#আমি_তারে_দেখেছি
#৯ম_পর্ব
রুম থেকে বের হতেই ফোনটা হাতে নিলো। সেখানে ইরশাদের নামটা ভেসে উঠল। আজ ছুটি, তাহলে কেন ফোন দিচ্ছে? ফোন ধরতেই ইরশাদের জোড়ালো স্বর কানে আসলো,
“স্যার কি একটু বনানীর এদিক আসতে পারবেন?”
“কেন বলতো?”
“আরেকটা অদ্ভুত আত্ম/হ/ত্যার কেস এসেছে স্যার।“
“আমরা কি করতে পারি এতে?”
“সেটা প্রথমে ভাবলেও যে মা/রা গেছে তার নামটি শুনলে ব্যাপারটাকে এতো সহজ ভাবে নিতেন না। মেয়েটির নাম দোলা। এবং এই মেয়েটির নাম নিয়নের সু/ই/সাই/ড নোটে উল্লেখ ছিল। ঘন্টা পাঁচেক আগে মেয়েটিকে তার ফ্লাটে ঝু/ল/ন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। তার রুমমেট, প্রতিবেশী, দারোয়ান মিলে তাকে সেখান থেকে নামিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানেই তাকে মৃ/ত ঘোষনা করা হয়“
ইরশাদের কথাগুলো বেশ স্থির চিত্তে শুনলো শান্ত। কিছুসময় সব তথ্য ধারণ করলো মস্তিষ্কে। মস্তিষ্কের নিউরণে বেশ রেষারেষি চলছে। নিয়নের মৃ/ত্যু রহস্য যতটা জটিল মনে হয়েছিলো তার থেকেও অধিক জটিল। জটগুলোয় ক্রমশ গিট লাগছে। শান্ত কিছু সময় মৌন থেকে শীতল কন্ঠে বলল,
“ময়নাতদন্ত করিয়েছে?”
“জি স্যার, রিপোর্ট এ দড়িতে ফাঁ/সের জন্য দম বন্ধ হয়ে মৃ/ত্যু লেখা”
“কেসটা কি আমাদের থানায় এসেছে?”
“না, স্যার বনানীতে এসেছে”
“তুমি জানলে কি করে?”
“মিডিয়া স্যার, অলরেডি হিউজ মিডিয়া কভার করছে ব্যাপারটাকে”
“মিডিয়া” শব্দটি শুনতেই অবাক হলো শান্ত। কপালে পড়লো ভাঁজ। বিস্মিত কন্ঠে বলল,
“মিডিয়া? আমি যতটুকু জানি দোলা মেয়েটির তেমন কোনো পপুলারিটি নেই। খুব বড় মাপের কারোর সন্তান ও নয়। তাহলে? মানে এত ক্ষুদ্র মানবী এত ফুটেজ পাচ্ছে কি না তাই”
“স্যার, মেয়েটি ক্ষুদ্র কেউ নয়। বেশ পপুলার ইনফ্লুয়েন্সার। ইন্সটাগ্রামে অনেক অনেক ফলোয়ারস। এজন্যই এত ফুটেজ”
এবার মিডিয়ার আস্ফালনের কারণটি বোধগম্য হল শান্তর। মিডিয়া নামক জিনিসটির আবিষ্কার হয়েছিলো মানুষের কল্যাণের জন্য। কিন্তু সময়ের অগ্রসরতা এই মিডিয়াকে হাসির খোরাক বানিয়ে দিয়েছে। তাদের কাজ সব থেকে অকেজো, মিথ্যে, বানোয়াট গল্প ছাপানো। যদি ও আজ বেশ কাজের খবর কভার করেছে। এই জন্য তাদের একুশ তো/পের সালামি প্রাপ্য। শান্ত মোটা স্বরে বলল,
“তুমি বনানী পৌছাও ইরশাদ আমি আসছি”
******
সারাদিনের গুড়িগুড়ি বর্ষণে শীতলতা নেমে এসেছে উষ্ণ ধরণীর বুক। সেই শীতলতার মাত্রা ম/রা বাড়িতে যেনো বেড়ে যায়। ঝিরিঝিরি হাওয়ায় তখন মিশে থাকে বিষাদের তিক্ত গন্ধ। হৃদয় ভাঙ্গা কান্নার সুরে ডুবে আছে বনানীর তিন নং রোডের সুউচ্চ সাত তলা ফ্লাটটির তিন তলা। পুলিশ, মিডিয়া, কেউ ই বাকি নেই সেখানে জড়ো হতে। মানুষের কোলাহলে বিষাদের তিক্ততা ভ্যাবসা গরমের মতো ঠেকছে। বনানী থানার অসি মোঃ আশফাকের ভাষ্য,
“এ তো ওপেন এন্ড শাট কেস। মেয়েটি জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো তাই এই স্টেপ নিয়েছি সিম্পল”
আশফাকের কথা শুনে সরু চোখে তাকালো শান্ত। প্রত্যুত্তরে গম্ভীরস্বরে বলল,
“সত্যি ই সিম্পল? একটি মেয়ে যার জীবনে কোন ঝামেলা নেই সে সত্যি বিনা কারণে সু/ই/সা/ইড করবে?”
আশফাক উত্তর দিতে পারলেন না। কারণ এখনো দোলার মৃ/ত্যু রহস্য উম্মোচন করতে পারে নি পুলিশ। দোলা যে ফ্লাটে থাকতো সেখানে তার সাথে আরোও তিনজন মেয়ে আছে। শামীমা, সিন্থিয়া, বীথি। শামীমা এখন রাজশাহীতে। সিন্থিয়া এবং বীথি মৃ/ত্যুর সময়কালে বাসায় ছিলো না। তাদের ভাষ্যমতে তারা শপিং এ গিয়েছিলো। সিন্থিয়া দোলার বিয়োগে ভেঙ্গে পরেছে। তার ভাষ্য অনুযায়ী, তারা না গেলে এমন কিছুই হতো না। তাদের ধারণাই ছিলো না এমন কিছু হবে। দোলার বাবা মা থাকেন সিলেট। সিলেটের অনেক বড় চা ব্যাবসায়ী তিনি। তাকে সাথে সাথেই জানানো হয়েছে দোলার মৃ/ত্যুর খবর। একমাত্র মেয়ের এমন মৃ/ত্যু হয়ত কোনো পিতামাতার কাম্য নয়। তারা রীতিমতো বিশ্বাস অবিশ্বাসের চরম দ্বিধার সম্মুখীন হয়েছেন। তারা সাথে সাথেই রওনা দিয়েছেন ঢাকার উদ্দেশ্যে। এদিকে রুমমেট সিন্থিয়া এবং বীথির অবস্থাও সূচনীয়।তাদের সাথে আলাদা আলাদা করে কথা বলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইরশাদকে আড়ালে নিয়ে শান্ত ধীর স্বরে বলল,
“তুমি এই মেয়ে দুটোর সাথে কথা বল। একটি তথ্য ও যেনো বাদ না যায়। আমি মৃ/ত্যু স্থানে যাচ্ছি”
“কিন্তু স্যার”
“খালি চোখে অনেককিছুই বাদ পড়ে যায় ইরশাদ। মাঝে মাঝে দৃষ্টির অগোচরেও অনেক কিছু ঘটে”
ইরশাদ কথা বাড়ালো না। শান্ত সেই রুমে গেলো সেখানে ঝু/ল/ন্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে দোলার ম/র/দে/হ। ফ্যানের সাথে ওড়নাটা এখন ঝুলছে। ওড়নাটি শান্তর নির্দেশে নামানো হল। সেখানে লেপ্টে আছে যুবতীর কালচে র/ক্ত। গলাটা ফাঁ/সের জন্য হালকা চিরে গেছে। ব্যাপারটা সূক্ষ্ণচোখে দেখে নিলো শান্ত। বিছানার উপর অবহেলিত টুলটা পড়ে রয়েছে। বিছানা থেকে ফ্যানের উচ্চতাটা বেশি। সেটাকে কমাতেই টুল ব্যবহৃত হয়েছে। এই টুলে দাঁড়িয়ে মেয়েটি গলায় ফাঁ/স দিয়েছে। গ্লাভস পড়া হাতে টুলটি ধরলো শান্ত। তারপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কন্সটেবল ইয়াসিনকে বলল,
“টুল সহ ফ্যান থেকে বিছানার উচ্চতাটা মাপ”
“কেন স্যার?”
“বাহ রে! আ/ত্ন/হ/ত্যাটা সত্যি আ/ত্ম/হ/ত্যা কিনা যাচাই না করেই সেটাকে ঘোষণা কি যথার্থ?’
“স্যার আপনার ধারণা এটা আ/ত্ম/হ/ত্যা নয়?”
“আমার ধারণা এখন নির্বিকার। প্রমাণ আর সাক্ষ বলে দিবে এটা আসলে কি? আ/ত্ম/হ/ত্যা নাকি খু/ন?”
শান্তর ধারণা সঠিক হল। টুলটি সহ বিছানা থেকে থেকে ফ্যানের উচ্চতা সাড়ে দশফিট। এবং শুধু টুলের উচ্চতা দু ফিট। অর্থাৎ এই টুল দিয়ে ফ্যান পর্যন্ত পৌছাতে হলে মানুষটাকে অন্তত সাড়ে আট ফুট হতে হবে। কিন্তু দোলার উচ্চতা মাত্র পাঁচ ফুট। শান্তর ঠোঁট চিরে ফুটে উঠল, নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল,
“কি ইয়াসিন? আ/ত্ম/হ/ত্যা নাকি খু/ন?”
“খু/ন স্যার”
“ঠিক, দশে দশ পেয়েছো তুমি। কারণ এখানে দোলা একা কখনো ছিলোই না”
“এটা কিভাবে বুঝলেন স্যার?”
“সিক্রেট”
বলেই শান্ত বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। সেই মুহূর্তে প্রবেশ করল দোলার পিতামাতা। মেয়ের লা/শ জড়িয়ে তীব্র কান্নার সুর মিশে গেলো সারা ঘরে। জনবলের ঢেউ পেরিয়ে বের হলো শান্ত। খুব বিষাদে তার অংশ নিতে ভালো লাগে না। মন দূর্বল হয়ে যায়। অন্যের বিষাদ তাকেও যেনো ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে। তাই দূরে থাকাই শ্রেয়। এখন গন্তব্য বসুন্ধরা। দুদিন পূর্বের সেই স্বল্প পরিচিত বাগদত্তা______
*******
নবনীতা একবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে, পরক্ষণেই সামনে বসে থাকা যুবকদ্বয়ের শক্ত মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করছে। এখন ঘড়িতে সময় সাড়ে এগারোটা। এবং এত গভীর রাতে তার সাথে সাক্ষাত করতে এসেছে দুজন যুবক। একজন তার হবু স্বামী এবং অপর জন তার বন্ধু নীলয়। দুজনের আসার কারণটা এখনো পরিষ্কার নয়। নবনীতা তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ল। দুজনকে পাশাপাশি বসিয়ে ক্লান্ত স্বরে বলল,
“চা খাবেন?”
দুজন ই মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল। নবনীতা রান্নাঘরে গেল। বসার ঘরে পীতপতন নীরবতা। নিশাদ উঠে নিজের ঘরে গেছে। আজ মা এবং শিরিন ফুপু হাসপাতালে থাকবেন। তাই নবনীতা এবং নিশাদ বাড়ি চলে এসেছে। নীলয়ের অস্বস্তি লাগছে। অন্যদিকে শান্তর মাঝে খুব একটা গতিবিধির পরিবর্তন দেখা গেলো না। সে বসার ঘরে টাঙ্গানো নবনীতার ছেলেবেলার ছবি দেখতে ব্যস্ত। নীবরতার রেশ ভেঙ্গে নীলয়ই প্রশ্ন ছুড়ল,
“আপনি এত রাতে নবনীতার বাসায় কি করছেন? ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু”
নীলয়ের কণ্ঠে ঝাঁঝের রেশ। তার ঠেস দেওয়া কথাটি শান্তর কপালে ভাঁজ ফেলল। উত্তরে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,
“আমার বাগদত্তার বাসায় আসার কারণটি না হয় আমি পরে ব্যাখ্যা করছি। আগে বল, তুমি এখানে কি করছো? বন্ধু হিসেবে সাড়ে এগারোটার দিকে আসাটা খুব সুন্দর দেখায় কি? যেখানে তুমি জানো বাসায় কেবল নবনীতা এবং নিশাদ আছে”
শান্তর ধাঁরালো প্রশ্নটি যেনো জ্বলন্ত লাভার মতো ঠেকলো। নীলয় অস্থির স্বরে বলল,
“ও আজ কলেজে আসে নি। তাই চিন্তা হচ্ছিল। তারপর উপর আংকেল অসুস্থ। তাই যদি কিছুর প্রয়োজন কিনা জানতে আসা?”
“কেবল এই কারণে? তাও সাড়ে এগারোটায়?”
“আমি ব্যস্ত ছিলাম এতোসময়”
“দোলা খু/ন হয়েছে সেই খবর পেয়েই কি আসা?”
শান্তর নির্লিপ্ত প্রশ্নে হতচকিত হল নীলয়। সাথেই সাথেই কাঁচ ভাঙার তীব্র ঝংকার কানে এলো। সামনে তাকাতেই দেখা গেল। নবনীতার হাত থেকে গলগলিয়ে পড়ছে রক্ত। শান্ত সাথে সাথে বসা থেকে উঠে ছুটে গেলো তার কাছে। চায়ের কাপ সহ ট্রেটি পরে গেছে হাত থেকে। সেই ভাঙা কাঁচেই হাত কেটেছে। শান্ত কাছে যেতেই নবনীতা বিড়বিড় করে বলল,
“আমি এবার ও পারলাম না”………
চলবে