আমি তারে দেখেছি শেষ পর্ব

0
905

#আমি_তারে_দেখেছি
#১৭তম_পর্ব তথা #প্রথম_পরিচ্ছদ_অন্তিম_পর্ব

নবনীতা কাঁপা হাতে নিজের ফোনটি হাতে নিল। ডায়াল করল পরিচিত একটি নাম্বারে। অপরপাশ থেকে ফোনটি ধরতেই বলল,
“আমার আপনার সাথে জরুরি কিছু কথা আছে। সময় হবে?”

নবনীতার অবলীলায় বলা আকুতিময় আবদারকে পায়ে ঠেলে দেবার সাহস বা ইচ্ছে কোনোটি ই নেই শান্তর। তার কণ্ঠ আজ শান্ত। বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল,
“এখন সময় পাবো না। সন্ধ্যার সময় একটু ফাঁকা আছে। চলবে?”
“চলবে”

থমথমে শোনালো নবনীতার কণ্ঠ। বেশ ভড়কে আছে সে। চিন্তাগুলো বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। শান্তর ইচ্ছে হলো কারণ শুধানোর কিন্তু এখন তার অনেক কাজ। নিয়নের কেসটা অফিসিয়ালি এবং আনঅফিসিয়ালি ক্লোজ করতে হবে। তার হাতে সময়ের ডায়রি। ডায়রিটি এখনো পড়া শেষ হয় নি। এই আ/ত্ম/হ/ত্যার মোড়কে সিরিয়াল কি/লিং এর এটাই একমাত্র ক্লু। তাই অফিসিয়ালি কেস ক্লোজের পূর্বেই এই ডায়রিটা পরে শেষ করতে হবে। তাই নির্লিপ্ত স্বরে বলল,
“নবনীতা, আমি রাখছি”

নবনীতা ভেবেছিল শান্ত তাকে প্রশ্ন করবে, প্রশ্ন করে তাকে উতলা করে দিবে কারণ জানার কৌতুহলে। কিন্তু এমন কিছুই হল না। শান্ত ফোন রেখে দিল। হয়তো সত্যিই ব্যস্ত। নবনীতা ফোনটি রেখেই বিছানায় গা এলিয়ে দিল। মাথায় অসহনীয় ব্যাথা হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ ক্রমাগত মাথায় হাতুড়ে পেছাচ্ছে। মুখের সম্মুখে নিজের হাতগুলো ধরলো সে। এই কোমল হাতে কারোর রক্ত লেগে আছে ভাবতেই গা গুলিয়ে উঠছে। আচ্ছা সে যা দেখে সেগুলো আদৌও স্বপ্নতো? নাকি প্রতিটা মুহূর্তে সেই উপস্থিত থাকে! তাহলে এতদিন যে মৃত্যুগুলো দেখেছে সব ই তার সম্মুখে ঘটমান কোনো ঘটনার স্মৃতি। তবে কি তুষারের সাথে হওয়া ঘটনাটাতে তার উপস্থিতি ছিল। ভাবতেই মস্তিষ্কের চাপ বাড়ল। আর তাকিয়ে থাকতে পারলো না নবনীতা। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল অশ্রুরেখা_______________

*********

ব্লাক কফি থেকে ধোঁয়া উড়ছে। সামনের সাদা বোর্ডে ছোট পিন দিয়ে আটকানো কিছু ছবি। মোট সাত টা ছবি। প্রথম নিয়ন। তার ছবির পাশে মার্কারে লেখা, মৃত্যু পটাশিয়াম সল্যুশনের প্রয়োগে হার্ট ফেইলিউর। পিতা জেলা প্রশাসক। হুট করেই কেস বন্ধ করে দেবার অর্ডার (ফিসি)। পকেটে পলিথিনে সিল করা সুইসাইড নোট। দ্বিতীয় ছবি দোলা। পাশে লেখা, গলায় দড়ি দিয়ে মৃত্যু। ঘটনাস্থলে পাওয়া টুলের হাইট ছোট। অর্থাৎ সেটাকে রেখে আত্ম/হ/ত্যা দেখাবার প্রয়াশ। বাবা-মা শহরের বাহিরে থাকেন। রুমমেটরা শপিং এ ছিল(ফিসি)। দোলার সাথে নিয়নের প্রেমঘটিত সম্পর্ক ছিল। তৃতীয় ছবি সময়। পাশে লেখা, বা হাতের ধমনী কেটে আত্ম/হ/ত্যা। ঘটনাস্থলে ডায়রি, সুইসাইড নোট এবং একটি পেনড্রাইভ পাওয়া গেছে। পেনড্রাইভে দোলার আপত্তিকর ছবি। দোলার সাথে তার সম্পর্ক ছিল। কিন্তু দোলা সেই সম্পর্কের অন্ত টানে। তাই প্রতিহিংসায় দোলা এবং নিয়নের হত্যা। অতঃপর এই গ্লানি মেনে না নিবার জন্য আত্ম/হ/ত্যা। হত্যার রাতে বাবা-মা কেউ বাসায় ছিলেন না(ফিসি)। তিনটি ছবি থেকেই তিনটি দাগ টানা, যেখানে লেখা একই ভার্সিটিতে পড়ে।

কফির কাপে চুমুক দিল শান্ত। খুললো সময়ের ডায়রি। ডায়রি এবং সুইসাইড নোটের হাতের লেখা একই। তাই এই ডায়রিটি আপাতত পক্ষে সময়ের ই মনে হচ্ছে। পাতা উল্টালো শান্ত। শিরোনামে লেখা “দোলার হ/ত্যা”

“আচ্ছা, ভালোবাসার মানুষটিকে নিজ হাতে হ/ত্যা করতে কেমন লাগে? সাধারণ মানুষের কষ্ট হবে, প্রচন্ড যন্ত্রণা তাদের অন্ধ করে তুলবে। তাদের হাত কাঁপছে, হৃদয় ছিড়ে যাবে। রক্তক্ষরণ হবে যে রক্তপাত দেখার ক্ষমতা কারোর নেই। কিন্তু আমার হচ্ছে না। বরং আনন্দ হচ্ছে। পৈশাচিক তৃপ্তি আমার হৃদয়কে ভাসিয়ে তুলছে। আসলে খু/ন করাটা এতটাও কঠিন কিছু নয়। কঠিন হলে প্রতিদিন এত মানুষ মরত না। প্রতিদিনের খবরের কাগজে এত শত বিজ্ঞাপন ছাপতো না। নিয়নের খু/নের পর যেন এই পৈশাচিক আনন্দটা আরোও বেড়ে গেছে। কি অদ্ভুত না! এতো পুলিশ, মিডিয়া, হৈ হুল্লোড়— আমি ওখানেই ছিলাম অথচ আমাকে কেউ ধরতেও পারে নি। দোলার ক্ষেত্রে অবশ্য হৈ-হুল্লোড় কম হবে, ও তো ডিসির মেয়ে নয়। অবশ্য যে ঢং করে তাতে মনে হয় সে বিল গেটস কন্যা। সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সর নামক পদবি পেয়ে সে যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। তাই তো আমাকে দেওয়া কমিটমেন্ট ও রাখে নি। কমিটমেন্ট ভাঙা মানুষকে আমি নিতান্ত অপছন্দ। হোক সে বন্ধু, হোক সে প্রেয়সী। কমিটমেন্ট ইজ কমিটমেন্ট। এখানে কোনো দ্বিরক্তির অবকাশ নেই। তাই দোলার সকল অভিযোগ আমার কাছে রাস্তার কোনায় অবহেলায় পড়ে থাকা ঠোঙার মত।

যাক গে, বেচারি নিয়নের মৃত্যুতে ভেঙ্গে পড়েছে। তাই তাকে তার প্রণয়নের নিকট পাঠানোর কথাই ভাবছি। সিন্থিয়ার সাথে কথা হয়েছে। সে বলেছে আজ বাসায় থাকবে না। তারা শপিং এ যাবে। এটাই সুযোগ। ও বাড়িতে আমার প্রায় যাওয়া আসা। ওদের ভীতু দারোয়ানটা ভীতুর পাশাপাশি বেশ লোভীও। আমি ওকে যেই কড়কড়ে হাজার টাকার লোভ দেখাই অমনি সে আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে। লোভ কত কিছু মানুষকে দিয়ে, তাই না? আমার জন্যই ভালো। সিন্থিয়া প্রথমে রাজী হচ্ছিল না, কিন্তু তার দূর্বলতাও আমার কাছে আছে। যাক গে, ওরা বেড়িয়ে যেতেই আমি ফ্লাটে গেলাম। দরজা খুলতেই দোলার মলিন, প্রাণহীন মুখশ্রী আমার সামনে এল। মেয়েটি কতটা মিয়ে গেছে। চোখের নিচে কালচেটে দাগ। ঘুম হয় নি যেন সহস্র বছর। আমাকে দেখেই তার মুখে ভেসে উঠল উচাটন। ভীত স্বরে বলল,
“তুমি?”
“তোমাকে দেখতে এলাম। ভালো আছো দোলা?”

দোলা উত্তর দিল না। সে দরজা আটকে দেবার জন্য উদ্ধত হল। কিন্তু পারলো না। আমি বাধ সাধলাম। কাতর স্বরে বললাম,
“আমাকে ক্ষমা করা যায় না। আমি মানছি, আমি খারাপ। কিন্তু আমি এখনো তোমাকে ভালোবাসি। তোমার সব দোষ মেনে তোমাকে ভালোবাসি”

দোলার মুখে এখনো ভয়ের তীব্রতা কমে নি। সে না শুনেই দরজা বন্ধ করতে চাইলো। আমাকে হুমকিও দিল। আমি হাসলাম। আর বললাম,
“তুমিও জানো আমিও জানি। তুমি কিছুই করবে না। ছবিগুলো এখনো আমার কাছে দোলা”

বলেই জোরপূর্বক ঢুকলাম ওর ফ্লাটে। দোলা দৌড়ে ফোনের কাছে যেতে নিল। আমি তার থেকেও দ্রুততার সাথে নাইলনের দড়িটা বের করলাম। তার পেছন থেকে তার গ/লায় পেঁচিয়ে নিলাম। মেয়েটা ছটফট করতে লাগলো। মেঝেতে পা আঁচড়ে, আমার খামচে বাঁচার আকুতি জানালো। আহারে, মৃ/ত্যু কারোর কাম্য নয়। আমি তার সেই কানে মুখ ঠেকালাম। একসময় যেখানে ভালোবাসার আর্জি করতাম সেখানে ধীর স্বরে বললাম,
“আমাকে এমনটা করতে তোমরা বাধ্য করেছো। আমাকে দানব তোমরা বানিয়েছো”

একটা সময় নিস্তেজ হয়ে গেল দোলার শরীর। অনন্ত যাত্রার পথে পা বাড়ালো সে। আমি সব প্রমাণ মিটিয়ে দিলাম। স্টোররুমের মই টা নিয়ে ওর ঘরে গেলাম। ওর খাঁট নিচু। তাই মই দরকার। ওড়না বাঁধলাম ফ্যান। ঝুলিয়ে দিলাম আমার দোলার নিথর লা/শ। আমার মন তৃপ্ত। নিজেকে কিউপিড মনে হচ্ছে। দুজনের মিলন হল বুঝি”

শান্তর গা কাঁপছে। এতোটা মানসিক বিকারগ্রস্থ কেউ হতে পারে? এতো প্যারানয়েড মানুষ আত্মহ/ত্যা করেছে বিশ্বাস হচ্ছে না তার। কিন্তু কোনো প্রমাণ নেই। তাই আজ অফিসিয়ালি এই কেসের ইতি টানা হবে। রিপোর্ট বানিয়ে শেষ করেছে ইরশাদ। এখন শুধু সাইনের অপেক্ষা। দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকালো একবার বোর্ডের দিকে। সেখানে রাকা, শ্রীবাস, বিভা এবং নবনীতার ছবি। অদ্ভুত ব্যাপার, নবনীতা এবার কোনো স্বপ্নের কথা বলে নি। নাকি এবারও স্বপ্ন দেখেছে সে। হঠাৎ ফোন বাজলো শান্তর। ফোন রিসিভ করতেই মুখশ্রীর রঙ পাল্টালো তার। কপাল কুঞ্চিত হল মুহূর্তেই।

*********

জসীম সাহেবকে বাসায় আনা হয়েছে। হাসপাতালে বসে টাকার অপচয় তার সহ্য হচ্ছিল না। হবেই বা কেনো! প্রতিদিন কাড়ি কাড়ি টাকার জ্বলাঞ্জলি সাথে হেনা বেগমের ফুলের তোড়া আর গ্রিটিং কার্ড। বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন জসীম সাহেব। অতীতে নিজের কার্যে নিজের মাথা ফাটাতে ইচ্ছে করে তার। কিন্তু কে জানতো সেই অতীতের রেশ এখনো তাকে তাড়া করবে। স্ত্রীর মত না থাকলে মোটেই এই বিয়ে হতে দিত না সে। শান্ত ছেলে হিসেবে মোটেই খারাপ নয়। কিন্তু ওই যে সে একেই গা/ধা পুলিশ উপরন্তু হেনার ছেলে। এই দুই ব্যাপার ই তাকে শান্তি দিচ্ছে না। বসার ঘরের মেঝে টান টান করে শুয়ে এই কথাগুলোই ভাবছিলেন ঠিক তখন ই দেখলেন নবনীতা বের হচ্ছে। ঘড়িতে সাড়ে ছটা বাজে। মাগরিবের আযান দিয়ে দিয়েছে। এখন মেয়ের বাহিরে যাওয়া সন্দেহের উদ্ভব করল। রাশভারি কন্ঠে শুধালেন,
“কোথায় যাওয়া হয়?”

বাবার প্রশ্ন শুনেই চমকে উঠল নবনীতা। কিছু সময় উত্তর হাতড়ে বলল,
“বান্ধবীর বাসায়, নোট নিব”
“ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটস এপের যুগে বাড়ি যেয়ে নোট নিবে। মিথ্যেও শিখলে নাকি? পুলিশ জানে তার বউ মিথ্যে বলে?”

নবনীতা উত্তর দিল না। ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। মিথ্যে কথাটা সাজাতে পারছে না। তাই এভাবে ধরা খেতে হল। জসীম সাহেব কিছুটা শান্ত থেকে বললেন,
“পুলিশটাকে বল, বাসার গেটে দিয়েই যেন না যায়। আমার ওর সাথে কথা আছে”

নবনীতা ঘাড় কাত করলো। তারপর আস্তে করে বেরিয়ে গেল। জসীম সাহেব সিলিং এর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার অনেককিছু বলার আছে শান্তকে__________

***********

ডিআইজি স্যারের বসার ঘর। জিরো পাওয়ারের লাইট জ্বলছে। আলোর তীব্রতা ক্ষীণ। লক্ষণ মোটেই সুবিধার লাগছে না। আজমল সাহেব বসে আছে ছোট টি টেবিলের সামনে। সামনে ওল্ড মংক। তার গ্লাসে হুইস্কি। বরফ ভাসছে। লোকটির মদ্যপানের অভ্যাস রয়েছে। প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর সে নিজেকে দান করেন মদের নেশায়। ক্রাইমে ঘেরা নিয়ন্ত্রিত বেরস জীবন থেকে মুক্তির উপায় বলা যেতেই পারে। চার গ্লাস অবধি তার অবস্থা স্বাভাবিক থাকে। কিন্তু পঞ্চম গ্লাস থেকেই নিয়ন্ত্রণ হারান। তখন অনিয়ন্ত্রিত কথা বলেন। অভাগ্যবশত শান্তর আগমণ তখন ই ঘটেছে। তার হাতে রিপোর্ট। আজ যেহেতু মানুষটি অফিসে যান নি তাই বাসায় ই ফাইলটা আনা। অর্ডারটা আজমল সাহেবের ই ছিল। একবার রিচেক করানো। এবং তাকে বলতে আসা তার ভাগ্নের খু/নী ধরা পড়েছে এবং মা/রা গেছেন। আরোও আগে আসত শান্ত। কিন্তু মাদার বাংলাদেশ এবং সামিয়া ভাবির যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। তাই বাসায় যেতে হয়েছিল ক্ষণিকের জন্য। কিন্তু আজমল সাহেবের অবস্থা দেখে সন্দেহ হচ্ছে সে আদৌও সেটা বোঝার পরিস্থিতিতে আছেন কি না। অবশ্য এলকোহল মানুষের চিন্তাধারাকে শীথিল করে দেয়। মস্তিষ্ক তার গতানুগতিক মাত্রায় চলে না। তাই একটু মেপে কথা বলা উচিত। এর মাঝেই আজমল সাহেব বললেন,
“ইয়াং ম্যান, কেমন চলছে দিনকাল?”
“ভালো স্যার”
“আচ্ছা, তুমি আমাকে স্যার বল কেন? ছোটবেলায় আমার কোলে হিসি করেছো মনে আছে? তোমার বাবা বেঁচে থাকলে বলতেন রাখ তোর স্যার, চাচা বল চাচা”
“জি বলতেন”
“তোমার বাবা সত্যি রসিক মানুষ ছিলেন। সাহসী, হাস্যরসে মোড়ানো পুরুষ। কিন্তু মানুষটি নেই। তোমার মাঝে আমি তার ছাপ পাই।“
“জি স্যার”
“কিন্তু তোমার মা হচ্ছেন একজন রগচটা মহিলা। হুট করেই রেগে যান। আমি ডিআইজি, অথচ সে মনে করেন এখনো তার স্বামীর জুনিয়র আমি। ইডিয়ট মহিলা”

শান্ত বুঝলো আজমল সাহেবের নেশায় ধরেছে। এখনো কেটে পড়া উচিত। নয়তো মাদার বাংলাদেশের সম্পর্কে অনেক কিছু শুনতে হবে। শান্ত একটু চুপ থেকে বলল,
“স্যার, নিয়নের খু/নী ধরা পড়েছে। কিন্তু সে মা/রা গেছে। এখন কেসটা অফিসিয়ালি ক্লোজ। ফাইল এনেছিলাম। ডিটেইলস আছে”
“নিয়ন, নিয়ন। ছেলেটা অকালে চলে গেল। সব পাপের ফল। পাপ বাপকেও ছাড়ে না”

আজমল সাহেবের এখন সপ্তম গ্লাস চলে। কিন্তু তার নেশাগ্রস্থ কথাটা সন্দেহের জন্ম দিল শান্তের শান্ত চিত্তে। বিস্মিত স্বরে বলল,
“কিসের পাপ স্যার? ডিসি স্যার কি খুব খারাপ কিছুতে জড়িত? কেঁচো খুড়তে সাপ না বের হয় একারণেই কি তিনি কেস অফ করে দতে চেয়েছিলেন?”

শান্তর প্রশ্নে মুখোভাব পালটে গেলো আজমল সাহেবের। কঠিন স্বরে বললেন,
“ফাইলটা টেবিলের রেখে চলে যাও। আমার কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না”

শান্ত কথা বাড়ালো না। ফাইল রেখেই সে বেড়িয়ে গেলো। এমন সময় তার ফোন বেজে উঠল। ইরশাদ ফোন দিচ্ছে। ফোন রিসিভ করতেই সে উদ্বিগ্ন স্বরে বলল,
“স্যার, একটা ব্যাড নিউজ আছে। সময়ের মার্ডার হয়েছিল। কারণ সময় বা হাতি। বাহাতি মানুষ বা হাতের ধমনী কাটতে পারে না। আরেকতা কথা। সময়ের ধমনী কাটায় যে ছোরা ব্যাবহৃত হয়েছে সেখানে তার হাতের ছাপের সাথে আরেকটি ছাপ ও পাওয়া গেছে?”
“কার?”
“নবনীতা ম্যামের”

****************

পার্কে মানুষের আনাগোনা কম। আঁধারের তীব্রতা স্বচ্ছ ল্যাম্পপোস্টগুলো ক্ষীন করতে পারছে না। ঝিরিঝিরি হাওয়া গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। খা খা রোদ্দুরের পরে কি করে এতো শীতলতার বিস্তার ঘটতে পারে ভেবে পাচ্ছে না নবনীতা। শান্তর আসার কথা বিধায় সে এখানে সাতটা থেকে উপস্থিত। এখন আটটা বাজে মানুষটির আসার নাম নেই। সে কি আসবে না? একা একা তার ভয় করছে কিন্তু তবুও বসে রয়েছে সে। তার বিশ্বাস শান্ত আসবে। তার যে শান্তকে অনেক কিছু বলার আছে।
“এতো রাতে এখানে কি করছিস তুই?”

গাঢ় কণ্ঠে সম্বিত ফিরল নবনীতা। সামনে চাইতেই দেখল নীলয় দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটিকে বহুদিন দেখে না সে। কাধে ল্যাপটপ ব্যাগ। পরণে টিশার্ট। ঘামে ভিজে গায়ে লেপ্টে আছে তা। চুল এলোমেলো। নবনীতা ধীর স্বরে বলল,
“শান্তর আসার কথা। তুই এখানে কি করছিস?”
“পাশেই আমার টিউশন ভুলে গেছিস? ছাত্রর পরানোর সময় সাড়ে আটটায়। একটু সময় আছে তাই পার্কে আসা। পুলিশ এখনো আসে নি না?”
“না, কাজে আটকেছেন হয়তো”

নীলয় তার পাশে বসল। কিছুক্ষণ তাদের মাঝে কেবল মৌনতা রইল। তারপর সেই নীরবতা চিরে নীলয় ই বলল,
“আচ্ছা, নীতু। ওই পুলিশটাকে তুই ভালোবাসিস?”

প্রশ্নটা খুব স্বাভাবিক। তবুও চমকে উঠল নবনীতা। অবাক স্বরে বলল,
“কেনো বলত?”
“কৌতুহল। তুষারের প্রতি তোকে আবেগে ভাসতে দেখেছি। তাই হুট করে বিয়ের কথা শুনতেই এই প্রশ্নটা জাগল”
“বিয়ে তো হবেই, সেজন্য ভালোবাসার কি প্রয়োজন?”

নির্বিকারস্বরে বলল নবনীতা। প্রতিত্তরে নীলয় বলল,
“আচ্ছা, আমি কি তোর পাশে থাকার জন্য খুব অযোগ্য?”

নবনীতার বিস্ময় আসমান ছুলো। বিমূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে রইল নীলয়ের দিকে। ছেলেটির কাতর দৃষ্টি তাকে ব্যথিত করছে। উত্তর হাতড়েও ব্যর্থ হল নবনীতা। উত্তর দেবার পূর্বেই নীলয়ের ফোন বেজে উঠল। ব্যাগে রাখা। ব্যাগ খুলে বের করতেই অসর্তকতায় ব্যাগটা পড়ে গেল। ভেতরের সবকিছু বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়লো কচি ঘাসের উপর। সেগুলো কুড়াতে ব্যাস্ত হল তারা। ফলে উত্তর দেওয়া হল না নবনীতার। হঠাৎ থমকে গেল সে বই এর ভেতর একটি দলামোচা কালো মাস্ক। তাতে একটি বাঘের কাজ করা। ঠিক স্বপ্নের সেই মাস্ক পরা মানুষটির মত। মাস্ক হাতে নিতেই মেরুদন্ড বেয়ে নামলো হিমস্রোত। ভয়ে লোম দাঁড়িয়ে গেল। ভীত চোখে তাকাল নবনীতা নীলয়ের দিকে। নীলয় ফোনে কথা বলছে। সেই মুহূর্তে তার ফোনও বেজে উঠল। ফোনের কর্কশ শব্দ সারা শরীরে ঝাকুনি দিল। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে “শান্ত” নামটি। তাড়াতাড়ি ফোনটি ধরল সে, কাঁপা স্বরে বলল,
“আমি তারে দেখেছি”

||সমাপ্ত|

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here