আমার_অবেলায়_তুমি
সানজিদা_বিনতে_সফি(সাথী)
পর্ব_ ১৫
লামিয়ার সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে মেহরাব। লামিয়ার বান্ধবী মনি কিচেনে মেহরাবের জন্য চা নাশতার ব্যবস্থা করছে। মেহরাবদের শুকনো মুখ ই বলে দিচ্ছে সকাল থেকে তার পেটে কিছু পরে নি৷ মেহরাব আসার পর থেকেই চুপ করে আছে। লামিয়ার প্রতি অভিমান তার মুখ থেকে কথা বের করতে দিচ্ছে না। মাহতাব এসেই লামিয়া কে কড়া ধমক দিয়েছে৷
–এরকম বোকামি কেউ করে? আমরা কি সবাই ম*রে গিয়েছিলাম? আমাদের বলা যেতো না? তুমি কাজটা ঠিক করোনি লামিয়া। অন্তত মেহরাবের সাথে বসে সব ডাউট ক্লিয়ার করতে পারতে। সম্পর্কে বিশ্বাস আর ভরসা থাকতে হয়। ভালোবাসাহীন সম্পর্ক তুমি বয়ে বেড়াতে পারবে। কারণ একসাথে থাকতে গেলে ভালোবাসা না হলেও একটা মানুষের প্রতি মায়া জন্মে যায়। আর ভালোবাসার চেয়ে মায়া প্রখর। কিন্তু বিশ্বাস আর ভরসা না থাকলে ভালোবাসার সম্পর্ক ও ভাঙ্গতে সময় লাগে না। আশা করি এমন বোকামি আর কখনো করবে না।
লামিয়া নিরবে অশ্রু ঝাড়াচ্ছে। তার ভুল টা কোথায়? সে তো মেহরাবের ভালোর জন্যই তাকে ছেড়ে এসেছে। মাহতাব সংক্ষেপে সব কিছু খুলে বললো লামিয়া কে। লামিয়া অপরাধবোধে মেহরাবের দিকে তাকাতে পারছে না। মেহরাব আসার পর থেকে একবার ও তার দিকে তাকায়নি। এতেই লামিয়ার কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। সে কি অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে মেহরাব কে!
মনি টেবিলে নাশতা দিয়ে লামিয়া কে ডেকে বলল,
— ভাইয়াদের নিয়ে টেবিলে আয়। আগে খাওয়া দাওয়া। তারপর বাকি কথা বলা যাবে। সকাল থেকে যে পেটে কিছু পরে নি সেই খেয়াল আছে? বড় ভাইয়া আসুন। দুলাভাই আপনিও আসুন।
— আমরা কিছু খাবো না মনি। এতো কষ্ট করার জন্য ধন্যবাদ। বাসার সবাই চিন্তায় আছে। আমাদের তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। আমার বোনটাকে দেখে রাখার জন্য ধন্যবাদ। তুমি বরং আমাকে এক কাপ চা দাও। তাহলেই হবে।
মাহতাবের কথায় মনি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মাহতাব যে এখানে খাবে না তা সে ভালো করেই জানতো। তবুও সে নিজের মতো আয়োজন করেছে। টেনশনে বাড়ির কেরোর পেটে যে দানা পানি পরেনি তা সে জানে। তাদের অভুক্ত রেখে মাহতাব ম*রে গেলেও খাবে না।
মনি দুজনকেই চা দিল।মেহরাব দুই চুমুক দিয়ে আর খেলো না। মাহতাব নিজের চা শেষ করে লামিয়া কে বলল,
— এবার যাওয়া যাক লামিয়া? তোমরা এসো। আমি নিচে যাচ্ছি।
— আমিও আসছি ভাই।
মাহতাব ছোট ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বললো না। মেহরাব ও মাহতাবের সাথে বেড়িয়ে গেল। যাওয়ার আগে মনি কে ধন্যবাদ দিতে ভুললো না। লামিয়া নিজের প্রতি এই অবহেলা মেনে নিতে পারছে না। শব্দ করে কেদে যাচ্ছে। মনি বিরক্ত হয়ে মুখ কুচকে বলল,
— এহন কান্দস ক্যা? জামাই রে ফালায় আহনের সময় মনে আছিল না? বেদ্দপ বেডি। তুমি কি মনে করসিলা তোমারে আইয়া কোলে নিয়া বইয়া থাকবো?এইবার যাও,জামাইর রাগ ভাঙ্গাও। ভাই আরেকটা বিয়া করলে একদম ঠিক হইতো। বেশি ভালোবাসে তো তাই হুস নাই। যেমনে মন চায় অবহেলা করো। এহন বুঝো মজা। সর সামনে থেইক্কা। আর দরজা ওই দিকে। তারাতাড়ি বাইর হ। তাড়ছিড়া বেডি।
লামিয়ার কান্না থেমে গেলো। মনির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
— তুই বেদ্দপ।তোর চোদ্দগুষ্টি তারছিড়া।তোর বাসায় না থাকলে কি হইবো। আমর কি বাড়িঘর নাই? গেলাম আমি। অসভ্য মাইয়া।
লামিয়া হনহন করে বেড়িয়ে গেল। মনি সেদিকে তাকিয়ে হালকা হেসে চা খাওয়ায় মন দিলো। সকাল থেকে তার পেটেও কিছু পরে নি।
মেহরাব ভাইয়ের দিকে কপাল কুচকে তাকিয়ে রাগী গলায় বলল,
— তুমি ওকে বকা দিলে না কেন? জোরে ধমক ও দাও নি।
— দিয়েছি।
— এটা কে ধমক বলে! আরো কিছু বলা দরকার ছিল। আসলে ভালো করে বকে দিবে। নাহলে আবারও এমন করবে।
— পারবো না। তুই দিস।
মাহতাবের সোজা জবাবে মেহরাব বলার মতো আর কিছু খুজে পেল না। সে কিভাবে বকবে! আজ পর্যন্ত তো কখনো একটা ধমক ও দেয়নি। সে তো শুধু ভালোবেসেছে। এখন মনে হচ্ছে ধমক দেয়া দরকার ছিল। মাঝে মাঝে বকাঝকা করলে প্র্যাকটিস থাকতো। তাহলে এখন তা কাজে লাগাতে পারতো। কি এক ঝামেলা। মেহরাব আবার মুখ কুচকে রইলো। এবার লামিয়ার সাথে সে টানা তিন দিন চার ঘন্টা কথা বলবে না। এটা লামিয়ার শাস্তি।
লামিয়া এসে কাচুমাচু করে দাড়ালো। মেহরাব অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। মাহতাব ভাইয়ের বাচ্চাদের মতো মুখ ফুলিয়ে রাখা দেখে মনে মনে হাসলো। লামিয়া কে গাড়িতে উঠতে বলে নিজে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে পরলো। মেহরাব হন্তদন্ত হয়ে বলল,
— তুমি ওখানে বসলে কেন? আমি চালাচ্ছি।
— পিছনে বস।
ভাইয়ের গম্ভীর গলা শুনে মেহরাব আর কিছু বলল না। চুপচাপ লামিয়ার পাশে গিয়ে বসে পরলো। তবে লামিয়ার দিকে ফিরেও তাকালো না।
— আমি ও বাড়ি যাবো ভাইয়া।
— কিন্তু মেহরাব ফ্ল্যাটে যেতে চাইছে।
লামিয়া মেহরাবের দিকে একবার আড় চোখে তাকিয়ে মিনমিনে গলায় বলল,
— আমার ওখানে একা একা থাকতে ভালো লাগে না। বাড়িতে নিয়ে চলুন না।
মাহতাব মেহরাবের দিকে একবার তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
— ঠিক আছে।
মেহরাব ও আর কিছু বললো না। সবার প্রতিই তার ভালোবাসা আছে। শুধু তার বেলায়ই অবিচার।
বাসায় পৌঁছাতেই সবাই লামিয়া কে ঘিরে ধরলো। ময়না বেগম কতক্ষণ বকাঝকা করে আবার নিজেই জড়িয়ে ধরে বসে আছে। মধু ও একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে আছে লামিয়া কে। সবার এতো ভালোবাসা দেখে লামিয়ার চোখ আবার ভরে উঠলো। কুলসুম বেগম ও এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গেছে। এমন যেন আর কখনো না করে তাও বুঝিয়ে বলেছে।
মাহতাব ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো মধু টেবিল সাজিয়ে ফেলেছে। মাহতাব কুলসুম বেগম কে একহাতে ধরে টেবিলের দিকে নিয়ে যেতে যেতে সবাইকে খেতে যেতে বলল,
— রহিমা,,মেহরাব কে ডেকে নিয়ে আয়।
— আইচ্ছা ভাইজান।
মেহরাব নিজের রুমে ঘাপটি মেরে বসে আছে। বাইরে বের হতে ইচ্ছে করছে না। মাহতাবের ডাক সে শুনেছে। তাই রহিমা আসার আগেই সে বেরিয়ে গেলো। টেবিলে গিয়েও সে লামিয়ার দিকে তাকালো না। সবাই মেহরাবের রাগ আর অভিমান বুঝলেও কিছু বললো না। তবে মধুর কাছে ব্যপারটি খুব ভালো লাগলো। ভালোবাসার মানুষদের অভিমান ও খুব সুন্দর। এই যে মেহরাব আড় চোখে দেখছে লামিয়া ঠিকঠাক ভাবে খাচ্ছে কিনা। তার দিকে তাকিয়েছে কি না। এসব দেখেও তো ভালো লাগে।
খাওয়া শেষে সবাই যে যার রুমে চলে গেলো। মাহতাব এখন অফিসে যাবে। আজ ঝামেলায় অনেকটা দেড়ি হয়ে গেছে। ঘড়ির কাঁটায় এখন প্রায় বারোটা বাজতে চললো।
মাহতাব কে রেডি হতে দেখে মধু ধীর গলায় বলল,
— আপনি কি অফিসে যাচ্ছেন?
— হুম। (আয়নায় মধুর দিকে তাকিয়ে)
— কাল রাতে তো ঘুমাতে পারেননি। এখন একটু ঘুমিয়ে বিকেলে গেলে হয়না?
মাহতাবের হাত থেমে গেলো। টাই বাধা রেখে সে মধুর দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,
— হয়।
— তাহলে রেস্ট নিন।
— আচ্ছা।
— তাহলে আমি যাই। আপনি ঘুমান।
— না।
— না মানে?
মাহতাব মধুর সামনে এসে দাড়ালো। পকেটে হাত গুজে মধুর দ্বিধান্বিত মুখের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,
— নাক ডাকা না শুনলে ঘুম আসে না।
মধুর মুখটা কালো হয়ে গেলো। অসহায় চোখে মাহতাবের দিকে তাকালো সে।
— তুমিও আমার সাথে ঘুমাবে এসো।
— আমার ঘুম আসছে না।(অসহায় গলায়)
— তোমার চোখ লাল হয়ে আছে। তুমিও কাল থেকে ঠিক করে ঘুমাও নি।
মধু আর কিছু বললো না। এভাবে দিনের বেলায় ঘুমিয়ে থাকলে মানুষ কি বলবে? সবাই খারাপ ভাববে হয়তো। তার সত্যিই খুব ঘুম আসছে।
— কেউ কিছু বলবে না। চুপচাপ শুয়ে পরো। আমি চেঞ্জ করে আসছি৷
— হুম।
মাহতাব চেঞ্জ করে এসে দেখে মধু আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে।
— ঘুমাও নি কেন?
— হ হ্যাঁ হ্যাঁ। ঘুমাচ্ছি।
মধু কাচুমাচু করে গিয়ে একপাশে সুয়ে পড়ল৷ মাহতাব জানলার পর্দা গুলো টেনে দিয়ে নিজেও মধুর গা ঘেঁষে শুয়ে পরলো৷ একটু ঘুমিয়ে নেয়া দরকার।
— দূরে কেন?আমার কাছে এসে ঘুমাও।
মধুর মুখটা শুকিয়ে গেলো। মাহতাবের কাছাকাছি শুতে তার ভয় করে। যদি হাত পা লেগে যায়! এমনিতেই তার নাক ডাকার জন্য বেচারা ঘুমাতে পারে না।
— আমি শক্ত করে ধরে রাখবো তোমায়। হাত পা ছুড়তে পারবে না। এসো।
মধু বোকা বনে গেলো। মনের কথা বুঝলো কি করে? সে কি জোরে জোরে বলে ফেলেছে।
মধুকে ভাবতে দেখে মাহতাব তাকে কাছে টেনে নিলো। নিজের বুকের সাথে মাথাটা চেপে ধরে মন্থর গলায় বলল,
— এবার ঘুমাও। বুড়ো বলে আমাকে বেরসিক ভাবার কারণ নেই। তোমার বর যথেষ্ট রোমান্টিক। দেখবে?
মধু দ্রুত মাথা নাড়িয়ে না বলার চেষ্টা করলো। কিন্তু মাহতাবের বুকে আটকে থাকায় বলতে পারলো না। মাহতাব মধুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মধুর কপালে চুমু খেয়ে ধীর গলায় বলল,
— ভালোবাসা নম্বর বত্রিশ। দেখেছো তোমার বর কতো রোমান্টিক?
চলবে,,
আমার_অবেলায়_তুমি
সানজিদা_বিনতে_সফি(সাথী)
পর্ব_ ১৬
আজ দুই দিন হলো লামিয়া মেহরাবের রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। মেহরাব তার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। লামিয়ার কষ্ট হলেও সয়ে নিচ্ছে। দোষ তার হয়েছে।মেহরাবের সাথে সরাসরি কথা বললে আজ এই সমস্যা হতো না। আজও সকালে মেহরাব হসপিটালে যাওয়ার সময় তাকে বলে যায়নি। গত দুইদিনে মেহরাব তার সাথে একটা কথাও বলেনি। রাতে বারান্দায় শুয়েছে। লামিয়া হাজার অনুরোধ করেও তাকে রুমে আনতে পারেনি। তাই আজ ঠিক করেছে আজ থেকে সে নিজেই বারান্দায় থাকবে। লোকটা সারাদিন পরিশ্রম করে এসে বারান্দায় শোয় তা তার একদম ভালো লাগে না। তাই আগে ভাগেই বারান্দা দখল করে রেখেছে সে। অবহেলা যা করার বিছানায় শুয়ে বসে করুক। সে নাহয় বারান্দায় মশার কামড় খেয়ে প্রায়শ্চিত্ত করবে।
মেহরাব বাসায় আসতে আসতে নয়টা বেজে গেছে। ড্রয়িং রুমে সবাই আড্ডা দিলেও লামিয়া কে না দেখে তার কপাল কুচকে গেল। আবার কোথায় গিয়ে ঘাপটি মেরে রয়েছে কে জানে! এই মেয়ে বাড়ি ছাড়া মানে তার চরিত্রের রফাদফা।
— ভাবি, লামিয়া কোথায়?
মেহরাবের বলতে দেড়ি হলেও ময়না বেগমের খপ করে ধরতে দেড়ি হয়নি। সে চায়ের কাপ নাড়তে নাড়তে হতাশ হওয়ার ভান করে বলল,
— আমরাও আছি ভাই। আমাদের খবরাখবর ও একটু জানতে চা। বউ তো তোর একার নেই,সব বিবাহিত ছেলেদের ই বউ থাকে।তারা এসেই এভাবে বউয়ের খোঁজ করে না।
— আমি করি আপা। একটা মাত্র বউ আমার। খোঁজ খবর না রাখলে আমাদের কাছে থাকবে কেন?আর তোমাদের আদরের বউ বাড়ি ছাড়লে তো তোমরা সেই আমার ঘাড় ই মটকাতে আসবে। তাই একটু খোজ খবর রাখতে হয়।
মেহরাব আর কিছু বলতে না দিয়ে হনহন করে নিজের রুমে চলে গেলো। কুলসুম বেগম বিরক্ত হয়ে বলল,
— মাত্র বাইরে থেকে এসেছে ময়না। সবসময় পিছনে লাগো কেন? বউয়ের খবর রাখবে না তো কি পাশের বাসার মানুষের খবর রাখবে?অদ্ভূত!
ময়না বেগম পাত্তা দিলেন না। সে নিজের মতো চা খাওয়ায় মন দিলো। আজ সারাদিন তার গুণধর ছেলে কল করেনি।কোন বিদেশি নিয়ে ঘুরছে কে জানে? বংশের মতো হয়েছে নিশ্চিত। অসভ্য ছেলেপেলে যত্তসব।
মাহট্যাব নিজের রুমেই অফিসের কাজ করছিল। কুলসুম বেগমের রাগী গলা শুনে দরজার সামনে এসে দাড়িয়েছে। দাঁড়ানোর কারণ যদিও ভিন্ন। তার পরিবারের সবার ব্যবহার সম্পর্কে সে অবগত। এসব তার কাছে নতুন কিছু নয়। কিন্তু আজকাল একটা বিষয় খুব নতুন আর উপভোগ্য। তা হলো,মধুর ভ্যাবাচেকা খাওয়া অসহায় মুখ। তাদের পরিবারের এই হালকা পাতলা সংঘর্ষ দেখে মধুর শুকিয়ে যাওয়া মুখটা দেখে মাহতাবের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে। মেয়েটা যে বড্ড সরল।
মধু মুখ কালো করে কিচেনে চলে গেলো। রহিমা সেফ কে সাহায্য করছে রান্নার জোগাড় করতে। সেদিকে তাকিয়ে কি মনে করে মধু নিজের রুমে চলে গেলো। মাহতাব বারান্দায় দাঁড়িয়ে বেলি ফুলের বাগানের দিকে তাকিয়ে আছে। সাদা সাদা ফুলে বাগান ভরে গেছে। ফুলের সুভাসে চারিদিক মো মো করছে। মাহতাব চোখ বন্ধ করে বুক ভরে শ্বাস নিলো। এই বেলিফুলের বাগান তার অসম্ভব প্রিয়। সে নিজের হাতে পরিচর্যা করে। কিন্তু গত একমাস যাবত সে বাগানে সময় দিতে পারছে না। ব্যবসার কাজে ইদানীং একটু বেশিই ব্যস্ত থাকে সে।
মধু ধীর পায়ে এসে মাহতাবের পাশে দাড়ালো। মাহতাব তখন চোখ বন্ধ করে বেলীফুলের সুভাস নিতে ব্যস্ত। মধুর আসার আভাস পেয়ে সে চোখ খুললো। মধুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
— কি ব্যাপার? শ্বাশুড়ি আর আপাকে ছেড়ে আসতে ইচ্ছে হলো? তুমি তো আমাকে পাত্তাই দিচ্ছো না মধু! এটা কি মেনে নেয়া যায় বলো? নাকি বুড়ো বলে আমার সামনে আসতে ইচ্ছে হয় না?
মধু অবাক চোখে তাকালো মাহতাবের দিকে। তার মনে মাহতাব কে নিয়ে কখনো কোন হীনমন্যতা আসেনি।মাহতাবের সামনে কম আসে এটা ঠিক। কারণ মাহতাবের হুটহাট রোমান্টিকতায় সে খুব লজ্জা পায়। ভয় ও পায় খানিকটা। এতো বড় একজন মানুষের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনা সে। সারাক্ষণ চিন্তায় গলা শুকিয়ে আসে। কখন কোন ভুল করে ফেলবে সেই চিন্তায় সে রাতে ঠিক মতো ঘুমাতেও পারে না। আর তার দূরে থাকাকে মাহতাব এমন কিছু ভাববে তা মধু কল্পনা ও করেনি।
মাহতাব মধুর মুখের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলো। মধুর আদুরে গাল দুটো টেনে দিয়ে আস্বস্ত গলায় বলল,
— মজা করছিলাম। ভয় পাচ্ছো কেন মধু? আমি ই তো। আমাকে ভয় নয়,ভরসা করবে। ঠিক আছে?
মধু আটকে রাখা শ্বাস টা ছাড়লো। লোকটার হুটহাট মজায় তার জান বেড়িয়ে যাওয়া জোগাড় হয়ে যায়। এভাবে কেউ মজা করে! মধু মুখ কালো করে দাড়িয়ে রইলো।
মাহতাব মধুকে এক হাতে টেনে তার কাছাকাছি দাড় করালো। হালকা অগোছালো চুল গুলো ঠিক করে দিতে দিতে শান্ত গলায় বলল,
— কিছু বলতে এসেছিলে?
— হুম।
— আচ্ছা বলো?
— এখন থেকে সবার জন্য আমি রান্না করতে চাই। আমরা মাত্র এই কয়জন মানুষ। এর জন্য একজন সেফ রাখার কি দরকার? আমার এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করে না। সময় কাটতে চায় না। প্লিজ না করবেন না।
মধুর আবদারে মলিন হাসলো মাহতাব। একহাতে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে নরম গলায় বলল,
— ঠিক আছে। তবে সেফ ও থাকুক। ও আমার পরিচিত কাছের একজন। বাবা মারা যাওয়ার পর আমি বেশির ভাগ সময় ক্যাম্পাসে নাস্তা করতাম। আমাদের ভার্সিটির ক্যাম্পাসে রান্না করতো ময়িন। বয়সে আমার থেকে বছর পাচেক ছোট হবে। তখন ই ময়িনের সাথে একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে। পড়াশোনা শেষ করে আমি যখন বিজনেস শুরু করি তখন আর ময়িনের। খোঁজ খবর রাখা হয়নি।
কিছু বছর আগে নিউমার্কেটের ফুটপাতে হকারি করতে দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। জিজ্ঞেস করতেই বলল,চাকরি টা চলে গেছে। তাই উপায় না পেয়ে হকারি করছে। সংসারে খুব টানাটানি অবস্থা। বউ বাচ্চা নিয়ে কোন রকম জীবন কাটাচ্ছে। আমার অফিসে চাকরি দিতে চেয়েছিলাম। ও রাজি হয়নি। সারা জীবন রান্নার কাজ করেছে। ফ্যাক্টরির কাজ নাকি ওর মাথায় ঢুকবে না।তাই বাসায় নিয়ে আসি। তখন থেকে আমাদের বাসায় ই আছে। এখান থেকে চলে গেলে ও মাঝ দরিয়ায় পরবে মধু। ও কোন সার্টিফাইড সেফ নয়। তাই ভালো কোথাও চাকরি পাবে না। তুমি রান্না করতে চাইলে করবে। তবে ময়িন ও থাকুক। ঠিক আছে।
মধু টলমলে চোখে মাথা নাড়ালো। মাহতাব মধুর মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে গম্ভীর গলায় বলল,
— অল্পতেই চোখে পানি আসে কেন তোমার? ইব্রাহিম বাড়ির বড় বউ তুমি। পাহাড়ের মতো শক্ত না হলে সবাইকে সামলাবে কি করে? এখন থেকে শক্ত করবে নিজেকে।
মধু নাট টানতে টানতে বলল,
— আচ্ছা।
মাহতাব মধুর মুখের দিকে তাকিয়ে হালকা শব্দ করে হেসে ফেললো। বউটা তার বড্ড বোকা।
মেহরাব রুমে এসে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে লামিয়া কে কোথাও পেলো না। কপাল কুচকে এপ্রোন টা টেবিলের উপর রেখে ওয়াশরুম চেক করলো। খালি ওয়াশরুম দেখে কপালের ভাজ গাড় হলো মেহরাবের। বারান্দার দরজায় কাছে গিয়েই মুখ থেকে বিরক্তিতে ‘চ’ শব্দ বেরিয়ে এলো। লামিয়া বারান্দায় উল্টো হয়ে শুয়ে আছে। মোটা একটা বইয়ের উপর মাথা দিয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মেহরাব লামিয়াকে না ডেকে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। দশ মিনিট পর ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সোজা বারান্দায় চলে গেলো। লামিয়া কে কোলে তুলে রুমে শুয়িয়ে দিয়ে আবার বারান্দায় গেলো। সমরেশ মজুমদারের বিখ্যাত উপন্যাস “সাতকাহন” ফ্লোর থেকে হাতে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এই উপন্যাস পড়েই তার বউয়ের মাথায় তাকে ছেড়ে একা থাকার কু মতলব এসেছে। সে কি সাতকাহনের দীপাবলির বরদের মতো নাকি?আশ্চর্য!!
এসব উপন্যাস আর বাসায় রাখা যাবে না। কি সাংঘাতিক ব্যপার স্যাপার।
রাতের খাওয়ার সময় মেহরাব আর লামিয়া কে ডাকেনি। লামিয়ার মেন্টাল কন্ডিশনের জন্য এখন প্রোপার ঘুম প্রয়োজন। জেগে থাকলেই উল্টো পালটা চিন্তা করে নিজের মাথা খারাপ করবে সাথে তার টাও করবে। রহিমা কে দিয়ে লামিয়ার খাবার রুমে নিয়ে রাখলো মেহরাব। রাতে জেগে গেলে খেয়ে নিবে।
লামিয়ার ঘুম ভাঙ্গলো মাঝরাতে। নিজেকে বিছানায় দেখে বুঝতে বাকি রইলো না মেহরাব তাকে এখানে রেখে গিয়েছে। বিছানা থেকে নেমে ধীর পায়ে বারান্দায় গেলো সে। মেহরাব এক হাত কপালে দিয়ে শুয়ে আছে। লামিয়া গিয়ে সোজা মেহরাবের পায়ের কাছে বসে পরলো। মেহরাব হুড়মুড় করে উঠে বসে লামিয়ার হাত দুটো চেপে ধরে হতভম্ব গলায় বলল,
— এসব কি করছো তুমি? পায়ে হাত দিচ্ছো কেন!
— আমাকে ক্ষমা করে দাও।আমি আর কখনো এমন ভুল করবো না। প্লিজ এবারের মতো মাফ করে দাও। তুমি এভাবে রাগ করে থাকলে আমার খুব কষ্ট হয়। দম বন্ধ হয়ে আসে। প্লিজ শেষবারের মতো ক্ষমা করে দাও।
লামিয়া ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। মেহরাব লামিয়াকে বুকে টেনে নিলো। এক হাতে চোখের পানি মুছে অস্থির হয়ে বলল,
— আরে কাদছো কেন? আমি রাগ করে নেই আর।কান্না বন্ধ করো প্লিজ। আর কখনো আমার পায়ে হাত দিবে না লামিয়া। আমি পছন্দ করি না।
শেষের কথাটা গম্ভীর গলায় বলল মেহরাব।লামিয়া তার হাতদুটো ধরে তড়িঘড়ি করে বলল,
— করবো না।আর কোন ভুল করবো না। এবারের মতো মাফ করে দাও।
— শোন লামিয়া, আমি তোমাকে ভালোবাসি। ভালোবাসা বোঝো? যা মনের অন্তস্তল থেকে আসে। যেখানে ভালোবাসা আছে সেখানে কখনো ধোকা,প্রতারণা থাকবে না। কেউ যদি ধোকা দিয়ে বলে, তার সাথে সম্পর্ক থাকলেও ভালো আমি শুধু তোমাকেই বাসি। তাহলে বুঝে নিতে হবে সে কখনো ভালোবাসেনি। আমি তোমাকে আমার সহধর্মিণী হিসেবে ভালোবেসেছি। আমার বাচ্চার মা হিসেবে নয়। কতো মানুষের হাত থাকে না,পা থাকে না। অপূর্ণতা নিয়ে তারা কি বেচে থাকছে না? আমাদের তো সব আছে। একটা সন্তান নাহয় নাই থাকলো। আল্লাহ হয়তো এতেই আমাদের কল্যাণ রেখেছে। কারণ সন্তান দেয়ার মালিক একমাত্র সে। আমরা কপাল কুটে ম*রে গেলেও সন্তান পাবো না যদি না সে চায়। তাই প্লিজ,আর কখনো এমন বোকামি করবে না।আমি কষ্ট পাই খুব। ভালোবাসি বলে কষ্ট দিয়ো না বউ।
চলবে,,
(রিচেক করা হয়নি। ভুল গুলো ক্ষমার চোখে দেখবেন।)