আমি তারে দেখেছি পর্ব ২

0
830

#আমি_তারে_দেখেছি
#২য়_পর্ব

নবনীতার সামনে চায়ের কাপ। ঠান্ডা হয়ে গেছে চা। শান্তের কেবিনে জবুথুবু হয়ে বসে আছে সে। লম্বা মেয়েটি পিঠ বাকিয়ে বসায় খুব ই ছোট লাগছে। শান্ত ফাইলটা এক নজর দেখতে দেখতে বিদ্রুপের স্বরে বলল,
“এই মৃত্যু কি স্বপ্নে দেখেছিলে?”
“এটা খু/ন”

নবনীতার কথা শুনতেই ভ্রু কুঞ্চিত হলো শান্তের। কপালে ভাঁজ গাঢ় হলো। সে তো বাজিয়ে দেখছিলো। কিন্তু তার উত্তরে অবাক না হয়ে পারলো না। অবাক স্বরে বলল,
“খু/ন? তুমি জানলে কি করে?”
“কারণ আমি তারে দেখেছি, আমি খু/নীকে দেখেছি”

শান্তের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো। মস্তিষ্কের নিউরনগুলো একে অপরের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। হাতের ফাইলটি রেখেই তড়িৎ গতিতে নবনীতার সামনে গিয়ে বসলো সে। হুট করে এগিয়ে এসে বললো,
“কোথায় দেখেছো? খু/ন হতে দেখেছো?

শান্তের বুলেট গতিতে ছোড়া প্রশ্নে বিধ্বস্ত হলো নবনীতা। কিছুটা ঘাবড়ালো ও বটে। সকাল থেকে কম ঝামেলার মুখোমুখি তো হয় নি সে। শান্তের প্রশ্নগুলো শুনতেই দৃষ্টি নামিয়ে নিলো নবনীতা। বিড়বিড় করে বলল,
“স্বপ্নে”

শান্তের এতো উৎসাহে শুধু পানি নয় একেবারে যেনো ঠান্ডা ঢেলে দেওয়া হয়েছে। মুহূর্তেই রাগে সমস্ত শরীরের লোম অবধি জ্বলে উঠলো। রাগ না সামলাতে পেরে চিৎকার করে উঠলো সে,
“ফাজলামি পেয়েছো? সব কিছুর তো একটা লিমিট থাকে। কিন্তু তোমার সেই জ্ঞানটুকুও নেই কোথায় কি বলা যায়! একটি ছেলে মা/রা গেছে। এখানেও তোমার স্বপ্নের গুনগান গাইছো? তুমি কি সত্যি পাগল নাকি তার ছে/ড়া?”
“আচ্ছা আমার কথা বিশ্বাস কেনো করেন না বলুন তো? আপনি তো প্রমাণ পেয়েছেন। আমার স্বপ্ন যে ভুল হয় না তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ তো আপনি। তাহলে বিশ্বাস করতে দোষ কোথায়?”

নবনীতাও দমলো না। তার গলার স্বর বাড়লো। চোখে, মুখে ফুটে উঠলো অদম্য অস্থিরতা। সে নিজেকে বিশ্বাস করানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। শান্ত হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের রাগ দমানোর চেষ্টা করলো। মনে মনে আওড়ালো,
“শান্ত, শান্ত হ। মেয়েরা মায়ের জাত, ওদের মা/রা যাবে না। শান্ত হ”

গাল ফুলিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। কপালের উপর চুলগুলো টেনে পেছনে ঠেলে গা এলিয়ে দিলো সোফায়। তারপর কঠিন গলায় বলল,
“কাকতালীয় শব্দটির সাথে পরিচয় আছে? আমার দূর্ঘটনার কথাটা মিলে যাওয়াটা একটি কাকতালীয় ঘটনা। প্রতিটা মানুষের অচেতন মন কিছুটা হলেও ভবিষ্যতবানী করতে পারে। প্রেডিকশন মাঝে মাঝে খাটে মাঝে মাঝে খাটে না। এটা সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার। আমিও পনেরোটা ভবিষ্যতবানী করলে দু একটা খেটে যাবে। ইভেন খেটে যায় ও। তাই বলে আমি জাংগিয়া পড়ে বাবা সেজে তোতা হাতে রাস্তায় মানুষের হাত দেখে বেড়াবো না”
“কাকতালীয় ঘটনা একবার দুবার ঘটে, বারবার যদি সেটা ঘটে তবে সেই ঘটনাটাকেও কি কাকতালীয় ট্যাগ দিবেন?”

নবনীতার কন্ঠের দৃঢ়তা বাড়লো। তার চোখ মুখ শক্ত। কোনো জড়তা নেই। এই ব্যাপারটি ভাবাচ্ছে শান্তকে। মিথ্যে কথা বললে মানুষের মাঝে একটা ভয় এবং জড়তা কাজ করে। মনের মাঝে ভয় থাকলে মস্তিষ্ক কাজ করে কিন্তু স্বচ্ছন্দে নয়। ফলে জড়তা, আড়ষ্টতা দেখা যায়। কিন্তু নবনীতার মাঝে তেমন কিছুই পরিলক্ষিত হলো না। বরং তার মাঝে যে অস্থিরতা সেটা তার কথা বিশ্বাস না করার জন্য। শান্ত কপাল ঘষলো। ধীর কন্ঠে শুধালো,
“খু/নী দেখতে কেমন?”

শান্তের প্রশ্নে প্রথকে বিস্মিত হলেও নিজেকে নিপুনভাবে সামলে নিলো নবনীতা। ধীর কন্ঠে বলল,
“আমি তার মুখ দেখি নি। মানে মাস্ক পরা ছিলো। কালো মাস্ক”
“ডিটেইলস এ বল। স্বপ্নে কি দেখেছিলে”
“আমার স্বপ্নটা বিক্ষিপ্ত ছিলো। সিন বাই সিন না। তবে ঝাপসা ঝাপসা। একটি গাড়ি। সাদা গাড়ি। এসে দাঁড়ালো বুড়িগঙ্গা ব্রীজের সামনে। ড্রাইভিং সিটের দরজা খুলে বের হলো একটি লোক। তার মুখে কালো মাস্ক। সে ঘুরে গিয়ে পাশের দরজাটা যখন খুললো সেখানে নিয়নকে দেখেছি ঘুমন্ত অবস্থায়। লোকটি নিয়নকে ঘাড়ে তুললো। তারপর ব্রীজ থেকে ফেলে দিলো। ঝপাং করে পানির শব্দ কানে আসতে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো”

নবনীতার কথা শেষ হতেই আড়চোখে তাকালো শান্ত এর দিকে। শান্ত এর মুখশ্রীতে অবিশ্বাসের মেঘ মেদুর। চোখের দৃষ্টি সন্দিহান। সে বিশ্বাস করে নি। নবনীতা হাল ছেড়ে দিলো। অজানা মানুষকে বিশ্বাস করানোর ইচ্ছে তার নেই। সব পুরুষ একই, শুধু খোলসটা আলাদা। নবনীতার চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে শান্ত জিজ্ঞেস করে উঠলো,
“নিয়নের কাছে সুইসাইড নোট পাওয়া গেছে। নোটটি ওর পকেটে ছিলো। পলিথিনের ভেতর। সেখানে তোমার নাম লেখা ছিলো। তুমি নিয়নকে চেনো কিভাবে?”

নবনীতা কিছুসময় চুপ করে রইলো। তারপর ধীর গলায় বলল,
“নিয়ন আর আমি একই সাথে পড়াশোনা করতাম। আমার ক্লাসের বখাটে ছেলেদের মধ্যে একজন। বখাটে বললাম কারণ বাবার ক্ষমতার অপব্যবহার সর্বদাই ওর মধ্যে দেখা যেতো। সবার উপর প্রভাব বিস্তার করা, ভয় দেখানো। এটাই যেনো নিত্যদিনের অভ্যাস। আমাদের ক্লাসের প্রায় সবার সাথেই ওর একটা ঝামেলা ছিলো। আমার সাথেও ওর একটু ঝামেলা ছিলো। কিন্তু ঝামেলাটা খুব নগন্য। কিছুদিন পর সেটা সমাধান ও হয়ে গিয়েছিলো। ও কেনো আমার নাম লিখলো আমার জানা নেই”
“ঝামেলাটা কি নিয়ে?”
“ঝামেলা টা একটি বিষয় কেন্দ্র করে নয়। অনেকগুলো বিষয়ের মিশ্রণ। নিয়নের কাজ কখনোই ভালো লাগে না আমার। ব্যক্তি হিসেবে আমি ওকে বলবো ডাহা ফেল। সবার উপর নিজের কৃতিত্ব জাহির করাটা আমার অপছন্দ। অতীব অপছন্দ। কিন্তু নিয়ন করতো। ও আমার বান্ধবীকে পছন্দ করতো। ওকে অনেক জ্বালাতন করতো। আমার সাথে ঝামেলার সূত্রপাত সেখানেই হয়েছিলো”
“মিটলো কিভাবে?”
“আমার বান্ধবীর বিয়ে হয়ে গেছে। তারপর থেকেই নিয়নের মধ্যে পরিবর্তন দেখা যায়। অহমিকা গুড়িয়ে গেলে যে ফাঁপা সত্তা থাকে ও সেটার ই প্রমাণ। এরপর থেকেই মোটামোটি সবার সাথেই ঝামেলাগুলোর অন্ত হয়”
“আচ্ছা, তোমার কি মনে হয় ও আ/ত্ম/হ/ত্যা করতে পারে?”

শান্ত বেশ অন্যমনস্কভাবেই প্রশ্নটি করলো। ফলে ভীষণ রাগ হলো নবনীতার। ক্রোধ মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
“আপনি কি আমার কোনো কথাই শুনেন নি? বলছি তো এটা আ/ত্ম/হ/ত্যা নয়। ও আ/ত্ম/হ/ত্যা করার ছেলেই নয়। কেনো করবে? টাকার অভাব নেই, ক্ষমতার অভাব নেই। জীবন মাখনের মতো। ও কেনো আত্মহ/ত্যা করবে? আচ্ছা আমার কথা বিশ্বাস করতে কি সমস্যা?”
“কেনো বিশ্বাস করবো?”
“আমি আপনার হবু স্ত্রী”

অকপটে উত্তর দিলো নবনীতা, তার মাঝে জড়তার রেশ মাত্র নেই। শান্ত ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। তারপর বিদ্রুপাত্মক স্বরে বললো,
“তাই বলে তুমি যদি বলো চাঁদ স্থির আর পৃথিবী তাকে কেন্দ্র করে ঘুরে, আমি তো বিশ্বাস করতে পারবো না। তুমি পাগল হতে পারো আমি নই। আর তার চেয়ে বড় কথা, তোমার কাছে প্রমাণ নেই। আমি রিপোর্টে কি লিখবো? আমার স্ত্রী স্বপ্নে খু/ন হতে দেখেছে তাই এটা খু/ন। মানুষ মানবে? পাগল ভাববে আমাকে। ভাববে পাবনা থেকে পালিয়ে এসেছি“

নবনীতা বসে থাকতে পারলো না। উঠে দাঁড়ালো। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। রাগে তার আপাদমস্তক কাঁপছে। বাবা কি দেখে এই বুড়ো লোককে পছন্দ করেছে কেবল সেই জানে। পুলিশ না ছাই, নিশ্চয়ই কারোর খাতা ছাপিয়ে চাকরি পেয়েছে, নয়তো ঘুষ। বাস্তবে সে মদনকুমার তর্কালংকার। নবনীতাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শান্ত অবাক কন্ঠে শুধালো,
“কোথায় যাচ্ছো?”
“জাহান্নামে, যাবেন?”
“না এখন না। অন্য কোনো দিন”

শান্তের রসিকতায় নবনীতার রাগ বাড়লো বই কমলো না। রাগান্বিত স্বরে বলল,
“আপনি একটা অসহ্য লোক, অসহ্য না মহাঅসহ্য”

বলেই হনহন করে বেড়িয়ে গেলো। শান্ত মুখ টিপে হাসলো। শ্যাম মুখশ্রীতে রাগ যেনো অলংকারের মতো মনে হলো। মেয়েটিকে প্রথমে নিরীহ গাভী মনে হলে এখন তাকে ক্ষুধার্ত বাঘিনী লাগছে। মন্দ লাগছে না। ভেবেছিলো বিয়ে নামক ঘন্টাটি গলায় বাধলেই সে হয়ে যাবে দাস। জীবনের সকল এক্সাইটমেন্টের সমাপ্তি ঘটে তার জীবন হয়ে যাবে বিনোদনহীন। কিন্তু নবনীতা মেয়েটির সাথে বিনোদনহীন হবার সম্ভাবনা নেই। একটু পাগল, একটু জেদি, একটু রাগী। কিন্তু খুব একটা মন্দ নয়। ভাবতেই হেসে উঠলো শান্ত। তখন ই রুমে প্রবেশ করলো কন্সটেবল সোহেল। হাতে ফাইল। এগিয়ে দিয়ে বলল,
“স্যার পোস্টমর্ডামের রিপোর্ট, ইরশাদ স্যার পাঠাইছে”

রিপোর্টটি দেখতেই কপালে ভাঁজ পড়লো। চোখে চিন্তার রেখা। সাথে সাথে মোবাইলটি বের করলো। অবহেলায় পড়ে থাকা কন্ট্যাক্ট লিস্টের নাম্বারে ফোন দিলো। কিন্তু ফোনটি বন্ধ।

ঝুমঝুমে মায়াবী সন্ধ্যা শুষে নিয়েছে আকাশের সকল রঙ। রাস্তার রোডলাইট গুলো জ্বলে উঠেছে। ফলে সোডিয়ামের আলোতে কালো রাস্তাটির উপর ছায়াশিল্প তৈরি হচ্ছে। কর্মব্যস্ততার পাঠ চুকিয়ে এখন ঘরে ফেরার তাড়া। অন্ধকার গলি দিয়ে ক্লান্ত পা জোড়া হাটছে। যানের দেখা নেই। মাথার উপর পূর্ণচাঁদ যা নববধুর মতো নিজেকে আঁড়াল করেছে মেঘের আঁচলে। নবনীতা কিছু সময় তাকিয়ে রইলো আকাশের দিকে। গুমোট হাওয়া ছুয়ে যাচ্ছে অবাধ্য কেশ। হাটতে মন্দ লাগছে না। হঠাৎ মনে হলো নির্জন গলিতে সে একা নয়। বুকটা ধক করে উঠলো। অজানা ভয় ভালোলাগাগুলো শুষে নিলো। হাত ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যাচ্ছে হিমস্রোত। ভয় গাঢ় হলো যখন সরু কাঁধে কারোর স্পর্শ অনুভূত হলো…………

চলবে

[গল্পটায় আপনাদের ভালোবাসা চাই। এটি ফেসবুকের গল্প, কোনো বই এর প্রমোশন নয়। আমার লেখা প্রথম বই “তন্দ্রাবিলাসী” পেয়ে যাবেন বইফেরী এবং বুকশেলফ.কম এ]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here