আমার_অবেলায়_তুমি
সানজিদা_বিনতে_সফি(সাথী)
পর্ব_ ১০
মাহতাব বেরিয়েছে আসরের আগে আগে। মধু আসরের নামাজ পড়ে কুলসুম বেগমের রুমে গেলেন। ময়না বেগম তার সাথে বসে। দুজনে কিছু একটা আলোচনা করছে।
— আসবো মা?
— আরে এসো বড় বউমা। আমার কাছে এসে বসো।
মধু ধীর পায়ে কুলসুম বেগমের পাশে গিয়ে বসলো। ময়না বেগম মধুর কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,
— মাহতাবের সাথে সব ঠিকঠাক আছে ? বজ্জাতটা তোমাকে আবার সিনামার ডায়ালগ শোনায় নি তো?
মধু অবুজের মতো ময়না বেগমের দিকে তাকিয়ে রইলো৷ কিছু না বুঝে মলিন গলায় বলল,
— বুঝি নি আপা।
— আহ! ও মা, মাইয়া তো কিছুই বোঝে না! শোন, মাহতাব কি তোমাকে খাটে জায়গা দিয়েছে? নাকি সিনেমার মতো বলেছে,আমার খাটে তোমার জায়গা হবে না। যাও ব্যালকনিতে গিয়ে শুয়ে পরো।
ময়না বেগমের নাটকিয় ভঙ্গি দেখে হেসে ফেললো মধু। কুলসুম বেগম ধমকে উঠে বলল,
— এসব কি ধরনের কথাবার্তা ময়না। বুড়ো হয়ে যাচ্ছো এখনো বুদ্ধি হলো না? তাদের ব্যক্তিগত ব্যপারে নাক গলাচ্ছো কেন?
ময়না বেগমের কোন হেলদোল হলো না। সে মধুকে উত্তরের জন্য তাড়া দিলো।মধু ময়না বেগমকে আস্বস্ত করে বলল,
— এমন কিছুই হয়নি আপা। সে আমার সাথে খুব ভালো ব্যবহার করে।
ময়না বেগম হা হুতাশ করে উঠলো। কুলসুম বেগমের কাছে নালিশ করার ভঙ্গিতে বলল,
— দেখেছো মা দেখেছো? বিয়েই করতে চাইছিল না।আর এখন বউ নিয়ে খাটে ঘুমায়!
কুলসুম বেগম বিরক্ত হলেন। মেয়ের ভিত্তিহীন কথা শুনে মুখ কুচকে বললেন,
— তাহলে তুমি কি চাইছিলে? সে বউকে মেনে না নেক? মধুকে ফ্লোরে শোয়ালে খুব খুশি হতে বুঝি?
ময়না বেগম মুখ বাকালেন।
— একদম ছেলের পক্ষ নিবে না। তাহলে এতো ঢং করার কি দরকার ছিল। ওর জন্য আমাদের অনশনে নামতে হয়েছিল ভুলে গেছো! তোমার ছেলের পেটে পেটে শয়তানি।
কুলসুম বেগম চুপ রইলেন। মেয়ের সাথে তর্কে গিয়ে নিজের ছেলেদের নামে বদনাম শুনতে সে মোটেও ইচ্ছুক নয়।
মধু কি বলবে বুঝতে পারছে না। আমতা আমতা করে বলল,
— চা খাবেন মা? আপা আপনার জন্য চা নিয়ে আসি?
— ওমা,তুমি যাবে কেন? রহিমা দিয়ে যাবে। খালা এলেই একসাথে খাবো।
— আমি করে আনি প্লিজ।এভাবে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করে না আপা।
ময়না বেগম হেসে ফেললো।
— আচ্ছা যাও৷ মায়ের ডায়েবিটিস আছে। চিনি দিও না।
— আচ্ছা।(হালকা হেসে)
— লামিয়া কেও ডেকে নিও। মেয়েটার যে কি হয়েছে কে জানে? খুব চুপচাপ থাকে ইদানীং।
মধু মাথা নাড়িয়ে সায় জানিয়ে চলে গেলো। লামিয়ার রুমের সামনে গিয়ে দরজায় হালকা নক করলো।
— আপু,,আছো?
— কে, ভাবি?দরজায় দাড়িয়ে কেন? ভিতরে এসো।
লামিয়া বারান্দা থেকে তড়িঘড়ি করে রুমে এলো। মধু রুমে ঢুকে লামিয়ার মলিন চেহারা দেখে নিজের মুখটাও মলিন করে ফেললো।
— বসো না ভাবি।
— বসবো না আপু। সবার জন্য চা বানাবো। তুমিও এসো না বাইরে।
— তাই! চলো তাহলে।
লামিয়ার সাথে কিচেনে চলে গেলো মধু।
মেহরাব আসলো সন্ধ্যায়। লামিয়া নিজেই গিয়ে দরজা খুললো। মেহরাব মলিন হাসলো। লামিয়া কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো মেহরাবের ক্লান্ত মুখের দিকে।
— ভিতরে আসতে দিবে না?
— ওহ,,এসো।
মেহরাব হেসে লামিয়ার নাক টেনে দিলো। ভিতরে ঢুকে ময়িনা বেগম কে ড্রয়িং রুমে দেখে অসহায় চোখে লামিয়ার দিকে তাকালো। ময়িনা বেগম নিশ্চিত এখন তার ক্লাস নিবে!
— এদিকে আয়।
— ফেশ হয়ে আসি আপা?বাইরে থেকে এসেছি। শরীরে খুব জীবানু। পাচ মিনিটে আসছি।
— একদম নাটক করবি না।আম্মার জন্য আখ আনতে বলেছিলাম, কাঠ নয়। তুই কি আমাদের দাত ভেঙ্গে মা*রতে চাইছিলি? (কটমট করে)
— কি বলো আপা!আমি নিজে খেয়ে চেক করে এনেছি।আখ তো ভালোই ছিল।
— আমি মিথ্যা বলছি?তুই আমাকে মিথ্যাবাদী বললি!মায়ের পেটের ভাই হয়ে তুই আমাকে এভাবে অপমান করলি! ওমা,,দেখে যাও তোমার ছেলে আমাকে কি বলছে।আমি আজই বাপের বাড়ি চলে যাবো।
মেহরাবের মুখটা থতথমে হয়ে গেলো। কোথাকার কথা কোথায় চলে গেলো তা ভাবতে ভাবতে মাথা ধরে যাওয়ার জোগাড়। সে হতভম্ব গলায় বলল,
— তুমি বাবার বাড়িতেই আছো আপা।
— তুই আমাকে বাবার বাড়ির খোটা দিলি! তোদের বাড়ি থাকি এটা চিৎকার করে বলে আমাকে অপমান করলি! আমি আজই চলে যাবো। ছোট ভাইদের এতো অপমান সহ্য করে থাকতে পারবো না।ও বাবা গো,,তুমি আমাকে কোথায় ফেলে গেলে!
মেহরাব মুখটা কাচুমাচু করে ফেলল।তার মনে হতে লাগলো সে নিশ্চয়ই আপা কে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। সব দোষ ওই বেটা আখ ওয়ালার। তাকে এই ভাবে ফাসিয়ে দিলো!
লামিয়া ঠোঁট কামড়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। যে কোন সময় তার মুখ ফসকে হাসি বেরিয়ে যাবে।
ময়না বেগমের আহাজারি শুনে মধু কিচেন থেকে বেড়িয়ে এসেছে। মেহরাবের কাচুমাচু মুখটা দেখে তার বড্ড মায়া হলো। ময়না বেগম আচলে মুখ গুজে গুনগুন করে কাদছে।
কুলসুম বেগম রুম থেকে রহিমার সাহায্যে বেড়িয়ে এসেছে। মেয়ের অত্যাচারে তার ছেলে দুটো অতিষ্ঠ। তবুও মুখ ফুটে একটা শব্দ ও করে না।
— দাড়িয়ে আছো কেন? গিয়ে ফ্রেশ হও।
মায়ের অনুমতি পেতেই মেহরাব দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করলো। মেহরাব যেতেই ময়না বেগম কান্না বন্ধ করে চা খাওয়ায় মন দিলো। কুলসুম বেগম দু পাশে মাথা নাড়িয়ে মেয়ের পাশে বসে পরলো।
— আর কতো জ্বালাবে ওদের? সারাক্ষণ পিছনে পরে থাকো কেন? সমস্যা কি?
ময়না বেগম চা রেখে আবার গুনগুন করে কাদতে লাগলো। আচল দিয়ে নাকের পানি মুছে হা হুতাশ করে বলল,
— তুমি এই কথা বলতে পারলে মা!এই তুমি আমার মা তো? নাকি আমাকে ড্রেনের পাশে কুড়িয়ে পেয়েছিলে? সত্যি করে বলো আমি বাবার আগের ঘরের মেয়ে না তো?(সন্দিহান গলায়)
— পাগল হয়ে গেছো? কিসব বাজে কথা বলছো?
— সত্যি করে বলো কোন ড্রেনের পাশে কুড়িয়ে পেয়েছিলে? আমি সেখানেই চলে যাব। তখন অন্তত কেউ থাকার খোটা দিবে না।
কুলসুম বেগম চুপ রইলেন। কথা বাড়িয়ে নিজের মাথা খারাপ করার মানে হয়না।
মধু অসহায় চোখে তাকিয়ে সব দেখছে।তার কি বলা উচিত, কি করা উচিত মাথায় আসছে না। তাই চুপ করে এক কোনে দাড়িয়ে রইলো। লামিয়া মেহরাবের সাথে সাথেই রুমে ঢুকেছে।
মাহতাব আসতে আসতে রাত দশটা বেজে গেছে। মেহরাব ময়না বেগমের ভয়ে আর রুম থেকেই বের হয়নি।কখন আপার কোন কথার প্যাচে পড়তে হয় কে জানে!
রাতে খাবার টেবিলে ময়না বেগম কে দেখা গেল না। মাহতাব জিজ্ঞেস করতেই লামিয়া সবকিছু খুলে বললো। মাহতাব দারোয়ান কে কল করে আখ নিয়ে আসতে বলে ময়না বেগমের রুমের দিকে পা বাড়ালো।
— আপার মেডিসিন গুলো বদলানো দরকার ভাই।ইদানীং বেশি বাচ্চামি করছে।
মাহিতাব ‘দেখছি’ বলে ময়না বেগমের রুমে চলে গেলো।
— আপা।
— আমি কারো আপা না। আমাকে ড্রেনের পাশে রেখে আয়। আমি ওখানেই থাকবো।
— তুমি আমাদের একমাত্র আপা। তোমাকে ড্রেনের পাশে রেখে আমরা বাসায় থাকবো কি করে? তার চেয়ে বরং আমরা সবাই ড্রেনের পাশে চলে যাবো। ড্রেনের আশে পাশে একটা বাসা বানিয়ে নেই আগে।এখন চলো খাবে।
— তোরা কেন যাবি? তোরা তো ইব্রাহীম বাড়ির ছেলে।আমাকে কুড়িয়ে এনেছে আমি যাব।
— খুদা পেয়েছে আপা। আসো না।
মাহতাবের ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের জেদ ছেড়ে দিলো ময়না বেগম। ভাইয়ের ক্লান্ত মুখে হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বলল,
— না খেয়ে আছিস কেন ভাই? খেয়ে নে।
— তোমাদের ছাড়া আমি খাই?
— চল চল।আগে খেয়ে নেই। খাওয়ার পরে তোর ছোট ভাই আর বাবার দ্বিতীয় পক্ষের সাথে একটা হেস্তনেস্ত করবো।
— আচ্ছা।
ময়না বেগম কে ডাইনিং এ দেখে মেহরাব দাত বের করে হাসলো। নিজের চেয়ার ছেড়ে ময়না বেগমের পাশে বসে আহ্লাদী গলায় বলল,
— রাগ করো কেন আপা। আমি তো তোমার সাথে মজা করছিলাম।
— দূর হ বেয়াদব।তোকে আমার ভালো করে চেনা আছে।আস্তো বদ একটা। গিয়ে তোর মায়ের কোলে উঠে বসে থাক।আমার পাশে আসবি না।
মেহরাব ময়না বেগমের কথা পাত্তা না দিয়ে তাকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরল। ময়না বেগমের গালে চুমু খেয়ে শব্দ করে হাসলো।মাহতাব আর কুলসুম বেগম মুচকি হাসলো।
— তুমিও বসে পরো মধু। আমরা নিজেদের টা নিয়ে খেতে পারি।দাড়িয়ে থাকতে হবে না।
মধুও বসে পরলো তাদের সাথে। এই পরিবার টা দেখলে ওর মন ভরে যায়। এতো ভালোবাসায় ঘেরা পরিবার টা এখন তার নিজের। এই ভালোবাসাময় মানুষ গুলো ও তার।
কয়েকদফা বৈঠক শেষ করে রুমে যেতে যেতে বারোটা বাজলো।মাহতাব আজ খুব ক্লান্ত। কয়েক জায়গায় দৌড়াতে হয়েছে আজ।
— আপাকে কিন্তু আমার দারুণ লাগে।
মধু হাসিমুখে কথাটা বলে বিছানা ঠিক করতে লাগলো।মাহতাব কপালে হাত রেখে সোফায় গা এলিয়ে বসে ছিল। মধুর কথা শুনে সোজা হয়ে বসলো। ধীর পায়ে হেটে মধুর পিছনে দাড়িয়ে মন্থর গলায় বলল,
— আর আপার ভাইকে?
মধু কেপে উঠলো। হচকচিয়ে ঘুরতে গিয়ে মাহতাবের বলিষ্ঠ বুকে ধাক্কা খেয়ে বিছানায় বসে পারলো।
— বললে না তো!
মধু অসহায় মুখে হাত কচলাতে লাগলো।মাহতাব এখনো দাঁড়িয়ে। যেন জবাব না নিয়ে সে যাবে না।
চলবে,,