আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ৯

0
129

#আমার_নিঠুর_মনোহর
#লেখিনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_নয়

গরম পানির মগটা হাতের থেকে ছিটকে পায়ের উপর পড়তেই তারিন যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল। সকালে উঠে সবার জন্য নাস্তা বানাতে ব্যস্ত তারিন। আমজাদ সাহেব হাঁটতে বের হয়েছেন। বর্ষা বেগম নিজের রুমে আছেন। তারিনকে সাহায্য করার জন্য একজন পরিচারিকা রাখা হয়েছে। সেও তারিনের হাতে হাতে সব করে দিচ্ছিলো। বর্ষা বেগম কাল থেকে তারিনের উপর রেগে আছেন। কথা বলছেন না কিছুতেই। তারিন যথাসাধ্য চেষ্টা করছে সবটা মানিয়ে নেওয়ার। তারিন বর্ষা বেগমের খাওয়ার জন্যই গরম পানি করে নিয়ে যাওয়ার জন্য রান্নাঘর থেকে বের হয়েছিলো। হুট করে ফ্লোরে পা পিছলে গিয়ে হাত থেকে গ্লাসটা তারিনের পায়ের উপর পড়েছে। মুহূর্তেই কাচের গ্লাসটা ভেঙে কয়েক টুকরো হয়ে গেলো। সেখান থেকে একটুকরো কাচ পায়ের নখে বিধে গেলো। পা মুহূর্তেই জ্বলে উঠল মারাত্নক যন্ত্রণায়। তারিনের চিৎকারে রান্নাঘর থেকে জাহেলা এগিয়ে আসলো। তারিনের পায়ের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলেন। চিৎকার করে বর্ষা বেগমের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,
“হায়! হায় রে! খালা, ভাইজান তাড়াতাড়ি আহেন। দেইখা যান কি সর্ব্বোনাশ হইছে।”
তারিন ব্যাথা আর জ্বালা পোড়াতে নিচে বসে কাতরাচ্ছে। তামজিদের আজ কলেজে জয়েন করার দিন। সেজন্যই রুমে রেডি হচ্ছিলো। হঠাৎ করে জাহেলার চিৎকার শুনে দৌড়ে এলো ড্রয়িং রুমে। তামজিদের পিছু পিছু বর্ষা বেগমও ছুটে এলেন। তারিনের অবস্থা দেখে দুজনেই একসাথে চিৎকার করে উঠল। তামজিদ তাড়াতাড়ি তারিনকে ধরে উঠালো। অতি সাবধানে সোফায় নিয়ে গিয়ে বসালো। জাহেলা কে আদেশ করল,
“আপা, তাড়াতাড়ি আগে বরফ নিয়ে আসুন। আমার রুমের ড্রেসিংটেবিলের উপর থেকে ‘ফাস্ট এইড বক্সটাও’ নিয়ে আসবেন।”
জাহেলা আদেশ পেয়ে সেদিকে ছুটল। তামজিদ দৌঁড়ে গিয়ে পানির জগ এনে তারিনের পায়ে পানি ঢালতে লাগলো। তারিন নিঃশব্দে কাঁদছে। নিজের বাড়ি হলে এতক্ষনে বিলাপ পেরে কাঁদা শুরু করে দিতো। এখানে লজ্জায় চুপচাপ কাঁদছে। কিছু বলছে না। বর্ষা বেগম তারিনের পাশে বসলেন। শাসনের স্বরে বলে উঠলেন,
“কী করে হলো এসব? দেখে কাজ করবে তো। এইটুকু একটা মেয়ে এত কাজ করতে হবে কেন? আমি এখনো বেঁচে আছি তো। আল্লাহ আমাকে এখনো অনেক সুস্থ রাখছে। কী অবস্থা হয়েছে! আল্লাহ মাবুদ!”
তারিন এবার শব্দ করে কেঁদে উঠল। বর্ষা বেগম যত্ন করে তারিনকে নিজের বুকের ভেতর আঁকড়ে ধরলেন। তারিনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলেন,
“কাঁদেনা মা। একটু সহ্য কর। এক্ষুনি ঠিক হয়ে যাবে।”
জাহেলা বরফ নিয়ে আসতেই তামজিদ তারিনের পায়ে বরফের টুকরো ঘষতে লাগলো। বর্ষা বেগম তামজিদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,
“তাজ, তাড়াতাড়ি ওকে হাসপাতালে নিয়ে চল। পায়ের রক্ত পড়া তো থামছে না। সেলাই লাগবে নাকি?”
তামজিদ ওর মাকে অভয়বানীতে বলে উঠল,
“চিন্তা করো না, মা। সেলাই লাগবে না। কমে যাবে। একটু ধৈর্য ধরো।”
তারপর তারিনের উদ্দেশ্যে শান্ত বাক্যে বলে উঠল,
“একটু সহ্য করে নাও, প্লিজ।”
তারিন কাঁদছে। কোনো কথা বলছে না। গরম পানিটা ফুটন্ত না হলেও মোটামুটি বেশ গরম ছিলো। পা সম্পূর্ণ লাল হয়ে উঠছে আস্তে আস্তে৷ রক্ত পড়াটা কমতে শুরু করেছে কিছুটা। তামজিদ কাটা জায়গায় যত্ন সহকারে ‘অ্যান্টিবায়োটিক মলম’ লাগাতেই তারিন পা সরিয়ে নিলো। ব্যাথাতুর স্বরে বলে উঠল,
“মাস্টার মশাই, জ্বলছে। আর দিয়েন না।”
বর্ষা বেগমের চোখের কোনেও পানি জমেছে। মেয়েটার চেহারাও ব্যাথাতে লাল হয়ে গেছে। তামজিদ তারিনের দিকে তাকিয়ে আলতো বাক্যে বলল,
“একটু সহ্য করো, প্লিজ। এক্ষুনি সেরে যাবে।”
বর্ষা বেগমও সেই সুরে সুর মিলিয়ে তারিনের চোখের পানিটুকু মুছে দিতে দিতে বলল,
“কান্না করিস না, মা। কমে যাবে, আল্লাহ ভরসা।”
তারিন বর্ষা বেগমের বুকের সাথে লেগে থাকলো চুপ করে। তারিনের কান্না থেমে গেলো কয়েক সেকেন্ডে। সব ব্যাথা ভুলে গেলো মায়ের মতো মমতাময়ী একজনের হাতের ছোঁয়ায়। মানুষটা উপরে উপরে কঠিন হলেও তার মনটা বড্ড নরম। তারিন ভাবছে, ‘কত সুন্দর মনের মানুষ হলে একজন শাশুড়ী তার ছেলের বউকে এতটা যত্নে নিজের বুকে আগলে রাখতে পারেন’! মায়ের মতো শাশুড়ী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। সব মেয়ের এই ভাগ্য হয়না। তারিন খুব ভাগ্যবতী এমন একজন শাশুড়ী পেয়েছে। তারিন কাল থেকে নিজের মাথায় সাজিয়ে রাখা সব দুষ্টু বুদ্ধিতে বিদায় দিয়ে দিলো। তারিনের এসব ভাবনা চিন্তার সমাপ্তি ঘটল তামজিদের স্বরে।
“ব্যাথাটা কি একটু কমেছে, তারিন?”
তারিন ভ্যাবাচেকা খেয়ে উঠল। পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো পায়ে সাদা ব্যান্ডেজ প্যাঁচানো। মলম লাগানোতে পায়ে আগের তুলনায় ঠান্ডা লাগছে। ভাবনার মাঝে নিজের যন্ত্রণা গুলো কখন যে ভুলে গিয়েছিলো নিজেও টের পায়নি। তারিনকে চুপ থাকতে দেখে তামজিদ পুনরায় প্রশ্ন করল,
“ব্যাথা লাগছে, তারিন?”
পায়ের বড্ড জ্বলছে। কিন্তু তা প্রকাশ করলো না, তারিন। প্রতিউত্তরে নিঃশব্দে মাথা নাড়ালো। অর্থাৎ ‘হ্যা, কমেছে’। জাহেলা এক গ্লাস পানি এনে দিতেই তারিন তা ঢকঢক করে গিলে ফেলল। বর্ষা বেগম তামজিদের উদ্দেশ্যে বলল,
“তাজ, তারিনকে নিয়ে ঘরে যা। আমি ওর জন্য রুমে খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
তারপর তারিনের উদ্দেশ্যে শাসনের স্বরে বলল,
“চুপচাপ বিশ্রাম নিবি গিয়ে৷ নড়াচড়া করিস না, মা। ব্যাথার ওষুধ আনিয়ে দিবো একটু পরেই৷ ঠিক হয়ে যাবে। ”
তারিন প্রতিউত্তরে প্রশান্তিময় হাসি উপহার দিলো। তামজিদ তারিনকে ধরে দাঁড় করাতেই তারিন ব্যাথায় চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো। তামজিদ তা খেয়াল করে জিজ্ঞেস করল,
“যেতে পারবে?”
তারিন ছোট্ট করে উত্তর দিলো,
“হ্যাঁ। ”
তামজিদ খুব সযত্নে তারিনকে রুমে নিয়ে এসে বিছানায় বসালো। ধমকে বলে উঠল,
“এই মেয়ে, তোমাকে সব কাজে এত বেশি বুঝতে হবে কেন? কে বলেছে তোমাকে এত বেশি বুঝতে? বলেছি আমরা কেউ? বলো, বলেছি?”
শেষের কথাটা তামজিদ বেশ জোরেই বলেছে। তারিন ভয় পেয়ে খানিকটা নড়েচড়ে বসল। জাহেলা খাবার দিয়ে যেতেই তামজিদ যত্ন নিয়ে খাইয়ে দিলো। একটা পেইনকিলার ও খাইয়ে দিলো। তারপর সর্তকতার স্বরে বলে উঠল,
“শোনো সারাদিনে একটুও নড়াচড়া করবে না। চুপচাপ রেস্ট নিবে। কিছু হেল্প লাগলে জাহেলা আপাকে ডাকবে। বুঝেছো?”
তারিন হেসেই বলল,
“ঠিক আছে, মাস্টার মশাই।”
তামজিদ তারিনকে সবকিছু বুঝিয়ে শুনিয়ে দিয়ে চলে গেলো নিজ গন্তব্যে।



দিন গড়িয়ে রাত নেমেছে ভুবন জুড়ে। তারিনকে আজ সারাদিনও বর্ষা বেগম বিছানা থেকে নামতে দেয়নি। কিছুক্ষণ পর পর নিজে এসেই তারিনের খোঁজ নিয়ে গেছেন৷ রাতের খাবার শেষ করে তারিন নিজের রুমে বসে বসে চিপস খাচ্ছে আর কিছু একটা ভাবছে। ওর পাশেই তামজিদ ল্যাপটপে নিজের কাজ করতে ব্যস্ত৷ তখনি তারিন হঠাৎ বলে উঠল,
“মাস্টার মশাই, একটা প্রশ্ন করবো?”
তামজিদ ব্যস্ত স্বরেই বলল,
“পারমিশন নিচ্ছো কেন? বন্ধুকে কিছু বলতে বুঝি পারমিশন লাগে?”
তারিন সে প্রসঙ্গে না গিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করল,
“আপনি আমাকে মন থেকে মেনে নিয়েছেন, মাস্টার মশাই?”
তামজিদ অবাক হলো। কিন্তু কাজের ব্যস্ততায় সেদিকে বেশি নজর দেওয়ার সময় হলো না। ব্যস্ত ভঙ্গিতেই বলল,
“হঠাৎ এ কথা বলছো যে? কোনো সমস্যা?”
তারিন ভাবুক স্বরে বলে উঠল,
“না। এমনি জানতে ইচ্ছে হলো।”
“ছোট মাথায় এত ভাবনা রেখো না।”
তারিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“ঠিক আছে।”
অতঃপর দুজনেই চুপ হয়ে গেলো। তারিন মনে মনে ভাবছে,
“তামজিদ এত শান্ত আছে কী করে? তামজিদ কি সত্যিই মন থেকে সব মেনে নিয়েছে? নাকি মেনে নেওয়ার চেষ্টা করছে? তামজিদ কি এত সহজে সব ভুলে গেলো? নিজের ভালোবাসাকে ভুলে যাওয়া এত সহজ?”
তামজিদের এত শান্ত ব্যবহারে তারিনের বড্ড সন্দেহ হচ্ছে। নিজের মনের প্রশ্নগুলোকে দমিয়ে রাখতে পারলো না। সন্দিহান স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“মাস্টার মশাই?”
“হু।”
“দিশা আপু আপনাকে এখন আর ফোন করে না?”
তামজিদের হাতটা থেমে গেলো। ভ্রু কুঁচকে তাকালো তারিনের দিকে। তারিন আগের থেকেই তামজিদের দিকে উত্তরের আশায় তাকিয়ে ছিলো। এবার তামজিদের চোখে চোখ পড়তেই দেখলো তামজিদের চোখে ভয় আর অস্বস্তি। কিন্তু কেন? কিছু কি তারিনের থেকে লুকানো হচ্ছে?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here