#আমি_তারে_দেখেছি (কপি করা নিষেধ)
#৭ম_পর্ব
শান্ত গাল ফুলিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ছড়ালো। রহস্যের সমাধান করতে হবে। তাও অতিসত্বর। কারণ বিয়ে মাত্র পনেরো দিন ই পিছানো হয়েছে। উপরন্তু আজমল সাহেব মাথা খাচ্ছেন। মোটামুটি মাদার বাংলাদেশ থেকে বেশ ভালোভাবেই বাংলাওয়াশ হলো তার। তাই তড়িৎ গতিতে ফোন দিয়ে আপডেট চাইলেন। মামুন স্যারের সাথেও একবার কথা বলতে হবে তার। তবে এখন ঘুমানো প্রয়োজন। নিদ্রা এবং ক্লান্তিতে মস্তিষ্ক এখন অচল প্রায়। তাই মার্কারটা রেখেই বিছানার দিকে পা বাড়াল শান্ত। তখন ই ফোনটা বেজে উঠলো তার। ইরশাদের নামটা ভাসছে স্ক্রিনে। ফোনটা রিসিভ করতেই তার ভীত কণ্ঠ কানে এলো,
“স্যার ডিসি স্যার কেস ক্লোজ করতে বলেছেন। এই মাত্র তিনি ফ্যাক্স পাঠালেন।“
কথা খানা শুনতে ই অকেজো, ক্লান্ত মস্তিষ্ক নড়েচড়ে উঠলো। নিউরনে কোষ দেহে যেন প্রবল শক্তিশালী বিদ্যুৎতরঙ্গ প্রবাহিত হলো। সে দৃষ্টি ঘোরালো ঘড়ির দিকে। ঘড়ির ছোট মোটা কাটা টি সাত টার ঘরে আস্তানা গেড়েছে ক্ষণ সময়ের জন্য। এতো সকালে ডিসি সাহেব ফ্যাক্স করবেন ব্যাপার টা হজম হচ্ছে না। প্রচণ্ড বিস্মিত হয়েছে সেই সাথে তীব্র কৌতূহল তাকে জেঁকে ধরেছে। কৌতূহল মিটা তে গম্ভীর স্বরে শুধালো,
“কেনো?”
“সেভাবে কিছুই জানি না স্যার। সকালে আমি তার ফ্যাক্স পাই। ফ্যাক্সটা বাসা থেকে করেছেন, তাও আবার পার্সোনালি”
“পার্সোনালি?”
“হ্যাঁ, স্যার”
“কারণ কি বলেছেন?”
“উনি বলেছেন ক্রাইম ব্রাঞ্চের এতো গুলো সময় নষ্ট করার জন্য উনি লজ্জিত। পুত্র শোকে ক্ষণ সময়ের জন্য তিনি ভাবুক হয়ে পড়েছিলেন। তাই তো সত্য চোখের সম্মুখে থেকেও দেখেন নি। উনার ছেলের পূর্ব থেকেই হৃদ রোগ ছিলো। চিকিৎসা ও চল ছিলো। তাই ময়নাতদন্তে যখন মৃত্যুর কারণ “হার্ট এট্যাক” বলা হয়েছে তখন উনি উনার এই ভুল বুঝতে পারেন। তাই এই কেসটা ক্লোজ করতে চান। তার ছেলে মা/রা গেছেন, এটাই সত্যি। এখন এই মৃত্যু কে নিয়ে কোনো প্রকার জল ঘোলা হোক উনি চান না। যদি পুলিশ এর পর ও তদন্ত করেন তাহলে তিনি তার ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার করবেন”
“উনি ফ্যাক্স এ লজ্জিত শব্দটি উল্লেখ করেছেন?”
“জি স্যার, নয়তো বলছি কি! প্রথমে তিনি “লজ্জিত” শব্দটি লিখেছেন, তারপর হুমকিও দিয়েছেন”
“বুঝলাম। কিন্তু খটকা তো থেকে যাচ্ছে ইরশাদ। সেটার কি করবো?”
“আমারও সন্দেহ হচ্ছে স্যার। ডিসি স্যার আমাদের কেসটা অফিসিয়ালি দিয়েছিলেন। কারণ আজমল স্যার আমাদের রিকোমেন্ড করেছিলো। আর আমরা সবাই তাদের দহরম মহরম কথা জানি। দূর সম্পর্কের শ্যালক বিধেয় আজমল স্যার ও একেবারে সব ছেড়ে গতকাল ছুটে গিয়েছিলেন। তাহলে এখন এতো পার্সোনালি ফ্যাক্স করার কি মানে! তাও এতো সকালে! আচ্ছা স্যার, উনাকে কেউ হুমকি দিলো কি?”
“হুমকি? ডিসিকে কে হুমকি দিবে?”
ইরশাদ শান্তর প্রশ্নে একটু থামলো। তারপর গলা খাঁদে নামিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে বললো,
“পুরোনো শত্রু, যার কাছে তার কোনো গোপন রহস্য সিন্দুক বন্দি। ব্লাকমেইল ও করতে পারে”
“ক্রাইম ফিল্ম দেখেছো রাতে?”
“আজ্ঞে স্যার, কিভাবে বুঝলেন?”
“তোমার রহস্যের সিড়িতে পা রাখা দেখেই অনুমান করলাম। অমন ক্রাইম ফিল্ম দেখলে সবাই নিজেদের ফেলুদা আর ব্যোমকেশ ভাবে। আপাতত এগুলো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। কেস ক্লোজ মানে কেস ক্লোজ। এখানেই সমাপ্তি। নাকে সরষে তেল মাখো আর ঘুম দাও”
“তাহলে বলছেন আর কিছু করবো না? আমি তো ভেবেছিলাম আপনি বলবেন ডিসি স্যারের ফোন ট্যাপ করতে”
“পাগলে কামড়েছে নাকি হোঁচট খেয়ে অর্ধ মস্তিষ্ক দান করেছো? ডিসি স্যারের ফোন ট্যাপিং উইথআউট পার্মিশন মানে সুখে থাকতে ভুতের কিল খাওয়া। একবার ধরা খেলে আন্দামানেও জায়গা হবে না। তাই বলছি নিজের কাজুবাদামের সাইজের মস্তিষ্ক টিকে আজকের জন্য রেস্ট দাও। এমনেই ছুটির দিন। গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরতে যাও”
শান্তর কথা শুনতে ই বেশ লজ্জা পেলো ইরশাদ। নববধূর ন্যায় লাজুক কণ্ঠে বলল,
“আমার গার্লফ্রেন্ড নেই স্যার।“
“ব্যাপার টা দুঃখজনক। এতো বয়স অথচ একটি নারী সঙ্গ জুট লো না তোমার জীবনে। আর তুমি কি না দুঃখ না পেয়ে নববধূ মতো লজ্জা পাচ্ছো? Shame on you”
“স্যার আপনিও তো সারাটা জীবন সিঙ্গেল ছিলেন, শেষমেশ আপনার আম্মা আপনার জন্য মেয়ে খুঁজছে। আরেকটা কথা, আমার বয়স আপনার চেয়ে কম”
“হ্যাঁ, আমি সিঙ্গেল কারণ সেটা আমার চয়েস। অপশন না। আর ভুলে যেও না সামনের মাসেই আমার বিয়ে হচ্ছে। এখন ফোন রাখো আর কোলবালিশ জড়িয়ে কাঁদো। সেটাই তোমার প্রাপ্য”
বলেই ফোনটা রেখে দিলো শান্ত। ইরশাদ কিছু সময় নিজের ফোনের স্ক্রিনের দিকে চেয়ে রইলো। তার সত্যি এখন বেশ দুঃখবোধ হচ্ছে। জীবনের সাতাশটা বসন্ত কেটে গেল বিনা নারীসঙ্গে, ব্যাপারটা সত্যি দুঃখজনক________
*************
তের বাই ছয়ের ছোট কেবিনে লোকের সমারোহ ঘটেছে। লোকের গ্যাদারিং এ নিঃশ্বাস নেওয়াও কঠিন হয়ে গিয়েছে। দুটো বেড, সোফায় বিন্দু পরিমাণ স্থান নেই বসার। শহরের একজন আত্মীয় বোধহয় বাদ নেই যে জসীম সাহেবকে সমবেদনা জানাতে আসেন নি। জসীম সাহেবের মাজায় বেশ ব্যাথা পেয়েছেন, শুধু তাই নয় তার হাড় নড়ে গিয়েছে। একমাস বেড রেস্টে থাকতে হবে হাড় নিজের আগের স্থানে যাবার জন্য। সামান্য পানিতে হোঁচট এতো ভয়ানক হতে পারে কে জানতো! জানলে হয়তো নিশাদ এতো খামখেয়ালী করতো না। অবশ্য এজন্য শারমিন বেগমের কম উচ্চবাচ্য শুনতে হয় নি তাকে। জসীম সাহেব ও ছাড় দেন নি। তার ধারণা এটা নিশাদের ইচ্ছাকৃত করা, কারণ গত রাতেও তিনি তাকে রামছাগলের সর্দার বলে গালমন্দ করেছেন। এটা তার বদলা ছিলো। কিন্তু ছাগলটা বুঝে নি এতটা মারাত্মক হবে। ভেবেছিলো বাবা হয়তো পড়বে, সামান্য ব্যথা পাবে। মহামান্যের উপর জব্দ যাকে বলে। কিন্তু সেই সামান্য এখন বিরাট চুপ নিয়েছে। ফলে নিশাদের এই বদলার শাস্তিরুপে জসীম সাহেবের সকল প্রকাশ মল মূত্র পরিষ্কারের দায়িত্ব তাকে দেওয়া হয়েছে। এতে তার শাস্তিও হলো, আবার পিতৃসেবা করে তার পাপমোচন হবে। নিশাদ বারবার বোঝাচ্ছে, কিন্তু কেউ তার কথা বিশ্বাস করছে না। শুধু নবনীতা বিশ্বাস করেছে। কারণ নিজের ভাই পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট বেকুব এবং আহাম্মকদের তালিকায় শীর্ষস্থান অর্জন করলেও এমন কাজ করবে না। কখনোই না_____
নবনীতা বিয়ে জসীম সাহেবের মাজার হাড় নড়ে যাবার জন্য এক মাস পিছানো হয়েছে। এতে আত্মীয় স্বজনের মাঝে বেশ কানাগোসা শুরু হয়েছে। তাদের এখানে আসার পর থেকেই আলোচ্য বিষয় নবনীতার বিয়েটা পিছিয়ে গেলো। না জানি শ্বশুরবাড়ি কি ভাবছে। হবু বর তো ব্যস্ত মানুষ সে কি ভাবছে তাদের সম্পর্কে। জসীম সাহেব বেডে শুয়েই ঘোষণা দিলেন,
“আমার মাজায় ব্যথা, বিছানায় পড়েছি। আর তোমাদের চিন্তা ওই গাধা পুলিশকে নিয়ে?”
“ঠিক বলেছেন ভাইজান”
জসীম সাহেবের সাথে নবনীতার ছোট ফুপু শিরিণ সম্মতি প্রকাশ করলো। তার বিয়ে নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। সে তার ভাইয়ের মাজার হাড় নিয়ে চিন্তিত। ক্ষণে ক্ষণে কাঁদছে। শুধু কাঁদছেই না, মরা কান্না করছে সে। তাকে দেখে যে কেউ ভাববে জসীম সাহেবের নিশ্চয় মরণ ব্যাধি হয়েছে, মাত্র কয়েক দিনের সঙ্গী সে। শারমিন বেগম তাকে শান্ত করতে চাইলে উলটো শারমিন বেগমকেই সে চুপ করিয়ে দিচ্ছে,
“ভাবি, তুমি কি মানুষ? ভাইজানের হাড় নড়ে গেছে আর আমি কাঁদবো না! যদি আর জোড়া না লাগে?”
শারমিন বেগম ক্লান্ত হলেন ননদকে বুঝাতে। নবনীতার শিরিণ বেগমের কাজগুলো অনর্থক মনে হচ্ছে। সামান্য বিরক্ত লাগছে। তার অবস্থা দেখে নিজেকে কন্যা হিসেবে অনুভূতিহীন মনে হচ্ছে। অবশ্য এটা তার দোষ নয়, এখন আর কোনো কিছু তাকে স্পর্শ করে না। কিছু মানুষকে কখনো দু:খ ছোঁয় না। তাদের অনুভূতিগুলো হলো জড়ো পাথরের ন্যায়। নবনীতা তাদের ই একজন। দু:খবিলাস তার কাছে কেবল ই নাটকীয়তার বহি:প্রকাশ।
দুদণ্ড নিঃশ্বাস নিতে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো সে। ঘুমানো হয় নি এখনো। মাথায় তীব্র যন্ত্রণা করছে। দোলা কে নিয়ে সামান্য চিন্তিত সে। মেয়েটির সাথে তার দহরম মহরম আছে তা কিন্তু নয়। হায় হ্যালোটুকুই শুধু হয়। মাঝে মাঝে তাও হয় না। কোনো কারণে মেয়েটি নবনীতাকে অপছন্দ করে। শুধু অপছন্দ নয় ভীষণ অপছন্দ করে। তবুও তার ক্ষতি হবে জেনে চুপ করে থাকাটা নির্দয়তা র কাজ। এই কাজটি করতে ইচ্ছে করছে না নবনীতার। তাই ফোনটা বের করলো সে। ক্লাসের হোয়াটস এপ গ্রুপ থেকে মেয়েটিকে খুঁজে নিলো। তারপর ফোন করলো। দুবার বাজার পর থমথমে কণ্ঠ কানে ভেসে উঠলো,
“আসসালামু আলাইকুম, কে বলছেন?”
“আমি নবনীতা”
নবনীতার নাম শুনতে ই যে মেয়েটি বেশ বিরক্ত এবং অপ্রসন্ন হয়েছে তার বুঝতে বাকি রইলো না দোলার। প্রচণ্ড ঝাঁজালো কণ্ঠে বললো,
“কি চাই?”
“তুমি কি কলেজ গিয়েছো?”
“না যাই নি। এজন্য ফোন করেছো?”
“না, একটা কথা ছিলো”
“হুম, বল”
“সাবধানে থেকো”
কথাটা শুনতে ই মেয়েটি তার কথা বলার ধরণ পালটে ফেললো। বেশ উগ্র স্বরে বললো,
“আমি সাবধানে ই আছি, তোমাকে বলতে হবে না। ফ্রিক কোথাকার”
বলেই ফোনটি রেখে দিলো। নবনীতার একটু সময় লাগলো মেয়েটির আচারণ হজম করতে। এতটা উগ্রভাবে বলার কিছুই নেই। সাবধানে থেকো বলাটা অন্যায় নয়। খানিকটা রাগ ও হলো। এই মেয়ের জন্য এতটা চিন্তিত হবার মানেই নেই। ফোনটা ব্যাগের ভেতর রেখে কেবিনের দিকে পা বাড়াতেই একজনের সাথে ধাক্কা খেলো। মাথা তুলতে ই মুখ ফসকে বের হলো,
“আপনি, এখানে?”
রীতিমত ফুলের তোড়া এবং হরলিক্স, ফল নিয়ে হাজির শান্ত। শান্তকে দেখে বেশ অবাক হলো নবনীতা। শান্ত ঠোঁটের কোনায় হাসি একে বললো,
“ শ্বশুর মশাইকে দেখতে আসলাম। খালি হাতে তো আসা যায় না। তাই সামান্য রোগী দেখার ফর্মালিটিস”
“গতকাল এতো গালমন্দ শোনার পর ও”
“অবশ্যই, হবু জামাই হিসেবে এটা আমার কর্তব্য। এইটুকু না করলে নিজের চোখেই গাধা হয়ে যাবো”
নবনীতা এখনো ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে আছে। লোকটির কি তার ছেড়া? সম্পূর্ণ ছেড়া? নবনীতা বিড়বিড় করে বললো,
“বিয়ে টা পিছাতে হবে, বাবাকে একমাস বেড রেস্ট দেওয়া হয়েছে”
“জানি”
“জানেন?”
“হ্যাঁ, জানি। আমিও সেই আর্জি নিয়েই এসেছিলাম। যাক ভালোই হলো, শ্বশুর মশাই আমাকে দোষারোপ করতে পারবেন না আর আমার হবু বউ এর সাথে প্রকাশ্যে প্রেম করার আকাশকুসুম স্বপ্নটাও পূর্ণ হবে। একে বলে সাপ ও মরল লাঠিও ভাঙ্গলো না। ভালো বুদ্ধি না?…………”
চলবে
[আমার লেখা প্রথম বই “তন্দ্রাবিলাসী” পেয়ে যাবেন বইফেরী এবং বুকশেলফ.কম এ]
মুশফিকা রহমান মৈথি