#আমার_নিঠুর_মনোহর
#লেখিনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_ছয়
নিজের স্বামীর মুখে অন্য মেয়েকে ভালোবাসার কথা শুনলে যে কারোর হৃদপিন্ডে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে যাবে। সে দিক দিয়ে দেখতে গেলে তারিন বড্ড শান্ত হয়ে আছে। কোনো প্রতিক্রিয়া করছে না৷ একজন ষোড়শী কন্যার মনে এখনো ভালোবাসার নিঁখুত অনুভূতি গুলো ঠিক করে জন্ম নেয় নি৷ তাই হয়তো তারিনও আজ সবটা বুঝতে পারছে না বলেই চুপচাপ মেনে নিচ্ছে। সেদিন বুঝবে সেদিন বোধহয় তারিনের হৃদয় ও ক্ষত বিক্ষত হবে? তামজিদ নিরবতা কাটিয়ে বলে উঠল,
“বিশ্বাস করো আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম৷ তুমি বার বার আমাকে বলছো না, আমি দুটো মেয়েকে ঠকিয়েছি। কিন্তু এটা সত্যি না। একদম না সত্যি না।”
“তাহলে কোনটা সত্যি , মাস্টার মশাই?”
তারিনের পাল্টা প্রশ্নে তামজিদ থামল কিছুক্ষণ। শান্ত, শীতল অসহায় স্বরে বলে উঠল,
“কোনো সম্পর্ক বিয়ে অব্দি নিয়ে যাওয়ার জন্য দুজনের সমান ভাবে চেষ্টা করতে হয়৷ কিছু স্যাক্রিফাইস করতে হয়। দিশা আমাকে ভালোবাসে ঠিকি কিন্তু আমার জন্য স্যাক্রিফাইসটা করতে পারলো না। আমার মা দুটো শর্ত দিয়েছিলো। এক. দিশাকে গ্রামে থাকতে হবে। চাকরি করা যাবে না। দুই.নয়তো আমাকে ছাড়তে হবে। দিশা দুটোর একটাতেও রাজি হয় নি। দিশা আমাকেও ছাড়বে না। আবার মায়ের শর্তেও রাজি হবে না৷ দিশা নিজের ক্যারিয়ার নিজের মতো করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলো। আর আমার মা চেয়েছিলো ঘরোয়া বউ।”
বলেই পুনরায় থামলো তামজিদ। ওর চোখে জল স্পষ্ট। এবার তারিনের বড্ড মায়া হচ্ছে মানুষটার জন্য। না জেনেই মানুষটাকে কত খারাপ কথা বলে ফেলেছিলো। তারিন চুপ করে তামজিদের দিকে তাকিয়ে রইল। তামজিদের কণ্ঠ কিছুটা কম্পিত শুনালো এবার। কাঁপা-কাঁপি স্বরেই বলে উঠল,
“অনেক ভাবে দিশাকে বুঝিয়েছিলাম যে, মা যা বলছে মেনে নিতে৷ পরে বিয়েটা হয়ে গেলে না হয় আমি সবটা ম্যানেজ করে নিবো। কিন্তু দিশা রাজি হয়নি। বরং আমাকে বলেছি, আমার পরিবার ছেড়ে ওর কাছে চলে যেতে। এখন তুমি বলো এটা কি একজন ছেলের পক্ষে সম্ভব? যার মা মৃ’ত্যুর দুয়ারে সেই ছেলের পক্ষে মাকে ছেড়ে প্রেমিকাকে বিয়ে করে চলে যাওয়া সম্ভব?”
তারিন চুপ রইল। উত্তর দিলো না। নিরবেই কেটে গেলো কয়েক মুহূর্ত। তামজিদ আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করতেই দুই ফোটা অশ্রুকণা দু’পাশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। তারিনের কেন যেন বুকের ভেতরে চিনচিন ব্যাথা করছে। কেন হচ্ছে এমন? তারিন নিচু স্বরেই বলে উঠল,
“বাসায় যাইবেন না, মাস্টার মশাই?”
তামজিদ ছোট করে উত্তর দিলো,
“হু।”
“তাইলে চলেন যাই।”
“আর একটু বসে যাই।”
তারিন আর কিছু বলল না। আগের ন্যায় চুপ করে গেলো। দুজন কথা বলতে বলতে সামনে একটা গাছের গুড়িতে বসে পড়েছিলো। সেখানটায় এখনো দুজন পাশাপাশি বসে আছে। তারিন চারদিকে তাকিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে ব্যস্ত৷ চারদিকটা সবুজে সবুজে ভরে আছে। ভোরের আলো এবার স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। সূর্যের লাল আভা ছেয়ে আছে আকাশ জুড়ে। হালকা শীতল বাতাশ বার বার বসন্তের জানান দিচ্ছে। তারিন মনে মনে ভাবছে,
‘গ্রামের সৌন্দর্য যে একবার উপভোগ করতে শিখে যায়। তার শহরের দালান কোঠা ধূলিসাৎ লাগে’। তারিনের ভাবনার ছেদ ঘটে তামজিদের অসহায় কিছু বাক্যে। তামজিদ আনমনেই বলল,
“জানো মেয়ে, এক পাক্ষিক কিছু টিকিয়ে রাখা যায় না। এক পাক্ষিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে গেলে দেখবা, তোমার হৃদয় ক্ষত হবে। সম্পর্কের দড়ি টেনে ধরে রাখলে তোমার হাত ক্ষতবিক্ষত হবে। এক পাক্ষিক চেষ্টায় তুমি কখনো সফল হবে না। এক পাক্ষিক জবানবন্দিতে ন্যায় বিচার পাবে না৷ আবার কোনো বিষয়ে এক পাক্ষিক আগ্রহ দেখালে কষ্ট তোমাকেই পেতে হবে। এক পাক্ষিক সব কিছু ভয়ানক বিষাদে ভরপুর। বি’ষের চেয়েও বিষাক্ত।”
তারিন মানুষটার মুখের দিকেই তাকিয়ে রইল৷ কী চমৎকার ভাবে লোকটা কথা বলতে জানে! যে কেউ তার কথাটা মুগ্ধ হতে বাধ্য। লোকটার কন্ঠ স্বরে আলাদা একটা মায়া কাজ করে। তামজিদ পাশ ফিরে চোখের পানি টুকু মুছে নিলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে উঠল,
“আমি এখনো দিশাকে ভালোবাসি ঠিকই কিন্তু দিশাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইনা। এত সহজে সব কিছু ভুলে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি এত তাড়াতাড়ি সব কিছু মেনে নিতেও পারবো না। তোমাকে ভালোবাসতেও পারব না। আমার সময় লাগবে, তারিন। আমাকে একটু সময় দিবে প্লিজ?”
তারিন শান্ত বাক্যেই শুধাল,
“আপনের উপর আমার কোনো জোর নাই, মাস্টার মশাই। আপনের যত সময় লাগে নিয়েন। কিন্তু আমারে ঠকাইয়েন না।”
তামজিদ অভয়বানী দিয়ে বলে উঠল,
“একজনকে ঠকিয়েছি। তোমাকে ঠকানোর মতো পাপ করবো না। তোমার সাথে আমার সম্পর্কটা পবিত্র। এই পবিত্র সম্পর্কের অমর্যাদা আমি করব না। নিশ্চিতে থাকো, মেয়ে।”
তারিন আগের ন্যায় চুপ৷ আজকে কেনো যেনো লোকটার কথাগুলো শুনতে ভালো লাগছে৷ নিরবে শুনছে সব। শোনাই যেন ওর এক মাত্র কাজ। কারোর কথার মায়া পড়া প্রেমে পড়ার চাইতেও মারাত্নক কঠিন কাজ!
“তারিন।”
হঠাৎ তামজিদের এমন মায়াময় ডাকে তারিন কেঁপে উঠল কিছুটা। আনমনেই উত্তর দিলো,
“বলুন।”
তামজিদ আগের ন্যায় মায়াময় স্বরে বলল,
“আমার বন্ধু হবে?”
তারিন আমতা আমতা করে বলল,
“আমি?”
“হ্যাঁ, তুমি। তুমি তো আমার স্ত্রী। আর ভালো স্ত্রী হতে হলে সবার আগে স্বামীর ভালো বন্ধু হয়ে উঠতে হয়। জানো?”
তারিন এবার তামজিদের দিকে অসহায় চাহনী নিক্ষেপ করল। সে চাহনীতে স্পষ্ট জানান দিচ্ছে যে, ‘ও জানেনা’। তারিনের চাহনীপানে তাকিয়ে তামজিদ কিছুটা হাসল। তারিনের গাল টেনে বলে উঠল,
“বাচ্চা! জানতে হবেনা। আমি শিখিয়ে দিবো। ঠিক আছে?”
তারিনও এবার মিষ্টি হেসে চঞ্চল স্বরে উত্তর দিলো,
“এক্কেবারে ঠিক আছে।”
তামজিদ হেসে তারিনে মাথার চুলগুলো কিছুটা এলোমেলো করে দিয়ে বলে উঠল,
“চলো এবার বাড়ি যাই।”
তারিন ও লাফিয়ে উঠে বলল,
“আইচ্ছা! চলেন।”
বলেই সামনে এক পা দিতেই তামজিদ তারিনের হাতটা ধরে ফেলল। শান্ত বাক্যে শুধাল,
“তুমি আজকের থেকে এভাবে কথা বলবে না।”
তারিন ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
“ক্যান?”
“কারণ, আমরা দুদিন পর শহরে চলে যাবো। তখন তোমাকে আমার পরিবেশের সাথে মানিয়ে চলতে হবে। তাই এখন থেকেই এই অভ্যাসটা বদলে ফেলো।”
তারিন ও মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো। তারপর দুজনে মিলে বাড়ি ফিরে এলো। সেদিন ওদের ঘরোয়া ভাবে বৌভাত হয়েছে৷ বৌভাত শেষে সন্ধ্যার সময় নিয়ম অনুযায়ী ওরা তারিনদের বাসায় আসল। সারাদিনের ধকল শেষে যখন তামজিদ এসে তারিনের পাশে বসল। তারিন তখন গায়ের গয়না খুলতে ব্যস্ত৷ তারিনকে দেখা মাত্রই তামজিদ জিজ্ঞেস করল,
“তোমাদের রেজাল্ট দিবে কবে?”
তারিনের মুখটা তখনি চুপসে গেলো। অসহায় মুখ করে তামজিদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“গুনে গুনে আর ১০দিন পর।”
তারিনের মুখ দেখে তামজিদের হাসি পেলো। তবুও সিরিয়াস ভাব বজায় রেখে বলল,
“তুমি আমাকে বিয়ের দিন মিথ্যা বলেছিলে কেন?”
তারিন এক মুহূর্তের জন্য অবাক হলো। পরক্ষনেই চট করে বুঝে গেলো তামজিদ কিসের কথা বলেছিলো। উত্তর না দিয়ে অন্য দিকে ঘুরে বসল। তামজিদ বলল,
“এই মেয়ে, তুমি কি ভুলে গিয়েছিলে যে আমি তোমার স্কুলের শিক্ষক। তাই তুমি কেমন ছাত্রী সেটা আমি এই কয়েকদিনে অল্প হলেও বুঝেছি। সাইন্সে পড়ুয়া কোনো ছাত্রী অবশ্যই খারাপ ছাত্রী না যে সে পড়া থেকে বাঁচতে বিয়েতে রাজি হবে।”
তারিন খানিকটা লজ্জা পেলো এবার। কাল তো মুখে যা আসছে বলে গেছে। কোনো কথাই ভেবে চিন্তে বলে নি। তবে এটা সত্যি যে, তারিন নিজের স্বপ্ন নিয়ে সিরিয়াস হলেও, পড়তে ওর একটুও ভালো লাগেনা। একদিক দিয়ে সত্যিই ও বিয়েতে এইজন্যই রাজি হয়েছিলো। তারিনকে চুপ থাকতে দেখে তামজিদ পুনরায় প্রশ্ন করল,
“এইযে মেয়ে! উত্তর দিচ্ছো না কেন?”
তারিন প্রশ্ন থেকে বাঁচতে আমতা আমতা করে বলে উঠল,
“সত্যি, মাস্টার মশাই। আমার পড়তে একটুও ভালো লাগেনা।”
তামজিদের মাথা ঘুরে গেলো। যেই মেয়ে কয়েক ঘন্টা আগে নিজের স্বপ্ন নিয়ে এত সিরিয়াস ভাবে বলল। সেই মেয়ে এখন বলছে পড়তে ভালো লাগেনা! তামজিদ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলতে শুরু করল,
“শোনো মেয়ে, ডাক্তার হওয়া মুখের কথা না। ডাক্তার হতে হলে অনেক পড়তে হবে। অনেক কষ্ট করতে হবে। অনেক খাটুনি খেটে তবেই তুমি ডাক্তার হতে হবে। এবার থেকে তোমার পড়াশোনার দায়িত্ব আমি তুলে নিলাম। তোমার ভালো স্বামী হতে না পারি। কিন্তু ভালো বন্ধু হয়ে থাকবো তোমার পাশে। ভালোবাসতে না পারি। তবে তোমার সাথে সব পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করব।”
প্রথমের কথাগুলো শুনে তারিন খুশি হলেও শেষে কথা গুলো শুনে ওর মুখটা চুপসে গেলো। তার মানে কি তামজিদ ওকে কোনোদিন ভালোবাসতে পারবে না? এভাবেই শুধু মানিয়ে চলবে সারাজীবন?
#চলবে