আমার রাজ্যের রানী পর্ব-২৪

0
801

#আমার রাজ্যের রানী
#Part : 24
#Writer : Sriti Nur Avni

?
নৌকার পাটাতনে বসে চাঁপা কাঁঠালি রঙের শাড়ির আঁচল টাকে নিজ গতিতে তীব্র বাতাসের সাথে পানিতে হাবুডুবু খেতে দিয়ে হাওরের পানিতে পা ঝুলাচ্ছে অভনী,,, তার বিপরীত পাশে বসে আরিহা নিঁচু হয়ে হাতে পানি নিয়ে খেলা করছে।মাইশা বসে আছে ওদের মাঝ বরাবর।পানি খুব ভয় পায় সে।তাই পানিতে পা বা হাত দেবার মতো সাহস পাচ্ছে না।তবে ঢেউয়ের শব্দের সাথে বাতাসের শু শা শব্দ আর ঝিকঝিক করা নীলচে বর্নের পানি দেখতে বেশ লাগছে তার কাছে।তবে নৌকার ইঞ্জিনের শব্দটা বেশ বিরক্ত লাগছে এই মুহূর্তে।

নৌকা চলতে শুরু করা মাএই তারা হারিয়ে যেতে থাকে জলরাশীর রাজ্য।
নৌকার মাঝখানে বসে হাতে ছিপ নিয়ে দুপাশে বসে আছে নীল আর মাহিব।নীরব মাইশার সাথে রাগ করে অপরপাশের পাটাতনে চুপ করে বসে আছে,,,বার বার মাইশা কে নিজের সাথে বসতে বলার পরও বসেনি মাইশা।নীরবের সাথে এমন চিপকে বসতে বেশ লজ্জা নাকি লাগে তার।

নৌকা চলছে তার আপন গতিতে,,ছিপ গুলোকে পানিতে রাখা হলেও নৌকা চলা কালে কোনো মাছ পাবে বলে আসা রইলো না,,,তাই ছিপ গুলো কে উঠিয়ে রাখলো,,তবে কিছুক্ষনের মধ্যেই নৌকা থামিয়ে মাছ ধরার তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হবে। নীরব প্রতিযোগিতা তে নারাজ,,,সে এখন না হওয়া বউকে সাথে নিয়ে পানিতে পা ডুবিয়ে ঘুরে বেড়াতে না পারায় গভীর শোকে শোকাহত হয়ে গালে হাত দিয়ে বসে আছে।

কিছুক্ষন পর নৌকা থামানো হলো,,
সবাই মুগ্ধ চোখে চারপাশে তাকিয়ে আছে,,,আকাশের নীল বর্নের সাথে নীলচে বর্নের পানি গুলো হালকা রোদে ঝলমলে হয়ে উঠেছে,,,জলাশয়ের বুকে মাঝারি সাইজের নৌকায় বসে আছে ওরা।শহরের বুকে প্রান ভরে নিঃশ্বাস নেয়া যায়না,,,এমন ঠান্ডা শীতলতা পরিবেশে মন ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে নিলে মন্দ হয়না।

নীল আর মাহিব ছিপ নিয়ে মাছ ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছে,,,নীরবের কাছে গিয়ে ওর মতো গালে হাত দিয়ে অসহায় মুখ করে বলে উঠলো নীল,,,,

—তোর শোক পালন করা শেষ হয়নি ভাইয়া?এভাবে শোক পালন করলে বিয়ের আগেই সব চুল পাকিয়ে বসে থাকবি পরে আর ভাবিপু তোকে বিয়েই করবে না রে।

নীলের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো নীরব,,আবারো বলে উঠলো নীল,,,

—শোন ভাইয়া তুই যদি আমার আর মাহিবের থেকে বেশি মাছ ধরতে পারিস তাহলে ভাবিপু কে আর তোকে এই নৌকায় রেখে আমরা অন্য নৌকায় চলে যাবো।তখন তুই আর তোর না হওয়া হবু বউ মন ভরে ঘুরে বেড়াতে পারবি।?

—সত্যিই?

—হাম হাম ?

নীল নীরব আর মাহিব মাছ ধরতে শুরু করলো,,,তিনজনের নৌকার তিন পাশে বসে আছে,,,অভনী আরিহা আর মাইশা অধীর আগ্রহ পূর্ণ চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে,,,মাহিব নিজের হাতের ছিপ টাকে পানির নিচে দিয়ে আরিহার পায়ে খোঁচা লাগালো,,,চোখ বন্ধ করে চিল্লিয়ে উঠে বলে উঠলো আরিহা,,,

—আপু সাপ সাপ সাপ,,,আপুরে সাপে কামর দিছে আমারে,,,আমি আর বাঁচমু না আপু আমার আর প্রেম করা হইলো না এই জীবনে।?

আরিহার কথায় অভনী পানি থেকে পা তুলে পেছনে ফিরে আরিহার কাছে গেলো,,,মাহিব নীল আর নীরবও দৌঁড়ে আরিহার কাছে গেলো,,,কিন্তুু আরিহার পায়ে সাপের কামরের কোনো দাগ নেই,,ভ্রু কুচকে আরিহার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো অভনী,,,

— কোথায় সাপ?কোনো কামর তো নেই আরু?ব্যাথা করছে?

অভনীর কথায় আরিহা চোখ খুলে তাকালো,, আসলেই তো কোনো দাগ নেই,,কোনো ব্যাথা ও নেই,, তাহলে?
চিল্লিয়ে আবারো বলে উঠলো আরিহা,,,

—-আপুুুু এই নদীতে ভুত আছে আপু,,আমারে এক্ষুনি নিয়ে যাইতে আসছিলো ভাগ্যিস পা তুলে ফেলছিলাম।আপু বাড়ি চল এই ভুতুরে নদীতে আমি আর থাকমু না।আমার পায়ে এসে
খোঁচা মারছে।?

বলেই জোরে জোরে কান্না করতে লাগলো,,,সবার কঁপালেই হালকা চিন্তার ভাজ পরে আছে,,,সত্যিই কি ভুত আছে নাকি?তবে আরিহার কথায় মাহিব হুহু করে হেসে উঠলো। সবার দৃষ্টি এখন মাহিবের দিকে,,,মাহিবের হঠাৎ এমন হাসি তে ভ্র‍ু জোরা কুঁচকে এলো সবার। হাঁসি থামিয়ে বলে উঠলো মাহিব,,,,,

—তোমাকে কি আমি শুধু শুধু পিচ্ছি বলি?শেষে কিনা ছিপের খোঁচা কে সাপ আর ভুত বানিয়ে দিলে??আবার কিনা এই বয়সেই প্রেম করার এতো শখ?

—ওই চুপ হাসবেন না একদম।আপনি আমার পিছনে এভাবে লেগে থাকেন কেন বলুন তো?আমি মোটেও পিচ্ছি নই,,আমার থেকে কম কম বয়সের মেয়েরাও প্রেম করে হুহ?,,প্রেম করাতে অনেক সুবিধা আছে।(আরিহা)

—ওহ তাই নাকি?তাহলে কি কি সুবিধা বলো তো দেখি?(মাহিব)

—physics,, higher math এর মতো বিরক্তি কর সাব্জেক্ট গুলোতে স্কুলের দেয়াল টপকে বিএফ এর সাথে ঘুরতে বের হয়ে যায় আমার ফ্রেন্ড রা কিন্তু আমি?আমাকে কেউ নেয়ার নাই বিধায় প্রতিদিন এক বস্তা বিরক্তি নিয়ে করতে হয় ক্লাস,,,ক্লাস না করে বাসায় চলে আসছি শুনলেই আপুর দপাস দপাস মাইর ?

এতোক্ষন ভ্রু কুঁচকে সবাই ওদের কথা শুনলেও আরিহার কথায় অভনী ব্যতিত সবাই হুহু করে হেসে উঠলো। অভনী ভ্রু জোরা আরেকটু কুঁচকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো আরিহার দিকে,,,ভয়ে ডুক গিলে বলে উঠলো আরিহা,,,

—-এ্যাহহহ? আপু রে আমি জীবনেও
প্রেম করুম না,,তবুও তুই আমার সাথে এখন যুদ্ধ লাগিস না প্লিজ।(আরিহা)

পিছনে ফিরে আবারো পানিতে পা ডুবিয়ে বসে পরলো অভনী,,আরিহা রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাহিবের দিকে,,কিন্তু মাহিবের এতে কোনো ভাবান্তর নেই,,সে একমনে ছিপের দিকে তাকিয়ে থাকতে ব্যাস্ত।নীরবের দৃষ্টিতে লাজুকতা,,যে দৃষ্টির মানে,,,
“আজ যেভাবেই হোক মাছ বেশি ধরবেই,,
মাইশা কে নিয়ে একসাথে পানিতে পা ভিজিয়ে ঘুরবেই”

অবশেষে মাছ ধরার পালা শেষ হলো,,নীরবের মুখে বিষন্নতা,,আবারো এই মূহুর্তে শোক পালন করা ছাড়া আর কিছু করার নেই তার,,,নীল ধরেছে ৩ টা, মাহিব ২ টা আর নীরব ও ২ টা,,,তবে সবথেকে বেশি না হওয়ায় আজ আর মাইশা কে নিয়ে পানিতে পা ডুবিয়ে ঘুরা হলো না নীরবের।নীরবের কাছে গিয়ে বলে উঠলো নীল,,,,

—আহারে আমার প্রেমপিপাসু ভাই টা,,,বলি ছেকা তো আর খাস নাই যে এমনি শোক পালন করছিস?
অপেক্ষা কর মেরা ভাই,অপেক্ষা কর।অপেক্ষার ফল মিষ্টি আছে,,,এবার তো হলো না,,,বিয়ের পর ভাবিপু কে নিয়ে সারা শহর,,দেশ,,বিদেশ ঘুরে বেড়াস।তখন আর আমরা কেউ তোদের পিছু পিছু কাবাব মে হাড্ডি হতে যাবো না।

—হুহ লাত্থি না খাইতে সর সামনে থেকে,,,তুই আর মাইশা দুইজনই আজ আমার ফিলিংসের বারোটা বাজানোর জন্য দায়ী,,,আমার সুযোগ আসুক আমি দেখাবো তোদের কে?।(নীরব)

মাছ গুলোকে মাঝির হাতে তুলে দিলো ওরা,,নৌকাতেই অনেকে রান্না করে খায় বিধায় মাছ কাটা সহ ভাজার সবকিছুই নৌকাতে রেখে দেয় মাঝি,,,নৌকার ছোট ছাউনির ভিতরে গিয়ে একসাথে মাছ ভাজি করে নিজেদের হাতে ধরা সদ্য নদী থেকে তোলা সুস্বাদু মাছ নিয়ে সবাই একটা একটা করে খেয়ে নিলো।

আবারো নৌকা চলতে লাগলো তার আপন গতিতে,,,নীল আর মাহিবও পানিতে পা ভিজিয়ে বসে আছে,,,এতো সুন্দর একটা মূহুর্ত কে শোক পালন করে শেষ করার চেয়ে মজা করে কাটানো টাই বেশ মনে হচ্ছে নীরবের কাছে।মাইশা কে নাহয় পরে দেখে নিবে।

বিশাল জলরাশির বুকে বিচ্ছিন্ন ছোট ছোট গ্রাম।যেনো একেক টা ছোট ছোট দ্বীপ।হাওর জুরে গলা ডুবিয়ে থাকা হিজল গাছের সারি সারি ফুল গুলো যেন সৌন্দর্য হাজার গুন বাড়িয়ে দিয়েছে।পানির নিচ থেকে জেগে উঠা করচের বন কিংবা শুশুকের লাফ-ঝাঁপ মূহুর্তেই মন ভালো করে দেবার জন্য যথেষ্ট।দূর থেকে আরো যত দূরে চোখ যায় স্নিগ্ধ গ্রামের মতোই শান্ত অথৈই পানি প্রান জুরিয়ে দিচ্ছে।জলের সীমানা শেষ হতেই যেনো বিস্তৃত আকাশ।তারই মাঝখানে ফুটে উঠেছে কিছু ঘরবাড়ি।
নৌকায় ঘুরতে ঘুরতে শোনা যাচ্ছে গ্রামের শিশুদের মিষ্টি কন্ঠে ভাটিয়ালি গান।বিভিন্ন ছোট ছোট মাঝির নৌকা ঘুরে বেড়াচ্ছে হাওরের পানির বুকে।শিশুদের সাঁতার কাটা আর হাওয়ের মাঝখানে ছোট-বড় গাছ প্রায় বিলীন হয়ে যাওয়া বাংলার গ্রামের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলছে।গ্রাম থেকে এসেছে অনেকদিন হয় অভনীদের,,আর যাওয়া হবে কিনা তাও জানা নেই,,,শহরে এতো সুন্দর পরিবেশ দেখা যায় না,,,তাই মন ভরে প্রকৃতির অদ্ভুত সুন্দর জায়গা টা গভীর ভাবে উপভোগ করছে সে,,আর তার পাশের সবাই। মাইশা প্রথমে ভয় পেলেও এখন অভনীর সাথে খুব স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে পানিতে পা ডুবিয়ে রেখেছে সে।বাবার চাকরির জন্য এদিকে খুব কমই আসা হতো তার।

?
————————————-
ঘুম থেকে উঠে মর্নিং walk এ বের হয়েছে নীর্ঝয়।বেশ কিছুক্ষন যাবৎই মনে হচ্ছে পেছন থেকে কেউ ওর পিছু পিছু আসছে।কিন্তু পেছন ঘুরে কাউকে দেখতে পাচ্ছে না সে।ব্যাপার টা অস্বস্তিকর।চরম রকমের অস্বস্তিকর!

যখন বাড়ির সামনে চলে আসলো তখন হুট করে একটা মেয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়ালো।আচমকা এমন হওয়ায় কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো নীর্ঝয়।ছোট বেলায় মায়ের কাছে শুনেছিলো ভয় পেলে গলায় ফুঁ দিলে নাকি ভয় কমে যায়,,,এখন সেই টেকনিক টাই কাজে লাগালো নীর্ঝয়।তবে তার এই কাজে সামনে নীল রঙের সুতি শাড়ি পরা মেয়েটা খিলখিল করে হাসতে লাগলো।
নীর্ঝয় ভ্রু জোরা কুঁচকে মেয়েটির দিকে তাকালো,,,
হ্যাঁ এটাতো গতকালকের সেই মেয়ে নীরা।নীল রঙের সুতি সাধারন শাড়ির সাথে হাতে নীল রঙের চুড়ি,,,ব্রাউন কালারের চুল গুলো আর ব্রাউন কালার নেই। গারো কালছে রঙের পিঠ অবধি চুল গুলো ছেড়ে রাখা,,,মুখে একগাধা মেকাপের প্রলেপ নেই,,চোখে গারো কাজল আর ঠোঁটে গোলাপি লিপস্টিক। এক দিনেই এতো পরিবর্তন? সবটা কি আমার জন্যই?তাহলে কি সত্যিই মেয়েটি ভালোবাসে আমাকে?

ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল নীর্ঝয়। মুচকি হেসে বলে উঠলো নীরা,,,,

—-আমাকে কেমন লাগছে মি.নীর্ঝয়?আপনার ভালোবাসার মানুষ টার মতো হতে না পারলেও তার মতো হবার চেষ্টা করেছি।

—সবাই চাইলেই সবার মতো হতে পারে না।তাই আমাকে ইমপ্রেস করার জন্য অভনীর মতো হতে চাইলেও কখনো ওর মতো হতে পারবে না গট ইট।

নীর্ঝয় হনহন করে বাসায় ভিতরে চলে গেলো।নীরার এখন চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে,,,সব কিছু সহ্য করতে পারলেও ভালোবাসার মানুষ টার অবহেলা সহ্য করা যায় না।ধুমরে মুচরে শেষ করে দেয় ভিতর টা,,,নীরার হাঁটছে তার গন্তব্যের উদ্দেশে,, চোখ দিয়ে পানি পরছে টপটপ করে,,,ভাবছে নীরা,,

—যতোই অপমান আর অবহেলা করুন মি. নীর্ঝয়।আমি হার মানবো না।আমার আপনাকে চাই মানে আপনাকেই চাই।আপনার ভালোবাসা টুকুই চাই আমি।

?
———————

কি ভেবেছো ভুলে গিয়েছি?সরে গিয়েছি তোমার রাস্তা থেকে?এতোই সহজ ঝাল মরিচ?তুমি প্রতিনিয়ত কোথায় থাকো কি করো তার সব আপডেট আমি পাই।এতো সহজে ছেরে দিবো ভাবছো কিভাবে?আই ওয়ান্ট ইউ ঝাল মরিচ,,, আই ওয়ান্ট ইউ (চিল্লিয়ে)

?
———————–
ড্রইং রুমের সোফায় বসে আছে সবাই।আগামিকাল আবারো ঢাকা ফিরে যাবে।তবে সাথে করে রায়হান চৌধুরী আর মরিয়ম চৌধুরী কেও নিয়ে যাবে।কারন নীরব আর নীর্ঝয়ের কিছুদিনের মধ্যেই বিয়ের কাজ অনুষ্টিত হবে,,,ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জ দূরে হবায়,,ঢাকা তেই বিয়ের অনুষ্ঠান হবে।তাই সবাই এটা নিয়েই আলোচনা করছে,,,মাইশা লজ্জায় লাল নীল হয়ে যাচ্ছে যা দেখে নীরব শয়তানি মার্কা হাসি দিচ্ছে।
তবে ড্রইং রুমের এককোনে বসে বইয়ের দিকে মুখ গুঁজে থাকতে হচ্ছে অভনী কে,,,,কারন ও যেখানেই যাক ওর পাশে যে ওর স্যার নামাক ভয়ংকর রাগী মানুষটা অলওয়েস ঘুরপাক খায়।❤

#চলবে,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here