#আমার রাজ্যের রানী
#Part : 42(last)
#Writer : Sriti Nur Avni
?
খরস্রোতা নদীর তীরে বয়ে যাওয়া ঢেউয়ের ন্যায় জীবন বহমান।কখনো বৃষ্টিস্নান্ত টলমল করা পানির ন্যায়,কখনো বা তীব্র রোদে ঝলসে যাওয়া উত্তপ্ত পানির ন্যায়।আবার কখনো বা জোৎস্নার আলোর ঝলমলে মেতে থাকা পানির ন্যায়।তবুও জীবন গতিশীল।।
দীর্ঘ ছয়মাস লন্ডন থেকে ডিগ্রি নিয়ে বাসায় ফিরেছে নীল।।তাই মিহিরের আদো আদো হামাগুড়ি দেবার আনন্দের সাথে জোড়া লেগেছে কাছের মানুষ কাছে ফিরে আসার আনন্দ।।
সময় গতিশীল। সে চলবে! চলবেই।তার সাথে কাঁধে হাত রেখে চলতে থাকবে জীবন।।সুখ,দুঃখ কষ্ট অভিমান সব মিলিয়েই চলবে সে।।
লন্ডন থেকে ফিরে এসে মাস দুয়েক যাবৎ চেম্বারে বসছে নীল।।অভনী পুরোদমে ব্যাস্ত এখন তার বাবার স্বপ্ন পূরনের লক্ষ্যে।।অন্যদিকে বড্ড মিষ্টি নিয়মেই এগিয়ে যাচ্ছে মাহিব আর আরিহার ঝগড়ার সাথে একটুকরো ভালোবাসা।।
.
?
খাটের মাঝখানে নীর্ঝয়ের কোলে মাথা রেখে একের পর এক আচার খাচ্ছে নীরা।।ভ্রু কুঁচকে নীরার দিকে তাকিয়ে আছে নীর্ঝয়।।এই আঁচার নামক খাদ্য টায় এমন কি আছে যার জন্য এভাবে খেতে হবে তা বুঝতে পারছে না নীর্ঝয়।।তবুও হেলেদুলে আচার খেতে খেতে মাঝে মাঝেই চোখ বন্ধ করে মুখ কুচকে অদ্ভুত এক শব্দ করাটা দেখতে বেশ লাগছে নীর্ঝয়ের।।ডুলু ডুলু পেটে নীরার মাঝে অন্যরকম সৌন্দর্য এসে ভীর জমিয়েছে।। হয়তো প্রতিটি মেয়েরই এমন সময় হাজারো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।লক্ষ্য করা যায় শরীরের পরিবর্তনে গুলুমুলু টাইপ কে।।তুলনামূলক ভাবে নীরার পেট একটু বেশিই বড়,,তাই হাঁটা চলা করতে বড্ড কষ্ট হয় তার।অফিস শেষ করে সারাক্ষণ নীরার পেছনেই লেগে থাকে নীর্ঝয়।।বাবা হবার অদ্ভুত আনন্দে অফিসের কাজ সেরে বাসায় এসে নীরা কে দেখতেই সব ক্লান্তিতা দূর হয়ে যায় তার।।এই মেয়েটাকেই একসময় এতোটা কষ্ট দিয়েছে ভাবতেই গাঁ শিউরে উঠে তার।।
.
.
.
?
আকাশে মস্ত বড় চাঁদ।চাঁদটা আজ বড্ড চঞ্চল।।পেঁজা তুলোর মতো আদুরে মেঘ গুলোর সাথে তার কতো লুকোচুরি খেলা!! তারই জোৎস্নার আলোয় খনে খনে বাতাসে ঢেউ তোলা নদীর মাঝে স্রোতে ভাসতে থাকা ডিঙি নৌকায় পা দুলিয়ে বসে আছে দুজন তরুন তরুনী।।হালকা আকাশি রঙের শাড়ি পরে বসে থাকা অভনীর বাম পাশে সাদা পাঞ্জাবি পরে বসে আছে নীল।।আজ হটাৎ এখানে আসার কারন নীলের কাছে অজানা।তাই অদ্ভুত মুগ্ধতার সাথে মুখে লেগে আছে একঝাঁক প্রশ্নের ঝঞ্জাট।।আজো নৌকায় কোনো মাঝি নেই।বৈঠা কে নিজগতিতে ছেড়ে দিয়ে আকাশের ন্যায় আকাশি পরীর দিকে তাকিয়ে আছে নীল।।আড়চোখে নীলের দিকে বারবার তাকিয়ে লজ্জামাখা হাসি দিয়ে মাথা নিঁচু করে ফেলছে অভনী।।নীস্তব্ধ পরিবেশে জমাট বেঁধে থাকা কথা বলতে গিয়েও বলতে না পারাটা বেশ বিষাক্ত!বড্ড বিষাক্ত ময় সময়।।
সমস্ত লজ্জা আর সংকোচ গুলো কে নদীর তীরে ভাসতে থাকা কচুরিপানার উপর রেখে দিয়ে বলে উঠলো অভনী,,,,,
—আমাদের দুজনের ভালোবাসা টা শুরু হয়েছিল নদীর তীরে।অদ্ভুত আনন্দ মাখা সময় গুলো ছিলো নদীর তীরে।হাতে হাত রেখে ঝুমঝুম করা নুপুরের শব্দের সাথে পথ চলা ছিলো নদীর তীরে।দুজন দুজনের ভালোবাসা প্রকাশ করা ছিলো নদীর মাঝে।প্রতিটি মেয়ের জীবনের কষ্টে আনন্দে মিশ্রিত সব থেকে বেশি স্বপ্ন দেখাময় বিয়ের দিনটি ছিলো আমাদের সমুদ্রের মাঝে।।দাম্পত্য জীবনের প্রথম রাতটি ছিলো নদীর মাঝে।আমাদের ভালোবাসার প্রতিক হলো সমুদ্র, পানি,বৃষ্টি আর একগুচ্ছ বর্ষার কঁদম ফুল। তাই জীবনে অন্যরকম আনন্দের, অনুভূতির মধুর কথাটিও আমি তেমাকে এখানেই বলতে চেয়েছি হিরো সাহেব।।
নীল ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে অভনীর দিকে।।অভনীর প্রত্যেকটি কথা খুব সূক্ষ্ণ ভাবেই শ্রবন করেছে সে।।তবুও প্রশ্নের ঝুলি টা যেনো একটু একটু করে বেড়েই চলছে।।
মুচকি হেসে ধীরে ধীরে নিজের ঠোঁট জোড়া নীলের কানের কাছে এগিয়ে নিলো অভনী।।কানের পাশে ফিসফিস করে বলে উঠলো সে,,,,,
—আমাদের ফুসকি সোনা এখন আমার পেটে হিরো সাহেব?।।ইউ উড বি ডেড ফুসকির আব্বু ?।
কানের পাশে ফিসফিস করে বলা অভনীর কথায় নিজে থেকেই চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে গেলো নীলের।।কানের পাশ থেকে মুখ এনে নীলের দিকে তাকাতেই মুচকি হেসে ভ্রু কুঁচকালো অভনী।।নীল আগের মতোই চোখ বন্ধ করে বসে আছে। ‘আচ্ছা মাঝে মাঝে কি মানুষ টার রিয়েকশন বাটন বন্ধ হয়ে যায়?নাকি রিমোট কাজ করে না?’
ভাবতেই কপালে ভাজ পরলো অভনীর।।একরাশ চিন্তার ভাঁজ।।
আস্তে আস্তে চোখ জোড়া খুলতেই চোখ বেয়ে ঝরঝর করে দু’ফোঁটা নোনাপানি গড়িয়ে পরলো নীলের।।নীলের চোখে পানি দেখে নীলের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো অভনী।”মানুষ টা কাঁদছে!কিন্তু কেনো?আচ্ছা এটাকেই কি সুখের কান্না বলে!যে কান্নায় ঝরে পরে সুখের লুকায়িত হাসি?”
এমনটা ভাবতেই নিজের ঠোঁট জোড়া এগিয়ে এনে নীলের চোখের পানি গুলো মুঁছে দিলো অভনী।।ধীরে ধীরে নীলের বাহুডোরে হেলে পরলো সে।।মূহুর্তেই প্রচন্ড শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো নীল অভনী কে।।মুচকি হেসে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো অভনী।।”আচ্ছা বাবা হবার অনুভূতি কি এমনি!এমনি ঝাঝালো ময় মিষ্টি?যে মিষ্টি অনুভূতি হাড়িয়ে ফেলে কিছু মূহুর্তের জন্য বাক শক্তি?”
তা নীলের কাছে অজানা।
.
.
.
?
রাত দশটা টা কি সাড়ে দশটা,,,,
নীলের শার্ট আর লুঙ্গি পড়ে রুমের মধ্যে পায়চারি করছে অভনী।। কনসিভ করার পর থেকে বড্ড অদ্ভুত অদ্ভুত ইচ্ছা অনিচ্ছা এসে ভর করেছে তার মধ্যে।। কখনো বা গাড়ি রেখে রাস্তায় হেঁটে বেড়াতে,,কখনো বা ভরা রাস্তায় কোলে উঠে নীলের কাঁধে মাথা হেলিয়ে ঘুরে বেড়াতে।কখনো টিভিতে কার্টুন দেখে নীলকে সাথে নিয়ে নেঁচে বেড়াতে কখনো বা তীব্র মন খারাপ ভাবে সবাই কে নিয়ে একসাথে গোমড়া মুখ করে বসে থাকতে।।আবার কখনো বা মাঝরাতে ঘুরে বেড়াতে কখনো বা অন্য মৌসুমের ফল খেতে।।আরো নানান রকম পাগলামিতে ভরপুর অভনী কেও বিরক্তির পরিবর্তে বেশ ইঞ্জয় করে নীল।।
পা দুলিয়ে খাটের উপর বসে ভাবনাতিত হয়ে অভনীর দিকে তাকিয়ে আছে নীল।বেশ কয়েক বার পায়চারি করে দৌঁড়ে নীলের কাছে এগিয়ে আসলো অভনী।।নীল কিছু বলার আগেই গরগর করে বমি করে ভাসিয়ে দিলো নীল কে।।তবুও নীলের চিন্তা অভনী কে নিয়ে।।টেবিলে রাখা বোতল থেকে অভনীর মাথায় পানি দিতে দিতে করুন দৃষ্টিতে অভনীর দিকে তাকিয়ে আছে নীল।।বমি করা শেষে ইনোসেন্ট মার্কা হাসি দিয়ে খাটে গাঁ এলিয়ে দিয়ে বলে উঠলো অভনী,,,,,,
—সরি হিরো সাহেব।আমার না এখন ওয়াসরুমে যেতে একদম ইচ্ছে করছিলো না।ইশশশ ওয়াশরুমে কি বিশ্রি মাছের গন্ধ!ইয়াক।
নীল কপাল কুঁচকালো। ঠোঁট উল্টে বললো,,,
—সবই ঠিক আছে কিন্তু ওয়াসরুমে তো কখনোই মাছ আনা হয়নি তাহলে মাছের গন্ধ আসবে কোথা থেকে?
—আছে আছে পঁচা মাছের গন্ধ আছে।আপনার কোলে মাথা রেখে ঘুমাতে ইচ্ছে করছে এখন আমার।আপনি এখন ফ্রেশ হবেন নাকি আমি শুয়ে পরবো?
—এই ওয়েট ওয়েট ওয়েট।আমি আসছি।
একজন সার্ভার কে ডেকে রুম ক্লিন করে দিতে বলে ওয়াসরুমের দিকে এগিয়ে গেলো নীল।।আসে পাশে তাকিয়ে কোথাও মাছের ছিটেফোঁটা গন্ধ না পেয়ে ঠোঁট উল্টালো সে।।নিজে ফ্রেশ হয়ে এসে অভনীকে জোড় করে ফ্রেশ করিয়ে দিলো নীল।
শরীর মুছে দিয়ে চিরুনি দিয়ে অভনীর চুল আঁচড়ে দিলো নীল।।ঘুমু ঘুমু চোখে পিটপিট করে তাকিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনের টুলে বসে আছে অভনী।।
কোলে করে অভনী কে শুইয়ে দিয়ে খাটে গাঁ এলিয়ে দিতেই টুপ করে বুকের উপর উঠে শুয়ে পরলো অভনী।বাম হাতে অভনীর মাথায় হাত দিয়ে মুচকি হেসে বলে উঠলো নীল, “পাগলী”।
একটা মানুষের রুপ গুন কথাবার্তা এটিটিউট কোনো একটা কিছুতে মুগ্ধ হয়েই ভালোলাগার জন্ম হয়।।।তৈরি করে তার প্রতি অদ্ভুত এক আকর্ষন।তার কাছাকাছি থাকার সুপ্ততাপে উত্তপ্ত করে দিতে শুরু করে।তার সাথে মিশতে মিশতে সময় কাঁটাতে কাঁটাতে এক সময় তার সবকিছুই ভালো লাগতে শুরু করে।তখন ভালো লাগার মূল কারন হয়ে যায় বিলীন।তখন ভালো লাগার মানুষটার প্রতি প্রথম ভালো লাগার কারন চলে যায় মনের অগোচরে।।আর এই ভালোলাগা ভীর জমিয়ে তৈরি করে একগুঁচ্ছ ভালোবাসা।।কারনহীন ভালোবাসা অবাস্তব। কোনো এক কারনে মুগ্ধ হয়েই একজন আরেক জনের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হয়।ভালোবাসা টা অপ্রতিরোধ্য হয়ে পরে।।
ভালোবাসার মানুষটার পাগলামো,দুষ্টুমি, রাগ, অভিমান,শাসন,বারন, আবার কখনো বাস্তবিক হওয়ার মতো ভালোবাসার মানুষটার সাথে যুক্ত সবকিছুই ভালো লাগতে শুরু করে।।সংকীর্ণ ভালোবাসায় তখন দুষ্টুমি গুলোও মাতিয়ে তুলে অন্যরকম ভাবে।।ঠিক তেমনি হয়েছে নীল অভনীর জীবনে।।বাবা হারিয়ে কঠোর বাস্তবিক হয়ে যাওয়া মেয়েটির মাঝেও আজ বাচ্চামি ধরনের পরিবর্তন এসেছে।তবুও নীলের ভালোবাসায় এক ফোঁটা কমতির বদলে এক ড্রাম ভালোবাসা যুক্ত হয়েছে।।ভালোবাসা!! সে তো এমনি।।❤
.
রাত সাড়ে এগারো টা,,,
নীলের বুকে মাথা রেখে গভীর ঘুৃমে বিভোর অভনী।।কিন্তু নীলের চোখে ঘুম নেই।।মায়া ভরা ঘুমন্ত প্রেয়সীর দিকে একদৃষ্টিতে মুচকি হেসে তাকিয়ে আছে সে।।হাজারের স্বপ্নের সুতো নিয়ে ছোট্ট বাবু কে নিয়ে মিষ্টি সংসারের জাল বুনতে ব্যাস্ত সে।।
”বউটা ইদানীং বড্ড বাচ্চা বাচ্চা হয়ে যাচ্ছে”
ভাবতেই নিজে নিজে হেসে উঠলো সে।।
মোবাইলের টুংটাং শব্দে ঘোর কাঁটলো নীলের।।ডান হাতে মোবাইল নিতেই কপালে ভাজ পরলো তার।।নীর্ঝয় ফোন দিয়েছে?কোনো সমস্যা হয়নি তো?
এমন টা ভাবতেই দ্রুত ফোন রিসিভ করে নিলো নীল।।অপরপাশ থেকে উত্তেজনা আর চাপা কান্নার শব্দ বিদ্যমান।বেশ কয়েকবার নীর্ঝয় কে ডেকে সাড়া না পেয়ে বলে উঠলো নীল,,,,
—নীর কথা বল।কি হয়েছে?কাঁদছিস কেনো তুই?নীরা ঠিক আছে তো??
নীলের কথায় অপরপাশের কান্নার ভারী শব্দ আরো বেড়ে গেলো।।প্রচন্ড চিন্তা আর উত্তেজনায় অভনী কে পাশে শুইয়ে দিয়ে উঠে বসলো নীল।।ফোন কেটে হাফিজুর রহমান আংকেল কে কল দিলে নীল কিছু বলার আগেই উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলেন ওনি,,,,,
—নীল বাবা তুই একটু হসপিটালে আয় না রে।।নীরা মা বাথরুমে গিয়ে পরে গেছে।।প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছিলো তাই হসপিটালে আনতেই ডক্টর আদিত্য বললেন হয় মা নয়তো বেবিকে বাঁচানো যাবে।নীর তো এই কথা শুনে কান্না শুরু করে দিয়েছে।ডক্টর অপারেশন করার জন্য সিগনেচার দিতে বলছে কাকে বাঁচাবে কিন্তু নীর দিচ্ছে না।ও বার বার বলছে ” আমি খুনি!আমি খুনি হয়ে যাবো বাবা।আমার একটা স্বাক্ষরে শেষ হয়ে যাবে তীলে তীলে গড়া একটা প্রান”।
তুই একটু আয় না প্লিজ নীল।।
—আংকেল আপনি চিন্তা করবেন না আমি এখুনি আসছি।আপনি সিগনেচার দিন আর বলুন আমরা নীরা কে বাঁচাতে চাই।নীর একটু পরে সিগনেচার দিয়ে দিবে।।
প্রানের বন্ধুর এমন করুন অবস্থা শুনতেই কেঁপে উঠলো নীল।।এমন অবস্থায় না চাইতেও নিজের কথা ভাবতেই চোখ জোড়া ছলছল হয়ে আসলো তার।।চোখ ঘু্ড়িয়ে অসহায় দৃষ্টিতে অভনীর দিকে তাকাতেই দেখলো উৎসুক দৃষ্টিতে বসে থেকে নীলের দিকে তাকিয়ে আছে অভনী।।নীলের এমন উওেজনা আর জলে টইটুম্বুর চোখ দেখে কোনো কথাই মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না তার।সব প্রশ্ন যেনো গলায় এসে ধলা বেঁধে আছে।।অভনীর কাছে এগিয়ে এসে অভনীর কপালে ভালোবাসার পরশ একেঁ দিয়ে বলে উঠলো নীল,,,,,
—সব কিছু ঠিক আছে পরী বউ।চিন্তা করো না। আমি বাসায় এসে সব বলবো তোমায়।সাবধানে থাকবে।আমি আজ রাতে আসবো নাকি আসবো না জানিনা।মামুনি কে বলে যাচ্ছি তোমার কাছে থাকতে।বেশি নড়বে না একদম।ওয়াশরুমে মামুনি কে সাথে নিয়ে যাবে।চুপটি করে ঘুমিয়ে থাকবে।মনে থাকবে?
অভনী হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো।।যার ধরুন সে বাধ্য মেয়ের মতো সব কথা শুনবে।।আবারো অভনীর কপালে ভালোবাসার পরশ একেঁ দিয়ে দ্রুত গতিতে তৈরি হতে লাগলো নীল।।
.
হসপিটালের করিডোরে বসে আছে কেউ,কেউবা পায়চারি করছে করিডোর ঘুরে।।নীরার বাবা আলতাফ খান আর মা ঊর্মিলা বেগম ও এসেছেন অনেক আগে।।নীর্ঝয় এখনো একাধারে বলেই যাচ্ছে সে খুনি,নীর্ঝয় কে নীল বুঝাতে বুঝাতেই দুজন নার্স তোয়ালে দিয়ে মুড়িয়ে ফুটফুটে দুটো বাচ্চা নিয়ে এগিয়ে আসলো ওদের দিকে।।বসে থাকা লোকজনের সাথে পায়চারি করা সবাই ও জড়ো হলো একসাথে।বাচ্চাদের দিকে না তাকিয়েই নার্স দের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো নীর্ঝয়,,,,
—নার্স নীরা!আমার নীর পাখি কেমন আছে?
—দেখুন আমরা আমাদের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছি মা বেবি তিনজনকেই বাঁচাতে।।বেবির উপর তেমন কোনো আঘাত না গেলেও মায়ের উপর রিস্ক রয়ে গেছে। তবে আমাদের আশা আছে উনি বেঁচে যাবেন।ওনার বেঁচে থাকার সম্ভাবণা ৭০%.
মাথা নিচু করে আবারো বসে পরলো নীর্ঝয়।।জমজ বেবি হয়েছে নীর্ঝয়ের। একটি মেয়ে আর একটি ছেলে।।মেয়ে বেবিটা কোলে নিয়ে নীর্ঝয়ের কাছে এগিয়ে গেলেন হাফসা আপু।। নীর্ঝয়ের মাথায় হাত রেখে বলে উঠলেন উনি,,,,,,
—দেখ নীর তোর কি ফুটফুটে শিশুটির আর রাজপুত্র হয়েছে।তুই দেখবি না ওদের? দেখ পিটপিট করে তাকাচ্ছে কিভাবে।।
—আপু আমি ওদের দেখতে পারবো না।।আমার নীর পাখি সুস্থ হয়ে যাবে। আমি আর আমার নীর পাখি এক সাথেই দেখবো ওদের।।
কথাটা বলতেই দু’ফোঁটা নোনাজল গাল ভেয়ে গড়িয়ে পরলো নীর্ঝয়ের।।ছেলেদের কাঁদতে নেই।হাজারো কষ্ট পেলেও কাঁদতে নেই।কিন্তু প্রিয় মানুষ টাকে হারানোর তীব্র ভয় যখন আঁকড়ে ধরে তখন চোখ কি আর বাঁধা মানে?
.
.
.
?
রাত আড়াইটা কি তিনটে,,,,,
ঘুম থেকে উঠে নীল কে ডাকছে অভনী।।ঘুম জড়িত কন্ঠে চোখ বন্ধ করেই বলে উঠলো নীল,,,,
—কি হয়েছে পরী বউ? ডাকছো কেনো?অফিসের কাজ শেষ করে মাত্রই তো ঘুমালাম।।
—উঠো।বাবুর ক্ষুধা লেগেছে। তার নাকি এখন নুডলস খেতে ইচ্ছে করছে।।আর সেটা তোমার হাতে।
অভনীর কথা কোনো টাই নীলের কান অবধি পৌঁছালেও ব্রেন অবধি পৌঁছায় নি।।সে ব্যাস্ত তার গভীর ঘুমে।। ভ্রু কুচকে নীলের দিকে তাকিয়ে জোড়ে ধাক্কা দিলো অভনী নীল কে।।যার ফলশ্রুতিতে খাট থেকে ধুরুম করে ফ্লোরে পরে গেলো নীল।।লাফিয়ে উঠে চিল্লিয়ে বলে উঠলো নীল,,,,
—কে কে কে কি হয়েছে?উফফফ ধাক্কা দিলে কেনো ?আমার কোমড় টা গেলো রে ?
—হুহ হয়েছে হয়েছে আর ডং করা লাগবে না।।তোমার এই স্টিল বডি তে যে সামান্য একটু পরে যাওয়া কিছুই হয়নি তা বেশ ভালো করেই জানি আমি।।?
শোনো বাবুর ক্ষুধা লেগেছে। ও নুডলস খেতে চাচ্ছে এখন।তাও আবার তার গুড পাপ্পার সাথে।।
করুন দৃষ্টিতে অভনীর দিকে তাকিয়ে নীল বললো,,,,,
—পরী বউ আমি তো রান্না পারিনা। তাছাড়া বাবু তো কথাই বলতে পারে না তোমাকে কীভাবে বললো?শুনো না একটু আগে মাএ ঘুমিয়েছি সকালে ইউটিউব দেখে রান্না করে দিবনে এখন একটু ঘুমাই।।
নীল বিছানায় শোয়ার জন্য বসতেই চিল্লিয়ে বলে উঠলো অভনী,,,,,
—আহহহ!
—কি কি হয়েছে?এমন করছো কেনো পরী বউ?কোথায় কষ্ট হচ্ছে তোমার?
—হুহ আপনার জানতে হবে না।।আপনি তো আর এখন বাবু কে নুডলস বানিয়ে খাওয়াবেন না।তাই বাবু আমাকে লাত্থি দিয়ে খাবে খাবে জানাচ্ছে।।আপনি তো আর জানেন না মায়েরা সন্তানের সব কথা শুনতে পায়।জান জান আপনি ঘুমান।ফুসকি ক্ষুধায় লাত্থি দিক আর আমি বসে থাকি।। (নাক টেনে)
—আচ্ছা আচ্ছা যাচ্ছি রে নেকামো বউ আমার।।(মুচকি হেসে)
ঠোঁট উল্টে মোবাইল হাতে ইউটিউবে রান্নার ভিডিও দেখতে দেখতে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো নীল।।পেটে হাত দিয়ে মুচকি হেসে ফিসফিস করে বলে উঠলো অভনী,,,,,,
—যাচ্ছে তোর গুড পাপ্পা! তোর জন্য নুডলস রান্না করে আনতে??।
.
সকাল ৯ টা,,,,
চেম্বারের উদ্দেশ্যে অভনীর হাত ধরে আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে নামছে নীল।।ড্রইং রুমের মাঝখানে চোখ যেতেই খুশিতে চিকচিক করে উঠলো অভনীর চোখ জোড়া।। সাদ আর সাইভা কে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন নীলিমা আহম্মেদ আর শাহেরা বেগম।।সাদমান চৌধুরী (সাদ) আর সাইভা চৌধুরী (নোহা) নীরা আর নীর্ঝয়ের দুইমাত্র রাজপুত্র আর রাজকন্যা।। তাদের পাশেই মিহির কে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নীরা,মিহিরের আদো আদো বুলিতে চাচা, বাবা,মামা ডাক শুনে মিহিরের হাত ধরে ফিকফিক করে হাসছে নীর্ঝয়।।অদ্ভুত সুন্দর এক মুহূর্ত।।
ওদের দেখে উত্তেজিত হয়ে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামতে নিলেই অভনীর হাত চেপে ধরলো নীল।।
চোখ মুখ শক্ত করে বলে উঠলো সে,,,,
—তুমি এখন একা নও ভুলে যাও কেনো?
এটা বলেই হুট করে অভনী কে কোলে তোলে নিলো নীল।।ডেবডেব করে নীলের দিকে তাকিয়ে আছে অভনী,,ড্রইং রুমে দাঁড়িয়ে থাকা নীর্ঝয় আর নীরা মুখ টিপে হাসছে।।শাহেরা বেগম সাদ কে নিয়ে অন্য দিকে মুখ গুড়িয়ে মুচকি হাসলেন।
নিচে নেমে অভনী কে নামাতেই দ্রুত পায়ে সাদ আর সাইভার দিকে এগিয়ে গেলো অভনী।অভনীর এমন উওেজনা দেখে টেবিলে খাবার দিতে দিতে বলে উঠলো মাইশা,,,,,
—অভনী বইন গো এমন লাফাইও না।।দেবরজি আমার যেই টমেটো হয়ে যাচ্ছে কখন না জানি তোমাকে মাথায় তুলে আছার মারে।যেই কেয়ারিং বর তোমার পারে না তো তোমাকে গুটিয়ে বুকের ভিতর ভরে রাখে।?
মাইশার কথায় রাগী দৃষ্টিতে মাইশার দিকে তাকালো নীল।।ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে একে একে সাদ,সাইভা আর মিহির কে আদর করে হাসতে লাগলো অভনী।।পাশ থেকে অভনীর মাথায় হাত রেখে বলে উঠলো নীরা,,,,,,
—কেমন আছো অভনী?
—এইতো বিন্দাস।তুমি?
পাশ থেকে মুখ বাকিয়ে বলে উঠলো নীল,,,,
—হুহ থাকবেই তো বিন্দাস।আমাকে নাকানি চুবানি খাইয়ে নিজে বিন্দাস আছেন।
চোখ পিটপিট করে নীলের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো অভনী,,,,,,
—কিছু বললেন?
—জি না ম্যাডাম।(মুচকি হেসে নীল)
—হাত মুছতে মুছতে সবার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে মাইশা বললো,,,,,
—আগে থেকেই সাবধানে থাক রে বোন।নীরার মতো এমন কিছু হলে নীর্ঝয় তো তাও তিনমাস বাচ্চাদের যত্নের সাথে নীরার যত্ন নিয়ে ওকে ভালো করে তুলেছে আর আমার দেবরজি তো সেখানেই স্ট্রোক করতো।।আল্লাহ না করুক তোমার কিছু হবার আগে দেবরজি ই মরে যেতো।।
—আহহ ভাবিপু এইসব কথা বলো না তো।।(নীল)
.
.
.
?
ছাদের কর্নারে বড় দোলনায় পিকু কে এক হাতে নিয়ে নীলের কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে অভনী।।নিজেকে বেশ ভারী লাগে ইদানীং তার।।
অভনীর ডুলুডুলু পেটে হাত রেখে বাবুর নড়াচড়া অনুভব করছে নীল।।হাতে থাকা বড় ফুচকার বাটি থেকে ফুসকা খেতে খেতে মাঝে মাঝেই খিলখিল করে হেসে উঠছে অভনী।।বাম হাত ঘুরিয়ে পাশ থেকে একটা শপিং ব্যাগ বের করে একগাল হেসে অভনীর দিকে দিলো নীল।।অভনী ভ্রু কুঁচকে তাকালো নীলের দিকে।হাতে থাকা ফুসকার বাটি টা পাশে রেখে হাত বাড়িয়ে শপিং ব্যাগ গ্রহন করলো অভনী।।শপিং ব্যাগ খুলতেই একঝাঁক আনন্দ এসে ভীর জমালো অভনীর মাঝে।। ছোট ছোট দুই জোড়া জুতা,,ছোট জামার সাথে রয়েছে কয়েক রকমের বেবিদের হেয়ার বেন।।
ছোট ছোট জুতা জোড়া হাতে নিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠলো অভনী। অভনীর হাত থেকে জুতো জোড়া নিজের হাতে নিয়ে অভনীর পেটের উপর রেখে বলে উঠলো নীল,,,,,,,,
—এগুলো আমার মাম্মামের জন্য। আমার ফুসকি সোনার জন্য।আদো আদো পায়ে আমার আর তোমার হাত ধরে হাঁটবে ও।।ওর নাম রাখবো আরাদ্দা আদ্রিজা ফিহা।।আরাদ্দা আদ্রিজা তোমার নামের সাথে আর ফিহা আমার নামের সাথে মিলিয়ে।।জানো আমি ওর জন্য স্কুল ব্যাগ সহ আরো অনেক কিছু কিনে রেখেছি আজ অফিসে।।সকালে ঘুম থেকে উঠে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে স্কুলে যাবার জন্য তৈরি করে দিবে তুমি ওকে, আমি আমার মেয়েকে নিয়ে দিয়ে আসবো স্কুলে।।শুনো মেয়েরা কিন্তু বাবার পক্ষেই বেশি থাকে তাই এই মিশন কম্পিলিট হবার পর কিন্তু তোমার দলের জন্য আরেক টা মিশন নিতে হবে।।
মুচকি হেসে নীলের কথা গুলো শুনছিলো অভনী।।শেষের কথাটা শুনেই কেঁপে উঠলো ও।লজ্জামাখা হাসি দিয়ে মাথা নিচু করে বলে উঠলো ও,,,,,
—তুমি কিভাবে জানো ও মেয়ে হবে?ডক্টর জানার শর্তেও তো তুমি কাউকে বলতে দাওনি এমনকি নিজেও শুনোনি কি বাবু হবে।।এটা নাকি সারপ্রাইজ হবে।তাহলে কিভাবে বলো আমাদের ফুসকি আসবে?পুসকু ও তো আসতে পারে তাইনা?
—ওহু আমার মেয়ে হবে মেয়ে।দেখে নিয়ো তুমি।
একগাল হাসলো অভনী। পরক্ষনেই হাসি বিলীন করে বলে উঠলো সে,,,,,
—হিরো সাহেব আমি যদি মারা যাই তুমি কি খুব বেশি কষ্ট পাবে??
মুহূর্তেই নীলের চোখমুখ লাল টকটক হয়ে গেছে।নীলের মুখের দিকে তাকিয়ে শুকনো ডুক গিললো অভনী।।অভনী কে কিছু না বলে দোলনা থেকে উঠে আকাশের দিকে তাকিয়ে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালো নীল।।এদিক ওদিক একবার তাকিয়ে হাত থেকে পিকু কে রেখে ভীতু পায়ে নীলের কাছে এগিয়ে গেলো অভনী।নীলের পেছনে গিয়ে দাঁড়াতেই অভনী কে শক্ত করে বুকের সাথে চেঁপে ধরে বলে উঠলো নীল,,,,,
—জন্ম,মৃত্যু আল্লাহর হাতে এই কথাটি বলা ঠিক নয় পরী বউ।কারন জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপই আল্লাহর হাতে।মানুষের ভাগ্য লেখা হয়ে আছে বহুবছর আগে থেকেই,,শবে বরাতের রাতে যেমন ভাগ্য পরিবর্তন করে লেখা হয় ঠিক তেমনি যেকোনো সময় আল্লাহর কাছে চেয়েও পরিবর্তন করা যায়।।আমি সবসময় আল্লাহর কাছে চাই আমরা দুজন একসাথেই যেনো বাঁচতে পারি,আর মৃত্যু ও যেনো একসাথেই হয়।কারন তুমি ছাড়া আমার অস্তিত্ব বিলীন,,আমার রাজ্য শূন্য। ইহকালে আর পরকালে তোমাকে শুধু আমার রাজ্যের রানী করেই রাখতে চাই পরী বউ।শুধু আমার❤
অভনী মুচকি হাসলো।দোলনায় রাখা ছোট ছোট জুতো জোড়ার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো সে,,,,,
—আমার কপালেও এতো এতো ভালোবাসা ছিলো আল্লাহ!বেবি কে নিয়ে এতো এতো স্বপ্ন দেখা হিরো সাহেব কে তুমি নিরাশ করো না আল্লাহ!পছন্দ হলে আমাকে নিয়ে যেও তুমি আল্লাহ,তবুও আমার বেবি আর হিরো সাহেব টাকে সুস্থ রেখো।
.
.
.
?
—————-
হসপিটালে অপারেশন থিয়েটারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সবাই।।অপরপাশে হসপিটালে নামাজের স্থানে বসে নামাজ পরছে নীল।।না চাইতেও চোখ বেয়ে অনবরত পানি পরছে তার।।তীব্র ব্যাথায় ছটফট করা অভনী কে দেখে ইচ্ছে করেছে সব কিছু বাদ দিয়ে তুলোর মতো গুটিয়ে শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরে রাখতে অভনী কে।।তাহলে যদি ভালোবাসার মানুষ টার ব্যাথা একটু কমে!!ভালোবাসার মানুষ টাকে নিজের হাতে অপারেশন করে কাঁটা ছেড়া করে সহ্য করতে পারবে না বিধায় O.T তে যায়নি সে।।
৪৫ মিনিট অপারেশন করার পর ফুটফুটে একটি কন্যা সন্তান নিয়ে বের হয়ে এলো একজন নার্স।।বেবি কে বের করার পরই দ্রুত গতিতে নীলের কাছে এগিয়ে গেলো নীল।।
“নীল তোর মেয়ে হয়েছে” বাক্য টা শুনতেই কেঁপে উঠলো নীল।দোয়া শেষ করে প্রায় দৌঁড়েই বেবির কাছে আসলো সে।উওেজিত কন্ঠে নার্স এর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো সে,,,,
—নার্স মিসেস ফারহান আহম্মেদ!আমার পরী বউ কেমন আছে?
—চিন্তা করবেন না ওনি সম্পুর্ন সুস্থ আছেন।।(মুচকি হেসে)
একটা দীর্ঘশ্বাস নিলো নীল।।বড় পাথর চাঁপায় পরে ছিলো যেনো সে এতোক্ষন।মুচকি হেসে নীলের দিকে তাকিয়ে বেবি কে নীলের কোলে দিতে দিতে বলে উঠলেন নীহাল আহম্মেদ,,,,
—আমার আজ কি যে খুশি লাগছে না নীল।কি বলবো তোকে!আমার ছোট ছোট ছেলে দুজনই বাবা হয়ে গেলো।
ধীরে ধীরে হাত দুটো এগিয়ে দিয়ে ফুসকি কে কোলে নিলো নীল।।কান্নাজরিত চোখে মুখে ফুটে উঠলো এক মুঠো হাসি।।বড় বড় চোখ করে নীলের দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝেই ছোট্ট করে হাসি দিচ্ছে ফুসকি।।যা নীলের গভীর থেকে গভীর তম যন্ত্রণা এক নিমিষে ঠান্ডা করে দেবার জন্য যথেষ্ট।।
.
.
.
আজ হসপিটাল থেকে নতুন অতিথি নিয়ে বাসায় যাবে অভনী।।মা হওয়ার উল্লাসিত আনন্দ চারদিক থেকে আঁকড়ে ধরেছে তাকে।। পুরো পারিবার জুরে নেমে এসেছে ঝলমলে খুশির আলো।এই ছোট্ট বয়সেই ডেবডেব করে তাকিয়ে থেকে পাকামি করে ফুসকি সোনা।।হাজারো স্বপ্ন গুলো সত্যি হবার আশা নিয়ে যখন রিসিপশনে ফুসকি অভনীর রিলিজের জন্য যাচ্ছিলো নীল তখনি অপর পাশের করিডোর থেকে চিল্লিয়ে বলতে লাগলো আগুন! আগুন! আগুন।।
মুহূর্তেই ভীর জমে গেলো চারদিকে।তবে কেউ আর দাঁড়িয়ে নেই।সবাই ছুঁটছে।কেউ কেউ নিজের প্রান বাঁচিয়ে ছুটছে কেউ কেউবা আবার অসুস্থ আপনজনদের ঠেঁলে ঠোঁলে নিয়ে যাচ্ছে।।
দৌঁড়ে উপরে চলে গেলো নীল।চিল্লানোর শব্দে সবাই কেবিনের বাহিরেই দাঁড়িয়ে ছিলো।।হাঁপাতে হাঁপাতে ফুসকি কে নীর্ঝয়ের কোলে দিয়ে অভনী কে নিজের কোলে নিয়ে সবাই কে নিয়ে দ্রুত বাহিরে বের হয়ে যেতে লাগলো নীল।।চারপাশ থেকে সবার ভারী কান্নার শব্দে থেকে গিয়েও আবার দৌঁড়াচ্ছে নীল।।।হসপিটালের বাহিরে পৌঁছিয়ে অভনী কে নামিয়ে দিয়ে নীর্ঝয়ের কোলে থাকা ফুসকির কাছে গিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে একবার ফুসকির দিকে তাকিয়ে ফুসকির কপালে স্নেহময় ভালোবাসার পরশ একেঁ দিয়ে বলে উঠলো নীল,,,,,
—ওদের নিয়ে দূরে চলে যা নীর।আমার ফুসকি সোনা আর পরিবারের গাঁয়ে যেনো একটু ও আগুনের ছোঁয়া না লাগে।যদি আমি বেঁচে ফিরে দেখি আমার ফুসকির কিছু হয়েছে তাহলে আমি নিজেই নিজেকে শেষ করে দিবো নীর।দূরে চলে যা তোরা।
উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলেন নীলিমা আহম্মেদ,,,,,,,
—কিন্তু তুই কই যাবি নীল।চল আমাদের সাথে চল।এইসব কি আবল তাবল বলছিস তুই।?
নীল আবারো ফুসকির দিকে তাঁকালো,,,ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই হাসছে ফুসকি।অভনীর দিকে একবার তাকিয়ে দৌঁড়ে হসপিটালের দিকে পিঁছিয়ে যেতে যেতে বলে উঠলো নীল,,,,,
—আমি একজন ডক্টর মামুনি।আমার হাজারো পেসেন্ট পরে আছে হসপিটালের ভিতরে।আমি কিভাবে পারবো ওদের না বের করে বাসায় ফিরে যেতে?আমার ফুসকি কে দেখে রেখো প্লিজ মামুনি।
অভনী তব্দা লেগে আছে।এমন পরিস্থিতি তে ওর কি করা উচিৎ বুঝতে পারছে না সে।চিৎকার করে হিরো সাহেব কে ডাকতে ইচ্ছে করছে তার,,কিন্তু চারদিকে হাজারো চিৎকারে শব্দে নিজের চিৎকার টা গলায় ধলা পেঁকে আছে যেনো।।আসেপাশে সবার সাথে আহম্মেদ পরিবারেও খুশির আমেজের পরিবর্তে নেমে এলো কান্নার ডল।।
চারদিকে এম্বুল্যান্স এর তীব্র আওয়াজে ভরপুর হলেও কয়েক মিনিটে ঘটে যাওয়ায় এখনো ফায়ার সার্ভিস এসে পৌঁছায়নি।।অভনী আশেপাশে একবার তাঁকালো।নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে তার।হাজারো স্বপ্নের সুতো কেঁটে পেটে হাত দিয়ে দৌঁড়ে হসপিটালের ভেতরে পৌঁছে গেলো অভনী।।পেছন থেকে কঁঠোর মায়ার বন্ধনে ডাকতে থাকা কারো কোনো কথাই কান অবধি পৌঁছালো না তার।।তার মাথায় এখন একটা কথাই ঘুরছে “আমার হিরো সাহেব ভিতরে আছে,আগুনের ভিতর”।
ভেতরে পৌঁছাতেই দেখলো নীল কয়েকজন অসুস্থ ব্যাক্তি কে দ্রুত নিঁচে নামিয়ে দিয়ে উপরে উঠছে।।নীল কে দেখে উওেজিত হয়ে অভনীও উঠতে লাগলো উপরে।।পেটের তীব্র ব্যাথায় ছটফট করছে অভনী।তবুও পেটে হাত দিয়ে নীলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো অভনী।।অভনী কে দেখে চমকে উঠলো নীল।চিল্লিয়ে বলে উঠলো সে,,,,
—তুমি এখানে কি করছো?চারদিকে কতো আগুন দেখতে পাচ্ছো না তুমি?যাও নিচে যাও তাড়াতাড়ি।তোমার কিছু হলে আমার ফুসকির কি হবে?
চারদিকে ছুটোছুটির পরিমান যেনো বেড়েই চলছে।আহা!কি সেই করুন পরিস্থিতি।জীবন বাঁচানোর জন্য কি সেই ভয়ানক যুদ্ধ।।। তারাহুরো করে অভনীর হাত ধরে নিচে নামাতে নিলেই পেটে হাত চেঁপে হেলে পরলো অভনী। চিৎকার করে অভনী কে ডেকে কোলে তুলে নিতেই দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের শিখা ঘিরে ধরলো তাদের।।নাহ উপায় নেই!পরী বউ চেয়েও পারেনি তার হিরো সাহেব কে নিচে নিয়ে যেতে আর না পেরেছে হিরো সাহেব তার পরী বউকে ফুসকির কাছে পাঁঠাতে।
জোড়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো নীল।নিস্তব্ধ হয়ে পেট চেপে শক্ত করে নীল কে জরিয়ে ধরে আছে অভনী।তীব্র পেটে ব্যাথার সাথে রাক্ষুসি আগুনের শিখায় বড্ড কষ্ট হচ্ছে তার।সেই করুন কষ্টের মুহূর্তেও বার বার মনে হচ্ছে তার ” আমার হিরো সাহেবের কষ্ট হচ্ছে,,রাক্ষুসি আগুনের শিখা খেয়ে ফেলছে আমার হিরো সাহেব কে,কিভাবে দূর করবো আমি ওর কষ্ট!কিভাবে?”
সবকিছুর পরেও একটুখানি হাসি ঝুললো অভনীর মুখে।হিরো সাহেবের দোয়া আল্লাহ কবুল করেছেন।একসাথে মৃত্যু দিয়েছেন আমাদের।ভাগ্যিস! নাহয় সহ্য হতো কীভাবে? জীবন্ত লাশ হয়ে?
ঝলসে যাওয়া হসপিটালের সামনের বড় নারিকেল গাছটায় ছোট্ট কালো হলদে রঙের একটি পাখি বসে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ঝলসে যাওয়া হসপিটালের দিকে।।আচ্ছা! পাখিটির ও কি আপনজনকে খেয়ে নিয়েছে ওই রাক্ষুসি আগুন?স্বপ্নের পাতায় সাজানো আরাদ্দা আদ্রিজা ফিহার (ফুসকির) মতো কি এতিম করে দিয়েছে তাকেও ধ্বসে পড়া জ্বলন্ত কুটির??
তিল তিল করে ঘরা স্বপ্ন সৌদো ভেঙে আজ খান খান।।এক নিমিষেই হারিয়ে গেলো হাজারো প্রিয় মানুষ।হাজারো মানুষের হাহাকার চিৎকারের জরিমানা কি দিতে পারবে এই রাক্ষুসি আগুন!!নাকি পারবে যুগ যুগ ধরে এমনি করে সাজানো স্বপ্ন গুলো কে ভেঙে দিতে??জীবন ঋতুর ন্যায়।খনে খনে মুহূর্তেই পরিবর্তনশীল সে।।?
বৃদ্ধ বয়সে পড়তে পড়তে যৌবনের আনন্দ অনুভব করার জন্য সাজানো ডায়েরির পাতা গুলো স্টোর রুমেই পরে থাকুক না হয় পরের প্রজন্মদের জন্য।।ওরা নাহয় দেখবে সমাজ কি!ওরা নাহয় শিখবে বন্ধুত্ব কি!ওরা নাহয় জানবে ভালোবাসা কি!ওরা নাহয় বুঝবে একগুচ্ছ স্মৃতি গুলোর সাথে ঝরে যাওয়া স্বপ্নের কষ্ট কি!!
.
(সমাপ্ত)?
(বাঁধা! বাঁধা শব্দ টা যখন কোনো কাজে চলে আসে তখন হাজার চেয়েও সে কাজে মনোযোগ দেয়া যায় না।কঁঠোর পরিশ্রম করে সেই বাঁধা অতিক্রম করে যখন সাজানো যায় আবারো সেটাই সফল।কিন্তু আমার গল্পের ক্ষেত্রে বাঁধার সাথে সেই কঠোর পরিশ্রম করতে পারিনি আমি।কারন মোবাইল নষ্টের সাথে হাত মিলিয়ে ছিলো ডিলিট শব্দ টাও।।প্রথম বার লিখে ডিলিট হয়ে গেলে পরে আর গুছিয়ে লিখতে ইচ্ছে করে না।।তাই কিছুটা ছাড়া ছাড়া হয়ে গেছে শেষের দিকে।।টেনে দেখা মুভির মতো ?এই এক মাসে শুধু চার থেকে পাঁচ পার্ট দিয়েছি আমি ?,,দুঃখিত এতো লেট করার জন্য।
আমি চেষ্টা করেছি গল্পটা সুন্দর করার।।জানিনা কেমন হয়েছে!তবে সবাই জানাবেন কেমন হয়েছে।।
আগুন!শব্দটা বর্তমানে অনবরত হয়ে যাচ্ছে,,,হারিয়ে যাচ্ছে এমনি হাজারো আপন জন ?)))