#আফিম_বড্ড_নেশালো
পর্বঃ০৫
লেখিকাঃমাহযাবীন
সন্ধ্যায় সবাই হল রুমে বসে টিভি দেখছে।আফিমও অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে হল রুমে এসে পত্রিকা টি নিয়ে বসে।কিছুটা সময় পত্রিকায় মুখ ডুবিয়ে থাকার পর আফিম নাফিয়ার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখে নাফিয়া খুব মনোযোগ দিয়ে টিভিতে বাংলা নাটক দেখছে।নাফিয়ার এতো শান্তি তার সহ্য হওয়ার নয়।সে নাফিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
-মিস.শেখ আমার জন্য এক কাপ কফি নিয়ে আসবেন কি?
-ও কফি আনতে যাবে কেনো এতো সার্ভেন্ট থাকতে।দাঁড়া কোনো একজন সার্ভেন্টকে বলছি!(সানিয়া বেগম)
-না না আন্টি।আমিই আনছি কোনো সমস্যা নেই।(নাফিয়া)
সানিয়া বেগম উত্তরে কিছু না বলে মুচকি হাসেন।এদিকে নাফিয়া যেন আফিমের মুখ থেকে এটি শোনার জন্যেই অপেক্ষারত ছিলো এতোক্ষণ।ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে নাফিয়া চলে যায় রান্নাঘরে কফি বানাতে।আর এদিকে কিছুটা সন্দিহান চোখে আফিম তাকিয়ে রয় নাফিয়ার যাওয়ার পানে।মেয়েটির মতলব তার কাছে ঠিক সুবিধের লাগছে না।
কিছুটা সময় পার হতেই নাফিয়া কফি হাতে ফিরে আসে।আফিমকে কফিটি এগিয়ে দেয় ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে।নাফিয়ার ওর দিকে তাকিয়ে হাসাটা ঠিকমতো হজম হলো না আফিমের।সে ব্রু কুঁচকে এক বার নাফিয়াকে দেখে নিয়ে একটু করে কফিতে চুমুক বসায়।কফির টেস্ট একদম ঠিক দেখে আফিম খানিকটা অবাক হয়।কারণ সে ভেবেছিলো নাফিয়া কফিতে কিছু একটা মিশিয়েছে।কিন্তু এমনটি না হওয়ায় আফিম আরো একবার নাফিয়ার দিকে তাকায় দেখে নাফিয়া টিভিতে মনোযোগ নিবেশ করেছে।আফিম আর বেশি না ভেবে কফিটি এক এক চুমুক করে পুরোটা শেষ করে নেয়।
খাওয়ার কিছুটা সময় পেরোতেই পেট কেমন জানি শব্দ করে ওঠে।আফিমের মনে হচ্ছে সে এখনই ওয়াশরুমে না গেলে বিরাট বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।পত্রিকাটা কোনো মতে রেখে আফিম দ্রুত গতিতে নিজের কক্ষের ওয়াশরুমের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হয়।দ্রুত পদে ওয়াশরুমে ঢুকতেই পা পিছলে ঠাস করে ওয়াশরুমের মেঝেতে পরে যায় সে।ভালো করে মেজেতে দৃষ্টিপাত করতেই সে দেখে পুরো ফ্লোরটায় সাবান পানি।পায়ে প্রচুর ব্যথা পাওয়া সত্ত্বেও কোনো মতে উঠে কাজটি সেরে নেয়।কাজ শেষ হতেই যেই সে বেরোতে যাবে তখন দেখে ওয়াশরুমের গেটটা বাইরে দিয়ে আটকানো।আফিম বেশ বুঝতে পারছে এইসব কাজের পেছনে কার হাত!রাগে পুরো মুখ লাল বর্ণ ধারণ করেছে তার।জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছেড়ে হাত বার বার মুঠোবন্দী করে এবং খুলে নিজের রাগ কমানোর চেষ্টা চালিয়ে চলছে সে।এরই মাঝে আবারও পেট শব্দ করে ওঠে তার।এভাবেই চলতে চলতে দুই ঘন্টা পার হবার পর নাফিয়া গিয়ে আফিমের ওয়াশরুমের দরজা বাইরে থেকে খুলে দিয়েই এক দৌড়ে দাদীর কাছে চলে আসে।
শরীর টা ভিষণ ক্লান্ত লাগছে আফিমের।ওয়াশরুমের দরজা খোলা পেয়েই বেরিয়ে আসে সে।কক্ষ পুরোটাই খালি দেখে আর কোনো কিছুতে মনোযোগ না দিয়ে টাওয়ালটি নিয়ে আবারও ওয়াশরুমে চলে যায় সে।ক্লান্ত শরীরেই গোসলটি সেরে কক্ষে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় এবং একজন সার্ভেন্টকে ডেকে স্যালাইন দিয়ে যেতে বলে।সেই রাতে আফিম আর নিজের কক্ষ হতে বের হয় না।
এদিকে নাফিয়ার যেনো ঈদ।সে তো মহা খুশি।আফিমকে তার উচিৎ শিক্ষা দিতে পেরে নিজের কাছেই বড্ড ভালো লাগছে তার।রাতে নিজের রুমের দরজা এবং জানালা টাও পর্যন্ত ভালোভাবে আটকিয়ে এসি ছেড়ে শুয়ে পরে নাফিয়া।আগের রাতে আফিম এক্সট্রা চাবি ব্যবহার করে ওর কক্ষে প্রবেশ করেছিলো তা বুঝতে পেরে আজ দরজার ছিটকিনি টাও লাগিয়েছে সে।অতঃপর বিছানায় আরাম করে শুয়ে সে কল্পনা করতে আরম্ভ করে আজ আফিমকে দেওয়া শাস্তিতে আফিম কেমন অনুভব করছিলো।ভাবতেই চরম আনন্দ হচ্ছে নাফিয়ার।সে মনে মনে বলে ওঠে,
“কাল সকালে মিঃআফিম ইবনানের অবস্থাই বলে দেবে নাফিয়ার সাথে টেক্কা দেওয়ার ফল কেমন হয়”
ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি টেনে চোখজোড়া বুজে নেয় নাফিয়া এক শান্তিময় ঘুমের আশায়।
!!
সকাল হতে দাদীর সাথে সাথেই আছে নাফিয়া।এক মুহূর্তের জন্যেও কোথাও একা থাকছে না সে।বলা তো যায় না আফিম কখন আবার তার উপর হামলা করে বসে।তার উপর আজ আবার স্কুল ও বন্ধ!স্কুলে থাকলেও চিন্তামুক্ত থাকা যেতো।
সকালে যখন দাদী ও নাফিয়া উভয়ই খাবার টেবিলে বসে গরম গরম চায়ে চুমুক বসাচ্ছিলো তখন দেখা মিললো আফিমের।গত কাল পিছলে পরায় পায়ে ব্যথা হয় তার।তাই জন্যে ঠিকমতো হাঁটতে পারছে না সে।আফিমকে এভাবে হাঁটতে দেখে মনে মনে খুবই খুশি হয় নাফিয়া এবং বলে ওঠে,
“এতোটুকু ডোজে ঠিক মতো হাঁটতে পারছে না আর আসছে নাফিয়ার সাথে টেক্কা দিতে।”
নাফিয়ার দিকে চোখ পরতেই আফিম দেখে নাফিয়ার ঠোঁটে হাসি।সাথে সাথেই চোয়াল শক্ত হয়ে যায় তার।হাত মুঠোবন্দি করে আফিম চুপচাপ হেঁটে নিজের পত্রিকাটি নিয়ে একজন সার্ভেন্টকে আদেশ করে খাবার তার রুমে পাঠিয়ে দিতে।অতঃপর নিজের রুমে চলে যায়।
এরপর থেকে সারাদিনে আফিমের দেখা মেলে না।আজ অফিসেও যায় না সে।সারাটি দিন নিজের কক্ষেই থাকে।এদিকে আফিমের ভয়ে ভয়ে নাফিয়া পুরো দিনে এক মুহূর্তও একা থাকেনি, সবসময় কারো না কারো সাথেই ছিলো।কিন্তু আফিমকে এভাবে সারাদিন রুমে থাকতে দেখে কেনো যেনো খারাপও লাগছে নাফিয়ার।সার্ভেন্ট যারা আফিমের রুমে গিয়েছিলো তাদের দাদী জিজ্ঞেস করেছিলেন আফিমের কথা।সবার উত্তর,”স্যার চুপচাপ শুয়ে আছেন।হয়তো স্যারের শরীর ভালো না”।সারাটি দিন আফিম নিজেকে এভাবে বন্দী করে রেখেছে সেই সাথে শরীরটিও ভালো নেই এগুলো দেখে নাফিয়ার খুব খারাপ লাগছে।রাতে নিজের কক্ষে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ভাবতে থাকে হয়তো সে অতিরিক্ত করে ফেলেছে।এতোটা না করলেও পারতো!মনে মনে সে এও ভেবে নেয় যে সে আফিম কে স্যরি বলবে।
!!
আফিম যেহেতু নিজ কক্ষ হতে বের হচ্ছে না তাই নাফিয়াও দরজা লাগানোর দিকে তেমন গুরুত্ব আরোপ করেনি।সে গোসল সেরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে আছে।এমন সময় হটাৎ তার কানে কোনো কাঁচের জিনিস ভাঙার আওয়াজ আসে।ব্রু জোড়া কুঁচকে নিজের কক্ষে প্রবেশ করতেই দেখে আফিম এক এক করে কাঁচের আসবাবপত্রগুলো মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলছে।অবাক হয়ে আফিমের এমন উদ্ভট কাজের দিকে তাকিয়ে আছে নাফিয়া।আফিম বেশ ক’টি আসবাবপত্র ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার পর নাফিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
-Walk on it!
আফিমের কথায় অবাকের চরম শীর্ষে পৌঁছিয়ে নাফিয়া বলে ওঠে,
-মানে?
-কানে শুনতে পাও না?হাঁটো এর উপর!(বেশ চেচিয়ে বলে ওঠে আফিম)
রাগে আফিমের শুধু চোখ দুটিই নয় দুধের ন্যায় ফর্সা মুখটিও রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে।আফিমকে দেখে ভয়ে কাঁপা কাঁপা ভাব নাফিয়ার।
নাফিয়াকে তার জায়গায় স্থির থাকতে দেখে আফিমের রাগ আরো বেড়ে যায় এবং সে বলে ওঠে,
-যা বলেছি তা যদি এখনই না করো তবে এরপর যা হবে তার জন্যে দায়ী থাকবে কেবল তুমি।
অতিরিক্ত রাগের বসে এখনই যে আফিম যেকোনো কিছু করে বসতে পারে তা বেশ ভালোই বুঝতে পারছে নাফিয়া।সে আর না ভেবে ধীরে ধীরে কাঁচের টুকরো গুলোর উপর একটি পা রাখে।সাথে সাথেই বেশ কয়টি কাঁচের টুকরো নাফিয়ার পায়ে ঢুকে যায়।ব্যথায় চোখে পানি চলে আসে নাফিয়ার।ঠোঁটে ঠোঁট চেপে চোখের জল আটকে রাখার বৃথা চেষ্টা করে দ্বিতীয় পা কাঁচের টুকরোগুলোর উপর রাখতেই দ্বিতীয় পায়েও কাঁচের বেশ ক’টি টুকরো বিঁধলো।ব্যথায় চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পরছে নাফিয়ার।সে কোনো ভাবেই তৃতীয় কদম ফেলার সাহস যোগাতে পারছে না।
এদিকে নাফিয়া যে সত্যিই কাঁচের উপর পা দেওয়ার মতো সাহস করবে তা চিন্তাই করেনি আফিম।নাফিয়ার পায়ের দিকটি রক্তে ধীরে ধীরে ভরে যাচ্ছে।আর নাফিয়ার চোখে জলগুলোও কেনোই যেনো আফিমের সহ্য হচ্ছে না।আফিম আর দেরি না করে নাফিয়াকে কোলে তুলে নেয়।এতোটা সময় চোখ বুজে ছিলো নাফিয়া হটাৎ এভাবে আফিমের কোলে তুলে নেওয়ায় চমকে চোখ মেলে তাকায় সে। আফিম,নাফিয়াকে বিছানায় পা তুলে বসিয়ে দিয়ে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে এসে নাফিয়ার পায়ের কাছে বসে।যেই আফিম ঔষধ লাগাতে যাবে ওমনি নাফিয়া পা সরিয়ে বলে ওঠে,
-অনেক হয়েছে মিঃইবনান।করেন করেছেন আপনি!প্রথমত পতিতা বলে আমায় অপমান করলেন তারপর রেগে একটি থাপ্পড় বসিয়ে দেওয়ার অপরাধে আমায় তুলে নিয়ে যেয়ে অসভ্যতা করলেন।কিচ্ছু বলিনি।ভাগ্যে হয়তো এটিই ছিলো বলে মেনে নিয়েছিলাম আর আমায় ধর্ষণ না করায় কৃতজ্ঞ ছিলাম।কিন্তু তারপরও আপনার থাপ্পড়ের জবাব দেওয়া বাকি রয়ে গিয়েছিলো দেখে আমাকে এই চাকরি দিলেন এবং হুমকি দিলেন যেনো আমি এই চাকরি টা না ছাড়ি।আপনি কি মনে করেন আফিম?আমি আপনার হুমকির ভয়ে এখনো এখানে আছি বা আপনার অত্যাচার আমি ভয় পাই?যদি এমনটি ভেবে থাকেন তবে এটি আপনার ভুল ধারণা। আমি এখানে আছি আমার পরিবারের স্বার্থে।তাদের আর্থিক সহায়তা করার জন্যে।আর আপনার এই অত্যাচার যদি ভয়ই পেতাম তবে আপনাকে পাল্টা জবাব দেওয়ার সাহস দেখাতাম না।তাই আমাকে দয়া দেখাতে আসবেন না।
এতোক্ষণ ধরে নাফিয়ার কথাগুলো চোয়াল শক্ত করে চুপচাপ শুনছে আফিম।নাফিয়ার পায়ের অবস্থা অতোটা ভালো না।আরো কিছুক্ষণ ধরে রক্ত এভাবে পরলে নাফিয়া জ্ঞান হারাবে।আফিমের যথেষ্ট রাগ উঠা সত্ত্বেও সে এখন কিছু বলতে চাচ্ছে না।নাফিয়া আবারও বলে ওঠে,
-এক মিনিট এক মিনিট!আপনার মাঝে আদৌও দয়া নামক কোনো অনুভূতি আছে নাকি সব নাটক?আমার তো মনে হয় নাটকই।কারণ যে ছেলে দিনের আলোয় সফল বিজনেসম্যান, রাতের অন্ধকারে সে এক পতিতা সন্ধানী।দেহ লোভী কোনো ব্যক্তির মানবীয় গুণাবলি থাকে না।আপনারও নেই।
ব্যাস এতোক্ষণ নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেও এখন আফিমের সহ্যের সীমা অতিক্রম হয়ে গিয়েছে।সে নাফিয়ার মুখ একহাতে শক্ত করে চেপে ধরে বলে ওঠে,
-হু দা হেল আর ইউ টু জাজ্ মি?কি জানো তুমি আমার সম্পর্কে?কতোটুকু জানো আমার সম্পর্কে?হ্যা?কোন সাহসে আমায় নিয়ে মন্তব্য করলে?আমার বাসার চাকর হওয়ার ও যোগ্যতা তোমার নেই সেখানে তুমি আমায় বিচার করছো?আমি যদি দেহ লোভীই হতাম তবে আমার গার্লফ্রেন্ড তাকে স্পর্শ না করার অপরাধে আমার পুরুষত্বের উপর প্রশ্ন তুলে আমায় ছেড়ে যেতো না!আমি যদি দেহ লোভীই হতাম তাহলে এতোদিন তোমার সতীত্ব অক্ষত থাকতো না!ইউ ব্লাডি ইডিয়ট।
বলেই নাফিয়াকে ছেড়ে দিয়ে আফিম দ্রুত পদে নাফিয়ার কক্ষ ত্যাগ করে।
চলবে।