আফিম বড্ড নেশালো পর্ব ১৭

0
430

#আফিম_বড্ড_নেশালো
পর্বঃ১৭
লেখিকাঃমাহযাবীন

“আপনি দয়া করে কক্ষ ত্যাগ করুন,আফিম।আমি একা থাকতে চাইছি।”
নিজের কান্না যথা সাধ্য আটকাবার চেষ্টা করে শান্ত কন্ঠে কথাটি বলে নাফিয়া।অবাধ্য অশ্রু কণা গাল বেয়ে গড়িয়ে পরছে তার।আফিম অসহায় দৃষ্টিতে কিছুটা সময় নাফিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে ধীর পায়ে নাফিয়ার দিকে এগিয়ে আসতে আরম্ভ করে।
নাফিয়ার একদম কাছে এসে নিজের ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে আলতো করে নাফিয়ার গাল বেয়ে পরা চোখের অশ্রু স্পর্শ করে আফিম।চোখের পানি মুছে দিয়ে নাফিয়াকে এক টানে নিজের বুকে নিয়ে এসে বলে ওঠে,
-তুমি একা নও তাই একা ছাড়ার প্রশ্নই ওঠে না।
কথাটি বলে একটু থামে আফিম।নাফিয়াকে বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরে নিজের চোখজোড়া বুজে বলে ওঠে,
-তোমাকে শক্ত হতে হবে,মিসেস.আফিম ইবনান।এ রোগের আতংকে ভেঙে পরা চলবে না।বরং সাহসের সাথে মোকাবেলা করতে হবে।আমি আছি তো প্রতিটি কদমে তোমার ঢাল হয়ে।
আফিমের বুকের সাথে লেপ্টে নিজের ভেতরের অনুভূতিগুলোকে অশ্রু রূপে বিসর্জন দিয়ে নিজের ভেতরের কষ্টটাকে কিছুটা কমানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নাফিয়া।অনেকটা সময় এভাবেই চলার পর ধীরে ধীরে আফিমের বুক হতে মাথা উঠায় সে।মৃদু স্বরে বলে ওঠে,
-এ রোগ আমার সৌন্দর্য কেরে নিবে,আফিম।
-পারবে না।
-এমনটি আপনি আমার মন রাখতে বলছেন কিন্তু সত্যি টা এটাই।
নাফিয়ার কথায় তাকে নিজের বাহুবন্ধনী হতে মুক্ত করে তার গাল আলতো করে দু’হাতের মাঝে নিয়ে আফিম বলে ওঠে,
-তোমার সৌন্দর্য তোমার ভাসা ভাসা মায়াবী এই চোখ জোড়ায়,খাঁড়া এই নাকটিতে এবং এই মুগ্ধ করা ঠোঁটে যা প্রথম দেখাতেই আমাকে ঘায়েল করেছিলো।সেই সাথে তোমার সব থেকে বড় সৌন্দর্য তোমার মানসিকতা,চিন্তাধারা এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যা প্রতিনিয়ত আমায় মুগ্ধ করে।এসবের মাঝে,শরীরের সৌন্দর্য তো আকর্ষণ মাত্র যা সময়ের সাথে সাথে শেষ হয়েই যায়।
কান্নার বেগ বৃদ্ধি করে নাফিয়া বলে ওঠে,
-আপনি শুধু মাত্র আমার কষ্ট লাঘব করবার জন্যেই এগুলো বলছেন,আফিম।কিন্তু একটি মেয়ের শারীরিক সৌন্দর্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ তা আমি জানি।
-যে ব্যক্তিত্বের মুগ্ধতায় আটকে যায় তার কাছে রুপ মূল্যহীন।আমি তোমাতে মুগ্ধ মিসেস.আফিম ইবনান,তোমার রুপে নই।তাই তোমার শারীরিক সৌন্দর্য আমার কাছে গুরুত্বহীন।
-আপনি আমার সাথে সুখি থাকবেন না,আফিম।
-তোমার উপস্থিতিই আমার সুখ।রাতে আমার বুকে তোমার অস্তিত্ব অনুভব করা টা আমার সুখ।অফিসের কাজ বেশি হলে রাত জেগে যখন কাজ করতে হয় তখন তুমিও রাত জেগে কাজে আমার সাহায্য করো।সে সময় তোমার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে।কাজের ফাঁকে ফাঁকে তোমার সেই রুপ দেখাটা আমার সুখ।বিষন্ন হয়ে কোথাও বসলেই যখন এক কাপ কফি হাতে আমায় কোম্পানি দিতে হুট করেই চলে আসো সেই সময়টুকু আমার সুখ।কাজের চাপে মাথা ব্যথা করলে যখন কিছু বলে উঠার আগেই কপালে তোমার হাতের স্পর্শ পাই ঠিক ঐটাই আমার সুখ।মাঝ রাতে স্লো মিউজিকে যখন ড্যান্স করার ইচ্ছে হয় তখন তোমার সঙ্গটাই আমার সুখ।এমন আরো অসংখ্য সুখ শুধু তুমিই আমায় দিতে সক্ষম, মিসেস. আফিম ইবনান।
কান্নার বেগ কমার জায়গায় আরো বেড়ে গেলো নাফিয়ার।অসংখ্য অনুভূতিরা তার মনে এসে জায়গা করে নিচ্ছে।আফিমের উচ্চারিত প্রতিটি শব্দে নিজেকে ভীষণ সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে তার।এতো টা ভালোবাসা সে তার স্বামী হতে পাবে তা ভাবনাতিত ছিলো তার।কিন্তু সে এটিও কোনোভাবে ভুলে যেতে পারছে না যে,তার এ শারীরিক ত্রুটি কোনো সামান্য বিষয় নয়।সারাজীবন নারীত্বে এ ত্রুটি নিয়েই কাটবে তার।এ ক্রুটি নিয়ে সে কোনো ক্রমেই আফিমের যোগ্য নয়।তবে আফিম কেনো থাকবে তার সাথে?আফিমের মতো এতো সুন্দর ছেলে চাইলেই কোনো আগুন সুন্দরী মেয়েকে বৌ বানিয়ে আনতে পারে তাহলে আফিম কেনো সারাটি নিজের জীবন তার সাথে কাটিয়ে সমঝোতা করে যাবে?এখন হয়তো আফিম আবেগের বসে এসব বলছে কিন্তু ক’দিন পর হয়তো এই আবেগ টা আর থাকবে না।তখন হয়তো সে নিজের জন্য সুন্দর কোনো মেয়েকেই বাছাই করে নিবে।ঠিক তখন কোথায় যাবে নাফিয়া?কিভাবে মেনে নিবে সে সবটা?তখনের পাওয়া কষ্টটার থেকে এখনই আফিমকে ছেড়ে দেওয়াটিই উত্তম নয় কি?
অল্প সময়ের মাঝেই অনেকটা ভেবে নাফিয়া অশ্রুসিক্ত নয়নে আফিমের চোখে চোখ রেখে বলে ওঠে,
-এসব আবেগে বলছেন আপনি।আমার উপর দয়া হচ্ছে আপনার সেজন্য বলছেন।আমার অপারেশনের পর আমি কুৎসিত হয়ে যাবো।তার আগেই আপনি আমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করুন।
কথাটি শোনা মাত্রই যেনো আফিমের মাথায় রক্ত উঠে গেলো।দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে চোখ জোড়া বুজে নিয়ে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে সে।মুহূর্তেই ফর্সা চেহারা রক্তিম বর্ণ ধারণ করছে তার।আফিমের এমন রাগ ১০ মাসে এই প্রথম দেখলো নাফিয়া।ভীষণ ভয় লাগছে তার আফিমের এমন রূপে।কথাটি বলা যে কতোটা ভুল হয়েছে তা এখন বুঝতে পারছে নাফিয়া।কিন্তু তার কাছে তো কথাটি সঠিকই মনে হচ্ছে।
নাফিয়ার মানসিক অবস্থার কথাটি ভেবে কিছুটা সময় নিয়ে আফিম নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে।কিছুটা সময় চোখ বুজে থাকবার পর নিজের রাগ টা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হলো সে।অতঃপর চোখ মেলে নাফিয়ার দিকে তাকিয়ে সে বলে ওঠে,
-একবার বলেছো,বলেছো! কিন্তু দ্বিতীয়বার সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা মাথায় আনলেও মেরে এখানেই পুঁতে রেখে দিবো।আফিম ইবনানের রাগ সমন্ধে তুমি এখনো অবগত নও।
কথা বলার সময় আফিমের কন্ঠস্বর ও লাল হওয়া চোখজোড়া দেখে ভয়ে মাথা নুইয়ে নেয় নাফিয়া।আঁখির জল যেনো আজ তার ফুরচ্ছেই না।আফিম কিছুটা সময় ক্রন্দনরত নাফিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।নাফিয়ার চোখের অশ্রুগুলো আফিমের হৃদয়কে পোড়াচ্ছে ভীষণ।না পারছে সইতে আর না পারছে কষ্টটা দূর করতে।নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছে তার।
অসহায় দৃষ্টিতে কিছুটা সময় নাফিয়াকে দেখে নিয়ে আলতো পায়ে নাফিয়ার কাছে গিয়ে অনতিবিলম্বে নাফিয়াকে নিজের বুকে টেনে নেয় আফিম।মাথায় হাত বুলিয়ে বলে ওঠে,
-তুমি বড্ড বেশি ভেবে এ বিষয়টিকে বড় বানিয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছো।তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী,মিসেস. আফিম ইবনান।অর্থাৎ আমার অর্ধেক অংশ।এখন আমার ডান হাতের একটি আঙুলে যদি কোনো ত্রুটি হয় তাহলে কি আমি আমার পুরো ডান পাশটিই কেটে নিজের থেকে আলাদা করে ফেলবো?আর যদি এমনটি করি তাহলে আমি বেঁচে থাকতে পারবো?পারবো না।ঠিক তেমনই মিসেস. আফিম ইবনান কে ছাড়া আফিম ইবনান বাঁচতে পারবে না। তুমি আমার কাছে এখন যেমন সুন্দর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ঠিক এমন সুন্দরই থাকবে।
আবেগাপ্লুত হয়ে আফিমকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নাফিয়া।একদিকে আফিমের মুখ হতে উচ্চারিত শব্দ গুলো তাকে সুখানুভূতি দিচ্ছে,ভরসা দিচ্ছে,আশ্বাস দিচ্ছে,নিশ্চয়তা দিচ্ছে ঠিক তেমনই তার রোগটিকেও সে ভুলতে পারছে না।কিন্তু এই মূহুর্তে সে এই রোগটি সম্পূর্ণরূপে ভুলে যেতে চাইছে।কারণ আফিমের হৃৎস্পন্দনে সে নিজের জন্য এতোটা ভালোবাসা খুঁজে পাচ্ছে যে পুরো দুনিয়াটা তার মিছে মনে হচ্ছে,এসব রোগ অতি তুচ্ছ মনে হচ্ছে।

!!
আফিমের দাদীর কক্ষে পাতানো সোফায় নাফিয়ার প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে বসে আছেন সানিয়া বেগম।সম্পূর্ণ প্রেসক্রিপশনে চোখ বুলিয়ে নেবার পর তার আর বুঝতে বাকি রয় না রোগটির বিষয়ে।তিনি এখন এও বুঝতে পারছেন যে তখন নাফিয়ার ওমন দৌড়ে নিজের কক্ষের উদ্দেশ্যে গমন করার কারণ কি ছিলো!সানিয়া বেগম একটি দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে গম্ভীর কণ্ঠে তার শাশুড়িকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠেন,
-আম্মা একটি বিষয় আপনাকে জানাতে চাইছি।
-নাফিয়ার বিষয়ে?
-জ্বি।
-বেশ দুশ্চিন্তা হচ্ছে বৌমা।বলো তো কি হলো মেয়ে টার?ওমন কাঁদছিলো কেনো?আর ওভাবে দৌড়ে কক্ষেও বা গেলো কেনো?
ভীষণ মন খারাপ নিয়ে মৃদু স্বরে সানিয়া বেগম বলে ওঠে,
-নাফিয়ার ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়েছে বলে ধারণা করছে ডাক্তার।
-কি বলো!এ রোগের চিকিৎসা কি?
-এ রোগ শরীরে কতো টা ছড়িয়ে পরেছে সেটির উপর ভিত্তি করে চিকিৎসা নির্ধারণ করা হয়।নাফিয়ার হয়তো অপারেশন করতে হবে।হয় টিউমারটি কেটে ফেললেই রেহাই মিলবে নাহয় যে পাশে টিউমার হয়েছে সে পাশটি পুরোটাই কেটে ফেলতে হবে।
-কি!!যদি এমনটিই হয় তবে কি এমন একটি ত্রুটিপূর্ণ মেয়ের সাথেই সারাটি জীবন কাটাবে আমাদের,আফিম?
-কি বলতে চাইছেন,আম্মা?

চলবে

[সবাই একটু কষ্ট করে গঠনমূলক মন্তব্য করবেন,অনুরোধ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here