#আমার রাজ্যের রানী
#Part : 28+29
#Writer : Sriti Nur Avni
?
বিদায় বেলা,,,
বিদায় জিনিসটা বড্ড কষ্টকর,,,হোক সেটা ক্ষনিকের বা চিরদিনের।একটি মেয়ের বিয়ের দিন বিদায়ের মুহূর্তে মেয়েটির চোখ থেকে যে জল গড়িয়ে পরে,,সেই জলে মিশে থাকে বাবার বাড়ি ছেড়ে যাবার কষ্টকর ভয়াবহ এক চিৎকার।সেই চিৎকার নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেয় কিছু সময়ের জন্য। চারপাশে এতো এতো মানুষ থাকলেও তার ভিতরে আত্নচিৎকার কেউই অনুভব করতে পারে না।বাবা মা তার রাজকন্যা টাকে যখন একটা ছেলের হাতে সারাজীবনের জন্য তুলে দেয়,,সেই মূহুর্তে বাবা মায়ের বুকের মাঝে বোবা চিৎকার হাউমাউ করে উঠে।সেই ভারি কান্না ছেলেটির কানে ততদিন পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনা যতদিন পর্যন্ত না সেই ছেলেটি তার নিজ মেয়েকে বিদায় করে দেয় আরেকটি ছেলের হাতে।মেয়েদের জীবন এক অদ্ভুত জীবন! যেই জীবন টাকে মরনের সীমা পর্যন্ত এগিয়ে নিতে নিতে নানান রকম সেক্রিফাইস করতে হয়।যেই জীবনে একটা মেয়ে তার জন্মস্থান কে আকড়ে ধরে বাঁচতে পারে না।এটাই যে প্রাকৃতিক নিয়ম।
মাইশা কাঁদছে।প্রান ভরে কাঁদছে সে আজ।কারন বিদায় বেলার মূহুর্ত টা ঘনিয়ে এসেছে তার।ভালোবাসার মানুষদের কাছেই যাচ্ছে সে কিন্তু আরেকটা ভালোবাসার পরিবার কে ছেড়ে।মোশারফ চৌধুরী,, মনিকা চৌধুরী জানেন ওদের মেয়ে সুখি হবে তার পরেও ওদের কান্নার বাঁধ মানছে না।অথচ প্রতিনিয়ত হাজার হাজার মা বাবা রা অনিশ্চিয়তার মুখে একটা মেয়েকে ছেরে দিতে হয়।ইসসসস কি কষ্টই না হয় হয়তো তখন!!ভাগ্য পরিক্ষার সম্মুখীন হতে হয়,,,যার ভাগ্য ভালো তার সব ভালো আর যার কপাল খারাপ তাকে আবার স্বামীর হাতেই মৃত্যু বরন করতে হয়।
সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না।বিদায়ের ঘন্টা শেষ হতেই মাইশা কে নিয়ে বাসার উদ্দেশ্য বের হয়ে গেলো সবাই।নীর্ঝয় নীলের সাথে এক গাড়িতে বসেছে,,,, নীলের দিকে তাকিয়ে রাগি সুরে বলে উঠলো নীর্ঝয়,,,,,
—ছেলেটা কে তুই মেরেছিস তাই নারে?
একনজর নীরবের দিকে তাকিয়ে না বুঝার ভান করে বলে উঠলো নীল,,,
—কোন ছেলে?
—তুই হয়তো মাঝে মাঝে ভুলে যাস আমি তোর বেস্ট ফ্রেন্ড। তোর মুখ দেখলেই আমি সব বুঝতে পারি।শাফিন নামের ছেলেটাকে তুই মেরেছিস?কিন্তু কেনো?
সামনের দিকে তাকি গাড়ি চালাতে চালাতে বলে উঠলো নীল,,,
—সবি যখন বুঝিস এটা বুঝিস না কেনো মেরেছি?আগেই বলেছি ড্রাগ ব্যাবসায়ী ছিলো যা এই দেশের জন্য অত্যান্ত ক্ষতিকর।
—তা তুই কিভাবে ধরলি আর কিভাবে মারলি?
—ওর পিছনে অনেকদিন আগে থেকেই লোক লাগিয়ে রেখেছি।গতকাল সকালে ড্রাগ ট্রান্সফার করার সময় আমার লোকেরা ভিডিও করে আর ধরে রাখে।তারপর আর কি আমি গেলাম কতক্ষন পিটালাম কিন্তু ছেলেটা বড্ড পাজি,,,আমার মুখে মুখে কথা বলে তাই জিব্বা টা কেটে ফেললাম।হাত দুটো দিয়ে আমার অনেক বড় ক্ষতি করতে চেয়েছে তাই হাত দুটো কেটে ফেলেছি।পা দিয়ে আমার পথে পা বাড়িয়েছে তাই পা দুটো কেটে ফেলেছি।আর চোখু দুটো?আমার কাছের কারো দিকে নজর দিয়েছে তাই উপরে ফেলেছি।তারপর নিজেই সবার সামনে রাস্তায় নিয়ে ফেলে দিয়েছি যেনো সবাই জানে আমি ই মেরেছি আর সেটা ড্রাগ ব্যাবসায়ের জন্য।,,,,আর কিছু?
—তোর হাত কাঁপে না?
—উহু অন্যায়ের শাস্তি দিলে আমার কখনো হাত কাঁপে না।হাত কাঁপলে কি আর টপ মাফিয়া হতে পারতাম?এ দেশে এখন তোর মতো ভেজা বিঁড়ালের দাম নাই রে দোস্ত।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবতে লাগলো নীর্ঝয়,,,,
—তুই কার জন্য এমন করেছিস তা আমি খুব ভালো ভাবেই জানি রে নীল।উপর দিয়ে এতো শক্ত দেখালেও ভেতর দিয়ে তুই কতোটা নরম তা খুব ভালো ভাবেই জানি আমি।মেয়েটা খুব ভাগ্যবতী তাই তোকে পাবে,,আবার তুই খুব ভাগ্যবতী অভনী কে পাবি।❤
?
বাসর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সবাই।টাকা ছাড়া ভেতরে যাওয়া নিষেধ আজ নীরবের জন্য।বেচারা নীরব ভেবে পাচ্ছে না নিজের ঘর,,নিজের খাট,,,নিজের বউ তাও ওদের কে টাকা দিবে কেনো?
কিন্তু না তার এই কথা সবাই মানতে নারাজ।বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকেও যখন ছারা পেলো না তখন পুরো ক্রেডিট কার্ড টা হাতে ধরিয়ে দিলো নীলের।অসহায় মুখ করে বলে উঠলো নীরব,,,,
—মেরা ভাই এবার তো ছাড়।বউটা আমার একা একা বসে আছে কে জানে কখন কে কিডনাপ করে ফেলে।
—যা ভাই যা।কালকে ভাবিপু যেভাবে বলেছে আজকে রাতে খবর আছে,,,,দেখ তোর ভাগ্য কি আছে।কয়টার খবর বাজাবে তোকে।
সবাই হাসতে হাসতে চলে গেলো দরজার কাছ থেকে,,,নীরব ১০ মিনিট দরজার বাহিরে পায়চারী করে হাঁটা দিলো রুমের ভিতর।
?
———————-
কিছুদিন পর,,,
নীলা আহম্মেদের রুমের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো অভনী।রুমের ভিতর থেকে কারো ডাকে দাঁড়িয়ে গেলো সে।গুটিগুটি পায়ে ভিতরে গিয়ে দেখলো নীলা আহম্মেদ ডাকছেন ওকে।পাশে গিয়ে বলে উঠলো অভনী,,,,
—জি ফুপু বলুন।
—আমার কোমর টা অনেক ব্যাথা করছে রে মা।একটু মলম লাগিয়ে টিপে দে না।
—ওকে আপনি সোজা হয়ে শুয়ে পরুন আমি দিচ্ছি।
মলম টা হাতে নিয়ে নীলা আহম্মেদ মালিশ করে দিতে লাগলো অভনী,,,বেশ কিছুক্ষন হবার পরেই আবারো বলে উঠলো নীলা আহম্মেদ,,,,,
—মাথা টাও ব্যাথা করছে রে,,,একটু মাথা টা টিপে দে।
মাথা ব্যাথার মলম নিয়ে আবারো মাথা টিপতে লাগলো অভনী।অন্যদিকে নীলের কাছে পড়ার সময় হয়ে গেছে।লেট করে গেলে এই গুরুগম্ভীর টা কি করবে কে জানে।অভনী কে ভাবনাতীত রেখেই বলে উঠলেন নীলা আহম্মেদ,,,,,,,
—জানিস নিতুর সাথে নীলের বিয়ে ঠিক করা আছে।নীলের ডাক্তারি পড়া শেষ হলেই বিয়ে দিয়ে দিবো ওদের।মেয়েটা আমার বড্ড ভালোবাসে নীল কে।নীলও ভালোবাসে।সেই ছোট বেলা থেকেই।
মূহুর্তেই চোখের নোনাজল গুলোর বাধ ভেঙে গেলো অভনীর।এমন টা কেনো হচ্ছে?হয়তো মানুষটা নিতু আপুকে ভালোবাসার কথাই বলেছিলো।ভালোবাসতেই পারে,,,এতে আমার খারাপ লাগার কি আছে?আমি কেনো ওদের মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবো যেখানে আমি ওদের বাসার আশ্রিতার সমান।কিন্তু চোখের পানি বড্ড বেইমান।না চাইতেও বের হবার জন্য যোদ্ধ করতে থাকে। পেছন ফিরে জল গুলোকে আড়াল করার ব্যার্থ চেষ্টা করছে সে।পাশ থেকে বলে উঠলো নীলা আহম্মেদ,,,,
—কিরে তুই খুশি হসনি?তোর ভাইয়ের বিয়ে বলে কথা।
—হুম ফুপু খুব খুশি।আচ্ছা আপনার ব্যাথা কমেছে?আসলে আমার পড়া আছে।
—এতো পড়াশোনা করে কি করবি শুনি বাপু?সেই তো কোনো এক রিকশাওয়ালার গলায় ই ঝুলে পড়তে হবে।
মুচকি হেসে বলে উঠলো অভনী,,,
—ফুপু রিকশা চালক রা কিন্তু নিজের গায়ের ঘাম জরিয়ে হালাল কাজ করে খায়।এমন কেউ আমার ভাগ্য থাকলে আমার কোনো আফসোস নাই।তবে পড়াশোনা আমি ছাড়বো না।
উঠে হাঁটা ধরলো অভনী নিজের রুমের উদ্দেশ্য। তবে মনটা আজ মানছে না।খুব করে কাঁদতে চাইছে সে।নিজের মনের সাথে হাজারো যোদ্ধ করে অবশেষে বই খাতা নিয়ে এগিয়ে গেলো নীলের রুমের দিকে।কয়েক দিন পরেই এক্সাম।এখন এসব ভেবে সময় কাঁটালে হবে না।মেডিকেল কোনো সহজ কথা নয়।
?
আচ্ছা তোমার মা বাবা কি তোমাকে কোনো কিছুই শেখায় নি? সবার সাথে একসাথে খেতে বসে পরেছো কেনো?জানোনা সবাই কে খাইয়ে পরে বউদের খেতে হয়?রান্না ভান্না ও তো কিছুই পারোনা।বলি স্বামীর কি বউয়ের হাতে কিছু খেয়ে মন চায় না নাকি বউ?
নীলা আহম্মেদের কথায় হাতে থাকা খাবারের লোকমা টা প্লেটে পড়ে গেলো মাইশার।শশুড় বাড়ির মতো এই বাড়িটা ভাবে না সে।পরিবারের কেউও ওকে মনে করিয়ে দেয় না এটা ওর ফুপুর বাড়ি নয় শশুড় বাড়ি।কিন্তু কিছু কিছু মানুষের সবার সুখ হজম হয়না।নীলা আহম্মেদের কথা শুনলেই প্রতিনিয়ত শশুড় বাড়ি শশুড় বাড়ি মনে হয় ওর কাছে।মাইশা কে uncomfortable ফিল করতে দেখে পাশ থেকে বলে উঠলেন নীহাল আহম্মেদ,,,,,
—তুই হয়তো ভুলে যাস নীলা যে ও এই বাড়ির বউ নয় এই বাড়ির মেয়ে।স্বামী কে পাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে খাইয়ে দিয়ে নিজে খেতে বসার মতো আদি নিয়ম এখন আর নেই।নীরবের কিছু খাওয়ার ইচ্ছা হলে অবশ্যই মাইশা মা রান্না করে দেয় যা তোর চোখে পরে না।
—ভাইয়া এমন সাফাই গাইতে গাইতেই না একসময় এই মেয়ে গাড়ে উঠে সব নিজের নামে নিয়ে নেয়।
—ফুপু মাইশাদের কম নেই যে ও আমাদের টার জন্য বসে থাকবে।তুমি হয়তো ভুলে যাও যে ও কে। (নীরব)
—দেখেছিস এখনি বউয়ের সাফাই গায়।দেখবি দেখবি একদিন সব নিজের হাতের মুঠোয় করে নিবে এই মেয়ে।
মাইশা আর খেতে পারছে না।চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে।পাশ থেকে রাগী গলায় বলে উঠলো নীলিমা আহম্মেদ চৌধুরী,,,,
—দিদি তুমি কি মেয়েটাকে একটু শান্তিও দিবে না?মেয়েরা বিয়ের পর নিজের পুরো পরিবার টাকে রেখে স্বামীর বাড়ি আসে। পরিবারের জন্য এমনিতেই মন খারাপ থাকে।তার মধ্যে তোমার এমন গিন্নিগিরি কথা কতোটা হার্ট করে বোঝোনা তুমি?আস্তে আস্তে সব শিখিয়ে দিবো আমি আমার মেয়েকে।
—হুহ আমার কথা এখন হজম হচ্ছে না পরে বুজবা। (নীলা)
ভাঙা ভাঙা গলায় বলে উঠলো নীলের দাদী মিসেস নাহিদা আহম্মেদ,,,,
—আইচ্ছা তুই জাস না কেন এহনো?বিয়া তো আর আইজ শেষ হয়নাই।বিয়া খাইবার আইসোস বিয়া শেষ এহন যা নিজের সংসার দেখ।খামোখা বউডার পিছন লাইগা আসোস কেন?
রাগে গজগজ করতে করতে উঠে দাঁড়ালো নীলা আহম্মেদ। সবার দিকে রাগী দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে হনহন করে চলে গেলেন নিজের রুমে।
অসহায় মুখ করে মাইশার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো নীহাল আহম্মেদ,,,,,
—কষ্ট পাস না মা।ও একটু এমনি।শোন তোদের হানিমুনের জন্য সুইজারল্যান্ড এর টিকেট কেটে রেখেছি আমি।পরশুই ফ্লাইট। এটা আমার পক্ষ থেকে তোদের গিফট।(মুচকি হেসে)
?
ড্রইং রুমের সোফায় বসে আছে সবাই,,,অভনীর নানু কে নিয়ে যেতে ওনার ছেলে আর ছেলের বউমা এসেছেন।মিসেস রহিমা বেগম মুখ ভার করে অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন।মাথা নিচু করে বলে উঠলো ওনার ছেলে,,,,,
—মা আমি আর এমন ভুল করুম না মা।চল আমার সাথে বাড়িতে।তোরে রাইখা যাওয়ার পর থেকে আমার ব্যাবসা শুধু লস আর লস ই যাইতাছে।কয়দিন পর না রাস্তায় বসতে হয়।দয়াকরে চল মা।
তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে উঠলেন মিসেস রহিমা বেগম,,,,
—ওহ ব্যাবসায় লস খাস দেইখা আইসোস নিয়া জাইতে?আমি কিন্তু আল্লাহর কাছে বিচার দেই নাই।নামাকে বইশা তোর আর নাতি গো লাইগা দোয়া ই করি।কিন্তু আল্লাহ বিচার কইরা দেয়।আমি জামু না।আমি এইহানেই মেলা ভালা আছি।তোর সাথে যামু পরে আবার আমারে ফালাইয়া দিবি তহন তো আমি আর আমার এই সোনার টুকরা ছেলে মেয়ে নাতি নাতনী গো পামুনা।না না আমি যামুনা তোর সাথে।
—যাবি মা তুই আমাদের সাথে।তুই আমার মা,,,আমার সাথে না গিয়ে এখানে থাকবি কেন?
পাশ থেকে হালকা চিল্লিয়ে বলে উঠলেন নীহাল আহম্মেদ,,,,,,
—-এনাফ ইজ এনাফ মি. রহমান।আপনার মা কোনো খেলনার পুতুল নয় যে যখন মন চাইবে জোর করে ফেলে দেবেন যখন মন চাইবে ঘরে তুলবেন।ওনি আপনার সাথে যেতে চাইলে বাধা দিতাম না কিন্তু ওনি যেতে চাইছে না মানে যাবেনা।দেখুন কেমন সন্তান আপনি! আপনার মা আপনাকে বিশ্বাস করতে পারেনা কখন না কখন আবার বৃদ্ধাশ্রম এ নিয়ে যান।কিন্তু এই মেয়েটা(অভনী কে দেখিয়ে) আর ওর মা কে বিশ্বাস করতে পারে কারন এতোদিনে তারা যতোটুকু খেতে পেরেছে ততটুকুই ওনাকে সাথে নিয়ে খেয়েছে।এই জন্যই বলে একবার বিশ্বাস ভেঙে গেলে তা যত আপন মানুষই হোক না কেন তা আর জোরা লাগেনা?
সো ভালোয় ভালোয় খেয়ে দেয়ে চলে যান।আপনার মতো ছেলেদের দেখলে ঘৃণা হয় আমার।
—আমি মইরা গেলে আমার লাশ টা নিয়া যাইস আর মন না চাইলে না নিলে আরো ভালা।কিন্তু তার আগে আমি যামু না।মনে করিস আজ থাইকাই তোর মা মইরা গেছে।
রহিমা বেগম উঠে নিজের রুমে চলে গেলেন।ওনার ছেলে আর বউমা উঠে চলে যেতে নিলে পিছন থেকে বলে উঠলো অভনী,,,,,
—প্রকৃতি কখনো তার প্রতিশোধ নিতে ভুলে না।দেখুন আপনাদের ভাগ্য কি আছে।
?
আজ অভনীর মেডিকেলের ভর্তি এক্সাম।রাতে সবকিছু নীলের কাছে একবার রিভাইস দিয়েছে সে।সকাল থেকে ওর থেকে পরিবারের সবার উওেজনা যেনো বেশি।নীলিমা আহম্মেদ অভনী তৈরি হতে হতে নিজের হাতে খাইয়ে দিলেন অভনী কে।শাহেরা বেগম বিনুনি করে দিচ্ছেন লম্বা চুল গুলো।নীহাল আহম্মেদ আর নীল দুজনেই তাড়া দিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আগে আগে পৌঁছে যাওয়া টাই বেশ ভালো বলে মনে হচ্ছে ওদের।অভনী যেনো ছোট বেলার প্রথম এক্সাম দেবার এক্সাইটমেন্টে চলে গেছে আজ।সবার কাছ থেকে দোয়া আর বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে গেলো নীল আর নীহাল আহম্মেদের সাথে।সারা রাস্তায়ই নীল অভনী কে টুকটাক বুঝিয়ে দিয়েছে আবারো সবকিছু।একনজরে নীলের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে আছে অভনী।ভালো প্রিপারেশনের পিছনে মানুষ টার অবধান বলা বাহুল্য।কিন্তু কোনো এক অজানা কারনে নীলের দিকে তাকালে বুকটা বেশ চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হয় তার।বার বার মনে হয় আচ্ছা সত্যিই কি ওনি নিতু আপু কে ভালোবাসেন?সত্যিই কি নিতু আপুর সাথে বিয়ে ঠিক??
?
——————-
ভার্সিটির লাইব্রেরি তে বসে একমনে বই পড়ছে নীর্ঝয়।
—হ্যালো মিষ্টার নীর্ঝয়।
কারো জোরে চিল্লানোর শব্দে ভ্রু জোরা কুঁচকে পিছনে তাকালো সে।মেরুন কালারের শাড়ির সাথে হাতে মেরুন কালারের চুড়ি মেয়েটার।মুখে রাগী আভা ফুটিয়ে তুলে বলে উঠলো নীর্ঝয়,,,,
—আমি কি বয়রা নাকি যে এভাবে ডাকতে হবে?আস্তে ডাকলে কি আমি শুনতাম না মিস. নীরা?
পাশের চেয়ারে বসতে বসতে বলে উঠলো নীরা,,,,
—যদি না শুনেন তাই তো ডাকলাম।তাছাড়া আপনি তো কানা সেটা সেদিন শপিং মলেই বুঝেছি বয়রা কিনা পরিক্ষা করে দেখতে দোষ কি?পরে যদি আবার আমাদের টোনা টুনি কানা বা বয়রা হয়?
বইয়ের দিকে তাকিয়ে রাগী চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো নীর্ঝয়,,,,
—কিসের টোনা টুনি?
লজ্জামাখা হাসি দিয়ে বলে উঠলো নীরা,,,
—-বারেহ আমাদের বিয়ের পর ১ বছরের মাথায় এক জোরা টোনা টুনি আসবে না?আমার কিন্তু টুইন বেবি খুব প্রিয়।
নীরার কথায় নীর্ঝয় বিষম খেয়ে গেলো।কি বলে এই মেয়ে?লজ্জা বলতে কি কিছুই নেই?এখনো এক্সেপ্ট ই করলাম না আর এখনি সোজা বাচ্চা তে চলে গেছে?
—লজ্জা নারীর ভূষন এতোদিন জানতাম কিন্তু ছেলেরাও যে বেবির কথা শুনলে এতো লজ্জা পেতে পারে আমার জানা ছিলো না।(নীরা)
খিলখিল করে হাসতে লাগলো নীরা।নীর্ঝয় অবাক নয়নে তাকালো নীরার দিকে।কয়েকদিনে অনেক বেশি পরিবর্তন এসে গেছে মেয়েটার মধ্যে। খিলখিল করা হাসির শব্দে অঝোর ধারায় মায়া খুঁজে পাচ্ছে নীর্ঝয়।হাসি বন্ধ করে নীর্ঝয়ের দিকে তাকাতেই চোখ নামিয়ে নিলো নীর্ঝয়।ভ্রু জোরা নাচিয়ে বলে উঠলো নীরা,,,,
—কি ব্যাপার মি. নীর্ঝয়?something something?
বই হাতে নিয়ে উঠে হাঁটতে হাঁটতে বলে উঠলো নীর্ঝয়,,,
—Nothing Nothing.
চেয়ার থেকে উঠে নীর্ঝয়ের সাথে হাঁটতে হাঁটতে বলে উঠলো নীরা,,,,
—সেটা সময় হলেই বোঝা যাবে।আচ্ছা সেদিন আপনার বোন কে একা একা ছেড়প দিয়েছিলেন কেনো?যদি কেউ ধরে নিয়ে যেতো?আমি ছেলে হলে তো আপনার মতো গাম্বা কে ছেরে ওকে নিয়েই চলে যেতাম দূর অজানায়।
হাঁটা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে গেলো নীর্ঝয়।নীরার দিকে রাগী লুক নিয়ে তাকিয়ে রাগী সুরে বলে উঠলো,,,,
—কে আমার বোন??আমার বড় আপুর বিয়ে হয়ে গেছে অনেক আগেই,,,বেবিও আছে দুটো।
—না না এই মেয়ের দুটো বেবি!ইমপসিবল!শপিং মলে তো একা একাই দেখেছিলাম।
নীর্ঝয় এবার বুঝতে পারলো নীরা অভনীর কথা বলছে।চোয়াল শক্ত করে নীরা আরেকটু কাছে মুখ নিয়ে বলে উঠলো,,,,
—অভনী আমার বোন নয়?।ও আমার ভালোবাসা।অভনী কেই ভালোবাসি আমি,,,,আর ওকে নিয়ে দূর অজানায় চলে যাওয়া তো দূরের কথা ভাবলেই তার অস্তৃত্ব বিলীন হয়ে যায়।যদিও বন্ধুর বউ হলো বোনের মতোই হয় কিন্তু ভালোবাসার মানুষ কে কি কখনো বোন ভাবা যায়?ভাই বোন সম্পর্ক টা অন্যরকম।
নীর্ঝয় সামনের দিকে হাঁটা ধরলো।নীরা কিছু সময়ে জন্য থমকে দাঁড়ালো। এই মেয়েটাই নীর্ঝয়ের ভালোবাসা?এতো কাছে থেকেও বুজতে পারলাম না?কিন্তু বন্ধুর বউ!তাহলে কি ওর ভালোবাসাকে ওর বন্ধু বিয়ে করে ফেলেছে?
?
——————————
সকাল থেকে বারান্দায় বসে একমনে মুড়ি চিবোচ্ছে অভনী।আর কিছুই গলা দিয়ে নামবে না তার।আর কিছুক্ষন পরেই মেডিকেল ভর্তি এক্সামের রেজাল্ট প্রকাশিত হবে।
একদিকে বাবার স্বপ্ন আর আরেকদিকে জল্লাদ টা তো কুপিয়ে কিমা বানিয়ে নদীতে ফেলে দিয়ে আসবে আমায়?।
অভনী ভাবনার সাথে একতালে হাবুডুবু খেতেখেতেই দরজা ঠেলে ভিতরে ডুকলো নীল।অভনীর সামনে গিয়ে রাগী লুক নিয়ে দাঁড়াতেই প্রান পাখি তার যায় যায় অবস্থা।কাঁপা কাঁপা পায়ে টুল থেকে উঠে দাঁড়াতেই এক হাত নীলের হাতের আয়ওে চলে গেলো তার।হাত ধরে টানতে টানতে নিচে নিয়ে যেতে লাগলো।একগাদা প্রশ্ন গলা পর্যন্তই আটকে আছে অভনীর,গলা দিয়ে কোনো কথাই বের হচ্ছে না।
নিচে নামিয়ে সবাই কে উদ্দেশ্য করে ডাকতে লাগলো নীল,,,এমন উওেজিত সুরে নীলের ডাক শুনে সবাই প্রায় দৌঁড়েই আসলো ড্রইং রুমে।নীলের রাগী গোমড়া মুখ আর অভনীর ভয় মাখা মুখ দেখে বুঝতে পারলো হয়তো মেয়েটা চান্স পায়নি।সবাই কে অবাক করে দিয়ে নীল বলে উঠলো,,,,,
—মিস. অভনী বাসা থেকে বের হন।
সবার চোখ দুটো রসগোল্লার মতো হয়ে গেলো।অভনীর চোখ দুটো প্রায় বেরিয়ে যাবার উপক্রম।কাঁদো কাঁদো মুখে ঠোঁট উল্টে বলে উঠলো অভনী,,,,,
—সেকেন্ড টাইমার খু..ব ভালো ভা..বে দিব।
—আমি আপনাকে বের হতে বলেছি মানে বের হবেন,,, এতো কথা কিসের?(ধমক দিয়ে)
—সবা..ই কে নিয়ে তো যাবো,,আরো কত কিছুই তো নি..তে হবে।ভিতরে ডুকতে দিন।
—যেহেতু অন্যায় টা একা করেছেন সেহেতু শাস্তি টাও একাই পেতে হবে।যান বের হোন।
—একা কো..থায় যাবো??
—মিষ্টির দোকানে জনগোষ্ঠির সবাই কে নিয়ে যাবেন কেনো?মিষ্টির দোকানে একা একাই যাওয়া যায়।
নীলের কথায় আবারো সবার চোখ গুলো রসগোল্লা হয়ে গেলো।খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলে উঠলো নীল,,,,,
—হাহাহাহা ভয় পেলে আপনাকে যা দারুন লাগে না মিস. অভনী।সবার চেহারার দিকে একবার দেখো প্রায় কেঁদেই দিচ্ছিলো ?
মিস. অভনী নিজের প্রতি আত্নবিশ্বাস নেই?আপনি চান্স পেয়েছেন।তাও আবার আমারি ক্যাম্পাস ঢাকা মেডিকেল এ।
এখনো পুরো কথাটা হজম করতে পারেনি অভনী।বার কয়েক মাথায় ঘুরপাক খেতেই চিল্লিয়ে লাফিয়ে উঠলো অভনী।সাথে পুরো পরিবার।শাহেরা বেগমের চোখে চিকচিক করা জল গুলো গড়িয়ে পরছেন বাধাহীন ভাবে।নানী আর দাদী কে নিয়ে ঘুরছে অনবরত।টাটকা হলুদ রঙের সেলোয়ার-কামিজ গুলোও প্রতিনিয়ত দুল খেয়ে যাচ্ছে অভনীর সাথে সাথে।বাবার স্বপ্ন পূরন করার লক্ষে আরো একদাপ এগিয়ে গেছে সে।সময় কি সব সময় এক রকম থাকে?কান্নার পরই তো ঝাপিয়ে পড়ে একদল গভীর সুখ।
?
————————-
স্কুলের গেট থেকে বের হতেই একটা কালো গাড়ি এসে সামনে দাঁড়ালো আরিহার। আচমকা এমন হওয়ায় ভয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো সে।কিন্তু কিছু বুঝার আগেই মুখ চেপে গাড়িতে নিয়ে বসিয়ে দিলো কেউ একজন তাকে।চোখ খুলে সামনে তাকাতেই দেখতে পেলো মাহিব ওর সিট বেল্ট লাগাতে লাগাতে মিটমিট করে হাসছে। মাহিব কে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়ে গুটিসুটি মেরে বসে পরলো সিটে।রাগী দৃষ্টিতে মাহিবের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো আরিহা,,,,,
—আমাকে কিডনাপ করছেন কেনো?আমি কিন্তু এখন চিল্লাবো।
—তো চিল্লাও। না করছে কে?
ডেবিল মার্কা হাসি দিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করতে শুরু করলো মাহিব,,,,মাহিবের দিকে একনজর তাকিয়ে চিল্লিয়ে উঠলো আরিহা,,,,,
—–আহহহহহহহহহ বাচাওওওও।আমার হিরো কই তুমি?বাঁচাও?
ভিলেন আমায় কিডনাপ করে নিয়ে যাচ্ছে বাঁচাওওওও?
—হিরো নিজেই যখন কিডনাপ করে তখন অন্য কোনো ভিলেইন আসতে পারেনা কাছে।চিল্লিয়ে গলা ভেঙে ফেললেও তোমার কোনো কথাই বাহিরে যাবে না মিস টুনটুনি (মুচকি হেসে)
—হুয়াট ইজ দিস টুনটুনি?আমি মোটেও টুনটুনি নই।কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমায় আগে সেটা বলুন।
—তুমি তো শিশু তাই শিশু পার্কে নিয়ে যাচ্ছি।
—একদম শিশু শিশু করবেন না।ক্লাস টেন এ উঠে যাবো আমি কিছুদিন পর (মুখ ভেংচি দিয়ে)
গাড়ি থামি আরিহার দিকে আরেকটু ঝুকে বলে উঠলো মাহিব,,,,,
—ওহ রিয়েলি?তুমি শিশু নও?আচ্ছা তোমার তো খুব ইচ্ছা প্রেম করে ক্লাস না করে বয়ফ্রেন্ড এর সাথে উরাল দিতে তাহলে চলোনা প্রেম টা করেই ফেলি (চোখ টিপ দিয়ে)
—নাহহহহহহহ ছি কি সব কথা আপনার।খুব পঁচা আওনি।আপনার সাথে যাবোনা আমি।আমি শিশু শিশুই ভালো।দূরে সরেন আমার থেকে।
হুহু করে হেসে গাড়ি ড্রাইভ করতে শুরু করলো মাহিব।নীলদের বাসার সামনে এসেই বলে উঠলো,,,,
—এই যে মিস. টুনটুনি।নামুন এবার গাড়ি থেকে।দেখুন আপনাকে কোথায় নিয়ে এসেছি।নীল ভাইয়া কল দিয়ে বললো বিধায় নিয়ে আসলাম নাহলে আপনার মতো ঝগরুটে কে আমি তো জীবনেও নিয়ে আসতাম না (হেসে)
—কিহহহহ আমি ঝগরুটে? (কোমরে হাত দিয়ে)
—-তা নয়তো কি?তবে ক্লাস নাইন কিন্তু অনেক বড় আমার কিন্তু আস সেভেনেরই একটা গার্লফ্রেন্ড ছিলো (চোখ টিপ দিয়ে)
মাহিব হনহনিয়ে বাসার ভিতরে চলে যেতে লাগলো,,,আরিহা ভ্রু কুঁচকে তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলে উঠলো,,,,
—কি বিচ্ছু ছেলেরে বাবা।
#চলবে,,,,,