আমার_অবেলায়_তুমি
সানজিদা_বিনতে_সফি(সাথী)
পর্ব_২২
সময় তার নিজের গতিতে চলছে। মাহতাব আর মধুর সম্পর্কর দৌড় কিছুটা এগুলেও নির্দিষ্ট একটা গন্ডির মধ্যে আটকে আছে।মাহতাব নিজের সবটা দিয়ে চেষ্টা করছে মধুকে ভালো রাখার। মধু নিজেও চায় মেহরাবের কাছাকাছি যাওয়ার। কিন্তু ললজ্জায় আড়ষ্টতায় আর পেরে উঠে না।
আজ লামিয়া সকাল থেকেই খুব ফুরফুরে মেজাজে আছে। অযথাই হাসছে আর লজ্জা পাচ্ছে। ময়না বেগম কয়েকবার ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছে ব্যাপার টা কি! কিন্তু তার মাথায় কিছুই ঢুকেনি। মধু কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে কয়েক বার জিজ্ঞেস ও করে ফেলেছে। উত্তরে লামিয়া শুধু লাজুক হেসেছে। মাসখানেক আগে সে আর মেহরাব বান্দরবান থেকে ঘুরে এসেছে। মূলত তার রাগ ভাঙ্গানোর জন্যই মেহরাব তাকে বান্দরবান নিয়ে গিয়েছিল। সেই সময়টা তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়ের মধ্যে একটি। ময়না বেগম পানের ডালা নিয়ে কুলসুম বেগমের রুমে চলে গেলো। ইদানীং কুলসুম বেগমের শরীর টা ভালো যাচ্ছে না। মেহরাব রেগুলার চেক-আপ করছে।কিন্তু স্বাস্থ্যের তেমন উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। খালা সারাক্ষণ কুলসুম বেগমের পিছনে পরে থাকে। তার সমস্ত দেখাশোনা সে নিজেই করে। রাতে তার খাটের পাশেই বিছানা পেতে ঘুমায়। মাহতাব আর মেহরাব এসেও খালার বিছানায় মাঝে মাঝে ভাগ বসায়। অর্ধেক রাত তারা মায়ের রুমেই কাটিয়ে দেয়। ময়না বেগম ও কুলসুম বেগমের কাছ ছাড়া হয় না। রাতে সেও তার পাশেই ঘুমায়।রহিমা আর জরি খালার সাথেই শোয়। কিন্তু যেদিন মাহতাব আর মেহরাব আসে সেদিন তাদের ছাদের স্টাফ রুমেই থাকতে হয়। সেখানে অবশ্য শোয়েবের সাথে তাদের ভালোই সময় কাটে। রহিমা আর জরি তো শোয়েব মামা অন্ত প্রাণ।
শোয়েব যদি বলে, ‘জরি,আজ আমাদের মুরগী টা ডিম পাড়বে’।জরি তাহলে আগে ভাগেই পেয়াজ মরিচ কে*টে বাটি নিয়ে রেডি থাকবে ডিম ভাজি করার জন্য। যদিও সে জানে এ বাসায় কোন মুরগী নেই। তবুও শোয়েব মামা বলেছে যখন, তখন গায়েবী থেকে এসে হলেও মুরগী ডিম পেরে যাবে।
ময়না বেগম দুজনের এই অবাস্তবিক ব্যবহার দেখে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে,শোয়েবের বিয়ের সময় দেনমোহর হিসেবে এই দুটো কে দিয়ে দিবে। একেবারে ঘাড় থেকে বিদায়। আ*পদ গুলোকে আহ্লাদ দিয়ে দিয়ে তার বাড়ির সবাই মাথায় তুলেছে। অবশ্য এতে তার ও কম বেশি হাত আছে। তাই বলে এভাবে বিগড়ে যাবে! ভালো ব্যবহারের এই প্রতিদান!
আজ মাহতাব আর মেহরাব এক সাথেই বাসায় এসেছে। কুলসুম বেগম এখন খাওয়ার দাওয়া নিজের রুমেই করে। বেশ কিছুদিন যাবৎ সে বিছানা নিয়েছে। তাই তাদের দুই বেলা খাওয়া কুলসুম বেগমের রুমেই হয়। সবাই যার যার প্লেট নিয়ে কুলসুম বেগমের রুমে হাজির হয়ে যায়। কুলসুম বেগম ও খুশি হয় খুব। সবার সাথে গল্প করতে করতেই নিজের খাওয়া শেষ করে। ইদানীং তিন বেলা তিন ছেলে মেয়ের হাতে খাওয়া হয়। তার মনেই হয় না সে অসুস্থ। জীবনের এতগুলো বছর পার করে এসে মনে হচ্ছে তার জীবন যেন পুরোটাই স্বার্থক। স্বামীর সংসারে আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত একফোটা দুঃখ তাকে গ্রাস করতে পারেনি। স্বামীর মৃত্যু তাকে বড় শোক দিয়ে গেলেও ছেলে মেয়েদের ভালোবাসায় সেই শোক কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে সে। প্রথমে স্বামী তারপর সন্তানরা তাকে শিশুর মতো আগলে রেখেছে। চারিদিকে বাবা মায়ের প্রতি সন্তানের অবহেলা দেখে নিজেকে চরম সুখী মানুষ মনে হয় তার। চোখ ভরে উঠলো কুলসুম বেগমের। তার সামনেই মাহতাব মনযোগ দিয়ে রুই মাছের কাটা বাছছে। পাছে মায়ের গলায় কাটা বিধবে সেই ভয়ে। সন্তপর্ণে নিজের চোখের জল টুকু লুকিয়ে মুচকি হাসলো সে। ছেলেটাকে এখন কেমন বাচ্চা বাচ্চা লাগছে! মনে হচ্ছে এই তো দশ বারো বছরের মাহতাব মাছের কাটা বাছতে গিয়ে আনমনে মাথা চুলকে ফেলছে। বেছে রাখা মাছটুকু দিয়ে মায়ের মুখে ভাত তুলে দিলো মাহতাব। মেহরাব কুলসুম বেগমের পায়ের কাছে বসে খাচ্ছে। ভাইকে শান্তিতে খেতে দেখে ময়না বেগমের মুখ কুচকে গেলো। নিজের গাধা ছেলেটা আস্ত মীরজাফর সে জন্মের কয়েক বছর পরেই টের পেয়েছে। দেখো কিভাবে তার দামড়া ভাই কে মাছ বেছে দিচ্ছে। এত কষ্ট করে জন্ম দিয়ে তার কি লাভ হলো! তাকে তো কোন দিন চিংড়ী মাছের ও ছাল ছাড়িয়ে দেয়নি।
— এতো দিনে মেয়েটার সুবুদ্ধি হয়েছে। কত করে বুঝিয়েছি,এই ছেলে তোকে জ্বা*লিয়ে মারবে৷ নতুন দেখে একটা বিয়ে করে নিচতলায় সেটেল্ড হয়ে যা। শোনেনি, আমার কথা শুনলে কি আর এতগুলো বছর নষ্ট হতো! সেই তো প্রেমে পড়লো। অবশেষে সুবুদ্ধি হয়েছে।
রুমের সবার নজর ময়না বেগমের দিকে। সে মুখ বাকিয়ে কথাগুলো বলে আপাতত খাওয়ায় মনোযোগ দিয়েছে। লামিয়া উৎসাহ চেপে রাখতে না পেরে বলেই ফেলল,
— কার কথা বলছেন আপা?
— কেন!তোর কথা। সকাল থেকেই তো সদ্য প্রেমে পড়া প্রেমিকার মতো লজ্জায় গলে গলে পরছিলি। আমি বুঝিনি ভেবেছিস? আমি সব বুঝি। চিন্তা করিস না। আমি তোর পাশে আছি৷
মেহরাব আহাম্মক হয়ে তাকিয়ে রইলো। লামিয়া ফ্যালফ্যাল করে একবার মেহরাবের দিকে আরেকবার ময়না বেগমের দিকে তাকালো। মধু মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে৷ সবাই হতভম্ব হলেও মাহতাব চুপচাপ মাছ বাছায় ব্যস্ত। শোয়েব কাকে শান্তনা দিবে তা নিয়ে দ্বিধায় আছে। মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে তার ছোট মামির পাশে থাকা উচিত। বেচারি শক সহ্য করতে পারলেই হলো!
— দেখলেন আম্মা! আপা কি বলছে! সত্যি করে বলেন আম্মা,আপনার বড় মেয়েকে কোন রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনেছেন?আমি এখন নিজ দায়িত্বে গিয়ে কম্বল সহ রেখে আসবো। বাইরে কিছুটা ঠান্ডা পরেছে হয়তো।
তুমি আমার সংসার ভাঙ্গতে উঠে পড়ে লেগেছো কেন আপা? আমার আলাভোলা বউকে এই কুবুদ্ধি দাও সারাদিন! আস্তাগফিরুল্লাহ!
— চুপ থাক। এই ময়না কখনো কাউকে কুবুদ্ধি দেয় না। তোর বউয়ের ভালোর জন্যই আমি সব সময় তাকে সাপোর্ট করি। তোর উচিত তাকে কনগ্রেচুলেট করা। তোমার ছেলে আস্তো বেয়াদব আম্মা দেখছো তো?
মাহতাব হতাশ মুখে ভাই বোনের দিকে তাকালো। মেহরাবের কাদো কাদো মুখ দেখে কিছুটা মায়া হলো তার। সব সময় ময়না বেগমের কাছে তর্কে হেরে বেচারার মুখটা চুপসে যায়। কুলসুম বেগম বিরক্ত হয়ে ধমক দিলেন,
— এই বয়সে এসেও বাচ্চাদের মতো আচরণ তোমাদের। আর ময়না, এসব কি ধরনের কথা? মুখে লাগাম টানো। এখানে তোমার ছোটরা আছে। কার সম্পর্কে কি বলছো বলার আগে একবার ভাববে না! দিন দিন ছোট হচ্ছো নাকি!
— আমাকেই ধমকে রাখতে পারো আম্মা। ছেলেকে কিছু বলো না। তোমার আদরের ছেলেদের কোলে নিয়ে বসে থাকো।
ময়না বেগম আঁচলে মুখ গুজলেন। লামিয়া এবার দিশেহারা বোধ করলো। ময়না বেগমের কাছে গিয়ে তাকে আস্বস্ত গলায় বলল,
— আপনি ভুল বুঝেছেন আপা। সকাল থেকেই আমার মনটা খুব ভালো ছিল। আপনি ফুপু হতে যাচ্ছেন। সকালে বাসায় টেস্ট করেছি। কথাটা আমি আপনার ভাইকে প্রথম বলতে চেয়েছিলাম। তাই আপনাকে কিছু বলিনি। ভুল বুঝবেননা আপা।
পুরো রুম আরেকবার স্তব্ধ হয়ে গেল। ময়না বেগম বাদে বাকি সবাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে লামিয়ার দিকে। মেহরাব সোজা দাড়িয়ে গিয়েছে। তার হাত পায়ের কাপন চোখে পরার মতো। মাহতাব গিয়ে সাথে সাথে জড়িয়ে ধরলো তাকে।লামিয়া চোখে জল আর মুখে হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে মেহরাবের দিকে। এই খুশিটাই তো সে দেখতে চেয়েছিল। মধুও এসে লামিয়া কে জড়িয়ে ধরলো। মাহতাবের এতোটা আনন্দিত চেহারা সে এর আগে দেখে নি। আচ্ছা,লোকটা যেদিন নিজের বাবা হওয়ার খবর পেলো সেদিন কতটা খুশি হবে? তাকেও কি এভাবে শক্ত করে জড়িয়ে রাখবে?ভাবতেই লজ্জায় নুয়িয়ে গেল সে।
চলবে,,