আমার অবেলায় তুমি পর্ব ১২

0
775

আমার_অবেলায়_তুমি
সানজিদা_বিনতে_সফি(সাথী)
পর্ব_ ১২

তপ্ত দুপুরে রোদের প্রখরতায় মাটি ফেটে চৌচির হওয়ার অবস্থা। প্রচন্ড গরমে মানুষের জীবন হাসফাস করছে। তবুও কেউ থেমে নেই। হকার থেকে রাস্তায় ভিক্ষে করা বৃদ্ধ, রিকশাওয়ালা থেকে দিনমজুর কারোর বিশ্রাম নেয়ার ফুরসত নেই। ঘামে ভেজা শার্ট গায়ের সাথে লেপ্টে গেলেও কেউ বসে দু দন্ড ছায়ার নিচে বসে নিজের ক্লান্ত শরীরটা কে একটু স্বস্তির পরশ দিতে চায় না।কারণ তাদের কাধে আছে একটা গোটা সংসারের দায়িত্ব। তাই বসে কিছুকাল জিড়িয়ে নেয়া তাদের জন্য বিলাসিতা ছাড়া কিছুই নয়।

রাজধানীর নিউমার্কেট এরিয়া তে জ্যামে আটকে এসব ভাবছিল লামিয়া। সকালের নাস্তা করেই সে বাসা থেকে বেরিয়েছে। অনেকদিন পর আজ সব বন্ধুরা একসাথে হবে। বিষন্নতা কাটাতে বন্ধুদের জুরি নেই। তাই আজ সারাদিন তারা বাইরে ঘুরেফিরে কাটাবে। অনেকদিন হলো মেহরাবের সাথে কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়না। মেহরাব একজন দায়িত্বশীল ডক্টর। সময় করে উঠতে পারে না ঠিকমতো। লামিয়ার এতে কোন অভিযোগ নেই। তার শুধু একটু ভালোবাসা পেলেই হবে।
চারিদিকে চোখ ঘুড়িয়ে লামিয়ার চোখ একজায়গায় গিয়ে আটকে গেল। লামিয়ার গাড়ি থেকে অনেকটা দূরে মেহরাব একটা মেয়ের সাথে দাঁড়িয়ে। মেয়েটা হয়তো কয়েকমাসের গর্ভবতী। দুজনের হাসিমুখ দেখে লামিয়ার হঠাৎ খেয়াল হলো সে মেহরাব কে এভাবে অনেকদিন হলো হাসতে দেখেনা।আহ!কি প্রাণচঞ্চল হাসি। দেখলেই মন ভরে যায়। কিন্তু লামিয়ার মন ভড়লো না। চোখের পাতা আর ঠোঁট কেপে কেপে উঠলো। কাপা কাপা হাতে হ্যান্ডব্যাগ থেকে ফোন বের করে কল করলো মেহরাব কে। কয়েকবার রিং হওয়ার পরে মেহরাব কল রিসিভ করলো।

— হ্যালো লামু,,এসময় কল করলে যে? তুমি ঠিক আছো? বাসায় কারোর কিছু হয়নি তো?

— সবাই ঠিক আছে মেহরাব। এমনি ই কল করলাম। তোমাকে খুব মিস করছিলাম। কোথায় তুমি? হসপিটালে?

— তোমার গলা কাপছে কেন লামিয়া? কেদেছো তুমি? আবার তোমাকে কেউ কিছু বলেছে? মিথ্যে বলবে না খবরদার।

মেহরাবের চিন্তিত গম্ভীর মুখটার দিকে লামিয়া একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মেহরাব চিন্তিত গলায় বার বার হ্যালো হ্যালো করছে।

— আরে ধুর। আমি ঠিক আছি। তুমি অযথাই চিন্তা করো। আচ্ছা, কোথায় আছো বললে না তো?

— আমি নিউমার্কেট এরিয়ায় আছি। আমার এক বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছে। তার সাথেই কথা বলছি। তোমাকে কেপটাউনের সামিয়ার কথা বলেছিলাম না? ওর সাথেই দেখা। তুমি কোথায়? গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে।

লামিয়া এতক্ষণ আটকে রাখা নিঃশ্বাস ছেড়ে হাসার চেষ্টা করে বলল,

— রত্নার সাথে বেরিয়েছি। আজ সারাদিন ঘুরবো। সারাদিন বাসায় থাকতে থাকতে হাপিয়ে গেছি।

— আচ্ছা যাও। সাবধানে থাকবে। কোন সমস্যা হলে সাথে সাথেই আমাকে কল করবে। মনে থাকবে?

— হুম।

লামিয়া কল কেটে স্বস্তির শ্বাস নিলো। মেহরাব কান থেকে ফোন নামিয়ে মুচকি হেসে পাশের মেয়েটিকে কিছু একটা বলছে। মেয়েটাও হাসছে। লামিয়া জানে মেহরাব তাকে নিয়েই কিছু একটা বলছে। মেহরাবকে সন্দেহ করার জন্য এখন নিজের উপরেই রাগ হচ্ছে। এভাবে কিভাবে সে মেহরাবকে সন্দেহ করতে পারে! নিজের কাছেই ছোট লাগছে। আজ মেহরাবের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিবে।

মাহতাব আজ দুপুরে বাসায় আসতে পারেনি। মিটিংয়ের জন্য আজ তাকে গাজীপুর যেতে হয়েছে। বিকেলের দিকে বাসায় আসবে বলেছে। আজ কুলসুম বেগম কে মধু নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছে। মাহতাব না আসতে পারলেও সে তো আছে।

ময়না বেগমের আজ নতুন রোগে ধরেছে। নিচের ফ্লোরের ভাড়াটিয়ার ছেলের বউ আজ ছাদে উঠে তার লাউ গাছের ডগা ছিড়ে নিয়েছে।দুপুরের আগে রহিমা ছাদে উঠেছিল ভেজা কাপড় দিতে। সে ই এসে এই ভয়াবহ খবরটা ময়না বেগম কে দিয়েছে। তখন থেকেই ময়না বেগম কিছুক্ষণ পর পর সেই ভাড়াটিয়ার বাসায় গিয়ে তাকে শাসাচ্ছে। মধু গিয়ে কয়েকবার টেনে আনলেও সে আবার নতুন উদ্যমে নিচে চলে যাচ্ছে ঝগড়া করতে। রহিমা,জরি আর খালা কে নিয়ে একটা টিম বানিয়েছে ময়না বেগম। কতবড় সাহস! তার গাছের লাউয়ের ডগা ছিড়ে নিয়ে আসে! কতো সাধের বাগান তার। এই মেয়ে কিভাবে পারলো এমন নির্মম কাজ করতে!

— দেখো জব্বারের মা,তোমার বউ আগেও অনেকবার এমন করছে। আজ সকাল সকাল আমার গাছের সবগুলো কচি ডগা ছিড়ে নিয়ে এসেছে। এতো সাহস পায় কোথায় তোমার ছেলের বউ? আমি এখনো আমার ভাইদের জন্য ও শাক নেইনি। আর এই মেয়ে নিজের মনে করে ছিড়ে এনেছে! কি অসভ্য মেয়ে এনেছো ছেলের জন্য। সামান্যতম ভদ্রতা জানে না।

ময়না বেগমের রাগে লাল হয়ে যাওয়া মুখটা দেখে জব্বারের মা মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইলো। ছেলের বউ টা আস্ত বেয়াদব। কাউকে মানে না।কারো ধার ও ধারে না। তাই বলে এমন কাজ করবে‌! লাজ্জায় মাথা তুলে তাকাতে পারছে না সে। কিন্তু তার বউয়ের মুখ বন্ধ নেই। সে সমানে ময়না বেগমের সাথে তর্ক করে যাচ্ছে।

— দুটো ডগা ছেড়ায় কি এমন ক্ষতি হয়েছে আপনার? এতো গলাবাজি করছেন কেন? ভাইদের এতো টাকা থাকতেও ছোটলোকের মতো ব্যবহার।

ময়না বেগম রেগে আগুন হয়ে গেলো। রহিমা আর জরি কয়েকবার তেড়ে গিয়েছে ওদের দরজার কাছে। খালা দুজনকে আটকে রেখেছে কোন রকম।আশেপাশের ফ্ল্যাটের মানুষ সব বেড়িয়ে এসেছে। সবাই এই মহিলার উপর বিরক্ত। এর ছোটলোকি স্বভাবের কথা কমবেশি সবাই জানে। ছাদে কাপড় দিলে একটা ক্লিপ ও পাওয়া যায় না। সব এই মহিলা নিয়ে আসে। বললে আবার পায়ে পা বাধিয়ে ঝগড়া করতে আসে। স্বামীর বেতন নেহাৎ ই কম নয়। লাখ দেড়েক বেতন পায়। তবুও ছ্যাচড়ামি ছাড়ে না।

— গলাবাজি কমিয়ে করো মেয়ে। নাহলে গলার রগ ছিড়ে বেহালায় লাগিয়ে দিবো। এতো গলাবাজি করো কিভাবে? লজ্জা করে না? আমার ভাইয়েরা কোটি টাকা ইনকাম করে তাতে তোমার কি?এখন বড় মন দেখিয়ে ভাইদের টাকা তোমার আলমারিতে রেখে যাবো অসভ্য মেয়ে?
বউরে সাবধান করো জব্বারের মা। এর পর এমন কিছু হলে আমি মাহতাবের সাথে কথা বলব। তোমরা পুরনো ভাড়াটিয়া, তাই এবারের মতো মাফ করলাম। বউয়ের মুখে লাগাম টানো। জব্বার অফিস থেকে আসলে আমার সাথে দেখা করতে বলবা।

মধু অসহায় চোখে দুই তালার সীরির কাছে দাঁড়িয়ে আছে। ময়না বেগম কে টেনেও সরানো যায় নি। বিগত দুই ঘন্টা যাবত সে এভাবেই ঝগড়া করে যাচ্ছে। বড়লোকেরা এভাবে ঝগড়া করতে পারে এটা মধুর জানা ছিল না।

শেষ পর্যন্ত কুলসুম বেগম এসে ধমকে ময়না বেগম কে বাসায় নিয়ে এসেছে। রহিমা আর জরি মুখ কালো করে দাড়িয়ে আছে। ঝগড়া মন মতো না হওয়ায় তাদের মুখ ভাড়। ওই বেয়াদবের চুল ধরে দুইটা ঝাকুনি দিতে পারলে একটু শান্তি লাগতো।

— তোমার বাড়াবাড়ি দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে ময়না। এভাবে বস্তির মহিলাদের মতো ঝগড়া করতে গিয়েছো কেন?, মানসম্মান কি আর রাখবে না?তোমার ভাই দুটোর সম্মানের কথা তো ভাবতে পার। ছোট বাচ্চা নও তুমি। নিজেকে ঠিক করো। মাহতাবের সাথে এসব বিষয়ে কোন কথা বলবে না। বুঝেছো?

ময়না বেগম তার মায়ের কথায় কান দিলেন না। রহিমার দিকে তাকিয়ে কর্কশ গলায় বলল,

— নিচে গিয়ে লাউশাক গুলো নিয়ে আসবি৷ আজ বাসায় লাউশাক রান্না করা হবে। ওই অসভ্য যেন আমার লাউ গাছের আশ ও না পায়৷ বেয়াদব।

রহিমা দাত কপাটি বের করে দৌড় দিলো নিচে।তার উপর মহৎ কাজের দায়িত্ব পরেছে। জরি ও পিছু নিয়েছে তার।

খালা রান্নাঘরে চলে গেছে। কুলসুম বেগম মেয়ের খামখেয়ালি পনা দেখে চরম চটে গেল। কাপা কাপা হাতে নিজের লাঠিটা নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। মধু কি করবে বুঝতে পারছে না। চলে যাবে নাকি ময়না বেগমের কাছে গিয়ে বসবে এটা ভেবে সে বিভ্রান্ত।

— এদিকে এসো মধু। তোমার সাথে গোপন কথা আছে।

ময়না বেগমের ষড়যন্ত্রের গলা শুনে মধুর মুখটা শুকিয়ে গেলো। এদের ভাই বোনদের একদম বিশ্বাস নেই। কথা বলে সুস্থ মানুষ কে হার্ট অ্যা*টাক দিয়ে দেয়ার অদম্য প্রতিভা আছে এদের। ধীর পায়ে ময়না বেগমের পাশে গিয়ে বসতেই সে ফিসফিস করে বলল,

— তোমাদের মধ্যে সব ঠিকঠাক চলছে তো? কবে সুখবর পাবো?মাহতাবের এক্টিভিটি কেমন?

মধু মুখ পাংসুটে করে বসে রইল। এক্টিভিটি মানে! এসব কি ধরনের কথা! মা*রার হলে গু*লি করে মেরে ফেলুক। এভাবে কথার বো*ম ফেলার কি দরকার?

ময়না বেগম মধুর ফ্যাকাসে মুখ দেখে মুখ কুচকে ফেললো। মনে মনে তিনি একশ ভাগ শিউর তার ভাই বউয়ের কাছে ফেইল করেছে।

— মন খারাপ করো না।

মধু চুপ করে বসে রইল। মধুকে মন খারাপ করতে না বলে নিজেই মন খারাপ করে বসে রইল। ইসস,এইটুকু মেয়েটার জীবন তিনি বরবাদ করে!

মাগরিবের আজানের পর পর মাহতাব বাসায় ঢুকেছে। মধু নিজে দরজা খুলেছে। মাহতাব মধুর দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে রুমে চলে গেলো। মধু নিজেও কিচেনে ছুটল এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত বানাতে। বেচারাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে।

মাহতাব ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো মধু তার জন্য শরবত আর হালকা কিছু নাস্তা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাহতাব হাতের ইশারায় বারান্দায় নিয়ে আসতে বলে ভেজা টাওয়াল নিয়ে বারান্দায় চলে গেলো।
মধুও মাহিতাবের পেছনে বারান্দায় গেলো। হাতের ট্রে টা ছোট টেবিলে রেখে নরম গলায় বলল,

— শরবত টা খেয়ে নিন। ভালো লাগবে।

— আমার পাশে এসে বসো। আরো বেশি ভালো লাগবে।

মধু আবার ভড়কালো। সারাদিন বোন লাগামহীন কথা বলে। এখন এই জনাব এসেও শুরু করেছে।

মাহতাব তিন চুমুকে শরবত শেষ করে মধুর হাত ধরে তার পাশে বসিয়ে দিলো।

— আমার কাছে কাছে থাকবে। ঠিক আছে?

— হুম।

— ফ্যামিলি প্ল্যানিং এর ব্যপারে কি ভাবলে?

মধু ক্লান্ত শ্বাস ছাড়লো। এর উত্তর তার কাছে নেই।

— আমি এসব বুঝি না।

— তাহলে কি আমি বুঝে নিবো? অভিযোগ করবে না তো?
তখন কিন্তু আমার দোষ দিতে পারবে না।

চলবে,,
(রিচেক করা হয় নি। অনেক পেইন নিয়েই লিখলাম। প্রেসার কমে যাওয়ায় ঘারের রগ থেকে এই সমস্যা হয়েছে। অনেকেই আমার সেই পোস্ট দেখেন নি। তাই আবার বলছি,আমার দুই আঙুল ফুলে আছে। ঘাড়ের রগ থেকে ডান হাত পুরো টাই ব্যথা। আশা করি বুঝবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here