#আবেগময়_সম্পর্ক
#২৪তম_পর্ব
#লেখিনীতে_মৃদু_সুপ্রিয়া
মেহুল অন্তরার হাতে হাত রেখে বলে,“আপনি আমাকে ক্ষমা করে দেবেন প্লিজ। আপনার জীবনে যে এত কিছু হয়ে গেছে সেই সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই ছিল না। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, রায়ানকে আমি আপনার কাছে এনে দেব। শুধু তাই নয়, আপনাকে আপনার পুরো পরিবার…”
মেহুলের কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই অন্তরা বলে, “আমি জানি তুমি কি বলতে চাইছ। কিন্তু সেটা হবার নয়।এমনিতেও এই পৃথিবীতে আমি আর মাত্র কয়দিনের অতিথি। এই দুদিনের জন্য এসে আমি তোমার জীবন তোলপাড় করে দিতে চাই না। তাই আমি তোমাকে অনুরোধ করব, আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যেন সত্য কারো সামনে না আসে। এতেই সব কিছু ঠিক থাকবে।”
মেহুল বলে, “আপনি এমন কেন করছেন বলুন তো? আপনার শেষ সময়ে তো নিজের পরিবারের সান্নিধ্য পাওয়া প্রয়োজন।”
অন্তরা নাছোড়বান্দা। সে বলে, “আমি এক জন মৃত্যু পথযাত্রী ব্যাক্তি। আশা করি আমার অনুরোধ তুমি ফেলবে না। ধরো, এটাই আমার শেষ ইচ্ছা যে আমার মৃত্যুর আগে যেন আকাশ ও ওরা আমার সম্পর্কে কিছু না জানে। তারা যেন সেটাই ভাবে যেটা আমি তাদের বলেছি। যে আমি আসলে সবাইকে ঠকিয়েছি।”
এপর্যায়ে মেহুল আর নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরে অশ্র ভেজা চোখে বলে,“এমন একটা শর্ত দিয়ে আপনি ঠিক করলেন না। শুধু মাত্র আমার কথা ভেবে আপনি নিজের শেষ সময়ে নিজের ভালোবাসার মানুষদের থেকে দূরে থাকবেন! এটা কি ঠিক?”
অন্তরা তখন মৃদু হেসে বলে, “আমার সারা জীবন অনেক কষ্টের সাথে অতিবাহিত হয়ে গেছে। আমি এই শেষ সময়ে একটু শান্তিতে থাকতে চাই। আমি জানি তুমি অন্যরকম। কিন্তু একজন মেয়ে কখনো তার স্বামীর পাশে অন্য কারো উপস্থিতি মেনে নিতে পারে না। সেখানে আমি তো এখনো তোমার স্বামীর প্রথম স্ত্রী। আমাদের ডিভোর্সও হয়নি। এই মুহুর্তে যদি আমি ফিরি তাহলে তুমি একটু হলেও জেলাস হবে। আর তোমার বিন্দুমাত্র কষ্টের কারণ হয়তো শেষ সময়ে আমাকে কষ্ট দেবে। তাই আমি চাই না, কেউ সত্যটা জানুক। তুমি শুধু রায়ানকে আমার কাছে এনে দাও। শেষ কয়টা দিন নিজের ছেলেকে আকড়েই বাঁচতে চাই আমি।”
___________°°°_
মেহুল বাড়িতে এসে রায়ানকে তৈরি করে বাইরে নিয়ে যাচ্ছিল। তখন আকাশ তার সামনে এসে বলে, “এই সময় তুমি রায়ানকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছ?”
মেহুল কোন ভনিতা ছাড়াই বলে, “আমি ওকে ওর মায়ের কাছে দিতে যাচ্ছি।”
মেহুলের কথা শুনে আকাশ অবাক হয়ে যায়। আকাশ রেগে গিয়ে বলে,“এমনটা তুমি কিভাবে করতে পারো? তুমি তো বলেছিলে রায়ানকে দূরে যেতে দেবে না তাহলে এখন এমন করছ কেন?”
মেহুল শান্ত ভাবে বলে, “কারণ তুমি তো রায়ানের নিজের বাবা নও। আমিও রায়ানের নিজের মা নই। তাই ওর উপর আমাদের কোন অধিকার নেই। ওর আসল মা যখন ওকে ফেরত চাইছে তখন নিয়ে নিক অসুবিধা কি।”
আকাশ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মেহুলের দিকে। এরপর তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে,“মানুষ ঠিকই বলে, সৎ মা কখনো আপন হয়না। রায়ান তোমার নিজের সন্তান নয় জন্যই ওকে এত সহজে অন্তরার হাতে তুলে দিতে চাইছ। তার মানে এত দিন তুমি রায়ানের মা হওয়ার নাটক করছিলে তাই তো?”
আমিনা আক্তার দূরে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলেন। আকাশের মুখে এমন কথা শুনে তিনি রেগে যান। এগিয়ে এসে আকাশের উদ্দ্যেশ্যে বলেন,“তুই কিন্তু এসব ঠিক বলছিস না আকাশ। আমি জানি মেহুল রায়ানকে কতটা ভালোবাসে। আর জানি জন্যই বলছি মেহুলের সিদ্ধান্ত একদম সঠিক। একটা বাচ্চা তার মায়ের কাছেই সবথেকে ভালো থাকে। রায়ানের সাথে তোর তো কোন রক্তের সম্পর্ক নেই। তাহলে তুই কেন ওকে যেতে দিতে চাইছিস না?”
আকাশ আর বলার মতো কিছু খুঁজে পায় না। তাই সে চুপ করে থাকে। আমিনা আক্তার চোখমুখ শক্ত করে বলেন,“মেহুল তুমি যাও রায়ানকে ওর মায়ের কাছে দিয়ে এসো।”
মেহুল বেরিয়ে যায়।
_________________
অন্তরার বাড়ির সামনে এসে কলিং বেল বাজায় মেহুল। কিন্তু কেউ দরজা খোলে না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর সে ধৈর্যহারা হয়ে অন্তরাকে কল দিতে থাকে। কিছু সময় পরেই অহনা এসে দরজা খুলে দেয়। তাকে খুব বিধ্বস্ত লাগছিল। দরজা খুলে দিয়েই অন্তরা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আর তার কান দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে। মেহুল ভয়ে চিৎকার করে ওঠে।
❤️
অন্তরার জ্ঞান ফিরলে সে নিজেকে হাসপাতালে আবিস্কার করে। তার বেডের পাশেই বসে ছিল আকাশ। আকাশ অন্তরার হাত ধরে কান্না করছিল।
অন্তরা সামনে তাকাতেই দেখতে পায় মেহুল রায়ানকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেহুল অন্তরাকে বলে,“আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। আমি আপনাকে দেওয়া কথা রাখতে পারিনি। আকাশকে আমি সব বলে দিয়েছি আপনার ব্যাপারে। কারণ আমি চেয়েছি এই শেষ সময়ে আপনি তার সঙ্গ পান।”
এদিকে আকাশ অন্তরার হাত ধরে কান্না করে বলে, “ভাগ্যের কাছে আমরা এত অসহায় কেন অন্তরা? জানো আমি একসময় তোমার জন্য কতটা পাগল ছিলাম। তোমাকে পাওয়ার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে কত কান্নাকাটি করেছি। ফলশ্রুতিতে তোমাকে পেয়ে তো গিয়েছিলাম কিন্তু আগলে রাখতে পারিনি। আর আজ দেখ তোমাকে চিরকালের মতো হারাতে চলেছি।”
অন্তরার মাথায় অনেক যন্ত্রণা হচ্ছিল। তবুও সে অনেক কষ্টে বলে, “ভাগ্য নিয়ে কখনো আফসোস করো না। যা হয় ভালোর জন্যই হয়। আমাদের একসাথে পথ চলা হয়তো ওটুকুই ছিল।”
আকাশ ডুকরে কেঁদে ওঠে। অন্তরা আকাশের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে, “শেষবেলায় তোমাকে কাঁদতে দেখতে চাই না। আমি চাই তুমি হাসি মুখে আমাকে বিদায় দাও।”
আকাশ অসহায়ের মতো বলে,“তোমার সারাটা জীবন দুঃখেই কে*টে গেল। সুখের দেখা তুমি পেলে না।”
অন্তরা ইশারা করে মেহুলকে কাছে ডাকে। মেহুল কাছে আসে। রায়ানকে অন্তরার বেডে বসিয়ে দেয়। অন্তরা রায়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,“এই তো আমার সুখ। আমার সন্তান।”
এরপর মেহুল আর আকাশের হাতে হাত মিলিয়ে দিয়ে অন্তরা বলে,“তোমরা দুজন সবসময় এভাবে একসাথেই থেকো। আর আমার রায়ানকে দেখে রেখো। আমার আর কিছু চাওয়া নেই।”
এটুকু কথা বলেই অন্তরার অবস্থার অনেক বেশি অবনতি ঘটে। দ্রুত তার নিঃশ্বাস পড়তে থাকে। হার্টবিটও দ্রুত কমছিল। নাক, কান দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়তে থাকে৷ এভাবেই একসময় অন্তরার জীবন থেমে যায়।
ডাক্তার অন্তরার মৃত্যু নিশ্চিত করার সাথে সাথেই ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে আকাশ, রায়ান ও মেহুল৷ রায়ান অন্তরার নিথর শরীর আকরে ধরে মা মা করে কাঁদতে থাকে। মেহুলও কষ্ট পায় অন্তরার জন্য। কারণ মেয়েটা নিজের কথা না ভেবে মেহুলের কথা ভেবেছিল সবসময়।
আকাশ অন্তরার হাত ধরে বলে,“পৃথিবীতে অনেক কষ্ট পেয়েছ তুমি। আশা করছি পরকালে অনেক ভালো থাকবে।”
অন্তরার মৃত্যুর পর তার দেহ নিয়ে আকাশ বাড়িতে নিয়ে আসে। আজ আমিনা আক্তারও অন্তরার জন্য কাঁদেন। মেয়েটাকে কত ভুল বুঝেছিলেন তিনি। কিন্তু মেয়েটা তো নির্দোষ ছিল। বরঞ্চ সে সারাটা জীবন কষ্টেই পার করে দিল।
আশিক, পিহু সবারই মন খারাপ। অন্যান্য মানুষেরাও সবাই হা হুতাশ করছে অন্তরার মৃত্যুতে। মেহুল অন্তরার উদ্দ্যেশ্যে শেষবারের মতো বলে, “উনি সত্যিই অনেক অভাগী ছিলেন। নিজের সন্তানকে শেষ ক’টাদিন নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আফসোস সুযোগই পান নি।”
#চলবে