#আমার_নিঠুর_মনোহর
#লেখিনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_সাত
“ভালোবাসতে না পারলে বিয়ে করছেন কেন, মাস্টার মশাই?”
তারিন আনমনে অস্পষ্ট স্বরে প্রশ্নটা করে বসল। তামজিদের ইন্দ্রদ্বয়ে সবটুকু বাক্য বোধগম্য হলো না। প্রশ্ন করল,
“কিছু বললে?”
তামজিদের প্রশ্নে তারিন ধ্যান ফিরে পেলো। মুখে হাসি টেনে বলল,
“কই না তো।”
প্রতি উত্তরে তামজিদ মিষ্টি হাসি উপহার দিলো। তারিন কি যেনো ভাবলো কিছুক্ষণ। পরক্ষণেই ভাবুক স্বরে প্রশ্ন করল,
“মাস্টার মশাই, কিছু মনে করলে কয়েকটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি?”
তামজিদ অভয়বাক্যে শুধালো,
“অবশ্যই।”
তারিন সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করল,
“আপনি তো এখানে স্কুলের চাকরি নিয়েছেন সবে মাস খানেক হলো। তাহলে এখন আবার ঢাকা যেতে চাচ্ছেন কেন?”
তামজিদ যেন এই প্রশ্নটার অপেক্ষা করছিল। তাই সেকেন্ডের মাথায় উত্তর দিলো,
“মায়ের উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। থেরাপি দেওয়াসহ অনেক ট্রিটমেন্ট করা বাকি এখনো৷ যেটা গ্রামে থেকে সম্ভব না। বিয়েটা এইজন্যই তাড়াতাড়ি করে দেওয়া হয়েছে।”
তারিন পুনরায় প্রশ্ন করল,
“তাহলে আপনি আর চাকরি করবেন না?”
তামজিদ হাসলো। বলল,
“চাকরি করবো না কেন, বোকা? অবশ্যই করব! কিন্তু সেটা এখানে না। ঢাকা একটা কলেজে বেশ ভালো স্যালারির চাকরির অফার পেয়েছি। সেখানেই জয়েন করব গিয়ে, ইন শা আল্লাহ।”
“গ্রামে ছেড়ে যাবেন কেন, মাস্টার মশাই?”
তামজিদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বলা শুরু করল,
“শোনো, আমি ছোট থেকেই ঢাকাতে বড় হয়েছি। বাবার চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর বাবা-মা গ্রামে চলে এসেছিলো। আমাদের ঢাকা ফ্লাট আছে সেখানেই আমি, আপু আর দুলাভাই থাকতাম। দুলাভাইয়ের অফিসটা আমাদের বাসা থেকে সামনে ছিলো আর আমিও একা তাই আপু আমার সাথেই থাকতো। পড়ালেখা শেষ করে সেখানেই চাকরিতে জয়েন করার পর থেকে মা প্রতিদিন ফোন করে অনুরোধ করতো গ্রামে চলে আসার জন্য। গ্রামের প্রতি আলাদা টান ছিলো কিন্তু তবুও অত ভালো চাকরিটা ছেড়ে আসতে মন সায় দেয়নি প্রথমে। মাস খানেক আগে আমার মায়ের বোনমেরু ক্যান্সার ধরা পড়ে। অলরেডি এটা ৪স্টেজ পার হয়ে গেছে। শরীরের সমস্ত হারে ক্যান্সারের জীবাণু ছড়িয়ে গেছে। তাই মায়ের রিকোভারি করার চান্স নেই বললেই চলে। বাকিটা আল্লাহ ভরসা।”
তামজিদ এটুকু বলেই থামলো। ছেলেটার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তা তারিন ছেলেটার চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারছে। কোনো ছেলের পক্ষেই মায়ের মৃ’ত্যু রোগের ব্যাখা দেওয়া সহজ কাজ নয়। তামজিদের বুকের ভেতরটা খালি খালি লাগছে বড্ড। ভালোবাসার মানুষটাকে হারিয়েছে। এবার যাকে নিজের চাইতেও বেশি ভালোবাসে তাকে হারাতে হবে। ভাবতেই ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কিছুক্ষণ থেমে তামজিদ শান্ত বাক্যে পুনরায় বলা শুরু করল,
“চাকরি পাওয়ার কয়েকদিন পরেই দিশার ব্যাপারটা মাকে জানিয়েছিলাম৷ তখন থেকেই মা রাজি ছিলো না। তখন থেকেই দিশাকে শর্ত দিয়েছিলো। আর সাথে ভাবার জন্য সময় ও সুযোগ দুটোই দিয়েছিলো। কিন্তু দিশা দুটোর একটাও কাজে লাগাতে পারেনি। তারপর যখন মা নিজের অসুস্থতার খবর জানতে পারল, তখনি হুট করে আমার বিয়ে নিয়ে উঠে পড়ে লাগলো। বাধ্য হয়ে মায়ের ভালোর জন্য তার সাথেই গ্রামে চলে আসলাম। এতগুলো দিন দিশার জন্যই মাকে মানানোর চেষ্টায় মত্ত ছিলাম। কিন্তু সফল হয়নি আমি। না দিশা আমাকে বুঝলো আর না মা আমাকে বুঝলো। আমার দুজন ভালোবাসার মানুষের একজনও আমাকে বুঝলো না৷ অথচ দুজনেই আমাকে সত্যিকারের ভালোবাসতো।”
পুনরায় দীর্ঘশ্বাসে খেলায় মেতে উঠল তামজিদ। কষ্ট হচ্ছে বড্ড ওর। অসহায় বাক্যে আবার শুধালো,
“বিশ্বাস করো, দিশা যদি আমার মায়ের কথা মেনে নিতো আমি ওর সব আবদার পূরণ করতাম। আমার মা আর বাঁচবে কয়দিন সেটা উপরওয়ালা ছাড়া আমরা কেউ জানিনা। যদিও ডাক্তারদের ভাষ্যমতে ধরে নেই আমার মা বড়োজোর ৬মাস কি তারও কম সময় বাঁচবে। এখন তুমি আমাকে বলো এই ৬মাস জন্য কি দিশা নিজের ক্যারিয়ার স্যাক্রিফাইস করতে পারতো না? ও তো নিজের জেদ আর ইগো নিয়েই থেকে গেলো। আর তোমাদের সবার চোখে আমি ঠকবাজ, বাজে পুরুষ হয়ে গেলাম। অথচ আমার চেষ্টার কোনো কমতি ছিলো না। মা আর শখের নারী দুজনের জেদ জিতে গেলো ঠিকই মাঝ খান থেকে আমি সবটা হারিয়ে ফেললাম৷ সেটা তোমরা কেউ দেখছো না?”
তারিন চুপ করেই আছে। তামজিদের চোখে আজকে আর জল নেই। আছে শুধু না পাওয়ার হাহাকার, দহনের জ্বালা। তারিনের বুক কাঁপছে। অজানা অনুভূতিতে গা গুলিয়ে আসছে বার বার। চোখ দুটো ফেটে যেনো অশ্রুরা হামলে পড়তে চাচ্ছে। খুব করে ইচ্ছে করছে তামজিদের পাশে বসে তামজিদের কাঁধে হাত রেখে বলতে যে,
“মাস্টার মশাই, আপনি কষ্ট পাবেন না। আপনার বন্ধু আছে তো। সে আপনাকে সামলে রাখবে।”
চেষ্টা করেও বলতে পারলো না। মনের কথা মনেই রয়ে গেলো। তারিন প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে প্রশ্ন করল,
“দিশাকে আপুকে আপনার মা মেনে নেয় নি তার কারণ, দিশা আপু শহুরের স্মার্ট, চাকরিজীবী মেয়ে। আসল কথা হলো, আপনার মায়ের চাকরিজীবী মেয়ে পছন্দ না, তাই তো?”
তামজিদ ছোট করে উত্তর দিলো,
“হ্যাঁ। এটাই মূল কারণ।”
“তাহলে আমার স্বপ্ন পূরণ হবে কী করে মাস্টার মশাই?”
তারিনের কম্পিত প্রশ্নে তামজিদের টনক নড়লো। সত্যিই তো! তারিনের পড়ালেখাও তো তাহলে সে মেনে নিবে না। তারিন অসহায় চোখে তামজিদের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য আকুল হয়ে আছে। তামজিদ কিছুক্ষণ ভেবে চিন্তিত স্বরেই বলল,
“বিষয়টা জটিল করে ভাবলে জটিল। আর যদি সহজ করে ভাবি তাহলে সহজ।”
তারিন কথাটার মানে ঠিক বুঝলো না। অবুঝ স্বরে প্রশ্ন করল,
“মানে?”
তামজিদ উঠে দাঁড়াল। পুরো রুপ পায়চারি করতে করতে চিন্তিত স্বরেই বলা শুরু করল,
“মা কি বলবে আমি জানিনা। হয়তো মেনে নিতে পারে আবার নাও পারে। মা তো নিজে তোমাকে পছন্দ করেছিলো, এই কারণে হলেও মেনে নিতে পারে। কিন্তু নিশ্চিত না। মাকে জানানোর পর আমরা মাকে রাজি করানো চেষ্টা করব। বাকিটা সময়ের উপরে ছেড়ে দাও।”
তারিন চিন্তায় পড়ে গেলো। বুকের ভেতর স্বপ্ন ভাঙার ভয় জাগ্রত হচ্ছে। তারিনকে চিন্তিত দেখে তামজিদ এসে তারিনের মাথায় হাত রাখল। শান্ত বাক্যে শুধাল,
“শোনো মেয়ে, আমি তোমার পাশে আছি। আমার দেহে প্রাণ থাকতে তোমার স্বপ্ন বিফলে যেতে দিবো না, ইন শা আল্লাহ। নিশ্চিন্তে থাকো। এখন এই ছোট্ট মাথায় বেশি চাপ না নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।”
তারিন সাহস পেলো এবার৷ বাবার পড় কেউ একজন ওর মাথায় ভরসার হাত রেখেছে। সাহস দিয়েছে। আর কি চাই ওর?
দুজনেই গিয়ে সুয়ে পড়ল বিছানায়। যতক্ষণ তারিনের ঘুম না আসল ততক্ষণ তারিন একেকটা হাসির ঘটনা বলা তামজিদকে খুশি রাখার চেষ্টায় মত্ত ছিলো।
–
–
–
ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে চা খাচ্ছেন আমজাদ সাহেব। তারিন রান্না ঘরে সবার জন্য নাস্তা বানাতে ব্যস্ত। তামজিদ কমলার খোসা ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে মাকে দিচ্ছে। আর নিজের এটা ওটা গল্প বলে হাসাচ্ছে। বর্ষা বেগমের অবস্থা আগের থেকে বেশ উন্নতির দিকে। ডাক্তার কিছুটা ভরসা দিয়েছেন। তামজিদ, তারিনরা সহ উনারা সবাই ঢাকায় এসেছেন সপ্তাহ খানেক হবে। সেদিন তারিনদের বাসা থেকে আসার পরের দিনেই ওরা ঢাকায় ফিরেছেন। তারিনের সাথে এই বাড়ির সবার খুব ভালো ভাব। তামজিদের বোনের সাথে এসেও তার সখ্যতা জমেছে বেশ। তামজিদের বোন ৮মাসের প্রেগন্যান্ট। তাই ভাইয়ের বিয়েতে যেতে পারেনি। তারিনও বেশ গিন্নির মতো সংসারের কাজে হাত লাগিয়েছে। যেটা দেখে বর্ষা বেগম তারিনের প্রসংশায় পঞ্চমুখর। তারিন রান্না ঘর থেকে বাধাকপির পাকোড়া বানিয়ে এনে সবাইকে দিলো। নিজেও তামজিদের আদেশে সবার সাথে বসল পাকোড়া হাতে৷ তামজিদ পাকোড়া মুখে দিতে দিতে বর্ষা বেগমের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“আর ৩দিন পর তারিনের এস এস সি রেজাল্ট দিবে, মা।”
বর্ষা বেগমকে বেশ খুশি দেখালো। হাস্যজ্বল স্বরেই বললেন,
“বেশ ভালো খবর।”
তামজিদ সাথে তার স্বরে স্বর মিলিয়ে বলল,
“আমার তারিন মা, খুব ভালো রেজাল্ট করবে দেখে নিও।”
তারিন প্রতিউত্তরে সৌজন্যবোধক হাসি দিলো। তামজিদ এবার আগের ন্যায় বলে উঠল,
“তারিনের রেজাল্ট পাওয়ার পর আমি এখানের একটা ভালো কলেজে ওকে ভর্তি করাবো। ও পড়ালেখা করবে।”
কথাটা শোনা মাত্রই বর্ষা বেগমের মুখ অন্ধকারে ঢেকে গেলো। মুখপানে একরাশ রাগ ও আক্রোশ ফুটে উঠল। তারিন সেদিকে তাকিয়ে ভয়ে ঢোক গিলল। তার মুখপানে স্পষ্ট যে, সে কিছুতেই এটা মেনে নিবে না…
#চলবে
[ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। আপনাদের মনে অনেক প্রশ্ন জমবে। একটু ধৈর্য ধরবেন, সব প্রশ্নের উত্তর আস্তে আস্তে দিব]