#আবেগময়_সম্পর্ক
#২৮তম_পর্ব
#লেখিনীতে_মৃদু_সুপ্রিয়া
মেহুল ঘরে বসে ছিল এমন সময় তার কাছে পিহুর ফোন কল আসে৷ মেহুল ফোনটা রিসিভ করে কান্নায় ভেঙে পড়ে। পিহুকে সব কিছু খুলে বলে। সব শুনে পিহু বলে, “তুই কাঁদিস না আপি৷ আমি আসছি ওখানে৷ তোর সাথে যা হয়েছে খুব অন্যায়। আমি এর শে*ষ দেখে ছাড়ব।”
মেহুল সারা রাত বেলকনিতেই কাটিয়ে দেয়। আকাশও লজ্জা এবং নিজের উপর রাগ থেকে মেহুলের সাথে কথা বলে না। সকালে উঠে আকাশ অফিসে চলে যায়। যাওয়ার আগে মেহুলকে সরিও বলে যায় কিন্তু মেহুল কোন রেসপন্স করে না।
মেহুল মায়ানকে তৈরি করে নিয়ে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে চলে আসে। বাড়িতে এসে সে টিভিতে নিউজ দেখে আজ অনেক ভাড়ী বৃষ্টিপাত হওয়ার আশংকা আছে। এই নিউজ দেখে মেহুল ভয় পেয়ে যায়৷ কারণ মায়ানকে স্কুল থেকে আনতে যেতে হবে। তাই মেহুল দ্রুত তৈরি হয়ে ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। মায়ানকে নিয়ে চলে আসতে নেবে তখন রায়ানকে দেখতে পায়। মেহুল শুধু এক বার রায়ানকে জিজ্ঞাসা করে সে তার সাথে আসতে চায় কিনা। কিন্তু রায়ান নিজের তেজ দেখিয়ে বলে, “আমি ছোট বাচ্চা নই। আমি একাই যেতে পারব।”
গতকালের তিক্ত অভিজ্ঞতার পর মেহুলের আর কিছু বলার ইচ্ছা ছিল না৷ তাই মেহুল একাই মায়ানকে নিয়ে চলে আসে। রায়ান তার কিছু বন্ধু দের নিয়ে ক্রিকেট খেলা খেলতে মাঠে যায়। মাঠে গিয়ে তারা ক্রিকেট খেলতে শুরু করে।
____________________
মেহুল বাড়ি ফিরতে ফিরতে মৃদু মৃদু বৃষ্টি পড়তে শুরু করে দিয়েছে। মেহুল ও মায়ান আসার সময় অল্প ভিজে গেছে। মেহুল প্রথমেই মায়ানের গা মুছে দেয়। এরপর নিজের শরীরও মুছে নেয়। এরপর মেহুল সোফায় বসে পড়ে। সে ভাবতে থাকে কিভাবে ধীরে ধীরে তার সাজানো সংসারটা ধ্বংসের দিকে চলে গেলো। এসব ভেবেই মেহুল একটা ডায়েরি বের করল। এরপর সেই ডায়রিতে লিখতে শুরু করে দিল,“আমার জীবন অনেক বৈচিত্রময় হয়ে গেছে৷ জীবনে সব থেকে বড় সার্থকতাই বুঝি কারো অনেক কাছের হওয়া। কারো আপন হওয়া৷ কিন্তু আমার দূভার্গ্য আমি যাদের আপন ভেবেছি তারা কেউই আমাকে আপন ভাবে নি। এই আফসোস আমার থেকেই যাবে। যেই রায়ানকে নিজের ছেলের মতো মানুষ করেছি তার কাছে আজ আমি সৎ মা। যেই আকাশের জন্য আমি এত কিছু করলাম সে পর্যন্ত আমার গায়ে হাত তুলেছে৷ এসব কিছুর পর আমার নিজেকে সব থেকে বেশি অসহ্য লাগছে। জীবনটাকে অনেক বেশি টক্সিক মনে হচ্ছে। খুব ভালো হতো যদি এই জীবন থেকে মুক্তি পেতাম। কিন্তু আমার নিজের ছেলে আমার মায়ানের জন্য আমাকে বাঁচতে হবে। আমি চাই মায়ানকে মানুষের মতো মানুষ করতে। ব্যাস আমার আর কোন চাওয়া নেই এই জীবনে।”
ডায়েরির পাতায় এতটুকু লিখেই দীর্ঘ শ্বাস নিলো মেহুল। তার চোখের কার্নিশে জলও জমেছে অল্প অল্প। প্রকৃতিতে যেমন বর্ষণ চলছে তেমনি তার চোখ দিয়েও গড়িয়ে চলছে জলের ধারা।
মেহুল একটু ফ্রেশ হয়ে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখতে পেল বৃষ্টির বেগ বৃদ্ধি পেয়েছে। মেহুলের এবার একটু টেনশন হয়। সে রায়ানের কথা ভাবে।এখনো রায়ান বাড়ি ফেরেনি। এই বৃষ্টিতে রায়ানের আবার কোন বিপদ হলো কিনা সেটাই ভাবছিল মেহুল। এমন সময় খুব জোরে বর্জ্যপাত হলো। মেহুল কেপে উঠল। তার মনে পড়ে যায় রায়ান বর্জ্যপাতে খুব ভয় পায়।
মেহুল আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারল না। মায়ানকে বিছানায় শুইয়ে দিল। আর বলল, “তুমি এখানেই থাকো। বাইরে যেও না। আমি তোমার ভাইয়াকে নিয়ে আসছি।”
মায়ান বলে, “বাইলে তো অনেক বৃট্টি(বৃষ্টি) হততে আম্মু। তুমি দেওনা(যেওনা)”
মেহুল মায়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “কোন চিন্তা করো না। আমি এই যাবো আর এই আসবো।”
“তুমি থত্তি(সত্যি) আথবে তো?”
“হুম”
বলে মেহুল মায়ানকে ঘরে রেখে চলে যায়। যাওয়ার আগে তাদের পাশের বাড়ির আনোয়ারা বেগমকে একটু মায়ানের পাশে থাকতে বলে। আনোয়ারা বেগম মায়ানকে নিজের নাতির মতোই দেখে। তার দুই ছেলেই বিদেশে থাকে। দেশে নিজের স্বামীর সাথে একাই থাকেন তিনি। তাই মেহুল যখন আবেদন করে তখন তিনি জানান তিনি থাকবেন।
আনোয়ারা বেগমকে মায়ানের পাশে রেখে মেহুল রওনা দেয় রায়ানকে খুঁজতে। কিছু দূর আসার পর মেহুল দেখতে পায় রায়ান রাস্তা দিয়ে ছুটে ছুটে আসছে। খুব বর্জ্যপাত হচ্ছে তাই হয়তো রায়ান ভয় পাচ্ছে। মেহুল একটু জোরে চিৎকার করে বলে, “রায়ান ধীরে আসো।”
কিন্তু রায়ান দ্রুত আসার চেষ্টা করে। অতর্কিতে রাস্তা পার হতে ধরে রায়ান। এমন সময় একটি গাড়ি সেদিকেই আসতে থাকে। মেহুলের নজর যায় সেদিকে। মেহুল রায়ানকে সরে যেতে বলে কিন্তু রায়ান জোরে ছুটে আসছিল। মেহুল কোন উপায় না পেয়ে দ্রুত ছুটে যায়। রায়ানকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়। কিন্তু নিজে গাড়ির সাথে ধাক্কা খায়। মুহুর্তেই মেহুলের রক্তাক্ত দেহ রাস্তার মধ্যে ছিটকে পড়ে। রায়ান এটা দেখে চিৎকার করে বলে ওঠে, “নতুন মা..”
মেহুলের শ্বাস দ্রুত পড়ছিল। রায়ান মেহুলের কাছে এসে বলে, “তুমি কেন আমাকে বাঁচানোর জন্য এত বড় রিস্ক নিলে নতুন মা? আমি তোমাকে কত ভুল বুঝেছি কত অপমান করেছি আর তুমি…তুমি চিন্তা করো না আমি তোমার কিছু হতে দেবো না।”
মেহুল রায়ানের হাত ধরে বলে, “আমার কাছে আর বেশি সময় নেই রায়ান। আমি তোমাকে সব সময় নিজের ছেলেই ভেবেছি। তোমাকে শুধু একটাই অনুরোধ করব আমার মায়ানকে মানে তোমার ভাইকে দেখে রেখ। ওর কোন অযত্ন হতে দিও না।”
রায়ান কান্না করতে করতে বলে,“না তোমার কিছু হবে না।”
রায়ান পাগলের মতো এদিকে ওদিকে ছুটতে থাকে। কিন্তু বৃষ্টির দিন হওয়ায় রাস্তা প্রায় ফাঁকা। মেহুলকে যেই গাড়িটা ধাক্কা দিয়েছে সেটাও পালিয়ে গেছে।
রায়ান অনেক কষ্টে দুই তিনজন মানুষকে খুঁজে নিয়ে আসে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। মেহুল মারা গেছে। রায়ান মেহুলের কাছে এসে তাকে জড়িয়ে বলতে থাকে,“কি হয়েছে তোমার নতুন মা? কথা বলো আমার সাথে। আমাকে শাসন করো, মা★রো যাই করো না কেন প্লিজ ফিরে আসো। আমি আর কখনো তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করব না। প্লিজ আমাকে এত বড় শাস্তি দিওনা।”
রায়ান মেহুলের সাথে কা★টানো তার সমস্ত মুহুর্ত মনে করতে থাকে। সেই প্রথম বিয়ের দিন মেহুল যখন রায়ানকে নিজের ছেলে করে আগলে নেয়। তখন থেকে রায়ানকে কতো আদর ভালোবাসা দিয়েছে। রায়ানের প্রতি সব অবদান মনে করে। আসলে একটা কথা ঠিক দাঁত থাকতে কেউ দাঁতের মর্যাদা দেয় না,কিন্তু হারালে ঠিকই আফসোস করে। তাই এখন রায়ান কান্না করতে করতে বলে,“নতুন মা, তুমি প্লিজ চোখ খোল। তাকাও আমার দিকে।”
রায়ানের সাথে আসা লোকেরা এসে তাকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। মেহুলের পালস চেক করে আর নিঃশ্বাস পড়ছেনা দেখে একজন বলে,“ইনি তো মা★রা গেছেন।”
কথাটা শুনে রায়ান স্তব্ধ হয়ে যায়। একজন তাকে বলে, “ইনি কি তোমার মা? তোমার পরিবারের কারো নাম্বার দাও। ইনি মারা গেছেন। তোমার পরিবারকে তো জানাতে হবে।”
রায়ান ভাবলেশহীন ভাবে আকাশের নাম্বারটা বলে। তারপর মেহুলের নিথর দেহের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে, “তুমি আমার উপর অভিমান করে চলে গেলে নতুন মা। এই অপরাধবোধ নিয়ে আমি সারাজীবন কিভাবে বাঁচবো? আমাকে তুমি অপরাধী বানিয়ে চলে গেলে।”
#চলবে