আমার_অবেলায়_তুমি
সানজিদা_বিনতে_সফি(সাথী)
পর্ব_৯
দুপুরের খাবার সবাই খুব আয়েশ করেই খেয়েছে। কুলসুম বেগম সহ সবাই খাবারের খুব প্রশংসা করেছে। ব্যাতিক্রম ছিল মাহতাব। সে কুলসুম বেগম কে খাইয়ে দিয়ে পরে নিজে খেয়েছে। “রান্না খুবই ভালো হয়েছে। ধন্যবাদ মধু।” তার প্রশংসার ঝুলি এখানেই শেষ। মধুর তাতে মোটেও মন খারাপ হয়নি। মাহতাব কে প্রতিদিনের তুলনায় বেশি খেতে দেখে তার মন এমনিতেই প্রফুল্ল হয়ে গেছে।
রুমের ঘটনার পর থেকে মধু যতটুকু পেরেছে মাহতাব থেকে দূরে দূরে থেকেছে। একবার ও তার সাথে চোখাচোখি হয়নি।
মানুষটার সামনে গেলেই লজ্জায় তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।
খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই যখন নিজের রুমে চলে গেলো তখন বাধ্য হয়ে মধুরও রুমের দিকে পা বাড়াতে হলো। মাহতাব এখনো রুমেই আছে। আজ ফ্যাক্টরি তে যাবে সে।তাই বাসা থেকে।একটু লেট করেই বেরুবে।
মধু দরজার সামনে কিছুক্ষণ কাচুমাচু করে দাড়িয়ে রইলো। লোকটা আবার তাকে কিভাবে লজ্জায় ফেলবে কে জানে!
মাহতাব বুঝতে পারলো মধু বাইরে দাড়িয়ে আছে।
— ভিতরে এসো মধু।
মধু হচকচিয়ে গেলো। থম মেরে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে ধীর পায়ে রুমে ঢুকলো। মাহতাব সোফায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছে। মধুর উপস্তিতি টের পেয়ে ল্যাপটপ বন্ধ করে মাথার পিছনে হাত গুজে গা এলিয়ে বসলো। দৃষ্টি মধুতে স্থির। মধু ভরকে গেল। আচল টেনে আড়ষ্ট হয়ে খাটের পাশে দাড়িয়ে রইলো। মাহতাব চোখের পলক ফেলছে না। চশমার ভিতরে চোখ গুলো একদৃষ্টিতে মধুকে অবলোকন করছে। মধু ঘামতে লাগলো। কাপা কাপা হাতে কপালের ঘাম মুছে আড়চোখে মাহতাব কে দেখলো। আল্লাহ! এখনো তাকিয়ে! লোকটা এমন নষ্ট চোখে তাকিয়ে আছে কেন! এতো ভদ্র মানুষের এমন একটা রুপ কেউ বিশ্বাস করবে? সে কি কাউকে গিয়ে বলবে এ কথা? সবাই পাগল ভাববে না তো?
নিজের মনে তালগোল পাকিয়ে ফেললো মধু। মাহতাব এখনো মধুকে দেখছে। মধুর দিকে চোখ রেখেই এসির টেম্পারেচার কমিয়ে দিলো। মধুর বুক কাপছে। হৃদপিণ্ড লাফিয়ে বাইরে চলে এলে বিপদ।
–এ এভাবে ক কি দেখছেন?
— তোমাকে।
মাহতাবের সোজা সাপ্টা জবাব। মধু আবার ভড়কালো। এর পরিবর্তে কি বলা উচিত খোজায় ব্যস্ত হলো। হাজার ভার খুজেও তার শব্দ ভান্ডার খালি। মাহতাব এবার নড়েচড়ে বসলো। চোখের উপর থেকে চশমা টা খুলে দুই হাটুতে ভর দিয়ে বসে বলল,
— অনেকবছর এভাবে মুগ্ধ হয়ে কাউকে দেখা হয়না। তাই দেখছিলাম৷ আপত্তি আছে?
মধু অস্থির চোখে তাকালো। তার অস্থির লাগছে। অস্বস্তি ও হচ্ছে খুব। কিন্তু কিভাবে বলবে। এইজে এখনো কিভাবে তাকিয়ে আছে! সে কিভাবে বলবে আমার আপত্তি আছে। ঘোর আপত্তি আছে।আপনি এভাবে নষ্ট মন নিয়ে আমার দিকে তাকাবেন না। কিন্তু বলতে পারলো না। এভাবে জিজ্ঞেস করলে কি বলা যায়?
— উহু।
মাহতাব হাসলো। মধুর চোখের আড়ালে হালকা করে ঠোঁট বাকালো। মধু মাথা নিচু করে দাড়িয়ে।
— আমার পাশে এসে বসো মধু৷ তোমার সাথে খোলাখুলি কিছু কথা বলি।
মধু ধীর পায়ে গিয়ে মাহতাবের থেকে যথেষ্ট দূরত্ব রেখে বসলো। মাহতাব হাত বাড়িয়ে মধুর একটা হাত নিজের হাতে নিলো। মধুর কাপা কাপা হাতে নিজের অপর হাতটি রেখে মুখোমুখি হয়ে বসে ধীর গলায় বলল,
— আমি কথা গুলো আগেই বলতে চেয়েছিলাম মধু। সময় টা সঠিক ছিল না এই কথা গুলো বলার।
(কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে)বাবা মারা যাওয়ার আগে বাস্তবতা সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল শূন্য। বাবারা এরকমই হয় মনে হয়। সমস্ত ঝড় ঝাপ্টা নিজের মধ্যে রেখে আমাদের উপর বটগাছের মতো দাড়িয়ে থাকে। আমার বটগাছের ছায়া যখন আমার উপর থেকে সরে গেল তখন আমি বাইরের উত্তাপ বুঝতে পারলাম। আমার এতো নাম ডাক একদিনে হয়নি। এসব কিছুর পেছনে আমার অক্লান্ত শ্রম আর জীবনের অনেকটা সময় দিতে হয়েছে। আমার তকদিরে ছিল তাই আমি সফল হয়েছি। অনেকে শ্রম দিয়েও সফল হয়না। আমি হয়েছি। আমার সব কিছু আমার পরিবার। তুমি এখন আমার পরিবারের একজন। আমার নিজের একটা অংশ তুমি। তাই তোমার কাছে আমার আবদার, আমার মা আর বোনের উপর কখনো রাগ করো না।তাদের বয়স হয়েছে। বাচ্চাদের মতো আচরণ করে মাঝে মাঝে।এমনিতে তারা কেউ খারাপ নয়।মানুষ হিসেবে তারা খুবই ভালো। তবে কোন মানুষই একেবারে পারর্ফেক্ট হয় না। তারাও নয়। একসাথে থাকতে গেলে নোকঝোক হয়ে গেলে সামলে নিয়। আশা করি কখনো বাড়াবাড়ি কিছু হবে না। যদি হয় তাহলে মনে রাখবে, তাদের জবাব জন্য আমি তোমার মুখ হয়ে যাব। সব কিছু আমি সামলে নিবো।এতটুকু বলতে পারি,তোমার উপর কখনো অবিচার করা হবে না। আম্মা, আপা বায়না করলে মনে করবে আমাদের বাসায় দুটো ছোট বাচ্চা আছে। তারাই তোমার কাছে আবদার করছে। তাদের বাচ্চাদের মতো সামলে নিবে। এইযে এত টাকা, নাম, পতিপত্তি দেখছ। এসব কিছুই আমার সম্পদ নয়। আমার সম্পদ আমার পরিবার,তোমরা। তোমরা ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকবো। কখনো মনে কোন অভিযোগ আসলে আমাকে বলবে। আমি তোমার অভিযোগের ডাকবাক্স হয়ে যাবো। তোমার সমস্ত অভিযোগ নিজের ভিতর নিয়ে নিবো। আমার পরিবারটা কে আগলে রেখো। তোমাকে আগলে রাখার দায়িত্ব আমার।
মধু মন্ত্রমুগ্ধের মতো মাহতাবের কথা শুনছিল। মন থেকে মাহতাবের জন্য অনুভূতি ঠিকরে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। মানুষ টার জন্য সম্মান অনেকটা বেড়ে গিয়েছে তার মনে। মাহতাব এখনো তার হাত ধরে বসে।মধুর অস্বস্তি হচ্ছে না। এ স্পর্শ অতি পবিত্র। তার স্বামীর।
— আমি মনে রাখবো। আপনাকে নিরাশ করবো না।ভরসা করেই দেখুন না।
— আমি তোমায় ভরসা করি মধু।
এই কয়েকটা বাক্যে মধুর চোখে আবার পানি এলো। ছলছল চোখে মাহরাবের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।
মাহতাব চট করে মধুর হাত ছেড়ে দিল। ইদানীং তার কি হয়েছে সে নিজেই জানে না। এই পুচকে মেয়েটাকে দেখলেই অনুভূতিরা ঠেলে বেরিয়ে আসে। মধুকে সে মন থেকেই মেনে নিয়েছে। মধুর জন্য ভাললাগা ও আছে। সেটা এক-দুই দিনের না। অনেক পুরোনো। প্রথম দিনের মধুর সেই অসহায় চোখ মাহতাবের কয়েকরাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। মধুর সমস্ত খোজ খবর নিয়েছিল মাহতাব। মধুর অবস্থার কথা জেনে খারাপ লেগেছে খুব। তবে নিজের বয়সের কথা বিবেচনা করে সামনে আগাতে ইচ্ছে হয়নি। এখন সেই মেয়েটাই তার স্ত্রী। তার পাশেই বসে রয়েছে। মাহতাব কিছু একটা চিন্তা করে বলল,
— আমাকে তোমার মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে মধু?
— আল্লাহ! এসব কি বলছেন? আমাকে নিয়ে মনের মধ্যে এমন দ্বিধা আনবেন না দয়া করে। আমার সৌভাগ্য আমি আপনাকে স্বামী হিসেবে পেয়েছি। এসব ভেবে আমাকে অপরাধী করবেন না।
— তার মানে তুমি আমাকে মেনে নিয়েছো?
মধু ভরকে গেল। আবার সেই বেহায়া দৃষ্টি! লোকটা এভাবে তাকায় কেন? চোখ দিয়েই তাকে ভয়।দেখাচ্ছে। মধু হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে মাহতাবের কথার মানে। এভাবে চলতে থাকলে সে হার্ট*ফেল করে মা*রা যাবে।
— এভাবে তাকাবেন না। আমার কেমন যেন লাগে।(মিনমিন করে)
মাহতাব ভিতরের হাসিটুকু বাইরে আনলো না। অসম্ভব কিউট তার বউ৷ বুড়ো না হলে কয়েকদফা দুষ্টুমি করে ফেলতো সে।এই বয়সে এসব করলে নিজের কাছেই অস্বস্তি লাগবে তাই কিছু বলল না। কিছুক্ষণ চুপ থাকলেও নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে পারলো না মাহতাব। একরোখা দৃষ্টিতে মধুকে দেখে শান্ত গলায় বলল,
— কেমন লাগে?যেমনই লাগুক।অভ্যাস করে নাও।
মধু অসহায় মুখ করে বসে রইল। লোকটা কিছু না করেও তাকে জ্বালাচ্ছে।
মেহরাব দুপুরের খাবার খেয়েই বেরিয়ে গেছে। ইদানীং তার ব্যবহারে অনেক পরিবর্তন এসেছে। লামিয়া বুঝতে পারে।কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলে না।যদি অপ্রিয় কিছু শুনতে হয়! যা সে সহ্য করতে পারবে না। মেহরাব কে একটু বেশিই ভালোবাসে লামিয়া। তার অবহেলা ভিতরে ভিতরে ক্ষত সৃষ্টি করছে।এই ক্ষতর জ্বালা যে বড় ভয়াবহ। মেহরাব কি বুঝতে পারে না! সব কিছু স্বাভাবিক থাকলেও কি যেন একটা স্বাভাবিক নেই। ইদানীং মেহরাব খুব বেশিই ব্যস্ত থাকে৷ বাসায় এলেও নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরে। লামিয়ার তা নিয়ে অভিযোগ নেই। সে শুধু স্বামীর বুকে শান্তিতে কয়েক ঘন্টা ঘুমাতে চায়। ইদানীং মেহরাব বোধহয় তাকে বুকে নিয়ে ঘুমাতে ভুলে যায়। সারারাত এপাশ ওপাশ করে কাটিয়ে দিলেও মেহরাবের ক্যন হেলদোল হয়না। লামিয়ার মেহরাব কে সন্দেহ করতে ইচ্ছে করে না।এতে তার নিজের ভালোবাসাই অপমানিত হবে। মেহরাব তাকে ধোকা দিতে পারে না।এ অসম্ভব!, আসলেই কি তাই!
চলবে,,