আমি তারে দেখেছি পর্ব ১১

0
431

#আমি_তারে_দেখেছি
#১১তম_পর্ব

খাবার টেবিলে একেবারে সাধারণ খাবারের আয়োজন। আড়ম্বরতার ছিটে ও নেই। মা থাকলে যে ক্ষেপতেন তার সন্দেহ নেই। কিন্তু শান্ত ই বলেছে সে নাকি মাছে ভাতে বাঙালি নয়, আলু ভাতে বাঙালি। তাই তো গরম ভাত, আলু ভর্তা, ডিম ভাজি আর ঘি দেওয়া হয়েছে। এবং মদনমোহন তর্কালংকার তা তৃপ্তির সাথে খাচ্ছেন ও। এক এক লোকমা মুখে তুলছেন আর বলছে,
“অমৃত”

নবনীতা বুঝল না, এই সাধারণ খাবারে অমৃতের কি কাছে। নবনীতার সামনে কফি। খাওয়ার ইচ্ছে মরে গেছে। দোলার মৃত্যুটি খুব ই রহস্যজনক। তাকে মে/রে ফ্যানের সাথে ঝু/লি/য়ে দেওয়া হয়েছে অথচ ওই সময় বাহিরের থেকে কেউ ভেতরে যায় নি। অদ্ভুত। নবনীতা যখন চিন্তায় বিভোর তখন শান্তর কণ্ঠ কানে এল,
“আচ্ছা, এই তুষার টা কে?”

“তুষার” নামটি শোনামাত্র খানিকটা চমকে উঠল নবনীতা। বিবর্ণ হয়ে উঠল শ্যামমুখখানা। কফিতে চুমুক দিতে যেয়েও থেমে গেল নবনীতা। তার চোখে মুখে অব্যক্ত অস্বস্তি লক্ষ করল শান্ত। তার কপালে গাঢ় ভাঁজ, বারবার হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি অন্য হাতের তালু ঘষছে। শান্ত ভাতের লোকমা মুখে তুলতে তুলতে বলল,
“বলতে না চাইলে জোর করব না। সব কথা আমার জানতে হবে জরুরি নয়”

শান্তর কথাটি কান অবধি পৌছাতেই কিঞ্চিত মিয়ে গেল নবনীতার। মুখশ্রীতে বিষাদের মেঘমেদুর ছেয়ে গেল। নিলীন চোখে কফির মগটির দিকে তাকিয়ে ধীর স্বরে বলল,
“তুষার নামটির সাথে জড়িত স্মৃতিগুলো ঠিক লুকানোর মত কিছুই নয়। সবার অতীত থাকে, ভেবে নিন আমি তুষার আমার অতীতের কোন অধ্যায়ের কিছু পাতা মাত্র। যে পাতাগুলোর এখন আর বই এর কোথাও স্থান নেই”
“তোমার মত নারীর ও তাহলে অতীত ছিল”
“কেন? আমার অতীত থাকতে পারে না?”
“না না, এমন টা নয়। আসলে তুমি হৃদয়হীনা কি না! তাই আর কি সন্দেহ হচ্ছে? এই কঠিন হৃদয়ে যে পুরুষ স্থান পেয়েছে না জানি সে কত টা প্রতিভাবান, চমৎকার”

শান্তর রসিকতার ছলে বলা কথায় ম্লান হাসল নবনীতা। স্বগোক্তির ন্যায় বলল,
“মানুষ সর্বদা একরকম থাকে না। মাঝে মাঝে পরিস্থিতির কাঠিন্য তাকে বদলে দেয়”

শান্ত আর কিছু শুধাল না। আসলে চাইল না। তুষার নামটি হৃদয়ে ছোট মাছের কাঁটার মত বিধলেও সে নবনীতাকে আর শুধাবে না কিছু। মাত্র দুদিনের সম্পর্কের জোর এতটা প্রবল নয়। তাই অহেতুক মাথা ব্যাথা হতে ইচ্ছে হচ্ছে না তার। সময় হোক, নবনীতা নিজ থেকেই তার বক্ষস্থলে জমায়িত কথাগুলো বলবে বলে তার ধারণা। তাই সব ছেড়ে খাওয়াতে মনোনিবেশ করল শান্ত।

শান্ত বিছানা করা হল বসার ঘরে। সোফা কাম বেডটা টেনে খাটের মত ব্যাবস্থা করে দিয়েছে নিশাদ। নবনীতাদের বাসায় ঘর তিনটে। নিশাদের পরীক্ষা বিধায় সে রাত জাগবে, ফলে শান্ত সেখানে ঘুমোতে পারবে না। কারণ আলো জ্বালিয়ে ঘুমানোর অভ্যেস তা নেই। তার ঘর হতে হবে অন্ধকারে নিমজ্জিত কোনো গর্ত। যেখানে আলোর বিন্দু মাত্র ঠাঁই নেই। সেইরকম হলেই তার ঘুম আসে নয়ত রাত পেঁ/চার মত জেগেই কাটাতে হয়। বাকি রইল নবনীতার ঘর। শান্তর এতে আপত্তি ছিল না। কিন্তু নবনীতার চোখ রাঙানোর সামনে সেই আবদারটা গলধঃকরন করতে হল তা। আর জসীম সাহেবের ঘরে সে মোটেই থাকবে না। ফলে তার ঠাঁই হল এই বসার ঘরে। নবনীতা তার সোফার পাশে পানির বোতল রাখতে রাখতে বলল,
“অহেতুক এই প্যারাটা মাথায় নিলেন। কি দরকার ছিল থাকার?”
“তুমি সত্যিই হৃদয়হীনা ড্রিম মেশিন, কোথায় আমার জন্য কষ্টে তোমার বুকে সিডরের মত ঝড় উঠবে। আমার হাতে হাত রেখে বলবে, “প্রিয় তোমার ভালোবাসা আমি জীবনের বিনিয়ে আগলে রাখব”। তা না, বলছো, প্যারা কেনো মাথায় নিলাম। হাহ! শেম অন ইউ। কয়টা হবু বর দেখেছ সকালে ডিউটি থাকা সত্ত্বেও রাতের বেলায় এসে পাহারা দেয় বউ কে?”
“আমি কি আপনাকে থাকতে বলেছি?”
“তা বল নি, কিন্তু আমি বুঝি। আমার থাকাতে তোমার ভালো লাগছে”

শান্তর কথাটি শুনে মুখে বিরক্তির শব্দ করলো নবনীতা। বিরক্তিমাখা কণ্ঠে বলল,
“এত অসহ্য মানুষ হয়?”

বলেই হনহন করে নিজ ঘরে চলে গেল। শান্তর মুখে প্রশান্তির হাসি। আজকের মত নবনীতা জ্বালানো মিশন শেষ। নিজের বিধ্বস্ত দিনের ক্লান্তি, জড়তা মুহূর্তেই বিলীন হয়ে গেলো এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খুনসুটির আলোকছটায়। মেয়েটির রক্তিম রাগি মুখশ্রী যেন চেরী অন দ্যা টপ। তবে এসবের মাঝেও একটি জিনিস মস্তিষ্ক থেকে বিচ্যুত হচ্ছে না। বিশ্বাস না করতে চাইলেও এটা সত্যি যে নবনীতার স্বপ্ন সত্যি হচ্ছে। শুধু তাই নয় খুব বাজে ভাবে সত্যি হচ্ছে। সাইন্টিফিক্যালি, লজিক্যালি এই ঘটনা অসম্ভব। নবনীতা ভণ্ডামি করছে এটাও বলতে পারছে না। কারণ সে আগ থেকেই তাকে দোলার মৃ/ত্যুর কথা শান্তকে জানিয়েছিলো। যদিও না চাইতেই বাজে একটি ধোঁয়াশা চিন্তা মনে আসছে, কোথাও এই মৃ/ত্যু গুলোর সাথে নবনীতা জড়িত নয় তো। কিন্তু সেখানেও পাজেল মিলছে না। দোলাকে খু/ন করা হয়েছে। এটা শিওর হবার কারণ, ওড়নাটির খুব একটা লম্বা ছিল না, টুলের উচ্চতাও ছিল দুই ফুট। আর দোলার উচ্চতা এত বেশি নয় যে সে গ/লা/য় সেই টুলে দাঁড়িয়ে ফ্যান অবধি পৌছাতে পারে। শান্তর ধারণা খু/নী দোলাকে হ/ত্যা করে তাকে ফ্যানের সাথে ঝু/লা/নো হয়েছে। পরবর্তীতে সেটা আ/ত্ম/হ/ত্যা রুপে দেখাতে টুলটি রাখা হয়েছে। খু/নী খুব চালাক ও বটে চতুরতার সাথে দোলার ফুট প্রিন্ট ও তুলে রেখেছে। অথচ নিজের কোনো ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেই। এই খু/নের সাথে নবনীতা জড়িত থাকলে তার পক্ষে এত গুলো কাজ করা সম্ভব নয়। কারণ নবনীতা উচ্চতা এবং জীর্ণশীর্ণ শরীরের পক্ষে এমনটা করা সম্ভব নয়। শান্ত রিচেক করার জন্য ফ্লাটের দারোয়ানকে শুধিয়ে ছিলও নবনীতার ছবি দেখিয়ে। কিন্তু দারোয়ান ভীত স্বরে বলল,
“স্যার, এই ম্যাডামরে কখনোই দেখি নি”

তাই এটা নিশ্চিত যে নবনীতা অন্তত ফ্লাটে তো যায় নি। উপরন্তু সে তখন হাসপাতালেই ছিল। তাহলে এই খু/ন গুলো করছে কে? তার মোটিভ কি? অদ্ভুত ব্যাপার নিয়নের সু’ই’সা’ইড নোটে দোলার নাম ছিল, তাহলে উল্লেখিত সবার খু/ন হবে? আর সবগুলো খু/ন ই কি স্বপ্নে দেখবে নবনীতা! স্বপ্নে সত্যি ভবিষ্যত দেখা যায়!

এর মাঝেই ফোনটি বেজে উঠল শান্তর। স্ক্রিনে ভেসে উঠল পরিচিত নাম, “মাদার বাংলাদেশ”

******

হেনা বেগম জসীম সাহেবের সম্মুখে বসে রয়েছেন। তার মুখে হাসি। বৃদ্ধার লাল ঠোঁটে হাসিটা মোটেই মানাচ্ছে না। বড্ড বেমানান লাগছে জসীম সাহেবের কাছে। তার সামনে খোসা ছাড়ানো আপেলের টুকরো। হাসপাতালে অন্য কোনো ফল দেবার রীতি নেই। শুধু ঠুসে ঠুসে আপেল খাওয়ানো হচ্ছে। অরুচি হয়ে গিয়েছে তাই আপেলের উপর। হেনা বেগম ও আপেল ই নিয়ে এসেছেন। তার ঠিক পেছনে গা/ধা পুলিশটা পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের এত ঘটা করে আসার হেতুটা বুঝে উঠতে পারছে না সে। হেনা বেগম ই নিস্তব্ধতা ভেঙে বললেন,
“আমাকে তোমার এখন অপছন্দ তাই না জসীম?”………

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here