আমার_অবেলায়_তুমি
সানজিদা_বিনতে_সফি
পর্ব_৬
দুপুরের ভ্যাপসা গরমে জনজীবন ওষ্ঠাগত। কড়া রোদে উত্তপ্ত রাস্তায় বাতাসের সাথে যেন আগুন ঝড়ে পড়ছে। মেহরাব বিরক্তির শিষ তুললো। গাড়ির এসি বাড়িয়ে লামিয়ার ফোনে কল লাগালো। আজ সারাদিন ব্যস্ততার জন্য একবার ও মেয়েটার খবর নেয়া হয়নি। দুটো সার্জারি ক্যান্সেল হওয়ায় সময়ের আগেই বাসায় ফিরে যাচ্ছে সে।
কয়েকবার লাগাতার রিং হওয়ার পরেও ওপাশ থেকে কল রিসিভ হলো না। মেহরাব ভ্রু কুচকে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইলো। বাসায় মেহমান আছে, কেউ কিছু বলে নি তো! ভাবতে চাইলো না মেহরাব। কিছু বললেও তার পরিবার সামলে নিবে। তবুও বক্ষপিঞ্জরে আনচান করছে। জ্যাম ছাড়ার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কচ্ছপের গতিতে এগুচ্ছে গাড়ি। কাপালে ভাজ ফেলে দোয়া দুরুদ পড়ে ময়না বেগম কে কল করলো মেহরাব। আপার কথা অনেকটা বা*রুদের মতো মনে হয় তার কাছে। কি থেকে কি শুনিয়ে দেয় ভাবা মুশকিল।
— আসসালামু আলাইকুম আপা। লামিয়া কল ধরছে না।বাসায় কি কিছু হয়েছে?
ময়না বেগম আ*র্তনাদ করে উঠল। নাটকীয় ভঙ্গিতে বুক চাপড়ে বলল,
— বিয়ে করে আপা কে একদম ই ভুলে গেছিস! একদিন ফোন দিয়া খবরও নেওয়ার প্রয়োজন মনে করিস না। বউ কল না ধরায় এখন আপার কথা মনে পড়ল?এই আমার নাম্বার ছিল তোর ফোনে? এখন কার থেকে নিয়ে কল দিয়েছিস সত্যি করে বল।দাড়া,আগে সালামের জবাব দিয়ে নেই, ওয়ালাইকুম আসসালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ।
মেহরাব বিমূঢ় হয়ে ফোন কানে নিয়ে বসে রইলো। ময়না বেগমের কথা সব মাথায় জট পাকিয়ে গেলো। কিছুক্ষণ মনে করার চেষ্টা করে আবার ও একই প্রশ্ন করল। ময়না বেগম এবার কষ্ট পাওয়ার ভান করে বলল,
— আজ থেকে তোর কোন বোন নেই।আমি ভাই হিসেবে তোকে তেজ্য করলাম। মিনিমাম সম্মানটুকুও নেই! কল দিয়ে বলতে তো পারতি,আপা কেমন আছো? কি করছো? সকালে খেয়েছো? তা না করে সরাসরি বউ! তোর বউ আমার পাশেই আছে। ভালো আছে। আমি তাকে পাটিসাপটা করে খাওয়াচ্ছি। কল কা*ট। তোর সাথে কথা বলে একটা পিঠা পেনে লেগে গেছে। বাসায় আয়,এটা তোকে খাওয়াবো। আসার সময় আম্মার জন্য আখ নিয়ে আসিস। আম্মা খেতে চেয়েছে।
মেহরাব তপ্ত শ্বাস ফেললো। ভুল করেও এটা বললো না, আম্মা আখ খায় না আপা।তার দাত নেই। পাছে আবার যদি তাকে বংশ থেকেই বাদ দিয়ে দেয়!
কল কে*টেই ফিক করে হেসে দিলো ময়না বেগম। লামিয়া পেট চেপে হাসছে। ভাইদের নাস্তানাবুদ করতে পারলে বুকের ভিতর শান্তি শান্তি লাগে। কেন যে সে ভাইদের ছোট হলো না? তাহলে আরো আহ্লাদ করা যেত।
মাহতাব রুমে এসে দেখে মধু ঘুমিয়ে আছে। ঘুমন্ত মুখেও অস্বস্তি স্পষ্ট। মাহতাবের কপাল কুচকে গেলো। মেয়েটা কি নিয়ে ইতস্ততা করছে? হয়তো নতুন পরিবেশ তাই!নিজ মনকে বুঝ দিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলো মাহতাব।লম্বা একটা শাওয়ার নিতে হবে। অস্বস্তিতে গা গুলিয়ে আসছে।
মধুর ঘুম ভাঙ্গল দুপুরের পড়ে। দগদগে সূর্যটা তখন পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। মাহতাবের ছোট মামী কয়েকবার ডাকতে চাইলে মাহতাবের থমথমে মুখ দেখে আর কথা বাড়ায় নি। সাহিদা রাগে ফুলে ফেপে উঠছে। বউয়ের জন্য দরদ যেন উপচে পরছে! আদিখ্যেতা বলে মনে মনে তিরস্কার করলো বার কয়েক।
কুলসুম বেগম কে নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছে মাহতাব। টেবিলের সবার কাছে বিষয় টা স্বাভাবিক। তারা আগে থেকেই দেখে আসছে মাহতাব তার মাকে দুপুরে নিজ হাতে খাইয়ে দেয়। কিন্তু এখন ঘরে বউ এসেছে। এই দৃশ্য পাল্টে যেতে কতক্ষণ?
মাহতাবের বড় মামাতো ভাইয়ের বউ টিপ্পনী কেটে বলেই ফেলল,
— মায়ের প্রতি এই ভালোবাসা থাকবে তো মাহতাব ভাই? এখন ঘরে বউ এসেছে। হিংসে করতে পারে। তখন আবার মা কে ভুলে যাবেনা তো?
মাহতাব চোখ তুলে তাকালো। ময়না বেগম আর লামিয়া শুকনো ঢোক গিলে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে মাহতাবের দিকে। তার শান্তশিষ্ট ভাই রেগে গেলে হুস থাকে না। সবার সামনে চিল্লিয়ে উঠলে একটা বিশ্রী অবস্থা হবে।
কুলসুম বেগম এসবে পাত্তা দিলেন না। তার ছেলে খাটি হিরে। হাজার ব্যস্ততার মাঝেও কতটা সময় ড্রাইভ করে বাসায় আসে শুধু তাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিতে। ছোট বেলায় মাহতাব সব সময় জেদ করতো তার হাতে খাওয়ার জন্য। মাহতাবের বয়স যখন চৌদ্দ কি পনেরো, তখন একদিন কুলসুম বেগম মাহতাব কে বলেছিলেন,
— আর কতো আমার হাতে খাবে বাবা? এবার তো বড় হয়েছো। নিজের হাতে খাওয়ার অভ্যাস করো। আমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। এখন তো আমার ছেলের হাতে খাওয়ার কথা।তা না,আমিই বুড়ো ছেলেকে খাইয়ে দিচ্ছি।
মাহতাব সেদিন খেতে খেতে মায়ের গাল ধরে আদুরে গলায় বলেছিল,
— আমি বড় হলে আমিই তোমাকে প্রতিদিন খাইয়ে দিবো আম্মা। ততদিন তোমার হাতে খাবো। তোমার হাতে না খেলে আমার পেট ভরে না আম্মা।
মাহতাব তার কথা রেখেছে। তার বাবা মারা যাওয়ার দিন থেকে মাহতাব কুলসুম বেগম কে সব সময় নিজ হাতে খাইয়ে দেয়। আগে তিন বেলা খাইয়ে দিলেও এখন সময়ের অভাবে পারে না।তাই দুপুরে বাড়িতে চলে আসে সে।
ময়না বেগম চোখ রাঙ্গিয়ে তাকালো ভাইয়ের বউয়ের দিকে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে খোচা মারতে পেরে সে ভিষণ খুশি। মাহতাব ধীরেসুস্থে কুলসুম বেগম কে খাওয়ানো শেষ করলেন। মায়ের মুখ যত্নসহকারে মুছিয়ে দিয়ে লামিয়া কে বলল,
— মাকে তার রুমে নিয়ে যাও লামু। দুই ঘন্টা রেষ্ট করতে হবে। আমি এসে মেডিসিন দিয়ে দিচ্ছি। লামিয়া কুলসুম বেগম কে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
— আমিই দিয়ে দিবো ভাইয়া। আপনি খেয়ে নিন।
মাহতাব কিছু বললো না। হাত ধুয়ে সোজা ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসলো।সবাই খাওয়া শেষ করে সেখানেই বসেছে। সাহিদা একটু পর পর মাহতাব কে দেখছে।
দুই বাচ্চার মা হয়ে সে অনেকটা বুড়িয়ে গেছে। তবে মাহতাব কে দেখে বয়স বোঝার জো নেই। শুধু কানের পাশের কয়েকটি চুলে পাক ধরেছে এই যা। মধুকে দেখার জন্য হাসফাস করছে ভিতরে ভিতরে। মাহতাব ভুল করেও তার দিকে তাকাচ্ছে না। কেন তাকাচ্ছে না? বউ পেয়ে তাকে দেখতেই চাইছে না! এই তার ভালোবাসার শ্রী?
মাহতাব ফোন ঘাটতে ঘাটতে তার মামাতো ভাইকে বলল,
— দিনকাল কেমন যাচ্ছে ভাই? ব্যবসার কি অবস্থা?
— আছে আলহামদুলিল্লাহ মোটামুটি। তোর মতো কোটিপতি বনে যাইনি এখনো।
তাদের কথার মাঝখানেই সেই ভাবি আরো কয়েকবার মাহতাব কে পিঞ্চ করে কথা বললো । সাহিদা সহ কয়েকজন শব্দ করে হাসছে।
— আপনি বুঝি মামীকে হিংসে করেন ভাবি? তা নাহলে এতো সহজেই বুঝে ফেললেন কি করে? আর বউ হিংসে করলে এক প্লেটে দুজনকে খাইয়ে দিবো। খাবারের টান পরবেনা আমার বাসায়। দুহাত ভরে টাকা কামাই। এদের জন্যই তো। দু’জন কে খাইয়ে দিলে হিংসে করবে না নিশ্চয়ই?
বেচারির হাসি হাসি মুখটা চুপসে গেলো।জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলল,
— আমি তো মজা করছিলাম ভাই। রাগ করলে নাকি?
— আমিও ঠিক আপনার মতোই মজা করেছি। রাগ করবো কেন?
থমথমে পরিবেশেই আগমন হলো মেহরাবের। ঘামে ভিজে যাওয়া শার্ট গায়ের সাথে লেপ্টে আছে।হাতে দু আটি আখ। লামিয়া ছুটে গিয়ে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিল। মেহরাব মুচকি হেসে পানি খেয়ে রুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। মাহতাব লামিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,
— মধুকে নিয়ে এসো লামু। ও হয়তো উঠে পরেছে।
লামিয়া মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো। লামিয়া কে পাঠানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে মধুকে একটু গুছিয়ে গাছিয়ে নিয়ে আসা।
— খাবে না আপা?
ময়না বেগম টেবিলের কাছে যেতে যেতে বলল,
— খাবো না কেন? তোদের জন্য বসে আছি ভাবিস না। আমি এমনিতেই দেড়ি করছিলাম। খেতে মন চাইলে টেবিলে আয়। মাহতাব মনে মনে হাসলো। বোন টা আর বদলালো না।
মেহরাব, মাহতাব , ময়না বেগম টেবিলে বসে অপেক্ষা করছে মধুর জন্য। ময়না বেগম সুফিয়া খালাকে বলল পিঠা গুলো ড্রয়িং রুমে নিয়ে যেতে।যার মন চাইবে খাবে।
মধুকে নিয়ে নিচে আসতেই সবার চোখ কপালে। সাহিদা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। মাহতাব এতো কমবয়সী মেয়ে বিয়ে করেছে কেউ আন্দাজ ও করে নি। কালো জামদানীতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে মধুকে। মাহতাব কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। মনে মনে বলল,
— সুন্দর! অসম্ভব সুন্দর।
মধু সবাইকে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করলো। লামিয়া তাকে রেডি করাতে করাতে সবার বিবরণ দিয়ে ফেলেছে। তাই রয়ে সয়ে সবার কথার উত্তর দিচ্ছে সে।
ময়না বেগমের কথা শেষ হতেই সাহিদা শ্লেষাত্মক গলায় বলল,
— আগে খেয়ে নাও মধু। সবাই ঘরের মানুষ। পরেও আলাপ করা যাবে। এই লামু,এসে বসে পর।
— বাবাহ আপা! ভাইয়ের জন্য তো কমবয়সী মেয়ে ধরে এনেছেন। এজন্যই বুঝি দু’দিনেই মাহতাবের মাথা ঘুরে গেছে?
সাহিদার হাসতে হাসতে মারা খোচাটা গায়ে মাখলো না মাহতাব।ময়না বেগম কিছু বলতে গেলেও তাকে থামিয়ে দিয়ে হাসি মুখে উত্তর দিলো,
— ঠিক ধরেছো সাহিদা। অপেক্ষার ফল সব সময় সুমিষ্ট হয়। আমি আমার দুঃখের বিনিময়ে সুখ কিনে এনেছি। সাময়িক কষ্ট টা এখন আশীর্বাদ মনে হচ্ছে। নাহলে এমন জীবনসঙ্গী পাবো কেন?
সাহিদার মুখটা অপমানে লাল হয়ে গেলো। থমথমে মুখে তাকিয়ে রইলো মধুর দিকে।
চলবে,,