবার?”
কবিতার ভীষণ আফসোস হলো। কেন ভাইয়া মায়াকে বিয়ে করে আনেনি। কিন্তু পরক্ষণেই মায়ার কিডন্যাপ এর কথা মনে হতেই বললো,”মায়াকে কারা কিডন্যাপ করেছিল? ও কি ঠিক আছে?”
“হুমম। এখন ঠিক আছে। হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। ঘুমের মেডিসিন দিয়ে রেখেছে। কখন ঘুম ভাঙবে কে জানে।”
“ওর বাসার মানুষকে জানিয়েছো বাবা?” কবিতার মা বললো।
“হ্যাঁ। ওর কাছে ফোন ছিল। সেখানে ওর বাবা-মা অনেক কল করছিল।৷ ওদেরকে জানানো হয়েছে। ওরা কিছুক্ষণ পরেই হয়তো চলে আসবে।”
“ওহ।” হতাশ গলায় বললো কবিতার মা। সে কি কি না ভেবে বসেছিল। আচ্ছা, এই মিষ্টি মেয়েটাকে তার বাবা-মায়ের কাছে চাইলে কি তার ছেলের বউ হিসেবে দিবে না?
★★★
ঘুম ভাঙতেই দেখলাম, আমি একটা অচেনা রুমে শুয়ে আছি। রুমে কেউ নেই। রুমটা বেশ গোছালো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বুঝতে পারলাম,এইটা একটা ছেলের ঘর। আমি উঠার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করলাম। বুঝতে চেষ্টা করলাম আমার সাথে কি হয়েছিল। ধীরে ধীরে মস্তিষ্ক সচল হতে লাগলো। মনে পড়তে লাগলো কি হয়েছিল আমার সাথে। রিকশাওয়ালা, কিডন্যাপার, কাব্য স্যার। উফফ, আর ভাবতে পারছি না আমি।
হুট করে দরজা দিয়ে কবিতা ঢুকে পড়লো। আমাকে চোখ খোলা দেখে চিৎকার করে বললো,”মা, ভাইয়া মায়া চোখ খুলেছে। ওর জ্ঞান ফিরেছে। তোমরা কই?”তারপর আমালর কাছে এসে বললো,”ভালো আছিস মায়া? জানিস, আমাদের জীবনটা না অদ্ভুত। না হলে কি আজই আমি তোকে দাওয়াত দিলাম। আর আর তুই বললি পার্মিশন নিবি বাসা থেকে। আর আজই তুই আমার বাসায় আসলি। তাও আবার আমার ভাইয়ের কোলে চড়ে।”বলেই হাহাহা করে হাসতে লাগলো।
আমার মাথা অনেক ঝিমঝিম করছে। সাব্বিরের কথা মনে পড়লো। আমি কবিতাকে জমি করলাম,”কবিতা, আমি বাসায় যাব। আমার ফোন কোথায়?আম্মা কেমন আছে?আমার ভাই কেমন আছে? বাবাও তো বাসায় নেই। সিলেট গেছে।আমি বাসায় যাব কবিতা।”

“তোমার বাবা কিছুক্ষণ পরেই আসবে মায়া। তোমার ভাই আর বোন হাসপাতালে ভর্তি। তোমার বোন ঠিকই আছে। কিন্তু তোমার ভাইয়ের হাত ভেঙে গেছে। তোমার আম্মাও সেখানে আছে।”
কবিতার কথার মাঝেই সেইখানে একজন মহিলা হাতে খাবার নিয়ে ঢুকলো। কবিতা বললো,”মায়া, উনি আমার মা।”
“মায়া, কেমন লাগছে এখন? জানি ভালো লাগছে না। মাথায় কি অনেক ব্যথা করছে?নাও,খাবারটা খেয়ে নাও। খেয়ে মেডিসিন নিতে হবে আবার।”
“আমি খাবো না আন্টি। আমি বাসায় যাব। আমার ভাই-বোনের কাছে যাব।”
“যাবে তো অবশ্যই। তোমার বাবা আসছে। বাবা আসলে তারপর যেও। এখন খাবার খেয়ে নাও।”
আমি অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও খাবার খেলাম। কিন্তু আমার মন পড়ে আছে আমার ভাই-বোনের কাছে।খাবার শেষ হলে কাব্য স্যার রুমে ঢুকলো মেডিসিন হাতে নিয়ে।উনাকে দেখেই আমার কেমন যেন লাগলো। উনি কি তখন সত্যিই ঐ কথা বলেছিল?নাকি আমিই ভুল শুনেছিলাম?কিজানি।
“ভাইয়া, মায়াকে তুই পেলি কিভাবে?আর মায়া যে কিডন্যাপ হয়েছে, সেটা কিভাবে বুঝলি?”
কাব্য একটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল কবিতার কথা শুনে।কিন্তু দ্রুতই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,”আসলে ওকে যে এলাকায় নিয়ে গিয়েছিল, তার কাছেই আমার এক ছাত্রের বাসা। আমি ওকে পড়াই। তখন দেখেছি। আর মায়াকে আমি সবসময় গাড়িতে আসা যাওয়া করতে দেখেছি। তাই ঐ রাস্তায় যেতে দেখলাম ওকে আবার রিকশা করে,ব্যাপারটা আমার স্বাভাবিক লাগছিল না। তাই পিছু নিয়েছিলাম।”
“ভালো করেছিস বাবা।”
“আমার বাবা কখন আসবে?”
কাব্য স্যার শান্ত গলায় বললো, “তোমার বাবা চলে আসবে মায়া। ততোক্ষণ শান্ত থাকো। মাথায় অনেক চোট পেয়েছো। আর এতো তাড়াতাড়ি করার কিছু নেই। তোমার বান্ধবীর বাসায়ই তো এইটা।”
★★★
হাসপাতালের করিডোরে বসে আছি আমি,সাবিহা আর আম্মা। বাবা আমাদের জন্য খাবার আনতে গেছে।সাবিহা আমার কাঁধে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলেছে। আমরা সবাই চুপ করে আছি। কিন্তু সবার মনে একই কথাই ঘুরছে। গতবছর কক্সবাজারে গিয়েও এই একই কাহিনি ঘটেছে। আবার আজও। এই ঘটনাগুলো কি কাকতালীয়? নাহ, মোটেও কাকতালীয় নয়। কি হচ্ছে আমাদের সাথে আমরা বুঝতে পারছিনা। কিন্তু সেদিন শত দুঃখের পরও একটা বিষয় স্বাভাবিক হয়েছিল। সেটা হচ্ছে সাবিহা। ও আমাকে বোন হিসেবে হয়তো সেদিনই মেনে নিয়েছিল। কিন্তু সেদিন ঐ কিডন্যাপারদের হাতে রক্তাক্ত হয়েছিলাম। বাম হাতের কনুই এর নিচে কেটে গেছে অনেকটা। এখনও সেই দাগটা মিশে যায়নি। আবার এখন মাথায় আঘাত।
“আপু, সাব্বির কি ভালো হবে না?”
“হবে। অবশ্যই ভালো হবে। ”
“দেখো, আমার পা পায়ে ব্যথা পেয়েছি। অনেক ব্যথা করছে।”
আম্মা আমাদের কাছে এসে গভীর মমতায় দুজনকে আদর করে দিল। আম্মাও মাথায় আঘাত পেয়েছে। কিন্তু সন্তানের আঘাতটাই যেন তার কাছে বেশি বড়।
“আম্মা, তোমাদের এক্সিডেন্ট হলো কিভাবে?”
“জানিনা, মা। আমি ভালোভাবেই গাড়ি চালাচ্ছিলাম। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল জানি না।ওদের কিছু হয়ে গেলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবোনা মা।”
“তোমার তো কোনো দোষ নেই মা। আমাকে যারা কিডন্যাপ করেছে, তারাই তোমাদের এক্সিডেন্ট করিয়েছে।”
আম্মা বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে বললো, “তুমি কিভাবে জানো?”
“ওরাই আমাকে বলেছে আপু।”
“কি বলছো এইসব?”
“হুমম। ”
“ওরা তো ধরা পড়েনি। পালিয়ে গিয়েছে। কোনো কিছুই জানতে পারবো না আমরা।” সাবিহা বললো।
“ওদের ধরেও কোনো লাভ নেই মা। ওরা শুধু গুটি মাত্র। এই সবকিছুর মাস্টারমাইন্ড অন্যকেউ। বুঝলে?”
“হুমম। ”
“আমরা কি পুলিশকে খবর দিব আম্মা?”
বাবা আমাদের কাছে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,”না মায়া। বিষয়টা আরও ঘোলাটে হবে। আমি বাইরে গেলেই তোমাদের সাথে এইসব হয়। আমি আর কখনোই যাব না তোমাদের ছেড়ে অন্য শহরে।”
সাবিহা হুড়মুড়িয়ে বলে উঠে,”বাবা, আমি হয়তো জানি, এইসব কে করেছে।”
“কে করেছে?”
“মামী আর তার ভাইপো । আমি নিশ্চিত। ”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here