#আমি_তারে_দেখেছি (কপি করা নিষেধ)
#৬ষ্ঠ_পর্ব
একটু এগিয়ে যেতেই দেখল সেই মাস্ক পরিহিত ব্যক্তি। নিষ্ঠুরতার সাথে গলা চাপছে একটি মেয়ের। মেয়েটি চিনে নবনীতা। মেয়েটির নাম দোলা। দোলা হাত পা ছুড়ছে। নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে সে। অপরদিকে নবনীতার মনে হলো তার পা কেউ আটকে রেখেছে। সে চাইলেও এগুতে পারছে না। চিৎকার করতে চাইলো কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছে না। ক্রমাগত ঘামছে সে। এর মাঝেই সেই মাস্ক পরিহিত ব্যক্তি সাথে চোখাচোখি হলো সে। সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যেন ক্ষতবিক্ষত করছে নবনীতা। সাথে সাথেই চোখ মেলল নবনীতা। তার সম্পূর্ণ শরীর ঘামে ভিজে আছে। আশপাশ তাকাতেই দেখল সে তার ঘরে। তবে এটা কি স্বপ্ন ছিলো?
নিস্তব্ধ ঘরে শীতলতা বিরাজমান। বাহিরের প্রকৃতি তে এখনো আলো পৌঁছায় নি, ছাই রাঙ্গা আকাশে এখনো চাঁদ খানা দেখা যাচ্ছে। কোকিল কুহু ধ্বনি কানে মৃদু মন্দা বাতাসে মিশে আছে। নবনীতা উন্মুক্ত চুলে দাঁড়িয়ে আছে ব্যাধিতে। তার শরীর এখনো ঈষৎ কাঁপছে। এমন স্বপ্নগুলো ভয়ংকর হয়, তার মস্তিষ্ক কে অকেজো করে ফেলে। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যায় সে। এমনটা যে প্রথম হচ্ছে তা কিন্তু নয়।
নবনীতা স্বপ্নে ভবিষ্যৎ দেখতে পারে যখন তার বয়স ছিলো মাত্র ষোল বছর। ষোড়শীর কাছে ঘটনাটি প্রথমে ছিলো কেবল ই একটি কাকতালীয় ব্যাপার। প্রথম প্রথম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা দেখতো। একেবারেই তুচ্ছ ঘটনা। বাবার টাই হারিয়ে ফেলেছে, মা হোঁচট খেয়েছে, নিশাদ স্যারের পিটুনি খেয়েছে। এরপর থেকে ঘটনা গুলো জটিল হতে লাগলো। যেমন একদিন দেখেছিল মা রান্না করতে যেয়ে গরম তেলের কড়াই উলটে ফেলেছেন। এবং হলো ও তেমন। মা সত্যি ই এমনটা করে ফেলেছিলেন। ফলে তার হাতের চামড়া ঝলসে গেলো। প্রথমে নবনীতার কাছে ঘটনা গুলো গুরুত্বহীন মনে হতো। কিন্তু ঘটনা তখন জটিল হল যখন সে দেখেছিল তার দাদার মৃত্যু। দাদা বহুদিন যাবৎ অসুস্থ ছিলেন। তার হার্টের ব্যামো ধরা পড়ায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। বৃদ্ধ মানুষ অসুস্থ হবেন অস্বাভাবিক নয়। চিকিৎসার এক পর্যায়ে তার শরীর সুস্থ ও হয়ে গিয়েছিলো। ফলে আবার তাকে বাড়ি ফেরত আনা হলো। বাড়ি ফেরত আনার রাতের নবনীতা স্বপ্ন দেখল দাদা মারা গেছেন। প্রিয় জনের বিয়োগ কেউ মেনে নেয় না, ষোড়শী ও স্বপ্ন টি মানতে পারল না। ঘুম থেকে ওঠা মাত্র তার শরীর ঘেমে নেয়ে একসার। ঘর্মাক্ত কপাল থেকে ঝরছে বিন্দু বিন্দু ভয়। বাবা-মাকে জানাতে ই জসীম সাহেব স্বপ্নের অর্থ বই বের করলেন। অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করলেন তিনি। কিন্তু আশাহত হলেন। কারণ দাদার মৃত্যু দেখলে কি ঘটে সেই উত্তর তার বই দিতে বাধ্য। ফলে প্রাণপ্রিয় কন্যাকে স্বান্তনাবানী দিয়ে বললেন,
“আসলে তুমি তো তোমার দাদা কে খুব ভালোবাসো তাই এমন উদ্ভট স্বপ্ন দেখেছো। কিন্তু দাদা তো এখন ভালো আছে। আরেক টা গুরুত্বপূর্ণ কথা, স্বপ্ন তো স্বপ্ন। ভোরের স্বপ্ন সঠিক হয়। তুমি তো বিকেলে দেখেছো। বিকেলের স্বপ্ন শয়তান দেখায়। তাই এখন যেয়ে আসরের নামাজ পড়ে ফেলো। দেখবে শান্তি লাগবে”
“কিন্তু বাবা এই স্বপ্ন স্বপ্ন না বাস্তব।”
“আরে মা কোনো স্বপ্ন ই স্বপ্ন থাকে না। সব বাস্তব ই হয়। তুই বরং নামাজ পড়। আর আমি একটা সদকা দেবার ব্যবস্থা করি।”
বাবা কিশোরী নবনীতার কথা বিশ্বাস করলেন না। নবনীতাও আর ঘাটালো না। ভাবলো সবাই তো স্বপ্ন দেখে তার স্বপ্নটাও বোধহয় তেমন ই। কিন্তু সব চিন্তা ভুল প্রমাণিত হলো যখন সত্যি ভোরের দিকে দাদার শীতল দেহটা বাবা আবিষ্কার করলেন।
সেদিন থেকে নবনীতা নিশ্চিত হলো তার স্বপ্নে ভবিষ্যৎ দেখার ক্ষমতা রয়েছে। সে যে বিষয়টি নিয়ে খুব চিন্তিত থাকে অথবা যাকে নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করে তাকে নিয়েই সে স্বপ্নটা দেখে। এর প্রমাণ অহরহ পেয়েছে সে। সে যে শুধু দাদা, নিয়ন এবং দোলার মৃত্যু দেখেছে তা কিন্তু নয় এর পূর্বেও সে মৃত্যু দেখেছে। অতি প্রিয় একজনের মৃত্যু দেখেছে সে। যখন সেই দুঃস্বপ্নটা সত্যি হয়েছিলো, হাতুর তালুতে বিন্দু বিন্দু অভিমান মুছেছিলো সে। কিন্তু আজও তার হৃদয় কঠিন হতে পারে নি। আজও সবজানা স্বত্তেও তার ভয় হয়, নিজেকে অসহায় মনে হয়। চিন্তাশক্তি বিনষ্ট হয়ে যায়। ফলে মূহুর্তের জন্য সে ভুলে যায় তার আরোও একটি ক্ষমতা আছে তা হলো স্বপ্ন পরিবর্তন ক্ষমতা। ক্ষমতাটি খুব একটা পুরাতন নয়, আবার একেবারে সদ্য জন্মানোও নয়। দুবছর যাবৎ এই ক্ষমতা অর্জিত হয়েছে। সামান্য পরিবর্তন সে করতে পারে। কিন্তু সেই পরিবর্তনের ফলে স্বপ্নের ঘটনার বিস্তার পরিবর্তন ঘটে। যেমনটা ঘটেছিলো শান্তর ঘটনায়। লোকটিকে কেনো বাঁচালো এই বিষয়ে সঠিক জানা নেই নবনীতার। হয়তো সেখানে একটি ছোট বাচ্চা ছিলো। হয়তো শান্তর উপর দয়া হয়েছিলো। নবনীতা জানে না। তবে এটুকু নিশ্চিত সে দোলাকেও বাঁচাতে চায়। উপায় একটি ই তাকে ঘুমাতে হবে। আবার একই স্বপ্ন দেখতে হবে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো এবার স্বপ্নে সে দেখবে সে মাস্ক পড়া মানুষটিকে জুতো খুলে মেরেছে। জুতো খু/লে মারতেই ব্যক্তিটি ভ্যাবাচেকা খেয়ে যাবে। মূহুর্তের জন্য সে নিজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে। ফলে দোলা পালানোর সুযোগ পাবে। যা ভাবা তাই কাজ। এখনো সূর্যের কিরণ প্রকাশিত হয় নি। ফলে এখন ই ঘুমাতে হবে। কিন্তু গোল বাধলো অন্য জায়গায়। যেই না ঘুমাতে যাবে অমনি জসীম সাহেবের হুংকার কানে এলো। হুংকার কানে আসতেই ছুটে গেলো নবনীতা। বসার ঘরে যেতেই দেখলো ফ্লোরে অবহেলায় ফেলে রাখা পানিতে হোঁচট খেয়েছেন জসীম সাহেব। ব্যাথায় কাঁতরাচ্ছেন রীতিমতো। কন্যা হিসেবে বাবার সেবা শুশ্রূষা করাটা এখন অতীব জরুরি। তাই ঘুমানোর প্লান আপাতত ক্যান্সেল_________
শান্তর রাতখানা নির্ঘুম ই কাঁটলো। বিনিদ্র চোখজোড়ায় ছলকে উঠছে ক্লান্তি। কখনো আঁধারের ছাই রঙ শুষে সূর্য্যিমামা নিজেকে প্রকাশিত করে ধরণীকে আলোকিত করেছে জানা নেই। তার প্রকৃতির রঙবদলে বিন্দু মাত্র আগ্রহ নেই। তার সমস্ত চিন্তাজুড়ে রয়েছে শুধু এই আ/ত্ম/হ/ত্যার মোড়কের খু/নটি। এবং তার সাথে নবনীতার যোগসূত্র। সুইসাইড নোটে কেনো নবনীতার নাম? নিয়ন তো হার্ট ফেইলিউরে মারা গেছে। তাহলে খু/নটা হলো কি করে? শান্তর ধারণা খু/নটা দুভাবে হতে পারে,
১. খু/নী নিয়নের পরিচিত কেউ। ফলে তার সাথে ঘুরতে বের হবার নামে তাকে ব্রীজের কাছে নিয়ে যেয়ে ধাক্কা নিয়েছে। হয়তো নিয়নের পূর্ব থেকেই হার্টের ব্যামো ছিলো। ফলে সে ভয়ের কারণে হার্ট এট্যাক করেছে।
২. তাকে অ/প/হ/র/ণ করে ভয় দেখিয়ে খু/ন করা হয়েছে পরে লাশ ব্রীজ থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
দুটি ঘটনাটিতেই এলিবাই এর ব্যাপার চলে আছসে। সামনে থাকা হোয়াইট বোর্ডে সে একে একে সব খটকাগুলো লিখেছে শান্ত। মোটিভের স্থানটি শূন্য। তীর চিহ্ণ দিয়ে সকলের নাম ও সে লিখেছে। সুইসাইড নোটে শুধু নবনীতার নাম ছিলো না। ছিলো মোট ছয়জনের নাম ছিলো। দোলা, শ্রীবাস, বিভা, রাকা, সময় এবং নবনীতা। সকলের সাথেই মোটামোটি কথা হয়েছে। কিন্তু কারোর কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জোগাড় হয় নি। কেবল নবনীতাই তাকে খুব ই গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য দিয়েছে। তাও আংশিক বিশ্বাসযোগ্য বলে ধারণা শান্তর। কারণ স্বপ্নে ভবিষ্যৎ দেখাটি অবাস্তব বিষয়।
শান্ত গাল ফুলিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো। রহস্যের সমাধান করতে হবে। তাও অতিসত্ত্বর। কারণ বিয়ে মাত্র পনেরো দিন ই পিছানো হয়েছে। উপরন্তু আজমল সাহেব মাথা খাচ্ছেন। মোটামোটি মাদার বাংলাদেশ থেকে বেশ ভালোভাবেই বাংলাওয়াশ হলো তার। তাই তড়িৎ গতিতে ফোন দিয়ে আপডেট চাইলেন। মামুন স্যারের সাথেও একবার কথা বলতে হবে তার। তবে এখন ঘুমানো প্রয়োজন। নিদ্রা এবং ক্লান্তিতে মস্তিষ্ক এখন অচল প্রায়। তাই মার্কারটা রেখেই বিছানার দিকে পা বাড়ালো শান্ত। তখন ই ফোনটা বেজে উঠলো তার। ইরশাদের নামটা ভাসছে স্ক্রিনে। ফোনটা রিসিভ করতেই তার ভীত কন্ঠ কানে এলো,
“স্যার ডিসি স্যার কেস ক্লোজ করতে বলেছেন”……………
চলবে
[আমার লেখা প্রথম বই “তন্দ্রাবিলাসী” পেয়ে যাবেন বইফেরী এবং বুকশেলফ.কম এ]
মুশফিকা রহমান মৈথি