আমার_অবেলায়_তুমি
সানজিদা_বিনতে_সফি(সাথী)
পর্ব_ ২০
পেশায় ডাক্তার হলেও হাড্ডি ভা*ঙ্গায় মেহরাবের জুড়ি মেলা ভাড়। জয়নাল বেপারী কিছু করতে না পারলে ও তার দুই ছেলে হাত পা চালাতে পিছপা হয়নি। মেহরাবের ও কিছুটা লেগেছে। তবে তিনজন কে তুলো*ধুনা করে ছেড়েছে সে।
মাহতাব শান্ত চোখে তাকিয়ে।
— ভাই, আমরা বাইরে যাচ্ছি। তোমার যা জানার জেনে নাও। এবার মুখ না খুললে হালকা আওয়াজ দিবে। গাড়িতে অনেক খেলনা আছে। সবগুলো দিয়েই ওদের সাথে খেলব। আয় শামির।
শামির মাথা নাড়িয়ে মেহরাবের পিছু নিলো। মাহতাব এখনো ঠায় গা এলিয়ে বসে আছে। মেহরাব যেতেই সোজা হয়ে বসলো। জয়নাল বেপারীর দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত শান্ত গলায় বলল,
— বলুন, মধুর সাথে কে এই নি*কৃ*ষ্ট কাজ করেছে?
জয়নাল বেপারী মাথা নিচু করে চুপ করে আছে। জয় আর সামিরের নাক মুখ ফে*টে র*ক্ত বেরুচ্ছে। দুজনের অবস্থাই শো*চ*নীয়। সামির কাপা কাপা গলায় অস্পষ্ট স্বরে বলল,
— ভুল হয়ে গেছে ভাইয়া। এবারের মতো মাফ করে দিন। ক্ষোভ ছিল ওর প্রতি। রাগ হতো দেখলে। ওর মায়ের জন্য আমাদের মা চলে গেছে। বাবা কে খুব ভালোবাসতাম।তাই মায়ের সাথে যেতে পারিনি। কিন্তু মা’কে ছাড়া থাকতে ক*ষ্ট হতো খুব। কতো রাত দুই ভাই কান্না করে কাটিয়েছি তা শুধু আমরাই জানি। বাবা’র জন্য ওনাকে কিছু বলতে পারতাম না। তাই সব রাগ মধুর উপর দিয়েই যেত। আমরা ওকে মা*র*ধর করতাম ঠিকই। কিন্তু কখনো খারাপ নজরে তাকাইনি।
— তাহলে মধুর শরীরে কামড়ের চিহ্ন গুলো কোথা থেকে এলো?(দাতে দাত চেপে)
জয় ভীত চোখে সামিরের দিকে তাকালো। সামির মাথা নিচু করে বসে আছে। জয় কাপা কাপা গলায় বলল,
— ওইদিন সামির নে*শা করেছিল,,ইচ্ছে করে করে নি। বড় কিছু হয়ে যাওয়ার আগেই আমি আটকে ফেলেছিলাম।
আলেয়া বেগম মূর্তির মতো এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। এদের কে সে নিজের ছেলের মতো আদর করেছে। তাদের মনে তার জন্য এতটা ঘৃ*ণা সে কল্পনা ও করতে পারে নি৷ জয়নাল বেপারীর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল সে আগে থেকেই সবটা জানতো। এই জন্যই বুঝি মধু কে বিয়ে দেয়ার এতটা তাড়া!
মাহতাব জয়নাল বেপারীর দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,
— যত দ্রুত সম্ভব আপনারা এই শহর ছেড়ে চলে যাবেন। আমি চাইনা আমার জন্য কোন মা সন্তান হারা হোক।
মাহতাব যত দ্রুত এসেছিল তার চেয়ে বেশি দ্রুত পায়ে বেপারী বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেল। মেহরাব আর শামির গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
— আমি আমার গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।তোরা ও চলে আয়।
মেহরাব কিছুটা আমতা আমতা করে বলল,
— সিরিয়াস কিছু ভাই?
— না।
মেহরাব আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। মাহতাব ওদের তারাতাড়ি আসতে বলে নিজের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলো। শামির বুঝতে পেরেও কিছু বললো না। শুধু মনে মনে মধুর ঠিক থাকার দোয়া করলো।
মাহতাব বাসায় গিয়ে সোজা নিজের রুমে চলে গেলো। মধু এখনো ঘুমিয়ে আছে। গাড়ির চাবি টা রেখে মধুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো সে। কপালে দীর্ঘ চুমু খেয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। মেয়েটা কি এজন্য ই নিজেকে গুটিয়ে রাখছে? একবার কি বিশ্বাস করে বলা যেত না!
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে মেহরাব কে কল করলো।
— বাসায় পৌছেছিস?
— এইতো, কাছাকাছি চলে এসেছি। গলির মোরে আছি। তুমি ঘুমিয়ে যাও। আমরা দুই মিনিটে বাসায় ঢুকবো।
— ঠিক আছে আয়। আমি জেগে আছি।
— হুম।
মাহতাব চুপচাপ মধুর পাশে শুয়ে পরলো। কয়েক সেকেন্ড এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হুট করেই মধুকে নিজের বুকে জরিয়ে ধরলো। এবার কিছুটা ভালো লাগছে। বুকের ভিতর বয়ে চলা ঝড় টা যেন এক নিমিষেই থেমে গেছে। কয়েক মিনিট পরেই মেহরাবের গাড়ির আওয়াজ পাওয়া গেল। মাহতাব নিজেও চোখ বুঝল। শরীর খুব ক্লান্ত লাগছে। মাহতাব সীদ্ধান্ত নিয়েছে মধুকে এ বিষয়ে কিছুই বলবে না। কখনো জানতেও দিবে না সে সব জানে। ভালোবেসে সে তার বউ কে বোঝাবে সব পুরুষ এক নয়। সেই তার জীবনের একমাত্র পুরুষ। যে তাকে বুকের খাচায় আগলে রাখবে। নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসবে। সময় লাগবে, কিন্তু একসময় সে সফল হবে নিশ্চিত।
মধুর ঘুম ভাঙ্গলো খুব ভোরে। মাহতাব তখনো গভীর ঘুমে বিভোর। নিজেকে মাহতাবের বাহুবন্ধনে দেখে হচকচিয়ে গেলো মধু। কাল রাতের কথা মনে পরতেই ভালো করে নিজের দিকে তাকালো। সব কিছু ঠিক দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে নিজেকে মাহতাবের থেকে ছাড়িয়ে নিল। ওজু করে এসে ধীর গলায় মাহতাব কে ডেকে তুলে নামাজের রুমে চলে গেলো। মাহতাব নিজেকে সামলে নিজেও ফ্রেশ হয়ে মসজিদে চলে গেলো। মাত্র দুই ঘন্টা ঘুমাতে পেরেছে সে। মাথা ঝিম ঝিম করছে। মেহরাব আর শামির ও ঘুম ঘুম চোখে ঢুলতে ঢুলতে মসজিদে গেল। মেহরাবের আজ একটা ওটি আছে দুপুরের পরে। আজ আর সকাল সকাল হসপিটাল যাবে না সে। কল করে হাফ ডে ছুটি নিয়ে নিবে।
নামাজ শেষে ছেলেরা সবাই আবার ঘুমিয়েছে। লামিয়া সকাল থেকেই মুখ ভার করে বসে আছে। ময়না বেগম অনেক খুচিয়েও পেট থেকে কিছু বের করতে পারেনি। সে নিশ্চিত তার বেয়াদব ভাই লামিয়ার সাথে পায়ে পা বাধিয়ে ঝগড়া করেছে। এতো ভালো মেয়েগুলোকে ই কেন এই বেয়াদবের কপালে পরতে হলো! মনে মনে আফসোসের শেষ নেই তার।
মধু সকাল থেকেই সবার সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করছে। কাল রাতের বিষয় নিয়ে মনের মধ্যে খচখচ করছে। মাহতাব রেগে আছে কি না তা নিয়েও মনের মধ্যে আনচান করছে।
ব্রেকফাস্ট টেবিলে থমথমে মুখে সবাই ব্রেকফাস্ট করছে। ময়না বেগম ধারালো দৃষ্টিতে দুই ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মেহরাব চোরের মতো আড়চোখে কয়েক বার তাকালেও এখন আর তাকাচ্ছে না।
— কাল রাতে কখন ফিরেছো?
কুলসুম বেগমের প্রশ্নে একবার চোখ তুলে তাকালো মাহতাব। পুনরায় খাওয়ায় মনোযোগ দিয়ে ধীর গলায় বলল,
— অফিস থেকে জরুরী কল এসেছিল আম্মা।সেখানেই গিয়েছিলাম। দেড়’টার দিকে ফিরেছি।
কুলসুম বেগম আর কিছু বললেন না। কিন্তু ময়না বেগম ফোস করে উঠলো।
— অফিস সামলে আর কি হবে। তোর ভাই কাল রাতে আবার মা*রা*মা*রি করে এসেছে। দেখ,হাত আর কপাল কালো হয়ে আছে। গু*ন্ডা হয়েছে একটা।
মধু অবাক চোখে তাকিয়ে আছে মাহতাবের দিকে। মাহতাব কাল রাতে বেরিয়ে ছিল? কই,তার তো মনে পরছে না!
মাহতাব মেহরাবের দিকে একবার তাকিয়ে আবার খাওয়ায় মন দিলো।
— দেখলে আম্মা, দেখলে? তোমার ছেলেরা আমাকে পাত্তাই দিচ্ছে না। বিয়ে করেছে শুক্রতে শুক্রতে সাত দিন হয়েছে। এখন ই এই অবস্থা!কয় দিন পর তো আমাকে বাড়ি থেকেই বের করে দিবে।
ময়না বেগম আঁচলে মুখ গুজে গুনগুন করে কাদতে লাগলো। লামিয়া মেহরাবের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে ময়না বেগম কে শান্তনা দিতে লেগে পরেছে। মেহরাব অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল,
— তোমার চোখে পানি আসে নি আপা।
শামির ফিক করে হেসে ফেললো। ময়না বেগম গজ গজ করতে করতে নিজের রুমে চলে গেলো। মাহতাব নিজের খাওয়া শেষ করে প্লেটে খাবার বেরে ময়না বেগমের রুমে চলে গেলো।
— কি দরকার ছিল এসব বলার?
— আরে লামু,আমি তো সত্যি টাই বললাম। সত্যি আপার চোখে পানি ছিল না!
কুলসুম বেগম দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এটা রোজকার কাহিনী। ছেলে আছে বিধায় সে নিশ্চিন্ত।
মধু কৌতূহল গলায় বলল,
— আপনি কিভাবে ব্যথা পেয়েছেন ভাইয়া? ইসস,কতখানি দাগ পরে গেছে!
— বাদ দিন ভাবি। এই লোক কোন দিন ও ঠিক হবে না। আমি আজ ই আমার ফ্ল্যাটে চলে যাবো।খবরদার আমার পিছু এসেছেন তো।
লামিয়াও রাগে গড়গড় করতে করতে চলে গেলো। মেহরাব অসহায় ছাগল ছানার মতো মুখ করে বসে রইল। কিছুদিন বউ ছাড়া কাটাতে হবে নিশ্চিত।
চলবে,,