#আমার রাজ্যের রানী
#Part : 36
#Writer : Sriti Nur Avni
?
রাত ১০ টা
নীর্ঝয়ের জ্ঞান ফিরেছে দুই ঘন্টা যাবত।।নীরা এখনো বাসায় যায়নি।।বড় কেবিন টায় নীর্ঝয়ের পাশের সিটেই নীল কে রাখা হয়েছে।।মাথায় প্রচন্ড আঘাত পাওয়ার কারনে মাথা ব্যথা করছে নীলের।নীরব,মাইশা,মাহিব,আর নীহাল আহম্মেদ বাসায় চলে গেছেন।।নীলিমা আহম্মেদ,, আর মোশারফ চৌধুরীর জন্য আলাদা কেবিন বুক করা হয়েছে।।অভনী নীলদের কেবিনের কর্নারের বেড টায় থাকবে।নীলিমা আহম্মেদ থাকবে বললেও অভনী জোর করলো ও এখানে থাকবে বলে।তাই নীলিমা আহম্মেদ ও আর বাঁধা দেননি।হাফসা আপু চলে গেছেন ৮ টার দিকে,,কারন ওনার ছোট বেবি আছে।তবে ওনার হাসবেন্ড জাহিদ হাসান রয়ে গেছেন।।নীরার বাবা আলতাফ খান ও যেতে পারছেন না মেয়ের জন্য।বেশ কয়েক বার বলা হয়েছে নীরা কে বাসায় যাওয়ার জন্য কিন্তু নাহ! ওর এক কথা নীর্ঝয় যতদিন হসপিটাল থাকবে ও নিজেও ততদিন হসপিটালে থাকবে।।বার বার মেয়ের মুখে এক কথা শুনে বেশ বিরক্ত বোধ করছেন আলতাফ খান।। নীলের কেবিনের এক কোনে বসে নীলের মাথায় হাত ভুলিয়ে দিচ্ছেন নীলিমা আহম্মেদ।।সারাদিন কেউই ঠিক মতো খায়নি।। সবার মুখগুলো চুপসে আছে।। দুহাত ভর্তি খাবারের প্যাকেট নিয়ে কেবিনে ডুকলেন হাফিজুর রহমান।।খাবার গুলো নীলিমা আহম্মেদ চৌধুরীর হাতে দিয়ে বলে উঠলেন,,,,
—আমার ছেলে মেয়েরা সারাদিন খায়নি ভাবি।।ওদের খেতে দিন আর আপনিও সবাই কে নিয়ে খেয়ে উঠোন।।আর ওরা দুজনই এখন আউট অফ ডেঞ্জারাস।তাই টেনশন করবেন না কেউ।।
নীলিমা আহম্মেদ খাবার গুলো হাতে নিয়ে শান্তির একটা নিশ্বাস নিলেন।।হাফিজুর রহমান ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন পাশের বেডে বসে থাকা আলতাফ খান আর নীরার দিকে।।নীরা একমনে শাড়ির আচল হাতে আঙুলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কি যেনো চিন্তা করছে।।হাফিজুর রহমান নীরার মাথায় হাত রাখতেই চমকে উঠলো নীরা।।ফেকাসে মুখে তাকালো ওনার দিকে।মুচকি হেসে বলে উঠলেন হাফিজুর রহমান,,,,
—মা বাসায় যাবা না।।অনেক রাত হয়ে গেছে তো।নীর এখন ভালো আছে। সারাদিন কিছু খাওনি।খেয়ে বাসায় গিয়ে রেস্ট নাও।।
বাবার কথা শুনে ঘার ঘুরিয়ে নীরার দিকে তাকালো নীর্ঝয়।।চোখ মুখ ফুলে আছে মেয়েটার।চোখের কোনে এখনো জমাট বেঁধে আছে অবাধ্য কিছু নোনা জল।।ফর্সা মুখে গাল দুটো লাল টকটকে হয়ে টমেটোর রঙ ধারন করে আছে।।মেয়েদের কাঁদলে মনে হয় একটু বেশিই সুন্দর লাগে।।অসহায় চোখে নীর্ঝয়ের দিকে একবার তাকিয়ে বলে উঠলো নীরা,,,
—আংকেল আমি এখানেই থাকবো।।আব্বু কে বলুন না প্লিজ বাসায় চলে যেতে।।
আবারো হালকা মুচকি হাসি দিয়ে বলে উঠলেন হাফিজুর রহমান,,,,
—এমন টা হয়না মা।।ওনি অবিবাহিত একজন মেয়েকে অপরিচিত দের কাছে এভাবে রেখে যেতে পারেন না।।তুমি এখন চলে যাও কালকে সকালেই নাহয় আবার এসো।।
নীরার মুখটা চুপসে গেলো।বাবার দিকে তাকালো একবার সে।।বাবার মুখটাও কেমন শুকিয়ে গেছে।।কিছু একটা ভেবে উঠে দাঁড়ালো সে।বাবা কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,,,,
—বাবা চলো বাসায় যাই।।তোমার ঔষুধ আছে বাসায়।।
মেয়ের কথায় যেনো আলতাফ খানের চোখ দুটো চিকচিক করে উঠলো হালকা খুশিতে।।মেয়ের জামাই হলে কথা ছিলো বা হবু হলেও,,কিন্তু এভাবে মেয়ের একতরফা ভালোবাসার মানুষ টার কাছে রাতে থাকাটা ওনার কাছে যুক্তিহীন।।ওনাদেরকে উঠতে দেখে কেবিনের এক কোনায় খাবায় রেডি করতে করতে বলে উঠলেন নীলিমা আহম্মেদ,,,,,,
—সে কি মা না খেয়ে চলে যাবে নাকি?বসো খেয়ে যাবে।।সারাদিন আমার সামনে কাঁদতে দেখেছি এখন আমার সামনে খেয়ে নাও দেখি।তারপর বাসায় যাবে।।ভাইয়া আপনিও বসুন।।
মুচকি হেসে আলতাফ খান বললেন,,,,
—নারে বোন মেয়েটা রাজি হয়েছে কখন কি মত হয়ে যায় বোঝা দায়।।তাই মত পাল্টানোর আগে বাসায় যাই।।
নীলিমা আহম্মেদ একটা ছোট টেবিলে খাবার সাজিয়ে আরেকটা প্লেটে খাবার নিয়ে এগিয়ে আসতে আসতে বললেন,,,,
—ভাইয়া রা আপনারা খেয়ে নিন।আমি আমার ছেলেমেয়ে দের খাইয়ে দিচ্ছি।
নীর্ঝয়ের বেডের একপাশে বসে পরলো নীরা।।নীরা যে এখন নীলিমা আহম্মেদের হাতে খেতে চাচ্ছেন তা বুঝতে পারলেন আলতাফ খান।তাই হাফিজুর রহমান আর মোশারফ চৌধুরী কে সাথে নিয়ে বসে পরলেন খাবারের টেবিল টাতে।।নীল উঠে বসেছে।তার বেডের এক কোনায় আকাশি রঙের জামা আর সাদা সেলোয়ার পরে বসে আছে অভনীও।ঢাকা শহরে বাহিরে সে শাড়ি ছাড়া বের হয়না বললেই চলে।কিন্তু সকালে নীলের খবর পেয়ে তারাহুরো করে চলে আসায় ড্রেস পাল্টানো হয়নি।।
নীলের বেডের আরেকপাশে বসে আছেন জাহিল ভাইয়া।।
নীলিমা আহম্মেদ একে একে সবাই কে খাইয়ে দিতে লাগলেন।।নীর্ঝয় অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।মায়ের হাতে খাবার খেতে কার না ইচ্ছে করে??নীর্ঝয়ের ও এখন ইচ্ছে করছে নীলিমা আহম্মেদের হাতে খেতে।।ছোট বেলায় মা হারিয়েছে সে।।নীলিমা আহম্মেদ কেই মামুনি হিসেবে মানে।।নীলিমা আহম্মেদ নীর্ঝয়ের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন নীর খেতে চাচ্ছে।।মুচকি হেসে নীর্ঝয়ের কাছে গিয়ে নরম করে ভাত মেখে খাইয়ে দিলেন ওনি।।নীর্ঝয়ের মুখেও ফুটে উঠলো এক টুকরো হাসি।।দুই লোকমা খাইয়ে দিয়ে বলে উঠলেন নীলিমা আহম্মেদ,,,,,
—নীর বাবা তোকে আমি স্যুপ খাইয়ে দিবো আজকে কেমন?? কালকে মন ভরে ভাত খাইয়ে দিবোনে।।
নীর্ঝয় ও আর কিছু না বলে মুচকি হাসলো শুধু।পাশথেকে জাহিদ ভাইয়া বলে উঠলেন,,,,
—মামুনি এখন আমাদের কে খাইয়ে দাও তো।।হাফসা টা আজ মামুনির হাতে খাওয়া মিস করলো।।তুমি চিন্তা করো না মামুনি শালা বাবুর জন্য খুব শীঘ্রই খাইয়ে দেয়ার লোক নিয়ে আসবো।।
এটা বলেই ওনি হালকা জোরে জোরে হেসে উঠলেন।নীর্ঝয় জাহিদ ভাইয়ার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আড়চোখে নীরার দিকে তাকালো।।জাহিদ ভাইয়ার কথা শুনে নীরার দিকে তাকাতে ইচ্ছে হলো কেনো বুঝতে পারলো না সে।।তবে মেয়েটার রিয়েকশন দেখার খুব ইচ্ছে জাগলো নীর্ঝয়ের।।কিন্তু নাহ নীরার এতে কোনো হেলদোল নেই সে নিজের মতো করে খেয়ে যাচ্ছে নিচের দিকে তাকিয়ে,,,নীর্ঝয় মনে মনে ভাবছে,,,
—মেয়েটার রিয়েকশন বাটন কি নষ্ট হয়ে গেলো নাকি?আমার দিকে তাকাচ্ছেও না একবার।।
খাওয়া শেষ হতেই বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্য উঠে দাঁড়ালেন আলতাফ খান আর নীরা।জাহিদ ভাইয়া আর মোশারফ চৌধুরী চলে গেলেন পাশের কেবিনে ঘুমানোর জন্য।।হাফিজুর রহমান আজ আর বাসায় যাবেন না।নিজের চেম্বারেই রাত কাটিয়ে দিবেন ওনি।।ধীর পায়ে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো নীরা।।ঘার ঘুরিয়ে নীর্ঝয়ের বেডের দিকে তাকালো সে।স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মানুষ টা ওর দিকে।।নীরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবছে,,,
“জীবনে অধিকার টা বড্ড বেশি প্রয়োজন।।অধিকার ছাড়া কারো বেপারে কথা বলা যায় না,,আর না যায় তার সেবা করা।।এই জন্যই বুঝি স্বামী নামক সম্পর্কে বাধা পরতে খুব বেশি ইচ্ছে হয়।।অধিকার নামক শব্দ টা আজ আমার আর নীর্ঝয়ের সাথে জুড়ে থাকলে ওকে হসপিটালে রেখে আমাশ বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হতে হতো না।।
.
.
.
?
কয়েকদিন পর।
হাফসা আপুর দুই বছরের ছেলে হাসিব কে কোলে নিয়ে বাবার রুমে বসে আছে নীর্ঝয়।।হাফিজুর রহমান মোটা ফ্রেমের চশমা চোখে লাগিয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন।সারাদিনের ব্যাস্ততায় দিনের বেলা পড়া হয়না পত্রিকা।বারবার বাবার দিকে তাকাচ্ছে নীর্ঝয়।মুখ ফুটে একটা কথা বারবার বেড়িয়ে যেতে চাচ্ছে কিন্তু তবুও আঁটকে রেখেছে নীর্ঝয়।।মোটা ফ্রেমের চশমা টা হাতে একটু নাড়িয়ে বলে উঠলেন হাফিজুর রহমান,,,,,
—নীর কিছু বলবি?
বাবার কথায় নীর্ঝয় যেনো আরেকটু ইতস্তত ভূত করলো।তবুও আমতা আমতা করে চোখ জোরা বন্ধ করে হুট করে বলে উঠলো সে,,,,
—বাবা আমি ৭ দিনের মধ্যে বিয়ে করতে চাই।
বাবার কোনো শব্দ না পেয়ে পিটপিট করে চোখ খুলে তাকালো নীর্ঝয়।বাবার দিকে তাকাতেই অবাক হলো সে বাবার কোনো রিয়েকশন নেই।।ঠিক আগের মতো করেই পত্রিকায় চোখ দিয়ে রেখেছেন ওনি।।দেখে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে নীর্ঝয়ের মুখে এই কথাটাই আশা করেছিলেন ওনি।কিন্তু নিজের মুখে নিজের বিয়ের কথাটা যে কারো কাছেই বড্ড বেমানান বলে হচ্ছে নীর্ঝয়ের কাছে।আচ্ছা আজকাল সবার রিয়েকশন বাটন কি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে নাকি?
নীর্ঝয় ভ্রু জোরা কুঁচকে হালকা চিল্লিয়ে বলে উঠলো আবারো,,,,
—বাবা আমি বিয়ে করবো।
পত্রিকায় মুখ রেখেই বলে উঠলেন হাফিজুর রহমান,,,,,
—জানি।
নীর্ঝয় কপাল কুঁচকে তাকালো বাবার দিকে।।আজকাল কি বাবা মনের কথা পড়তে পারেন নাকি?
ভাবতে ভাবতেই হাসিব কে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো নীর্ঝয়।একটু সামনে এগোতেই পেছন হেকে হাফিজুর রহমান বলে উঠলেন,,,,,
—আমি কালকেই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আলতাফ খানের বাসায় যাবো।
হাফিজুর রহমানের কথা দাঁড়িয়ে গেলো নীর্ঝয়।বাবা কিভাবে জানলো ও নীরা কে বিশে করতে চায়??আচ্ছা বাবা আমার শরীরে অপারেশন করে কি এমন কিছু লাগিয়ে দিয়েছে নাকি যার কারনে আমার মনের কথা বুঝতে পারে??আচ্ছা বাবা কি এটাও বুঝতে পারছে যে আমি নীল আর অভনীর বিয়ের আগে বিয়ে করতে চাই বলে ৭ দিনের ভিতর বিয়ে করতে চাচ্ছি??তাছাড়া আমার জন্য নীরা মেয়েটাই পার্ফেক্ট।আস্তে আস্তে করে ও আমার অব্যেশ হয়ে গেছে।।বাবা কি তাহলে সত্যি সত্যিই সার্জারী রেখে সাইকিয়াট্রিস্ট হয়ে চলছেন নাকি??
.
.
.
?
রাতের খাবার খেয়ে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো অভনী।নীলের রুম ক্রস করতে রুমে কাছে যেতেই নীলের কারো সাথে কথা বলার কন্ঠ বেশে আসছে।প্রথমে পাত্তা না দিয়ে দুই পা এগুতেই থমকে দাঁড়ালো অভনী।।বারান্দায় নীলের সাথে দাঁড়িয়ে আছে নিতু।।নিতু নীলের হাত ধরে আছে,,,তবে নীলের মুখে বিরক্তি স্পষ্ট। হাত জোরা নিতুর মুঠোয় রেখেই বলে উঠলো নীল,,,,
—নিতু ভালোবাসা বলে কয়ে আসেনা।ভালোবাসা টা হুট করে হয়ে যায়।।ঠিক তেমনি তোমার টা আর আমার ভালোবাসা টাও হয়ে গেছে।এতে কারো দোষ নেই।তাছাড়া ভালোবাসা বলে ভালোবাসাতে হয়না।বা চিল্লিয়ে ভালোবাসি বললেই সেটা সত্যিকারের ভালোবাসা হয়ে যায় এই উক্তিতে আমি বিশ্বাসী নই।।সত্যি কারের ভালোবাসা হলে সেটা উপলব্ধি করা যায়।জোর করে কিছুই হয়না।।
এতোটুকু শুনেই পিছন ফিরে ধীর পায়ে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো অভনী।।চোখ জোড়াতে তার জলে টইটম্বুর।গল্প বা উপন্যাসের বিখ্যাত বিশ্বাসঘাতক মনে হচ্ছে এখন নীল কে অভনীর কাছে।রুমে গিয়ে একে একে সবকিছু ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করছে তার।চিল্লিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে কেনো করলেন আপনি এমন??কেনো আমার ফিলিংস নিয়ে খেলা করলেন??কিন্তু নাহ!চাইলেই এমন টা করতে পারবে না সে এখন।।ধীর পায়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলো সে।বারান্দার গ্রিলে রাখা হাতটা কেঁপে উঠছে বারবার।কান্না গুলো ভীর জমিয়েছে বুকে।ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কান্না করে কেঁদে কেটে বন্যা বানিয়ে ফেলতে।আর সেই বন্যায় ভেসে যাক নীল।চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে অভনীর,,, “কেনো করেন তাহলে আমার জন্য এতোকিছু??হুয়াই??
বাট না এভাবে চলতে পারে না।আই হেভ টু বি স্ট্রং বাট দিস ফিলিংস??
চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরলেও চিৎকার করে কাঁদতে পারছেনা অভনী।জমাট হয়ে থাকা চিৎকার গুলো দীর্ঘশ্বাস হয়ে বের হচ্ছে তার।অভনীর মনে হচ্ছে ভালোবাসা টা কি তবে ভুল??
#চলবে,,,,,,