#আমার_অবেলায়_তুমি
#সানজিদা_বিনতে_সফি
#পর্ব_৪
মাহতাব অফিসে পৌছে নিজের কেবিনে চলে গেলো। অফিসের সবাই মাহতাব কে রাগী গম্ভীর মানুষ হিসেবেই জানে। কিন্তু মাহতাবের অসম্ভব ভালো ব্যবহারের জন্য সবাই তাকে সমিহ করে চলে।
মাহতাব কেবিনে ঢুকেই ম্যানেজার কে কল করলো তার কেবিনে আসার জন্য।
ম্যানেজার নক করে ভিতরে এসে মাহতাবের সামনে এসে দাড়ালো।
— বসুন হাসিব সাহেব।
— জি স্যার।
— আমি কাল বিকেলে বিয়ে করেছি হাসিব সাহেব। হুট করেই সব হয়ে গেছে তাই কাউকে কিছু জানানো হয়নি। রিসিপশনে বড় করে আয়োজন করে সবাইকে জানাবো। আপাতত আপনি হালকা মিষ্টিমুখ করার ব্যবস্থা করুন। অফিসের সবাইকে মিষ্টিমুখ করবেন। গেটম্যান সহ সবাই যেন পায় খেয়াল রাখবেন।
হাসিব সাহেব হা করে তাকিয়ে আছে মাহতাবের দিকে। তার স্যার বিয়ে করেছে বিশ্বাসই হচ্ছে না। নিজের হতভম্বতার রেষ কাটিয়ে কোন রকম সম্মতি দিয়ে বেরিয়ে গেল।
অফিসের মধ্যে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেছে। প্রায় সবাই মাহতাবের বিয়ের কথা শুনে খুশি হয়েছে। হাতে গোনা কয়েকজন মুখ টিপে হাসাহাসি করছে। তাদের অবশ্য কেউ পাত্তা দেয়নি।
মেহরাব হসপিটালে এসে ড.কানিজ ফাতেমা কে নিয়ে মধুর কেবিনে গেল। লামিয়া আগেই চলে এসেছে। মধু আর ময়না বেগম তখন গল্প করছিল। আসলে ময়না বেগম একাই কথা বলছিল মধু চুপচাপ শুনছিল। ময়না বেগমের পরিবারের নারী নক্ষত্র সব বর্ণনা করা শেষ।এমনকি মাহতাবের প্রাক্তন প্রেমিকার কথাও বাদ রাখেনি। তার মতে সব কিছু শুরুতেই জেনে রাখা ভালো। পরে অন্য কারো থেকে জানলে সংসারে অশান্তি হবে। মধুর অবশ্য মাহতাবের প্রাক্তনের কথা শুনে খারাপ লাগেনি। বরং মাহতাব এতো বছর তাকে মনে রেখে যে কষ্ট পেয়েছে তার জন্য খারাপ লেগেছে।
মধুকে চেকআপ করা শেষে ডক্টর চলে গেলো। আপাতত মধু ঠিক আছে।কাল সকালে বাসায় নিয়ে যেতে পারবে। কিছুদিন ফুল রেস্টে থাকতে হবে।
লামিয়া আসতেই ময়না বেগম তাকে আপেল কে*টে দিলেন। পাশে বসিয়ে কুলসুম বেগম কি করছে,তাকে ধমক টমক দিয়েছে কিনা সেই খবরাখবর নিচ্ছে। তার ভাষ্যমতে তার ভাই দুটো আহাম্মক। বউদের হয়ে কথা বলতে গেলে তাদের জ্বিব্বায় জ্যাম লেগে যায়। আর বড় আহাম্মক টা তো যখন তখন গিরগিটির মতো রঙ বদলায়। আস্তো বেয়াদব!
লামিয়া শব্দ করে হাসছে। মেহরাব কয়েকবার চোখ রাঙিয়ে তাকিয়েছে। সেদিকে সে মোটেও পাত্তা দিচ্ছে না। মেহরাব কে জব্দ হতে দেখে তার মজা লাগছে।
— রাতে আমাদের মধ্যে কি কথা হয়েছিল লামু? মনে আছে তো?
লামিয়ার মুখ শুকিয়ে গেল। কাল একটু মুখ টিপে হাসার জন্য মেহরাব তাকে শাস্তি দিয়েছে। বুড়ো বয়সে এসে লোকটার মাথা খারাপ হয়েছে। সেজন্যই ঘুম থেকে উঠতে এতো দেড়ি হয়েছে। লামিয়া মেহরাবের দিকে তাকিয়ে মুখ বাকিয়ে চুপ করে রইলো।
— তুই ওকে চোখ রাঙ্গাচ্ছিস কেন বেয়াদব! তোর চোখ খুলে আমি জাদুঘরে রেখে আসবো।
— তুমি ভুল বুঝছো আপা!
মেহরাবের অসহায় কন্ঠে মোটেও দমে গেল না ময়না বেগম। গমগমে গলায় বলল,
— আমার চুল বাতাসে পাকেনি। হাড়ে মজ্জায় শয়তানি তোদের। লামিয়া কে জ্বালালে আমি ওকে আবার বিয়ে দিয়ে দিবো। ঘটক আমার হাতেই আছে।
লামিয়া আবার ফিক করে হেসে দিলো। মেহরাব হার মেনে মুখ কালো করে বেড়িয়ে গেলো। বোন টা যে কার মতো হয়েছে কে জানে?সারাক্ষণ তাদের পিছনে লেগেই থাকে।
মধু হাসি মুখে ভাই বোনের খুনশুটি দেখছিল। ভাই আর ভাইয়ের বউয়ের প্রতি এতো ভালবাসা দেখে ওর মনটা ভালো হয়ে গেলো। এরকম একটা পরিবার তো ওর স্বপ্ন ছিল। কতো রাত সেই স্বপ্নে বিভোর থেকেছে সে৷ এবার বুঝি তার স্বপ্ন পুরোন হলো!
— তুমি শুয়ে থাকো মধু। বসে থাকতে খারাপ লাগবে তো।
ময়না বেগমের আদুরে গলা শুনে চোখ ভিজে গেল মধুর। চোখের কোণে পানি নিয়ে ধরা গলায় বলল,
— এতো আদুরে গলায় ডাকবেন না আপা। আমার অভ্যাস নেই। এতো আদুরে ডাক শুনলে বুক ধরফর করে৷ কোথাও একটা চিনচিনে ব্যথা হয়,কান্না আসে। আমাকে একটু কম কম আদর করুন। আস্তে আস্তে আমি বেশি ভালোবাসা পাওয়ার অভ্যাস করে নিবো।
ময়না বেগম মধুকে তৎক্ষনাৎ বুকে টেনে নিয়েছে। লামিয়া ও পাশ থেকে জরিয়ে রেখেছে। ময়না বেগম মধুর মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত গলায় বলল,
— এখন থেকেই অভ্যস্ত হয়ে যা। তুই নিজেও জানিস না তুই আমাদের কে।আমাদের কলিজার একটা অংশের ভালো থাকার কারণ তুই। তোকে আমরা এখনো সিন্দুকে ভরে রাখিনি এই তো ঢের। অমূল্য রত্নের থেকেও বেশি মূল্যবান রত্ন তুই আমাদের। আমার ভাই টাকে একটু ভালোবেসে আগলে রাখিস তাহলেই হবে। তোর নিজের জন্য ভালোবাসার চিন্তা করতে হবে না। ভালোবাসার সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে তুই।যত পারিস নিয়ে নিবি। মাহতাব তোকে বুকে ভরে রাখবে। শুধু একটু সময় দে।
লামিয়া, মধু, ময়না বেগম সবার চোখেই পানি। পরিবার টা এবার বুঝি সম্পুর্ন হলো।
হসপিটাল থেকে বেরিয়ে মেহরাব সরাসরি মাহতাবের অফিসে এসেছে। ভাইয়ের কাজে সাহায্য করলে ভাই তারাতাড়ি ভাবির কাছে যেতে পারবে। মাহরাবের কেবিনে ঢুকে অবাক হয়ে গেলো সে। পুরো কেবিন জুড়ে ফুলের ছড়াছড়ি৷ মেহরাব হেসে বললো,
— এগুলো কে দিলো ভাই?
— অফিসের সবাই নতুন জীবনের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছে। (হালকা হেসে)
— তুমি সবাইকে বলে দিয়েছো?(অবাক হয়ে)
— অন্যকারো থেকে শুনে আমাকে নিয়ে গসিপ হবে এটা আমার পছন্দ নয়। (গম্ভীর গলায়)
মেহরাব মাথা নাড়লো।
— তোমার মিটিং ছিল মনে হয়? আমাকে বুঝিয়ে দাও,আমি মিটিং সামলে নিবো।
— আমাকে থাকতে হবে।
মেহরাব আর কিছু বললো না। ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হুট করেই বলল,
— তুমি খুশি তো ভাই?
মাহতাব শান্ত চোখে তাকালো। ল্যাপটপ থেকে হাত সরিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো। চোখ থেকে চশমা টা খুলে শান্ত গলায় বলল,
— বাবা যখন মা*রা গেলো তখন আপা সবে স্বামী হারিয়ে আমাদের বাসায় এসেছে। তুই টেনে আর আমি অনার্সের ছাত্র। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারি মানুষটা যখন আমাদের ছেড়ে চলে গেলো তখন আমাদের অবস্থা অনেকটা মধুর মতো হয়েছিল। ছেলে সহ আপাও তার শ্বশুর বাড়িতে অত্যাচারিত হয়েছে। আপার শ্বাশুড়ি তাকে ঠিকমতো খেতে দিতো না। একবার গরম ভাতের প্লেট আপার গায়ে ছুড়ে মারে। আপার গলা সহ কাধের অনেকটা পু*ড়ে গিয়েছিল সেদিন। তারপর আপাকে বাবা গিয়ে নিয়ে আসে আমাদের বাড়ি।আদরের মেয়ের এই অবস্থা দেখে সহ্য করতে পারেনি বাবা।একদিন স্ট্রোক করে বসে। আর আমাদের ছেড়ে চলে যায়৷ মা শোক সামলাতে পারলেও আপা খুব ভেঙে পরে। বাবার একাউন্টে বেশি টাকা ছিল না। আমাদের বাড়িটা তখন নতুন করা হয়েছে। পাচ তলা বাড়িটা করতে বাবার প্রায় সব টাকাই খরচ হয়ে গিয়েছিল। বাসা ভারার টাকা দিয়েই আমাদের সমস্ত খরচ চলতো। ঠিক সেই মুহুর্তে সাহিদা আমাকে ছেড়ে গেল। কারোর অসহায় চোখের আকুতি আমি বুঝি মেহরাব। আমি মধুর মাঝে আমার আপার অসহায় মুখটা দেখেছি। আমি ওর আকুতি ভরা চোখে পুরনো আমাকে দেখেছি। আমাদের কষ্টের সময় পার হয়ে গেছে। এখন আল্লাহর রহমতে আমরা সুখে আছি। সেই সুখের অংশ নাহয় মধুও হলো।
— তাকে মেনে নিবে না?
— ভালোবাসা টা একদিনে হয়না মেহরাব। এখন আর আবেগে ভেসে যাওয়ার বয়স নেই আমার যে হুট করেই ভালোবাসা হয়ে যাবে। তার জন্য সময় দরকার। দুজনের মেনে নেয়া, মানিয়ে নেয়ার একটা ব্যপার আছে। আমি আমার সমস্তটা দিয়ে চেষ্টা করবো। এতটুকু বলতে পারি,সাহিদার জন্য এখন আর কোন অনুভূতি নেই৷ সে তার মতো সুখে থাক। আমিও নাহয় আমার ভালো থাকা খুজে নিবো।
মেহরাব মুচকি হাসলো। ভাই কে নিয়ে তার চিন্তা নেই। সে কখনো অবিবেচকের কাজ করে না। তাদের আজকের এই অবস্থান তার ভাইয়ের জন্যই। তাকে ডাক্তার বানানোর সমস্ত অবদান তার ভাইয়ের। বট গাছের মতো তাদের ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
মাহতাব হসপিটালে পৌছালো বিকেল পাচ টায়। ময়না বেগম তখনো মধুর পাশে বসে। লামিয়া হাজার বলেও তাকে বাসায় পাঠাতে পারে নি। মাহতাব এসে ময়না বেগম কে এক হাতে জরিয়ে ধরে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। ময়না বেগম ভাইয়ের ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলতে পারলো না। তাকে গাড়ি তে তুলে দিয়ে ড্রাইভার কে সাবধানে গাড়ি চালাতে বলে আবার হসপিটালে চলে এলো সে। লামিয়া তাকে দেখে বেরিয়ে গেল।
মাহতাব মধুর সামনে বসে শান্ত গলায় বলল,
— এখন কেমন আছো? ব্যথা কমেছে?
মধু ইতস্ততভাবে বলল,
— জি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।
— কাল বাসায় নিয়ে যাবো।তোমার মা সহ সবাই থানায় আছে। শুধু তোমার সৎ ভাই জয় বাইরে। তোমার এতে কোন সমস্যা আছে?
মধুর কিছুটা খারাপ লাগলো। তবুও মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো। মাহতাব তার জন্যই তো এতো কিছু করেছে। কিছু বলে তাকে ছোট করার মানেই হয় না। তাছাড়া তাদের শাস্তি হওয়া দরকার।
— দেখো মধু,আমি কিছু কথা তোমাকে সরাসরি বলতে চাই। আমার বয়স বর্তমানে ৩৮ বছর।আর তোমার বাইশ। আমাকে মেনে নিতে তোমার সমস্যা হতেই পারে। তাই তোমার যত সমস্যা আমাকে বলবে। আমি সাধ্য মতো চেষ্টা করবো সমাধান করার। তবে কখনো বিচ্ছেদ পাবেনা। বোঝ ই তো,বুড়ো বয়সে তো আর বউ পাবো না। তাই তুমিই সম্বল।
মধু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে মাহতাবের দিকে। মাহতাব কথা শেষ করে ওয়াশরুমে ঢুকে গেছে ফ্রেশ হতে।
চলবে,,,
(আহ লোডশেডিং! রাতে দিনে সমান।)