#আমার_অবেলায়_তুমি
#সানজিদা_বিনতে_সফি(সাথী)
#পর্ব_ ১৩
ইব্রাহিম বাড়ির পরিবেশ আজ সকাল থেকেই থমথমে। সব সময় শান্ত থাকা মাহতাব আজ সিংহকে মতো হিংস্র চোখে মেহরাবের দিকে তাকিয়ে আছে। মেহরাব স্তব্ধ হয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। কি থেকে কি হয়ে গেলো কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না। লামিয়া! লামিয়া তাকে ছেড়ে গেছে! এই মেয়েটা তো তাকে ছাড়া একরাত থাকতে পারে না। তাহলে আজ কিভাবে তাকে ছেড়ে গেলো! এখন রাতে সে কিভাবে ঘুমাবে? মেহরাবের বাহুতে মাথা না রাখলে ত তার ঘুম হয় না। ইসস,কাল সারা রাত মেয়েটা হয়তো ছটফট করেছে। এখন নিশ্চয়ই মাথা ব্যাথায় অস্থির হয়ে এদিক সেদিক পায়চারি করছে। লামিয়া ঠিক আছে তো! কার বাসায় গেলো? মামার বাড়িঘর তো যায়নি। তাহলে?
— কি করেছিস তুই মেহরাব? মেয়েটা বাড়ি ছাড়ল কেন? সত্যি করে বল।
ময়না বেগম সহ বাসার সবাই কেপে উঠলো। মধু এক কোণে দাঁড়িয়ে ফুপিয়ে কাদছে। মাহতাব আর তার বিয়ের এক মাস পার হয়েছে সবে। কিন্তু এ বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষের সাথে যেন তার হাজার বছরের সম্পর্ক।
মাহতাবের হুংকারে মেহরাব মাথাটা হালকা উঁচু করলো। টলমলে চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে চাইলো সে। কিন্তু ঠোঁট দুটো আলাদা করতে পারলো না। কয়েকবার কেপে উঠলেও মুখ থেকে কোন শব্দ বের হলো না মেহরাবের। নিদারুণ অসহায় চোখে তাকিয়ে শুধু নিজের মাথা নাড়িয়ে বলল সে কিছুই জানে না।
কুলসুম বেগম এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার কিছুটা অস্বস্তি নিয়েই বলল,
— আমার মনে হয় লামিয়া অন্য কারো সাথে,,,
–মাআআআ!!
বাকি কথা আর মুখ থেকে বের কররে পারল না সে। তিন ছেলেমেয়ে এক সাথে গর্জে উঠলো। সারাজীবনে যা কখনো হয়নি আজ তা হলো। মায়ের উপর গলা উচু করলো তারা। মাহতাব বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। তার মা এমন কথাও বলতে পারে! কুলসুম বেগম ছেলেমেয়ের চোখের দিকে তাকানোর সাহস করলেন না। কিন্তু গত কয়েকটা দিন লামিয়া সব কিছুতেই কেমন উদাসীন ছিল। ঘনঘন ফোন আসত। ফোনে কথা বললেই লামিয়ার মুখটা বিষন্নতায় ঢেকে যেতো। কুলসুম বেগম অনেকবার বিষয়টি খেয়াল করেছেন। কয়েকবার লামিয়ার সাথে কথা বলতে গিয়েও নিজেকে থামিয়ে দিয়েছে। তিনি ভেবেছেন স্বামী স্ত্রীর মান অভিমান চলছে হয়তো। তাই আর আগ বাড়িয়ে কিছু বলেননি। কিন্তু এখন আফসোস হচ্ছে। জিজ্ঞেস করলে অন্তত নিজের মনকে শান্তনা দেয়া যেতো।
— তুমি এমন কথা কিভাবে বললে মা! লামিয়া কে তো আর আজ নতুন দেখছো না। তাহলে? মাঝে মাঝে তো আঙ্গুল নিজের ছেলের দিকে ও একটু তুলতে পারো। সে তো আর জমজমের পবিত্র পানি নয়। ছেলের কাছেও জিজ্ঞেস করো তার কারো সাথে পরকীয়া চলছে কি না?
ময়না বেগমের এমন কথায় সবাই অবাক চোখে মেহরাবের দিকে তাকালো। মেহরাব নিজেও অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে তার আপার দিকে। পরকীয়া! সে কি এতটাই জঘন্য? বউ রেখে বাইরে পরকীয়া করবে?
— এসব কি বলছো আপা? আমাকে নিয়ে এমন কথা কিভাবে বলতে পারলে!তুমি তোমার ভাইকে চেনো না? আমি কেন এমন করবো? ভাইয়া!! তুমি কেন চুপ করে আছো? আরে আমি ভালোবাসি আমার বউ কে। অন্য মেয়ের কথা কোনদিন চিন্তাও করিনি। আল্লাহর দোহায় লাগে, আমাকে এতটা নিচ ভেবো না।
মেহরাব নিজের শান্ত খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। চিন্তায়, অস্থিরতায় ক্রমশ হাইপার হয়ে উঠছে। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আটকে আটকে আসছে তার।তার পরিবার,যেখানে সে জন্ম থেকে বড় হয়েছে। যাদের সাথে তার জীবনের ৩৪ বছর কেটেছে।তারাই তাকে অবিশ্বাস করছে! এতো বড় একটা অভিযোগ তার বিরুদ্ধে নিরদ্বিধায় করে ফেললো!
মেহরাব হাত পা ছড়িয়ে আবার ফ্লোরে বসে পরলো। মাহতাব উঠে গিয়ে মেহরাব কে শান্ত করার চেষ্টা করছে। মেহরাব এতোটাই উত্তেজিত হয়ে গেছে যে,যে কোন সময় প্যানিক এট্যাক হয়ে যেতে পারে।
— নিজেকে সামলা মেহরাব। তোরা কেউ-ই আমাদের কাছে ফেলনা নয়৷ ভুল তুই করেছিস। লামিয়া কে অনবরত ইগনোর করেছিস। সব কিছুই আমার চোখে ধরা পরে মেহরাব। বাড়ির অভিভাবক আমি। চোখ কান বন্ধ করে তো আর রাখতে পারি না।
— আ আমি ক কি করেছি ভাই? আল্লাহর দোহায় লাগে আমাকে বলো আমি কি করেছি? সবাই কেন আমার দিকে আঙ্গুল তুলছে? লামিয়া কেন আমাকে ছেড়ে চলে গেছে ভাই আমাকে বলো প্লিজ। আমি আর এসব নিতে পারছি না।
মেহরাবের বেদনায় নীল হয়ে যাওয়া মুখের পানে তাকিয়ে মাহতাব আর কিছু বলতে পারলো না। সে তার ভাইকে চিনে। তার ভাই এমন কিছু করতে পারে না।
এরকম ভয়ংকর পরিস্থিতিতেই বাসার কলিং বেল বেজে উঠলো। রহিমা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। সবাই ভেবেছে হয়তো লামিয়া এসেছে। সবাই কে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে বাসায় প্রবেশ করলো এক অচেনা মেয়ে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা প্রেগন্যান্ট। মেহরাব উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল দরজার দিকে। কাঙ্ক্ষিত মুখ না দেখে চোখ নামিয়েঅপি ফেললো সে। লামিয়া ছাড়া এখন আর কোন কিছুতেই তার আগ্রহ নেই। রাত দুটো থেকে সকাল আট টা পর্যন্ত পরিচিত সব জায়গায় পাগলের মতো খুজেছে লামিয়া কে। মাহতাব ও তার সাথেই ছিল। সব তো ঠিক ছিল। তাহলে হঠাৎ কি এমন হলো যে লামিয়ার চলে যেতে হলো।
অপরিচিত মুখটা দেখেই সবার মুখ আগের চেয়ে বেশি থমথমে হয়ে গেলো। মাহতাব ছাড়া বাকি সবাই মুখ কুচকে তাকিয়ে আছে। মাহতাব মেহরাবকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাড়ালো। মধু একপাশে চুপ করে দাড়িয়ে আছে। মেয়েটাকে তার একদম ভালো লাগেনি। কাল বিকেলে ও এই মেয়ে বাসায় এসেছিল। বাকিরা যে যার রুমে ঘুমাচ্ছিল। একমাত্র সে আর জরি কিচেনে বিকেলের নাস্তা বানানোর কাজে ব্যস্ত ছিল। এই মেয়েই তো কাল লামিয়ার সাথে দেখা করেছে৷ তার পর থেকেই লামিয়া সারা টা সময় কেমন মনমরা হয়ে ছিল।
— ভিতরে এসো এলিজা। তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
এলিজা ধীর পায়ে এসে ড্রয়িং রুমে এসে দাড়ালো। মাহট্যাব ইশারায় বসতে বলল তাকে। ময়না বেগমের পাশের সোফায় গিয়ে চুপচাপ বসে পরলো সে।
— মধু,,এলিজার জন্য পানি নিয়ে এসো।
— জি।
মধু কিচেনে চলে যেতেই মাহতাব সিঙ্গেল সোফায় বসে শান্ত চোখে তাকালো এলিজার দিকে। চোখ ঘুড়িয়ে একবার মেহরাবের নির্জীব মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
— কাল এ বাসায় কেন এসেছিলে?
এলিজার বুক অস্বাভাবিক ভাবে কাপছে। এসির নিচেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। মাহতাব শান্ত হয়ে থাকলেও তার ভয়ে এলিজার কলিজা শুকিয়ে গেছে। মাহতাব কে সে মৃত্যুর মতো ভয় পায়। মেহরাবের মুখের অবস্থা দেখে সে বুঝে গেছে বাসায় কি হয়েছে। কাপা কাপা হাতে কপালের ঘাম মুছে জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো। মধু ততক্ষণে তার সামনে পানি এনে রেখেছে।
— পানি খেয়ে দ্রুত জবাব দাও এলিজা। বিষয় যখন আমার পরিবার নিয়ে তখন একচুল ছাড় পাবে না।
মাহতাবের শক্ত গলা শুনে তারাতাড়ি পানির গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে ফেললো এলিজা। মেহরাব উঠে এসে অবাক গলায় বলল,
— তুই কাল আমাদের বাসায় এসেছিলি! কই,আমাকে তো কিছু বলিস নি!
— বলবে কেন। নিজের কুকীর্তির কথা কে ঢোল পিটিয়ে বলে।
— কি বলছো ভাইয়া? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। প্লিজ একটু খুলে বলবে?
— এসব ভালো লাগছে না মাহতাব। ঠিক করে বল কি করেছে এই মেয়ে?
সবার আগুন দৃষ্টি মুহুর্তেই এলিজা কে জ্বা*লিয়ে দিবে যেন।ময়না বেগম তো পারলে এখনই দু ঘা লাগিয়ে দেয়। মাহতাব মধু কে ইশারা করলো ময়না বেগমের কাছে যেতে। কখন মে*রে দেয় বলা যায় না।
মধু ময়না বেগমের পাশে গিয়ে বসলো। তার একহাত নিজের হাতে নিয়ে তাকে আস্বস্ত করলো। কুলসুম বেগম মুখ কুচকে রেখেছে। সব কিছু বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে তার।
এলিজার নিরবতা দেখে মাহতাব ঠান্ডা গলায় হু*মকি দিয়ে বলল,
— দেখো মেয়ে,বেশি কথা আর ন্যাকামি আমার একদম পছন্দ নয়। মুখ খুলে সত্যি টা বলো। নাহলে আমি এক্ষুনি থানায় কল করবো। লামিয়া কে কি*ডন্যাপ করার অপরাধে জেলে পচে ম*রতে হবে। আর আমি এটা নিশ্চিত করবো, তুমি যাতে কোন ভাবেই ছাড়া না পাও।
মেহরাব শুধু অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। কি হচ্ছে কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না।
— আ আমি লা লামিয়া কে ব বলেছি আমার পেটে মেহরাবের বাচ্চা। সে লামিয়া কে আর চায় না। তাই আমার সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।
মেহরাব ধপ করে বসে পরলো। ময়না বেগম ফুসে উঠেছে। মধুর হাত একঝটকায় ছাড়িয়ে কষিয়ে চর লাগিয়েছে এলিজার গালে। মাহতাব ময়না বেগম কে ছাড়িয়ে নিয়েছে সাথে সাথে। এই মেয়েকে সে ছাড়বে না। তার পরিবার ভাঙ্গার চেষ্টা করে কতবড় ভুল করেছে তা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়াবে তাকে।
— আহ আপা! তোমার লেগে যাবে তো। এভাবে কেউ হাইপার হয়? এসে চুপ করে বসো।
মধু হা করে তাকিয়ে আছে ভাই বোনের দিকে। দুই টনের থাপ্পড় লাগিয়েছে এলিজা কে অথচ ভাই বলছে তার বোনের নাকি লেগে যাবে! কি আশ্চর্য!!
— কাল থেকে এক কেজি চালের ভাত খাবে প্রতিদিন। এমন দুর্বল বউ আমার পছন্দ নয়।
মাহতাবের কথা শুনে মধু মুখ কালো করে ফেললো। আপার এতো শক্তি যে কই থেকে আসে কে জানে। এখন এখানে তার কি দোষ?
চলবে,,
(আলহামদুলিল্লাহ আমি কিছুটা সুস্থ। এখন থেকে আগের মতো গল্প পাবেন ইনশাআল্লাহ। আর সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন। সময়ের অভাবে রিচেক করা হয় নি। ভুল গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)