#আমি_তারে_দেখেছি
#১৫তম_পর্ব
সাইড টেবিলের ল্যাম্পটি জ্বালাতেই ভয়টা গাঢ় হল। নিজের হাতের দিকে চাইতেই ভয়ে থিতিয়ে গেল। গাঢ় লাল রক্তে হাত রক্তিম হয়ে আছে তার। শুধু তাই নয়, সাদা জামাটিতেও লেগে আছে তাজা রক্তের দাগ, শুকিয়ে কালচে হয়ে আছে। মুহূর্তেই মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে গেল নবনীতার। বুক এখনো কাঁপছে। স্বর বের হচ্ছে না গলা থেকে। সে চিৎকার করতে চাইল কিন্তু পারল না। মাথাটা ঝিমঝিম করছে।খুব কষ্টে নিজেকে শান্ত করল সে। হয়তো শরীরের কোথাও কেঁটে গেছে, হয়তো চোট পেয়েছে। অসাড় মস্তিষ্কের অহেতুক যুক্তিতে ভয় কিছুটা হয়েও লঘু হল। উন্মাদের মত খুঁজতে লাগল আহত অংশ খানা। হ্যা, নিশ্চয়ই কোনভাবে ব্যথা পেয়েছে। তাই রক্তে রঙ্গিন হয়েছে হাত। কিন্তু কিছু সময়ের মাঝেই শান্ত হৃদয় অশান্ত হয়ে উঠল। বিচার ক্ষমতা লোপ পেল। তার শরীরের কোথাও চোটের চিহ্ন নেই, এমন কি পিঁপড়াও তাকে কামড়ায় নি। নবনীতার সন্ত্রস্ত চোখজোড়া রক্তাক্ত হাতটিকে দেখতে লাগল। অবচেতন মনে ভেসে উঠল সময়ের মৃ/ত্যুর দৃশ্য। অজান্তেই ভয়ানক একটি প্রশ্ন গ্রাস করল মস্তিষ্ক, কোনো ভাবে কি এটা সময়ের রক্ত? কিন্তু এমন তো হবার কথা নয়। নবনীতার স্বপ্ন শুধু আগত ভবিষ্যতের একটি ঝলক মাত্র। অনেকটি ক্যামেরার রিল পর্দায় চালানোর মত। সেখানে এমনটা অস্বাভাবিক ই নয় অসম্ভব। নবনীতা ছুটে গেল ওয়াশরুমে। ধুয়ে ফেলল হাতের রক্তটুকু। মুখে পানির ঝাপটা দিল। ভারসাম্যহীন নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। মাথা এখন সচল হয় নি। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না, কি করা উচিত। সব কিছুকে দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যেতেও পারছে না। কাউকে জানাতেও পারছে না। অহেতুক সন্দেহের সুঁই তার দিকে ঘুরবে। সবাই অহেতুক তাকে দোষারোপ করবে। নবনীতা নিজেকে নিজে বুঝাল,
“রিল্যাক্স, এটা একটা দুঃস্বপ্ন। আমার পক্ষে সময়ের বাসায় যাওয়া সম্ভব ই নয়। অসম্ভব”
নিজেকে যখন বুঝাতে ব্যস্ত তখন ফোনের তীক্ষ্ণ রিংটোন নিস্তব্ধতা চিরল। সাথে সাথেই কেঁপে উঠল নবনীতা। কাঁপা হাতে ফোনটি হাতে নিল সে। ফোনের স্ক্রিনে ভাসছে “শান্ত” নামটি। তিন-চার বার নিঃশ্বাস ছেড়ে ফোনটি ধরল সে। ঈষৎ ভাঙ্গা গলায় বলল,
“হ্যালো”
“শুভ সকাল ড্রিম মেশিন। কি স্বপ্ন দেখলে আজকে?”
শান্তর মুখে নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় “স্বপ্ন” শব্দটি শুনতেই ছ্যাত করে উঠল হৃদয়। যথাসাধ্য প্রচেষ্টায় নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করল নবনীতা। কৃত্রিম স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
“কোন স্বপ্নের কথা জানতে চাচ্ছেন?”
“যে স্বপ্ন সত্যি হয়”
“আপনি তো সেগুলোতে বিশ্বাস করেন না”
“তবুও বউ এর স্বপ্নের খোঁজ থাকা ভাল”
“আমি আপনার বউ নই”
“হবে তো একদিন, আমি সেদিনের অপেক্ষায় রয়েছি”
নবনীতা চুপ করে রইল। নবনীতার মৌনতা কিছুসময় অক্ষত রেখে শান্ত তাতে বা হাত দিল। স্বাভাবিক স্বরে বলল,
“ঘুরতে যাবে আজ?”
“আজ?”
“হ্যা, আমি ছুটি নিয়েছি। স্যারকে বলেছি কেস সলভ এর জন্য ব্রেইনের রেস্ট দরকার। আর আমার রেস্ট তোমাতে নিহিত। তাই ঘুরতে যেতে চাই।আবহাওয়া নরম। রোদের তেজ নেই। ইট পাথরের শহরের এক বিন্দু অরণ্যে ঘুরে আসা যাক। হয়তো অরণ্যেই দুজনের অতৃপ্ত হৃদয়ের হারানো চাবিটা খুঁজে পাবো”
শান্তর কথায় আবারো মৌন থাকল নবনীতা। কিছু একটা ভাবল। তারপর নির্লিপ্ত স্বরে বলল,
“আপনি সত্যি আমার হৃদয়ের হারানো চাবি খুঁজতে চান?”
“না চাওয়ার কারণ আছে কি? যার সাথে কিছুদিন বাদে জুড়তে চলেছি তার হৃদয়ে প্রবেশ করতে না পারাটা কিন্তু একদিক থেকে ব্যর্থতাই। আর আমি মানুষটি ব্যর্থতা পছন্দ করি না”
শান্তর কথাগুলো তপ্ত হৃদয়ের কাছে এক পশলা শীতল বর্ষণের ন্যায় লাগল। নবনীতার সন্ত্রাসে চাঁপা হৃদয় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মুহূর্তের জন্য ভুলে যেতে চাইলো ক্রুর বাস্তবতাকে। মস্তিষ্ক থেকে একটু পূর্বের দেখা ভয়ানক স্মৃতিটিকে মুছে ফেলতে চাইল। অশান্ত চিত্তকে শান্ত করে ধীর স্বরে বলল,
“কখন বের হচ্ছেন?”
“বিকেলে, পড়ন্ত বিকেলে তোমার শ্যামরাঙ্গা মুখখানা প্রেমিকের অতৃপ্ত চোখে দেখবো”
“আপনি এগুলো কেনো করেন? এই ক্রিঞ্জি ডায়ালগগুলো বলতে লজ্জা লাগে না?”
“একজন মহাপুরুষ বলেছেন, প্রেমিক হতে গেলে নির্লজ্জ হতে হয়”
নবনীতা উত্তর হাতড়াল, এই লোকের সাথে বিতর্কে নামলে হার ব্যতীত কিছুই পাওয়া যাবে না। তাই উত্তর না দেওয়াই শ্রেয়। শুধু কৃত্রিম কঠিন কণ্ঠে বলল,
“রাখছি”
ফোন কেটে দিল নবনীতা। ফোন রেখে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো নিজের রক্তাক্ত জামাটির দিকে। রক্ত শুকিয়ে কালছে দাগ এখনো লেগে আছে। এটা রক্ত ই এটুকুতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হল, রক্তটি কার?
******
অট্টালিকার ভাঁজে একমুঠো সবুজের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে নবনীতা। হাটে আলু মাখা। সিদ্ধ আলু আঁচারের তেল, ঝাল, লবণ দিয়ে মাখা। সবুজে ঘেরা, স্বচ্ছ জলরাশির উপর দাঁড়িয়ে কেউ আলু মাখা খেতে পারে ব্যাপারটা শান্তকে না দেখলে জানা হত না কখনোই। লোকটি সত্যি ই আলু পাগল। কি মুগ্ধ হয়ে সে আলু মাখা খাচ্ছে। নবনীতার হাতে এখন না খাওয়া অবস্থাতেই কাগজে মুড়ানো আলুমাখা রয়েছে। তার খেতে ইচ্ছে করছে না। সে গাঢ় নয়নে দেখছে শুধু জলরাশি। মৃদু বাতাসের ফিসফিসানি শুনতে মন্দ লাগছে না। মাঝে দাঁড়ানো পুরুষটি একটু ঝুকে দাঁড়ালো। হাতে থাকা কাগজটি মুড়ে পকেটে পুড়ল। ব্যাপারটা লক্ষ করল নবনীতা। অবাক স্বরে শুধাল,
“কাগজটা ফেলবেন না? প্যান্টটা ময়লা হবে তো?”
“নিচে ফেলছে পরিবেশ ময়লা হবে”
“ডাস্টবিন আছে”
“এখন তোমাকে ছেড়ে যাব না”
বেশ গম্ভীর কণ্ঠে কথাটা বলল শান্ত। নবনীতা কথা বলতে চায়, কিন্তু কথা খুঁজে পেল না। কি কথা বলা উচিত তার জানা নেই। ডেটিং নামক শব্দটি তার কাছে নবীন উৎপত্তি। একটি পুরুষের সাথে সময় ব্যয়িত করাটা তার কাছে নতুন একটি কাজ। তুষারের প্রতি তার আবেগ নামক অনুভূতিটি থাকলেও কখনো একাকীত্বে সময় কাটানো হয় নি। শান্তর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন। লোকটি নিজ থেকেই মিশতে চায়। তাই নবনীতার বারণ করার কারণ থাকে না। নীরবতায় চির ধরাল শান্ত। গাঢ় কন্ঠে বলল,
“একটা কথা বলব?”
“বলুন”
“তোমাকে বিয়ে করাটা কিন্তু আমার ইচ্ছের ঝুলিতে ছিল না”
“আমি জানি, আমার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই”
“তাহলে রাজি কেন হলে?”
“অসম্মতির কারণ খুঁজে পাচ্ছিলাম না”
“যাক আমাদের কিছু তো মিলেছে। আসলে আমাদের এত অমিল যে, সারাজীবন মিল খুঁজে বেড়ালেও সেই সন্ধ্যান শেষ হবে না। এটাকে ওয়াল্ডস লার্জেস্ট ট্রেজার হান্ট বলা যাবে”
“তাহলে আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছেন?”
নবনীতার স্পষ্ট প্রশ্নে একটু সময় নিল শান্ত। তারপর গাঢ় পুরুষালি কণ্ঠে বলল,
“তোমাকে জানতে”
“জি?”
“আমি তোমাকে জানতে চাই নবনীতা, চিনতে চাই। আর আমি এখন ফান করছি না। আই এম ড্যাম সিরিয়াস”
শান্তর কথা কর্ণপাত হতেই নবনীতা তার দিকে তাকাল। শান্তর প্রগাঢ় নয়ন তার মুখশ্রীতে হামলে পড়ছে। এই দৃষ্টির অর্থটি খুব ই ভয়ানক। নবনীতা তার নয়নে চোখ রাখার সাহস পেল না। শান্ত ঝিলের গভীরতা মাপার সাহস নেই তার। লেকের শান্ত পানির দিকে চেয়ে বলল,
“এতদিন যা ছিল তা কি ফাজলামি ছিল তবে?”
“সেটা বলতেই পার। আসলে আমি মানুষটি মোটেই এমন নই। একটু মুক্ত গাঙচিলের মত বিচরণ তবে তোমার ভাষার ঐ ছ্যাবলাটি নই। শুধু তোমার কাছেই এমনটা হতে ভাল লাগে। আনন্দ পাই তোমার রঙ্গিম রাগে রাঙ্গা মুখ খানা দেখে। তুমি আমার কাছে বিচক্ষণ রহস্য উপন্যাসকের খুব যতনে লেখা মিস্ট্রি, আমি তার এক এক পাতা স্বযত্নে পড়তে চাই”
“পুলিশের মুখে সাহিত্য বেমানান। আপনার কথায় থাকবে কাঠিন্য। শক্তপুক্ত সংলাপ। তাই কথাগুলোকে সিরিয়াসলি নিচ্ছি না”
“সেটা তোমার ব্যাপার ড্রিম মেশিন। আমার সেটাতে মাথা ব্যাথা নেই। তবে তোমার স্বপ্নে নিজেকে দেখার ইচ্ছে হয়”
“দুঃসাহসিকতা ভাল নয়”
“তুমি তো স্বপ্ন বদলাতে পার। নাহয় আমাকে নিয়ে সুন্দর স্বপ্ন গুলোই দেখো”
“আপনার বিশ্বাস হয় আমার কথা?”
নবনীতার কণ্ঠে তাচ্ছিল্য। শান্ত খানিকটা মিয়ে গেল। তার এখন বিশ্বাস করে না। বিশ্বাস করতে পারে না। লজিক দিয়ে জীবন কাটানো মানুষদের ব্যপারগুলো মোটেই বিশ্বাস হবার কথাও নয়। দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল,
“না বিশ্বাস করি না”
“তবুও আমাকে জানতে চান? মিথ্যুক, ডপবাজকে জানার ইচ্ছে?”
নবনীতার প্রশ্নে তার হাহাকার মিশ্রিত ছিল। মেয়েটির হৃদয়ের চাঁপা হাহাকার ভোঁতা সুঁচের মত বিঁধল। উত্তরটি দেবার পূর্বেই তার ফোনটি বেজে উঠল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল “ইরশাদ” নামটি। ফোন রিসিভ করতেই ইরশাদ ব্যস্ত গলায় বলল,
“স্যার, গুলশান-২ এ আসতে পারবেন?”
“আজ আমার ছুটি ইরশাদ”
“আই নো স্যার। বাট ইমার্জেন্সি”
ইমাঞ্জেন্সি সত্যি ই ছিল। সময় ছেলেটি আ/ত্ন/হ/ত্যা করেছে। শুধু তাই নয়, ঘটনাস্থলে পাওয়া গেল তার সুই/সাই/ড নোট, যেখানে লেখা,
“নিয়ন এবং দোলাকে খু/ন আমি করেছি। নিজের কৃতকার্জের ভার আর বইতে পারছি না। তাই এই জীবন ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলাম”………………
চলবে