আমি তারে দেখেছি পর্ব ১৬

0
465

#আমি_তারে_দেখেছি
#১৬তম_পর্ব

নবনীতার প্রশ্নে তার হাহাকার মিশ্রিত ছিল। মেয়েটির হৃদয়ের চাঁপা হাহাকার ভোঁতা সুঁচের মত বিঁধল। উত্তরটি দেবার পূর্বেই তার ফোনটি বেজে উঠল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল “ইরশাদ” নামটি। ফোন রিসিভ করতেই ইরশাদ ব্যস্ত গলায় বলল,
“স্যার, গুলশান-২ এ আসতে পারবেন?”
“আজ আমার ছুটি ইরশাদ”
“আই নো স্যার। বাট ইমার্জেন্সি”

ইমাঞ্জেন্সি সত্যি ই ছিল। সময় ছেলেটি আ/ত্ন/হ/ত্যা করেছে। শুধু তাই নয়, ঘটনাস্থলে পাওয়া গেল তার সুই/সাই/ড নোট, যেখানে লেখা,
“নিয়ন এবং দোলাকে খু/ন আমি করেছি। নিজের কৃতকার্জের ভার আর বইতে পারছি না। তাই এই জীবন ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলাম”

এই তিনটে লাইনের চিঠিটি উলোটপালোট করে দুবার পড়ল শান্ত। তার শ্যাম কপালে তীব্র ভাঁজ। সুইসাইড নোটটা লেখার সময় ছেলেটির হাত ঘামছিল। সেই ঘামের শুকনো দাগ কাগজের উপর ও স্পষ্ট হয়ে আছে। হাতের লেখাগুলো এবড়োথেবড়ো, যেন সদ্য লিখন শেখা বাচ্চার হাতে কলম ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। শান্তর একটা ধাধা কিছুতে মিলছে না তা হল, ভীত মানুষ আত্ম/হ/ত্যা করল কি করে! আত্ম/হ/ত্যা কাপুরুষের কাজ হলেও তা সম্পাদনের জন্য প্রয়োজন অসীম সাহস। জীবনের উপর বিতৃষ্ণা না আসা অবধি এই পদক্ষেপ কেউ নেয় না। শান্ত সরু চোখে একবার তাকালো সময়ের নিথর লাশটির দিকে। বা হাতের ধমনীতে নিষ্ঠুর ভাবে চালানো হয়েছে ছুরি, ছুরিটা তার পাশের পাওয়া গেছে। লাশের কোথাও কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। শুধু ধমনীটি কাঁ/টা। আশেপাশে কাগজের স্তুপ। প্রতিটিটায় একটি কথাই লিখে কেঁটে দেওয়া হয়েছে। সে যেন নিজের সাথে দ্বন্দে ছিল। কি লেখা উচিত, না লেখা উচিত। এমনটা তখন ই সম্ভব যখন কেউ তার সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্বিধাগ্রস্থ হয়। তবে কি সময় নিজেকে শেষ করতে চায় নি? তবে শান্তর ধারণা এটা আত্নহ/ত্যা নয়, দোলা এবং নিয়নের মত এটা খু/ন। কিন্তু এটা শুধু তার বিক্ষিপ্ত চিত্তের একটি চিন্তা, যার কোনো সত্যতা নেই। সেই সত্যতা অবশ্য সে খোঁজার চেষ্টায় আছে।

ঘরের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে নবনীতা। পার্কে বাগদত্তাকে একা ফেলে আসার মত আক্কেলহীন কাজ শান্ত করতে পারে না। সে যথেষ্ট দায়িত্ববান। তাই নবনীতাকেই বগলদাবা করে নিয়ে এসেছে সে। অবশ্য নবনীতাও অমত করে নি যখন শুনেছে সময় মারা গেছে। মস্তিষ্কে সকালের ভয়ংকর স্মৃতিগুলো সেলুলয়েডের ফিল্মের মত ভেসে উঠেছিল। ভয়ে ভেতরটা চুপসে যাচ্ছিল বটে, কিন্তু একটা জিনিস জানবার কৌতুহল তাকে এখানে টেনে এনেছে। সময়ের নিথর দেহটা ঠিক সেখানেই রয়েছে যেখানে সে দেখেছিল। হাতের অংশটা ঠিক সেভাবেই কাটা যেভাবে স্বপ্নে দেখেছিল। নবনীতার অন্য স্বপ্নগুলোর মত এটা আবছা নয়। যেন চোখের সম্মুখে সে ঘটনাগুলো হতে দেখেছে। তাই একটা বিশ্রী সন্দেহ হচ্ছে তার। সে সময়কে দেখার ছুতোয় এগিয়ে গেল তার লাশের দিকে। ফ্লোরে জমাট বাধা রক্তের উপর খুব সাবধানতার সাথে নিজের ওড়নার ত্রিকোনটুকু রাখল। এর মাঝেই হাবিলদার আব্দুল বলে উঠল,
“ম্যাডাম কাছে যাওয়া যাবে না”

নবনীতা তার কণ্ঠ শুনতেই ধীর স্বরে বলল,
“বুঝতে পারি নি সরি”

বলেই আড়াল করে নিল রক্ত লাগা ওড়নাটি। তারপর আবার আগের স্থানে চলে গেল। তার মুখশ্রীর ভীতিভাব কাউকে প্রশ্ন করতে দিল না। এদিকে শান্ত ব্যস্ত ক্লু খোঁজায়। কাজে মগ্ন পুরুষকে সর্বদাই সুন্দর দেখায়। তাই তো মুগ্ধ নয়নে শান্তকে দেখতে মন্দ লাগছে না নবনীতায়। মুখশ্রীতে কাঠিন্য, দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণতা, কপালে প্রগাঢ় ভাজ। অতিরিক্ত কথার বালাই নেই। ব্যাপারটা নবনীতার জন্য নতুন। এর মাঝেই সময়ের টেবিলের বই গুলোর পেছনে একটি কালো মলাটের ডায়রি এবং একটি পেনড্রাইভ পাওয়া গেল। ইরশাদ ডায়রিটি শান্তর হাতে দিল। শান্ত এলোমেলোভাবে একটি পাতা বের করতেই তার চোখ বিস্ফারিত হল, ভ্রু কুঞ্চিত হল। স্পষ্ট পরিষ্কার হাতের লেখা। লেখার সময় বেশ যত্নের সাথে লেখা হয়েছে। লাইন এদিক ওদিক হয় নি, কাটাকাটি নেই। যেন কোনো উপন্যাস লেখা, অথচ লেখাগুলো মোটেই স্বাভাবিক নয়। নীল রঙ্গের ফাউন্টেন পেন দিয়ে শিরোনাম দেওয়া, “নিয়নের হ/ত্যা”

“নিয়নের হ/ত্যা করার ইচ্ছে ছিল না আমার। কিন্তু যে বন্ধু বন্ধুত্ব রক্ষা করতে পারে না তার বাঁচার অধিকার নেই বলে আমি মনে করি। অবশ্য আমার মনে করা বা না করায় পৃথিবীর খুব একটা যায় আসার কথাও না। পৃথিবী আমার নিয়মে চলে না, আমি পৃথিবীর নিয়মে চলি না। মাঝে মাঝে নিজের কথাগুলো ভেবে নিজের হাসি পায়। আমি এত অদ্ভুত কেন? আমার চিন্তাধারা এত অদ্ভুত কেন? এই যে আমি এখন আমার কাছের বন্ধুর হত্যার বিস্তারিত বর্ণনা লিখছি আমার মাঝে কোনো প্রায়শ্চিত্ত মনোভাব নেই, আমার কষ্ট লাগছে না, বুক কাঁপছে না। বরং পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে। ভেবেই আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। অথচ অন্য কেউ হলে কোথাও না কোথাও তাদের বিষন্নতা ছুয়ে যেত। তাদের হাত কাঁপতো, অনুতাপ হত। কিন্তু আমার হচ্ছে না। ওর বাঁচার অধিকার নেই। সত্যি নেই। বিষধর সাপ না কামড়ালেও সে বিষধর। তার বিষ ছড়ানোর পূর্বেই শেষ করে দেওয়া বুদ্ধিমানের। নিয়ন তেমন ই কিছু। তাই ওকে বিষের সাহায্যে মা/রার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু পরে ভাবলাম সেটা করলে ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। কাঁচা কাজ করা যাবে না। তাই আমি সুক্ষ্ণভাবে কাজটা সমাধান করলাম। নিয়নের হার্ট এ ব্লক গআছে। যদিও তা সামান্য কিন্তু আমার জন্য কাজের। আজ আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে ঘুরতে গিয়েছিলাম। ফলে ওর বাবাও ড্রাইভার ছাড়া ওকে আমাদের সাথে যেতে দিয়েছেন। ওর সাথে সবসময় থাকা সামসু আংকেল ও আজ থাকবে না। ভাবতেই ভালো লাগছে আমার পথে কোনো বাধা নেই। সব বন্ধুরা মিলে লেকের দিকটা গিয়েছিলাম। সেখান থেকে আমি আর নিয়ন আলাদা হয়ে যাই। আমি ওকে নিয়ে বুড়িগঙ্গার এদিকটায় এসেছিলাম। সবাই ভাবে খু/ন করতে হয় নির্জনতায়। কিন্তু আমার মতে লোকের মাঝে খু/ন করাটা সবচেয়ে বুদ্ধিমানের। লোকের ভিড়ে, ব্যস্ততার মোড়কে কোথায় কি হচ্ছে দেখার সময় কারোর নেই। আমরা দাঁড়ালাম ব্রীজের শেষ কোনে। নৌকার সারিতে যাত্রির উঠার তাড়া যখন। বাতাসে হতদরিদ্র মানুষদের কল্লোল, যদিও নিয়নের ব্যাপারগুলো ভাল লাগে না। কিন্তু আমার বেশ লাগছে, এসএসসি স্টুডেন্ট এর গোল্ডেন পাবার মত আনন্দ। আমি সুযোগ খুজছিলাম, কিন্তু সেই সুযোগ নিজ থেকেই আমার কাছে এল। নিয়ন আমাকে বলল,
“দোস্ত আমাকে একটু হেল্প করবি? আমার একটা ইঞ্জেকশন দিতে হবে। আমার ব্যাগেই আছে”

আমি জিজ্ঞাসা করলাম,
“কিসের ইঞ্জেকশন?”
“আমার হার্ট এর জন্য”

আমি হাসলাম। ওকে বললাম,
“চিন্তা করিস না, আমি ভালো ইঞ্জেকশন দিতে পারি”

নিয়ন ছেলেটা সবখানে হুমড়িতুমড়ি দেখায় কিন্তু ও একটা আস্তো বোকা। না হলে কি আমাকে এত বিশ্বাস করে? অবশ্য ও আমাকে যেভাবে বিশ্বাস করেছে আমিও তাকে ঠিক সেভাবেই বিশ্বাসের প্রতিদান দিলাম। এই নিষ্ঠুর পৃথিবী থেকে মুক্তি। ঔষধের বদলে পটাসিয়ামের সল্যুশন সিরিঞ্জে ভরলাম। নিজ হাতে ওর শিরায় ইঞ্জেক্ট করলাম। গুনে গুনে একমিনিটের মাঝেই ওর শরীর খারাপ হতে লাগল। আমিও বন্ধুত্বের খাতিরে ওকে মুক্তি দিলাম যন্ত্রনা থেকে। নিয়ন যখন ব্রীজের দিকে ঝুকে ব্যাথায় কাবু আমি তখন ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলাম ব্রীজ থেকে। এত দ্রুত সব কিছু হয়েছে যে কেউ বুঝতেও পারে নি। কোলাহলের ধ্বনিতে চাপা পড়ে গেল নিয়নের আর্তনাদ। কেউ হয়ত খেয়াল ও করে নি এখানে কেউ পড়ে গেছে। কি দারুণ নিষ্ঠুরতা”

শান্তর কপালে এখনো ভাঁজ অক্ষত। কতটা ঠান্ডা মাথায় খু/ন করা হয়েছে ভাবতেই অবাক লাগছে। পানিতে বারো ঘন্টা লাশ থাকার জন্য তা নষ্ট হয়ে গিয়েছে ফলে ইঞ্জেকশনের দাগটা মিলিয়ে গেছে। পটাশিয়াম রক্তের সাথে মিলে যায়। ফলে ময়নাতদন্তে ধরা পড়েছে হার্ট ফেইলিউর। বাহিরে কান্নার সুর তীব্র হচ্ছে। সন্তান হারা বাবা-মায়ের আর্তনাদ মিশে আছে বাতাসে। এর মাঝেই ইরশাদ বলল,
“স্যার কেস কি তাহলে ক্লোজ?”
“আসলেই কি ক্লোজ?”
“খু/নী ধরা পড়লে তো হাতে আর কিছুই নেই স্যার”

শান্ত উত্তর দিল না। ইরশাদের কথার যৌক্তিকতা রয়েছে। যেখানে খু/নী নিজের স্বীকারোক্তি দিয়েছে সেখানে আর কি করার আছে। কিন্তু একটা খটকা এখন আছে, ডায়রি এবং সুইসাইড নোটের হাতের লেখা এক কিন্তু বড্ড অমিল। যে ব্যাক্তি খু/নের বর্ণনা এত সুন্দর করে দিয়েছে সে সুইসাইড নোট লেখার সময় ভয় পাচ্ছিল কেন!

*******

নবনীতার হাতে একটি সাদা কাগজ। কাগজটি নিয়ে বিমূঢ় দৃষ্টিতে সে বসে রয়েছে। তার মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে আছে। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না তার। কিন্তু সত্য অস্বীকার করার জো নেই। রিপোর্ট অনুযায়ী তার জামায় থাকা রক্ত এবং ওড়নার রক্তটি একই ব্যক্তির। অর্থাৎ সময়ের। যে সেদিন সময়ের লাশের কাছ থেকে ওড়ণায় যে রক্তের স্যাম্পল নিয়েছিল সেটা এবং জামায় থাকা রক্তটি ফরেন্সিক ল্যাবে টেস্ট করতে দিয়েছিল। যদিও ল্যাবের অফিসারটি তাকে অনেক বেশি জেরা করছিল কিন্তু বেশ ভালো অংকের টাকার লোভে সে টেস্টটি করাতে সক্ষম হয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, সময়ের রক্ত তার জামায় লাগল কি করে? নবনীতা কাঁপা হাতে নিজের ফোনটি হাতে নিল। ডায়াল করল পরিচিত একটি নাম্বারে। অপরপাশ থেকে ফোনটি ধরতেই বলল,
“আমার আপনার সাথে জরুরি কিছু কথা আছে। সময় হবে?”………………

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here