#আমি_অর্ষা
#মেঘাদ্রিতা_মেঘা
#পর্ব_৫
আপনারা যাবেন জেলে পরিবারের সাথে আত্মীয়তা করতে।আমাদের সাথে নয়।
সেই মুহূর্তে আমি গিয়ে তুর্জর গালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেই।
আর তুর্জ আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
অতঃপর বলে উঠে,
_অর্ষা!
_হ্যাঁ #আমি_অর্ষা
আমিই অর্ষা,এই জেলের মেয়ে অর্ষা।
আমি এই জেলে পরিবারের মেয়ে।
আমি সেই মেয়ে,যার সাথে আপনার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো।
আমি সেই অর্ষা যাকে বিয়ে করলে আপনার মান সম্মান নষ্ট হবে,আপনি আপনার বন্ধুদের কাছে আমার পরিচয় দিতে পারবেন না বলে গায়ে হলুদের দিন চো রের মত পালিয়ে গিয়েছিলেন।
হ্যাঁ আমি সেই অর্ষা,যে কিনা সেই দিনের পর এলাকায় মাথা তুলে কথা বলতে পারিনি।
আর না পেরেছে আমার পরিবার।
আপনি জানেন?গ্রামে একটা মেয়ের বিয়ে ভেঙে গেলে সমাজ তাকে কেমন চোখে দেখে?
লোকের চোখে আমি খারাপ।
তাই নাকি আমার বিয়ে ভেঙে গিয়েছে।
আমি নাকি অ পয়া,অ লক্ষী,আমার নাকি কোন দোষ আছে তাই আপনারা বিয়েটা ভেঙে দিয়েছেন।
আচ্ছা বলুন তো,আসলেই কি আমি খারাপ ছিলাম?
আপনি জানেন,আমার গরীব বাবা কত কষ্ট করে বিয়ের কেনাকাটা করেছিলেন?
কত কষ্টের টাকা তার।
আমার বাবা মাছ ধরেন বলে আপনার জাত যাবে আমার পরিচয় দিতে।
ওই আপনি কি মাছ খান না?
কেন খান আপনি মাছ?
ওই মাছ যারা ধরে তাদের ঘৃণা করেন,তাদের ধরে আনা মাছ কিনে খান কেন?
তখন ঘৃণা লাগেনা?
আমার বাবা কি চু রি করেন?
নাকি অ বৈধ কোন উপায়ে টাকা উপার্জন করেন?
আমার বাবা কষ্ট করে মাছ ধরেন,আর সেই মাছ বিক্রি করে সৎ ভাবে টাকা কামিয়ে আনেন।
আপনার মত নিচু মনের মানুষ তা বুঝবেনা।
_অর্ষা (রেগে গিয়ে)
_চুপ,একদম চুপ।
আজ আমি বলবো আপনি শুনবেন।
_আপনি বলেছিলেন না,আমি আপনাকে ঠকানোর মত বা আপনার সাথে প্রতারণা করার মত মেয়ে না?
আপনার সেই বিশ্বাস আছে আমার প্রতি।
আমি আসলেই কাউকে ঠকানোর মত বা প্রতারণা করার মত মেয়ে না।
আমি তো আজ প্রতারণা করলাম না।
আর না ঠকালাম।
আমি আমার বাবার অপমানের প্রতিশোধ নিলাম।
দিনের পর দিন আমার বাবা মায়ের মুখ লুকিয়ে কান্নার প্রতিশোধ নিলাম।
আপনার জন্য অন্যের কাছে অপমানিত হবার প্রতিশোধ নিলাম।
আর আজ আপনার কাছে অপমানিত হবার প্রতিশোধ নিলাম।
আর আপনি আমাকে ভালবাসেন তাইনা?
আপনি আমাকে না আমার সৌন্দর্য্য কে ভালবাসেন।
আমি সুন্দর না হলে আপনি আমাকে ভালবাসতেন না।
আজ আমি সুন্দর বলে আপনি আমার কোন কিছু জানার ও প্রয়োজন করেন নি।
আপনি আমার রুপ দেখে পাগল হয়েছেন।
আমার পরিবার সম্পর্কে জানলে কখনোই আমাকে ভালবাসতেন না।
আমি এমন ছেলেকে কখনোই আমার জীবন সঙ্গী হিসেবে চাইবোনা,যে আমার বাবার কাজ কে অসম্মান করবে।
আমার বাবাকে অসম্মান করবে।
জেলে পেশাটাকে অসম্মান করবে।
খেটে খাওয়া মানুষদের অসম্মান করবে।
তাই আমি আপনাকে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে আমার পক্ষে আপনাকে বিয়ে করা সম্ভব না।
আপনি আমাকে কি রিজেক্ট করবেন।
আমিই আপনাকে আজ রিজেক্ট করলাম।
_কিন্তু অর্ষা আমাকে তো কিছু বলার সুযোগ অন্তত দাও।
_না।
আজ আমি আপনার কোন কথাই শুনবোনা।
অনেক হয়েছে আর না।
_অর্ষা আমি অনুতপ্ত।আমার ভুল হয়েছে।
আমার উচিৎ হয়নি জেলে পেশাটাকে অসম্মানের চোখে দেখা।আমাকে একটা সুযোগ দাও।
_দুঃখিত মিঃ তুর্জ আমাকে ক্ষমা করবেন,আমি আপনাকে কোন সুযোগ দিতে পারলাম না।
আপনার আজকের এই শিক্ষাটা আশা করি সারাজীবন মনে থাকবে।
অন্তত আজকের এই ঘটনার জন্য আপনি ২য় বার কোন দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষকে অসম্মান করতে গেলেও ২য় বার ভাব্বেন।
_বাবা মা চলো,
ও হ্যাঁ,
মিঃতুর্জ,
আমি আপনার দেয়া চুড়ি,কাজল,ঝুমকো কানের দুল,আর শাড়ি সব কিছুই আপনাকে ফেরত পাঠিয়ে দিবো এই ঠিকানায়।
ওসব নিয়ে চিন্তা করবেন না।
_ওসব তুমি কোথায় পাবে?ওগুলো তো আমাদের বাসায়।
_আজকের গুলোর কথা বলিনি আমি।
আগে যে চিরকুটের সাথে পাঠিয়েছিলেন সেগুলোর কথা বলেছি।
_চিরকুট? আমি তো কোন চিরকুট পাঠাইনি।
_কোনো চিরকুট পাঠান নি মানে?
আপনি আমাকে একে একে কাজল চুড়ি ঝুমকা শাড়ি এগুলো পাঠাননি চিরকুটের সাথে?
_নাতো।
_তাহলে আপনি যে ওইদিন আমাকে ছাদে আসতে বললেন শাড়ি পরে?
_আমি?আমি কবে তোমায় শাড়ি পরে ছাদে আসতে বল্লাম?
_এক মিনিট এক মিনিট,
যেদিন আপনি আমাকে প্রপোজ করলেন।
ওইদিন আমি যেই শাড়িটা পরে ছিলাম,ওটা কি আপনি দেন নি আমাকে চিরকুটের সাথে?আর লিখেন নি,আমি যেন শাড়িটা পরে ছাদে যাই?
_আরে বাবা কত বার বলবো?
আমি দেইনি কোন শাড়ি টারি,আর না লিখেছি কোন চিরকুট।
আমার টাকা অত বেশি হয়ে যায়নি যে কোন মেয়ের পেছনে অযথা টাকা নষ্ট করবো।
_থ্যাংকস টু আল্লাহ।
আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়েছেন।
আপনার মত ছোট মনের মানুষ থেকে আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়েছেন।
আর এত্ত বড় ভুলের পর্দা আল্লাহ আমার চোখ থেকে আজ সরিয়ে দিয়েছেন।
ভালো থাকুন।
থ্যাংক ইউ অলসো,সত্যি টা বলার জন্য।
যে আপনি এসবের কিছুই আমাকে দেন নি।
আর এত বড় মনও আপনার নেই যে আপনি আপনার ভালবাসার মানুষকে আই মিন যাকে ভালবাসেন তাকে কিছু গিফট করবেন।
আপনি ছোট মনের মানুষ, সারাজীবন ছোট মনের ই থাকবেন।
আল্লাহ হাফেজ।
চলো বাবা মা,চল প্রেমা রুনা।
আমি বাবা মাকে নিয়ে আর ওদের নিয়ে চলে আসি বাসায়।
আর ভাবতে থাকি,
তুর্জ এসব না দিলে কে দিয়েছে তাহলে আমাকে এগুলো?
আদিব তো দিবেনা কারণ আদিব তো ভালবাসে প্রেমা কে।
তাহলে কি অরণ্য?
না না তা কেন হবে?
তারা ধনী মানুষ।
আমার মত মেয়েকে কেন তারা…
আর যদি সে দিয়েই থাকবে,তাহলে ছাদে কেন আসেনি সেদিন।
নাকি কেউ ফান করেছে আমার সাথে?
মাথায় কিছুই আসছেনা।
প্রেমা আর রুনা আমাকে বলে,এখন এত সব ভেবে লাভ নেই।
জানিতো মাথায় অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।
বাদ দে ওসব।
যখন ঢাকায় যাবো তখন খুঁজে বের করবোনে মানুষ টা কে।
এরই মধ্যে দুদিন পর হঠাৎ করেই খবর আসে আমি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে গেছি।
আমাকে সিলেক্ট করা হয়েছে।
বাবা মা আমি আমরা সবাই তো খুশিতে আত্মহারা।
আমাকে আমাদের এখানকার একটা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে হবে।
আজ আমি আমার বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছি।
বাবা তো খুশিতে মিষ্টি আনতে চলে গেলেন।
আর খুশিতে বলতে বলতে গেলেন,আমি আজ থেইকা অর্ষা ম্যাডামের বাপ।
আমারে সবাই দেইখা কইবো,ওই যে ওইডা অর্ষা ম্যাডামের বাপ যায়।
আমার মাইয়্যা আজ শিক্ষক হইছে।জেলের মাইয়্যা আজ শিক্ষক হইছে।
আজ আমাদের ঢাকায় যাবার কথা ছিলো।
আমি প্রেমা আর রুনাকে বললাম,তোরা যা।
আমি কিছু দিন পর আসি।
আর ওদের বলি,বাসার সবাইকে যেন জানিয়ে দেয় আমার এই সুখবর টা।
এরপর ওরা চলে যায়।
আমি থেকে যাই গ্রামে।
কিছু দিন পর আমি ঢাকায় গিয়ে আমার সব কিছু গোছগাছ করি।
আর বাড়ীওয়ালা আংকেল এবং আন্টিকে জানাই,
আমার যেহেতু আমার গ্রামে থেকে শিক্ষকতা করতে হবে তাই আমার পক্ষে আর শহরে থাকা সম্ভব হচ্ছেনা।তাই আমার বাসা টা ছেড়ে দিতে হচ্ছে।
যদিও রুনা আর প্রেমা থাকবে।
আমি শুধু আমার পরীক্ষার সময় এসে আমার পরীক্ষা গুলো দিয়ে যাবো।
আন্টি আমার শিক্ষকতার জন্য খুশি হলেও আমি চলে যাবো বলে মন খারাপ করছে।
আমি প্রথমার মা এবং আরেক স্টুডেন্ট এর মাকেও সব বুঝিয়ে বললাম।
আর বললাম,এখন থেকে ওদের রুনা পড়াবে।যদি তাদের কোন আপত্তি না থাকে।
প্রথমা আর আমার আরেক স্টুডেন্ট আমার জন্য মন খারাপ করে।
আর বলে,মাঝে মাঝে এসে যেনো আমি ওদের দেখে যাই।
আদর করে যাই।
আমারো সবার জন্য মন খারাপ লাগে।
কিন্তু কি আর করার।
স্বপ্ন যে পূরণ করতে হবে আমার।
আমার বাবা মায়ের স্বপ্ন।
চলে আসি বাসায়।
চলছে দিন।
রুনা আর প্রেমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করি,
আর কি কোন চিরকুট বা গিফট এসেছিলো আমার নামে?
ওরা না করে।
দেখতে দেখতে চলে যায় আরো কিছু দিন।
আমার এখন আর বুঝতে বাকি নেই চিরকুট আর গিফট গুলো কে দিয়েছিলো।
ওই অরণ্যই দিয়েছিলো ওগুলো।
এছাড়া আর কেউ নয়।
কিন্তু সে কেন তাহলে দেশ থেকে চলে যাবার সময় আমার সাথে দেখা তো দূরে থাক।
একটু কথা পর্যন্ত করে গেলোনা?
এসব ভাবতে ভাবতে মা চলে আসেন আমার রুমে।
আর এসে বলেন,
_কেমন যাচ্ছে তোর দিন কাল?
_এইতো ভালো মা।
_এখানে একবারে যে চলে আসলি,পড়াশোনার ক্ষতি হইতেছে নাতো তোর?
_না মা হচ্ছেনা।
ক্লাস গুলো মিস যাচ্ছে,তবে আমি রুনা আর প্রেমার থেকে সাজেশন সংগ্রহ করে নিচ্ছি।
_দেখিস মা,পড়াশোনার যেন কোন ক্ষতি না হয়।
_আচ্ছা মা।
এভাবে কেটে যায় আরো কিছু দিন।
ভাবলাম,পরীক্ষা আসুক তখন প্রেমাদের ওখানে গিয়ে আন্টির নাম্বার থেকেই একটু অরণ্যর সাথে কথা বলে নিবো।
আর জিজ্ঞেস করবো,চিরকুট আর গিফট গুলো সত্যি সত্যিই সে ই দিয়েছেন কিনা।আর কেন ই বা দিলেন।
আর যদি সে ই দিয়ে থাকেন তাহলে ওই দিন ছাদে আসতে বলে কেন তিনি ছাদে আসলেন না।
পরের দিন আমি বিদ্যালয়ে গিয়ে ক্লাস নিচ্ছিলাম বাচ্চাদের।
আর ওদের বলছিলাম,
কোন কাজই ছোট নয়।
তোমরা কখনো কোন কাজকে অসম্মান করবেনা।
কোন কাজের লোককে অসম্মান করবেনা।
কৃষক,তাতী,রিক্সাচালক,জেলে, কামার,কুমার,দর্জি,মুচি এরাও আমাদের মতই রক্তে মাংসে গড়া মানুষ।
তারা আছেন বলেই আমরা শান্তিতে বসবাস করতে পারছি।
কৃষক না থাকলে আমরা ধান/চাউল,ডাল তেল,ফলমূল সবজি এগুলো পেতাম কই?
তাতী কাপড় না বু্নলে,দর্জি কাপড় না শেলাই করলে পরতাম কি?
রিক্সাওয়ালারা রিক্সা না চালালে তোমরা কিভাবে চলতে?
কষ্ট হতো না?
জেলেরা মাছ না ধরলে মাছ পেতাম কই?
মা রান্না করে দিতো কিভাবে?
আর মুচি যদি জুতা শেলাই না করতো আমাদের নতুন জুতা যে মাঝে মাঝে ছিঁড়ে যায়।
তা আমাদের শেলাই করে দিতো কে?
তারা সবাই আছেন বলেই আমরা আরামে বসবাস করতে পারছি।চাকুরীজীবিরা কি এগুলো করতে পারতো?চাকুরীজীবিরাও যেমন কাজ করেন।
তারাও তাদের কাজ করেন।
তাহলে সবাই বুঝেছো,কোন কাজকে ছোট করে দেখবেনা কখনো।
মনে থাকবে?
_জ্বী আপা মনে থাকবে।
_আর তোমরা কিছু না বুঝলে না জানলে আমাদের জিজ্ঞেস করবে।
আমরা তোমাদের শিক্ষক।
তোমাদের বোঝানো,জানানো,শেখানো আমাদের কাজ।
তোমাদের সুশিক্ষায় সুশিক্ষিত করা আমাদের দায়িত্ব।
_জ্বী আচ্ছা আপা।
_আচ্ছা সবাই তাহলে ভালো থেকো।
আজকের মত এখানেই সমাপ্ত।
_আসসালামু আলাইকুম আপা।
_ওয়ালাইকুম আসসালাম।
সেদিনের মত ক্লাস শেষ করে যখন আমি রুম থেকে বেরিয়ে চলে যাচ্ছি,
হঠাৎ করেই চোখ যায় বিদ্যালয়ের মেইন গেইটের সামনে।
আর আমি আঁতকে উঠি,
চলবে…